গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ইমাম হুসাইন (আ) ইয়াজিদকে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর জনগণ ও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এই মহান ইমামের প্রতি। ইমাম মদীনা ছেড়ে চলে আসেন মক্কায়। মক্কায় হজের মওসুমে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ইমাম হুসাইন (আ)। ইরাকের ও বিশেষ করে কুফার হাজার হাজার বিপ্লবী মুসলমান বিপ্লব ও মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ইমামের কাছে চিঠি লেখেন।
কুফার জনগণ ইয়াজিদের প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র আনুগত্য প্রকাশ না করার কথা শুনে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই শহরের জনগণ প্রকৃত ইসলামী খেলাফতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ও তাঁদেরকে মুক্ত করার জন্য ইমামের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে অন্তত ১৮ হাজার চিঠি পাঠিয়েছিল। প্রতিটি চিঠিতে অন্তত ১০০ জনের স্বাক্ষর ছিল।
কিন্তু কুফাবাসীরা প্রয়োজনের সময় ইমামের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।
এমনকি কুফার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য ইমাম হুসাইন (আ) যখন চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা)-কে কুফায় পাঠান তখন কুফাবাসী ইমামের এই দূতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। ইয়াজিদের মনোনীত গভর্নর ইবনে জিয়াদের ত্রাস-সঞ্চারী নানা পদক্ষেপের ফলে আকিল জন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং তিনি একাকী বীরের মত লড়াই করে নৃশংসভাবে শহীদ হন। ।
কিন্তু আকিল (রা.)'র শাহাদতের পরও ইমাম হুসাইন (আ.) যদি দোদুল-মনা কুফাবাসীদের আহ্বানে সাড়া না দিতেন, তাহলে ইতিহাসে এই ইমামকে কাপুরুষ বলে উল্লেখ করা হত এবং বলা হত লাখো মানুষের মুক্তির আহ্বানকে উপেক্ষা করে ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন।
কুফার পথে যাওয়ার সময় আকিল (রা.)'র শাহাদতের খবর শুনে কেঁদে ফেলেন ইমাম হুসাইন (আ.)। কিন্তু তবুও তিনি বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সময় ইমাম আবৃত্তি করেছিলেন পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত যেখানে বলা হয়েছে: "মুমিনদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ কেউ (শাহাদতের জন্য) প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি।"(সুরা আহজাব, ২৩)
ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় থাকতে চাইলে সেখানেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারতেন না। ইয়াজিদের গুপ্ত-ঘাতকরা হজযাত্রীর ছদ্মবেশে মক্কায় এসে ইমামকে হত্যার চেষ্টা করছিল। এখানে তিনি ইয়াজিদের গুপ্ত-ঘাতকের হাতে শহীদ হলে তাতে ইয়াজিদি শাসক-গোষ্ঠীর অপরাধ জনগণের কাছে অস্পষ্ট থাকত এবং গণ-জাগরণ গড়ে তোলা সম্ভব হত না। এ ছাড়াও ইমাম পবিত্র কাবাঘরের আশপাশসহ ইসলামের ঘোষিত শান্তির শহর হিসেবে মক্কাকে সংঘাত ও রক্তপাত-মুক্ত রাখার জন্য এই শহর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন এবারের হজ তিনি করবেন পবিত্র কারবালায়। সেখানে তিনি কোনো পশু নয় বরং কুরবানি করবেন নিজেকে নিজের পরিবার ও নিবেদিত-প্রাণ একদল সঙ্গীকে।
