সূরা ইউসুফ; আয়াত ৬১-৬৫
সূরা ইউসুফের ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
قَالُوا سَنُرَاوِدُ عَنْهُ أَبَاهُ وَإِنَّا لَفَاعِلُونَ
“তারা বলল, আমরা পিতার সঙ্গে কথা বলবো এবং (তাঁকে সম্মত করানোর চেষ্টা করবো) আমরা এ কাজ নিশ্চয়ই সম্পন্ন করবো।” (১২:৬১)
আগের পর্বে বলা হয়েছে, হযরত ইউসুফ সহজেই তাদেরকে চিনে ফেললেন কিন্তু তারা হযরত ইউসুফকে চিনতে পারল না। তারা হযরত ইউসুফ (আ.) এর কাছে আবেদন জানাল, আমাদের বৃদ্ধ বাবা এবং ছোট ভাই এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এখানে উপস্থিত হতে পারেনি। কাজেই তাদের দু'জনের জন্যও খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হোক।
হযরত ইউসুফ (আ.) তাদের আবেদন রক্ষা করলেন এবং বলে দিলেন, এবার ঐ দুইজনের খাবার দিয়ে দেয়া হচ্ছে কিন্তু এর পরের বার অবশ্যই ছোট ভাইটিকেও সঙ্গে আনতে হবে; অন্যথায় কারো জন্যই কোনো বরাদ্দ থাকবে না।
৬১ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা এই শর্ত মেনে নিয়ে বললেন, “বাবা যদিও ছোট ভাইটিকে আমাদের সঙ্গে আসার অনুমতি দিতে চাইবেন না, তারপরও আমরা বাবাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ছোটভাইকে সঙ্গে আনার চেষ্টা করবো। "
হযরত ইয়াকুব (আ.) ভালো করেই জানতেন, তার এই ছেলেরা হযরত ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বেনইয়ামিনের প্রতি কেমন হিংসা পোষণ করে। ফলে ছেলেরাও এটা বুঝতো যে, ইউসুফের দুঃখজনক ঘটনার পর হযরত ইয়াকুব কিছুতেই বেনইয়ামিনকে তাদের সঙ্গে মিশর পাঠাতে চাইবেন না। কাজেই পরের বার খাদ্য নিতে আসার সময় বেনইয়ামিনকে সঙ্গে নিয়ে আনা যাবে কিনা এ নিয়ে তাদের মধ্যেও উদ্বেগ কাজ করছিল।
এই সূরার ৬২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ لِفِتْيَانِهِ اجْعَلُوا بِضَاعَتَهُمْ فِي رِحَالِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَعْرِفُونَهَا إِذَا انْقَلَبُوا إِلَى أَهْلِهِمْ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
"ইউসুফ তার কর্মচারীদের বলল, তারা যে পণ্যমূল্য দিয়েছে তা তাদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও; যাতে পরিজনদের নিকট প্রত্যাবর্তনের পর তারা বুঝতে পারে যে, পণ্যের মূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে। তাহলে তারা পুনরায় আসতে পারে।" (১২:৬২)
হযরত ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়েও ভাইদের অতীত অপরাধের জন্য প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তা করলেন না। তিনি ভাইদের চেনার পর তাদের জন্য নির্ধারিত খাদ্য দিয়ে দিলেন,এমনকি তারা পণ্যের যে মূল্য পরিশোধ করেছিল তাও তিনি গোপনে ফেরত দিয়ে দিলেন। প্রতিশোধ পরায়ণতার চেয়ে ভালোবাসাই যে মহত্বের লক্ষণ হযরত ইউসুফ (আ.) এর এই আচরণ আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিচ্ছে।
সূরা ইউসুফের ৬৩ ও ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
فَلَمَّا رَجَعُوا إِلَى أَبِيهِمْ قَالُوا يَا أَبَانَا مُنِعَ مِنَّا الْكَيْلُ فَأَرْسِلْ مَعَنَا أَخَانَا نَكْتَلْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ (63) قَالَ هَلْ آَمَنُكُمْ عَلَيْهِ إِلَّا كَمَا أَمِنْتُكُمْ عَلَى أَخِيهِ مِنْ قَبْلُ فَاللَّهُ خَيْرٌ حَافِظًا وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
“তারা যখন পিতার নিকট ফিরে এলো,তখন তারা বলল, হে পিতা! আমাদের জন্য রসদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে,সুতরাং আমাদের ছোট ভাইকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিন যাতে আমরা রসদ পেতে পারি। নিশ্চয়ই আমরা তার রক্ষণাবেক্ষণ করবো।” (১২:৬৩)
“(হযরত ইয়াকুব) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সেরূপই বিশ্বাস করব যে রূপ এর আগে তার ভাইয়ের ব্যাপারে তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম? আল্লাহই রক্ষণাবেক্ষণে শ্রেষ্ঠ এবং দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।" (১২:৬৪)
বেনইয়ামিনকে সঙ্গে করে না গেলে এরপর আর মিশর থেকে খাদ্য আনা যাবে না। তাই হযরত ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তাদের পিতার কাছে অঙ্গীকার করল, যেকোনো প্রকারেই হোক তারা বেনইয়ামিনকে পুনরায় নিরাপদে বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে। হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর মনে একদিকে ইউসুফকে হারানো তিক্ত অভিজ্ঞতা অপরদিকে বেনইয়ামিনকে সঙ্গে না পাঠালে খাদ্যও পাওয়া যাবে না,তাই তিনি আল্লাহর ওপর নির্ভর করলেন এবং বেনইয়ামিনের নিরাপত্তার ভার তাঁর ওপরই ন্যস্ত করলেন। কঠিন সময়ে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা একদিকে মনকে যেমন প্রশান্ত করে তেমনি এতে ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহর ওপর অকৃত্রিম নির্ভরতা ঐশী সাহায্যকে অনিবার্য করে তোলে।
এই সূরার ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَمَّا فَتَحُوا مَتَاعَهُمْ وَجَدُوا بِضَاعَتَهُمْ رُدَّتْ إِلَيْهِمْ قَالُوا يَا أَبَانَا مَا نَبْغِي هَذِهِ بِضَاعَتُنَا رُدَّتْ إِلَيْنَا وَنَمِيرُ أَهْلَنَا وَنَحْفَظُ أَخَانَا وَنَزْدَادُ كَيْلَ بَعِيرٍ ذَلِكَ كَيْلٌ يَسِيرٌ
“যখন তারা তাদের মালপত্র খুলল তখন দেখতে পেল তাদের পণ্য-মূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আমরা আর কি প্রত্যাশা করতে পারি? এ আমাদের প্রদত্ত মূল্য, যা ফেরত দেয়া হয়েছে। আমরা পুনরায় আমাদের পরিবারবর্গকে খাদ্য সামগ্রী এনে দেব এবং আমরা আমাদের ভাইয়ের পর্যবেক্ষণ করবো এবং আমরা অতিরিক্ত আরও এক উট বোঝাই পণ্য আনব,ওই পরিমাণ (মিশরের রাজার নিকট) অতি নগণ্য মাত্র।" (১২:৬৫)
হযরত ইউসুফ (আ.) প্রথমেই পণ্যের মূল্য গ্রহণ না করার কথা বলতে পারতেন। তিনি সেটি করলেন না, কারণ এতে ভাইদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারতো অথবা তারা এতে অপমানিত বোধ করতে পারতেন। এসব কারণেই হয়তো তিনি পণ্যের মূল্য গ্রহণ করলেন আবার অজ্ঞাতসারে তা ফেরত দিয়ে দিলেন। তিনি ভাইদের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখলেন।