আশুরার পূর্ব দিন অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়। এর আগেই আরোপ করা হয়েছিল অমানবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখী ও অন্য সবার জন্য ফোরাতের পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি। ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।
ইমাম হুসাইন (আ.) নয়ই মহররমের বিকালের দিকে এক দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে দশই মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। ইয়াজিদ বাহিনীর প্রধান প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিকালেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সঙ্গীরা আবারও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।
নয়ই মহররম কালজয়ী কারবালা বিপ্লবের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি অর্জনের সর্বশেষ দিন। এই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ১০০ জন সহযোগী। আর এ জন্যই তাঁরা ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।
কারবালা বিপ্লব মানব সভ্যতা ও ইতিহাসের এক অনন্য বিপ্লব। এ বিপ্লবে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে মানুষের শ্রেষ্ঠ কিছু গুণের সর্বোত্তম প্রকাশ এবং বীরত্ব ও ন্যায়নীতির পরিপূর্ণ সৌন্দর্য, তেমনি অন্যদিকে ফুটে উঠেছে শয়তান ও পশু-শক্তির দানবিকতা আর পাশবিকতার চরম প্রকাশ। একদিকে ফুটে উঠেছে খোদা-প্রেমের চরম প্রকাশ আর অন্য দিকে কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব তথা অধঃপতন আর বিবেকহীনতার সর্বগ্রাসী সয়লাবের নিদর্শন।
কারবালার কালজয়ী মহা-বিপ্লব নানা শিক্ষার এক বিশাল সূতিকাগার ও মানুষ হিসেবে তথা খোদার প্রতিনিধি বা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি (আশরাফুল মাখলুকাত) হিসেবে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার শিক্ষা লাভের এক অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়।
খোদাপ্রেম, ইমামের আনুগত্য, আন্তরিকতা, মানবতা, নৈতিকতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, সৎ-কাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধ, আত্মত্যাগ,মুক্তিকামীতা, দায়িত্বশীলতা, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা, সময়োচিত পদক্ষেপ বা সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহারের মত বিষয়গুলো কারবালার কালজয়ী বিপ্লবে প্রবাদতুল্য আদর্শ বা শিক্ষা হিসেবে ফুটে উঠেছে।
সুখে ও দুঃখে সব সময় মহান আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা কারবালা বিপ্লবের মহানায়কদের রেখে যাওয়া একটি বড় শিক্ষা। ইমাম হুসাইন (আ) জীবনের শেষ রাত্রে স্মরণ করলেন সেই সময়ের কথা যখন মুসলিম বিশ্বে তিনি ও তাঁর ভাই হাসান (আ) ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবার আদরের শিশু।
ধর্মে ও জিহাদে যে জোর-জবরদস্তি নেই তাও ইমাম শিখিয়ে গেছেন কারবালায়।
আজ আশুরার পূর্ব রাত। যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত। কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস। বোবা পশুরাও টের পেয়ে গেছে তাদের মধ্যেও অস্বাভাবিক অস্থিরতা। আজ আকাশের তারাগুলোর কোন ঝিকিমিকি নেই, নিস্প্রভ। তাদের মধ্যেও মেঘের আড়ালে লুকাবার প্রচেষ্টা । ফোরাত নদীর পানির প্রবাহ আজ বারবার থমকে দাড়াচ্ছে । বোবা পরিবেশ আর পশুগুলোর বুক ফাটা আর্তনাদে কি যেন বলতে চাইছে । কিন্তু হায়! আমরা তাদের ভাষা বুঝি না। শুধু বাতাসের দীর্ঘশ্বাস আমাদের কানে এসে বাজছে । হ্যাঁ , আগামীকাল রাসুলের কলিজার টুকরো খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমার নয়নমনি ইমাম হোসেন (আ.) শহীদ হবেন । নবীজী যে গলদেশে চুম্বন করেছেন সেখানে ছুরি চালানো হবে; যে দেহে তিনি তার অসংখ্য পবিত্র চুম্বনের পরশ বুলিয়েছেন সেই মোবারক দেহের উপর দিয়ে দশটি ঘোড়া দাবড়ানো হবে। হায় কারবালা! হায় হোসেন!