ইমাম হুসাইন (আ) ইরাকের দিকে তাঁর সফরের কথা তুলে ধরেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা শহীদ হবেন বলেও জানিয়ে দেন। ফলে তাঁর কাছে নানা দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে জড়- হওয়া হাজার হাজার সঙ্গীর বেশির ভাগই ইমামকে ত্যাগ করে। আল্লাহর পথে জীবন দিতে এগিয়ে আসার জন্য ইমামের আহ্বানে খুব কম মুসলমানই সাড়া দেয়। এমনকি গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তি ইমামকে সফর বাতিল করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম জানান যে তিনি যেখানেই যান না কেন তাঁকে হত্যা করা হবেই। ইমাম মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়ায় মনে মনে খুশি হন মক্কার উচ্চাভিলাষী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের। কারণ, তিনি মহানবীর আহলে বাইতকে হিংসা করতেন এবং জানতেন যে ইমাম হুসাইন যতদিন মক্কায় থাকবেন ততদিন জনগণ অন্য কোনো নেতাকে গুরুত্ব দেবে না।
কারবালা বিপ্লবের যুগে উমাইয়ারা ইসলামের শেষ প্রাণ-প্রদীপটুকুও নিভিয়ে ফেলার আয়োজন পাকাপোক্ত করেছিল। এর আগে নানা বিচ্যুতি ও অধঃপতন সত্ত্বেও ইসলামের বাহ্যিক কিছু বিধি-বিধান অন্তত প্রকাশ্যে মেনে চলত উমাইয়ারা। কিন্তু ইয়াজিদের মত প্রকাশ্য পাপাচারীকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে প্রকৃত ইসলাম তখনই চিরতরে বিলুপ্ত বা কবরস্থ হত। আর উমাইয়ারা বলতো দেখুন মহানবীর নাতি তথা বেহেশতি যুবকদের সর্দার ইমাম হুসাইনই (আ) তো আমাদের সমাজ-ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন বা এই ব্যবস্থাকেও ইসলামী সমাজ বলে মেনে নিয়েছেন!
অনেকের মনেই এ প্রশ্ন জাগে যে ৬১ হিজরির মধ্যেই মুসলমানদের এত দুর্দশা কেন ঘটেছিল? মুসলমানদের মধ্যে কি মুনাফিকদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ইমাম হুসাইন ছাড়া অন্য কেউ ইসলামকে চরম দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার দরকার মনে করেননি?
আসলে দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে মহানবীর (সা) বংশধরদের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন গোত্র ও ব্যক্তিত্বের অভাব ছিল না। তাদের সহযোগিতা নিয়েই অধঃপতিত উমাইয়ারা মুসলমানদের ওপর ক্ষমতাসীন হয়ে বসে।
অন্যদিকে যুগে যুগে নবী-রাসূলদের তিরোধানের পর খুব দ্রুত তাদের উম্মতের বিভ্রান্ত হওয়ার নজির দেখা যায়। মুসা (আ)’র জাতি ইহুদিরা এই মহান নবীর জীবদ্দশায় উনার মাত্র চল্লিশ দিনের অনুপস্থিতিতে তথা তুর পাহাড়ে মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগের দায়িত্ব পালনের অবকাশেই বাছুর পূজারী হয়ে পড়ে। হযরত ঈসা নবীর উম্মতেরও প্রায় বেশিরভাগই কয়েকজন ধূর্ত ও প্রতারক ইহুদির কারসাজিতে এই মহান নবীকে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করতে থাকে। অন্য কথায় খ্রিস্টানরাও খুব দ্রুতই বিভ্রান্ত হয়েছিল।
অন্যদিকে নবী-রাসূলদের মত তাঁদের প্রকৃত প্রতিনিধিরাও অশেষ সাহসের অধিকারী ছিলেন জুলুম ও অন্যায়ের মুকাবিলায়। ইব্রাহিম (আ) গোটা জাতি ও পরাক্রান্ত সম্রাট নমরুদের মূর্তি-পূজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। হযরত ইয়াহিয়া নবীকেও (আ) তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে জীবন দিতে হয়েছিল। ইমাম হুসাইন (আ) নিজেও কারবালার দিকে সফরের পথে নানা স্থানে যাত্রা-বিরতির সময় বলতেন: ‘আল্লাহর কাছে দুনিয়ার মূল্যহীনতার জন্য এটাই যথেষ্ট যে ইয়াহিয়া ইবনে জাকারিয়ার (আ) মাথা উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল এক চরিত্রহীন ব্যক্তিত্বের কাছে। আর এ কাজটি করেছিল বনি ইসরাইলের একদল নৈতিক চরিত্রহীন ব্যক্তি।’(রেডিও তেহরান)