সূরা ইউসুফ; আয়াত ৫৩-৫৫ (পর্ব-১৬)
সূরা ইউসুফের ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَا أُبَرِّئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ إِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّي إِنَّ رَبِّي غَفُورٌ رَحِيمٌ
"আমি কখনো নিজেকে নির্দোষ মনে করি না, মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্মপ্রবণ, কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন, নিশ্চয় আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।" (১২:৫৩)
মিশরের রাজা যখন হযরত ইউসুফ (আ.) কে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দেন তখন হযরত ইউসুফ বললেন, আগে এটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, তিনি নির্দোষ এবং নিরপরাধ। শেষ পর্যন্ত রাণী রাজার কাছে তার অপরাধের কথা স্বীকার করে এবং হযরত ইউসুফ (আ.)কে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘটনা আগের পর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ৫৩ নম্বর আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় বা ইন্দ্রীয় পরায়ণতার কারণে মানুষ পাপের দিকে পা বাড়ায়। মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয় তখনি তার মধ্যে পশুসুলভ আচরণ স্বাভাবিকে পরিণত হয়। তখন মানুষ আর তার পরিণতির কথা ভাবতে পারে না। এ অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ ছাড়া কারো পক্ষে কুপ্রবৃত্তিকে দমন করা সম্ভব নয়। আর যারা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সব কাজে তারই সাহায্য কামনা করে একমাত্র তারাই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে থাকে।
পবিত্র কুরআনে মানুষের নাফস্ বা অন্তরিন্দ্রীয়কে কয়েক পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে পশু প্রবৃত্তি যা মানুষকে ইন্দ্রীয় পরায়ণতা ও কাম লালসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। কুরআনের পরিভাষায় একে ‘নাফসে আম্মারা’ বলা হয়েছে। এর পরবর্তী পর্যায়ে আসে নাফসে লাওয়ামাহ অর্থাৎ যে মনোবৃত্তির কারণে মানুষের চিত্তে পাপ বা অপরাধের জন্য অনুশোচনা জাগ্রত হয় এবং এর ফলে ক্ষমা বা তওবার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। আর ‘নাফসে মুতমায়্যিন্নাহ’ হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়। এই পর্যায়ে কেবল নবী-রাসূল এবং অলি-আউলিয়াগণ পৌঁছতে পারেন। এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর মানুষ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হয় না। এবং সফলতার সঙ্গে ঐশী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পরে। এই কারণেই হযরত ইউসুফ (আ.) নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও গর্বিত ও অহংবোধ করলেন না বরং তিনি অকপটে বললেন, আমিও একজন মানুষ ফলে জুলেখা যা চেয়েছে আমার চিত্তেও সে অনুভূতি রয়েছে কিন্তু আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে পশুবৃত্তি বা কাম-লালসা থেকে পবিত্র থাকতে সাহায্য করেছে।
এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, কখনো নিজেকে ভুলের উর্ধ্বে বা পুতঃপবিত্র মনে করা উচিত নয়। কারণ যে কোনো সময় যে কারো পদস্খলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হওয়া উচিত নয়। কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
এই সূরার ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ الْمَلِكُ ائْتُونِي بِهِ أَسْتَخْلِصْهُ لِنَفْسِي فَلَمَّا كَلَّمَهُ قَالَ إِنَّكَ الْيَوْمَ لَدَيْنَا مَكِينٌ أَمِينٌ
“রাজা বলল! ইউসুফকে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমি তাকে আমার বিশ্বস্ত সহচর নিযুক্ত করব। অতঃপর যখন তার সঙ্গে মত বিনিময় করল তখন বলল, আজ থেকে আপনি আমাদের নিকট মর্যাদাশালী ও বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকবেন।" (১২:৫৪)
জুলেখার সঙ্গে কথা বলার পর যখন মিশরের রাজা বুঝতে পারলো যে, হযরত ইউসুফ (আ.) নির্দোষ এবং একজন চরিত্রবান মানুষ তখন তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং রাজা হযরত ইউসুফের সঙ্গে রাষ্ট্রের নানা বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, হযরত ইউসুফ (আ.) কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন, তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাই রাজা হযরত ইউসুফকে তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করলেন। হযরত ইউসুফের সঙ্গে কথা বলে রাজা দু’টি বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। একটি হযরত ইউসুফের বিচক্ষণতা অপরটি তার সততা ও আমানতদারী। একজন ঈমানদার, সৎ ব্যক্তি সবার শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় এই আয়াত থেকে আমরা এটাই উপলব্ধি করলাম। হযরত ইউসুফ আল্লাহর নবী ও সৎ ব্যক্তি ছিলেন। ফলে এক সময় তা বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র সুস্পষ্ট হয়ে উঠে এবং তার জ্ঞান প্রতিভা ও সততা সকলের সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠে।
এই সূরার ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
قَالَ اجْعَلْنِي عَلَى خَزَائِنِ الْأَرْضِ إِنِّي حَفِيظٌ عَلِيمٌ
"ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করুন আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অভিজ্ঞ।" (১২:৫৫)
হযরত ইউসুফ (আ.) রাজার বিশেষ উপদেষ্টা নিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পর একজন বিচক্ষণ, সৎ ও আস্থাবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নিজেই রাজাকে প্রস্তাব দেন যাতে রাষ্ট্রের কোষাগারের দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। কারণ হযরত ইউসুফ (আ.) ঐ স্বপ্নের ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। কাজেই তিনি জানতেন প্রথম সাত বছর গম ও খাদ্য সামগ্রী সঠিকভাবে মজুদ করতে হবে এবং পরবর্তী সাত বছর দুর্ভিক্ষের সময় তা সুপরিকল্পিতভাবে জনগণের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে তিনি রাষ্ট্রের কোষাধ্যক্ষ বা খাজাঞ্চীর পদ গ্রহণের জন্য রাজার কাছে আবেদন করলেন। ক্ষমতা বা পদের মোহ তার ছিল না। দুর্ভিক্ষের সময়ে জনগণকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই তিনি ঐ দায়িত্ব গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন।
এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, নিজের সামর্থ বা যোগ্যতার বিষয়টি প্রকাশ করা উচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসা উচিত।