আগামীকাল সারা বিশ্ব শোকে দুলে উঠবে। স্বয়ং রাসুল এই শোকের স্বত্বাধিকারী। সাত আসমানের ফেরেশতারাও শোকের পোষাক পড়েছেন। ইমাম হোসেন (আ.) এর বোন জয়নাবের কান্নায় ফেরেশতাদের অশ্রুর বাঁধ ভেঙে গেছে। তাদের ব্যাথা ভরা আহাজারীতে খোদার আরশ আজ কেঁপে উঠেছে। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাও অশ্রু সজল চোখে শরীক হয়েছেন এ মাতমে। কারবালার উষর প্রান্তরে নবী পরিবারের সদস্যদেরকে এজিদের সৈন্যরা পরিবেষ্টন করে রাখার নয় দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এ নয় দিন ইমাম হোসেন (আ.) এজিদের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বহু নসিহত করেন। তারা যে জঘণ্য পাপ করতে উদ্যত হয়েছে তিনি সে সম্পর্কে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। এজিদ নিযুক্ত কুফার শাসনকর্তা উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ ক্রমেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সে ওমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে কারবালায় হাজার হাজার সৈন্য প্রেরণ করতে থাকে। এই সৈন্য সংখ্যা অচিরেই বিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইমাম হোসেন (আ.) তারপরও হাল ছাড়েন না। তার অন্তর যে দয়ায় আপ্লুত। তিনি যে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত, নবীজীর দৌহিত্র তার দেহে প্রকৃত বীর হযরত আলীর রক্ত প্রবাহিত।
তিনি শেষ মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শত্রু সেনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "তোমরা কি আমাকে চেন না? তোমরা কি জাননা যে আমার নানা ছিলেন রাসুলে খোদা (সা.)? তোমরা কি জান আমার পিতা আলী বিন আবু তালিব? তোমরা কি জাননা আমার মা হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.) হলেন মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর কন্যা? তোমরা কি জান আমার নানী ছিলেন ইসলাম গ্রহণকরী প্রথম মহিলা হযরত খাদিজা (রা.)? তোমরা কি জান না যে সাইয়্যেদুস শোহাদা হযরত হামজা (রা.) ছিলেন আমার পিতার চাচা? তোমরা কি জান না হযরত জাফর তাইয়াব (রা.) ছিলেন আমার চাচা? তোমরা কি জানো রাসুলেখোদার পবিত্র তরবারী আমার হাতে রয়েছে? তোমরা কি জান আমার মাথার এ পাগড়িটি মহানবী (সা.) এর। তোমাদের কি জানা নেই আমার পিতা হযরত আলী (আ.) প্রথম ব্যাক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং জ্ঞান ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে অতুলনীয়? আমার রক্ত তোমরা কি করে হালাল মনে করেছো, অথচ আমার বাবা হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন। কিয়ামতের দিন হামদের পতাকা তারই হাতে থাকবে।"
পাপে যখন মানুষের অন্তর সম্পূর্ণ কলুষিত হয়ে যায় তখন কোন নূরই তাদেরকে হেদায়েত করতে পারে না। ইমাম হোসেন (আ.) এর এই বলিষ্ঠ ও আবেগময়ী ভাষণেও এজিদের বিভ্রান্ত সৈনিকদের মনে কোন পরিবর্তন এলো না। ইবনে জিয়াদ যুদ্ধ শুরুর জন্য তার সেনাপতি ইবনে সাদকে চরম পত্র দিল। হয় আমিরুল মোমেনিন হিসেবে এজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নতুবা মৃত্যু। এছাড়া আর কোন পথ ইমামের সামনে খোলা রইল না। ইমাম এজিদের আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর আনুগত্যকেই বেছে নিলেন। কারণ তিনি নিজেই দোয়া করতেন, "হে আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত আমি তোমার আনুগত্য করি অনুসরণ করি, ততদিন আমার হায়াত বাড়িয়ে দিও। আর যদি তা শয়তানের চারণভূমিতে পরিণত হয় তাহলে আমাকে তোমার কাছে তুলে নিও।"
ইমাম হুসাইন (আ.)’র জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্য। মনে পড়ে গেল তাঁর মহান পিতার শাহাদতের সময়কার কথাটি, সেটি হলো, কাবার প্রভুর কসম আমি সফল হয়েছি। তিনি বলেছিলেন খোদার কসম, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি। মনে পড়ে গেল নানাজী রাসূল (সা.)’র কথা। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাঁকে দিয়েছিলেন।
এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন চোখে তন্দ্রা চলে এলো। স্বপ্নে দেখলেন নানাজান রাসুলে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতিমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে (তাদের সবার ওপর মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও দরুদ বর্ষিত হোক)। তাঁরা বললেন, হে হুসাইন! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে। এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ইমাম তাঁর বোন বিবি যেইনাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে? যেইনাব (সা.) চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ইমাম তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।
ইমাম (আ.) পরদিনের মহাকুরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। এই কুরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এতে তিল পরিমাণ খাঁদ থাকতে পারবে না। কারণ, আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাঁদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজ-দেহে সঞ্চালিত হবে। শহীদের খুন রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত সমাজ-দেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায়। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে। শহীদরা কিয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাঁদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী-রাসূলরাও তাঁদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন।
তাই ইমাম তাঁর কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমাণ গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, "আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে বেশি নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে বেশি উত্তম মনে করি না। মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।"
ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক ইমাম হুসাইন (আ.) সকলকে কাছে ডাকলেন। বললেন, "ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না। ভাইসব, তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমরা এখন মুক্ত। আমার জন্যে শুধু শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন অন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও, কেউ দেখতে পাবে না।"
ইমাম ভাষণ শেষ করে তাঁর ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন। যখন অন্ধকার হয়ে এলো তখন ইমামের সাথে আসা অনেক লোক সঙ্গোপনে ইমাম বাহিনী ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল। এদের সবাই পার্থিব লাভের আশায় মক্কা থেকে ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিল। যখন আলো জালানো হল তখন দেখা গেল মুষ্টিমেয় কিছু লোক মাত্র রয়ে গেছেন। এদের সংখ্যা একশো জনেরও কম।
আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মুমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জ্বল দীপ্তিমান হয়ে উঠল। মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তাঁর প্রয়োজন ছিল। তবুও তিনি তাঁর সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা কেন গেলে না?" এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, "একি বলছেন হযরত! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাব? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাব? আমরা কি বলব মহানবী (সা.) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি। তা কখনো হবে না। নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সাথে থেকে শহীদ হব।"
বীরত্ব ও সাহসিকতার অনন্য পরাকাষ্ঠা ইমাম হোসাইন (আ.) এর ভাই আব্বাস সবার আগে এগিয়ে এসে বললেন , 'আমরা তোমাকে একা রেখে নিজ নিজ শহরে ফিরে যাবো-এরকম কোনো দিন যেন না আসে ৷'
মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, "প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি! আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাব? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন। আমরা যুদ্ধ করব। গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাব, বর্শা চালব। ওগুলো ভেঙে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করব।"
সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম ! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবো না। আপনার জন্যে যদি নিহত হই এবং জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেচে থাকব এ কি করে হয়? যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, খোদার শপথ, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে ইচ্ছে করে একবার মরে আবার জীবিত হই, আবার মরে আবার জীবিত হই-এভাবে হাজারবার মরে বেঁচেও চাই নবীজীর খান্দান এবং এই যুবকদের জীবন সকল প্রকার বালা-মুসিবত্ থেকে রক্ষা পাক ৷'
ইমাম হাসানের ইয়াতিম পুত্র তেরো বছরের সুদর্শন কাসেম (আ)ইমামের পাশে চীত্কার করে বললেন, চাচাজান ! আমিও কি এই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাবো ? ইমাম তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মৃত্যুকে তুমি কীভাবে চিন্তা করো ? কাসেম বললেন, 'চাচাজান! আল্লাহর দ্বীনের সহযোগিতা করতে গিয়ে এবং জুলুম-অত্যাচার দূর করতে গিয়ে যেই মৃত্যু ঘটে তাকে আমি মধুর চেয়েওমিষ্টি বলে মনে করি ৷' ইমাম এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন ,হ্যাঁ , ভাতিজা আমার,তুমিও শহীদ হবে ৷ একথা শুনে এই কিশোর তখনই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে লাগলেন ৷ আর ইমাম হোসাইন ( আ ) চাঁদের রূপালি জ্যোত্স্নায় তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে দোয়া করলেন ৷ অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি শত্রুদের শিবিরগুলোর দিকে তাকিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১৭৮ এবং ১৭৯ নম্বর আয়াত দুটি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘কাফেররা যেন এই চিন্তা না করে যে,তাদের আমরা যে অবকাশ দিয়েছি তা তাদের মঙ্গলের জন্যে ৷ আমরা তাদেরকে অবকাশ দেই এইজন্যে যে,যাতে তারা তাদের গুনাহের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তোলে,তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ৷ এটা সম্ভব নয় যে , আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখবেন, তবে যে পর্যন্ত না ভালো থেকে মন্দ আলাদা হয়।
সঙ্গী-সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মুবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। ইমাম হুসাইন (আ.)’র ভাষণের পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে মশগুল হলেন ইবাদতে। কেউ সিজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে। কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে। দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাদের এই প্রার্থনায়।(রেডিও তেহরান)