সূরা ইউসুফ; আয়াত ৮৩-৮৬
সূরা ইউসুফের ৮৩ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنْفُسُكُمْ أَمْرًا فَصَبْرٌ جَمِيلٌ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ (83) وَتَوَلَّى عَنْهُمْ وَقَالَ يَا أَسَفَى عَلَى يُوسُفَ وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ
“ইয়াকুব বলল, না তোমরা এক মনগড়া কথা নিয়ে এসেছো। সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়। হয়ত আল্লাহ তাদেরকে এক সঙ্গে আমার নিকট এনে দিবেন। তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।” (১২:৮৩)
“পুত্রদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বলল,আফসোস ইউসুফের জন্য! শোকে তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং সে ছিল অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট।" (১২:৮৪)
হযরত ইউসুফ (আ.) এর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা শেষ পর্যন্ত বেনইয়ামিনকে মিশরে রেখেই দেশে ফিরে গেল এবং বাহ্যত তারা যা দেখেছে, বুঝেছে সে অনুযায়ী বাবার কাছে সব ব্যক্ত করল এবং এটা বুঝাবার চেষ্টা করল যে, বেনইয়ামিন চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়েই মিশরে আটক রয়েছে। আগের পর্বে এ পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে।
৮৩ ও ৮৪ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, হযরত ইয়াকুব (আ.) পুত্রদের বক্তব্য শোনার পর বললেন, মনে হচ্ছে তোমাদের কুপ্রবৃত্তি আরেকটি নোংরা কর্মকে তোমাদের চোখের সামনে সুন্দররূপে তুলে ধরেছে। ইউসুফকে হারিয়ে আমার যে মর্মজ্বালা, বেনইয়ামিনকে মিশরে রেখে তোমরা তা আরও বাড়াতে চাও। কিন্তু আমি অসহিষ্ণু হতে চাই না। আমি ধৈর্য ধরবো। আশা করি মহান আল্লাহ তাদের দু’জনকেই আমার কাছে এনে দিবেন। তবে হযরত ইয়াকুব (আ.) ধৈর্য ধারণ করলেও তিনি ভীষণ মানসিক কষ্টে দিনযাপন করছিলেন। মনস্তাপ ও চোখের পানিতে তার চোখ সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং দৃষ্টিশক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
বেনইয়ামিনের ক্ষেত্রে তার বৈমাত্রেয় ভাইদের কোনো অশুভ ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না। এক্ষেত্রে তাদেরকে দোষীও সাব্যস্ত করা যাবে না। কিন্তু হযরত ইউসুফের সঙ্গে তারা যে আচরণ করেছে,হযরত ইয়াকুব তা কখনোই ভুলতে পারেন নি। এজন্য তিনি এবারও পুত্রদের কথা বিশ্বাস করতে পারেননি । তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করলেন এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করে ধৈর্য ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এই সূরার ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
قَالُوا تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُفَ حَتَّى تَكُونَ حَرَضًا أَوْ تَكُونَ مِنَ الْهَالِكِينَ
“তারা বলল, আল্লাহর শপথ! আপনি তো ইউসুফের কথা ভুলবেন না-যতক্ষণ না আপনি মুমূর্ষু অবস্থায় পতিত হবেন বা মৃত্যুবরণ করবেন।" (১২:৮৫)
বেনইয়ামিনকে মিশরে আটক করার ঘটনা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর মনে ইউসুফকে হারানোর কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়। তাই তিনি ঘন ঘন ইউসুফের কথা মনে করতে লাগলেন-যেটা তার পুত্রদের মোটেও ভালো লাগছিলো না। কারণ তারা ইউসুফকে ভীষণ হিংসা করতো। এজন্য তারা তাদের পিতাকে বলল, ইউসুফের দুঃখে আপনি নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলছেন। ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে, আমরা তা স্বচক্ষে দেখেছি। কাজেই ইউসুফের কথা মনে করে কেন আপনি নিজের ক্ষতি করছেন।
হযরত ইয়াকুব (আ.) আল্লাহর নবী হিসেবে ইউসুফকে ভালো করেই চিনতেন। তার ভবিষ্যৎ তিনি উপলব্ধি করতেন। কিন্তু ইউসুফের প্রতি পিতার ভালোবাসার কারণ তার বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল না। তাই তারা ইউসুফের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিল এবং তাকে পথে কাঁটা হিসেবে বিবেচনা করতো।
এরপর ৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
قَالَ إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ
“ইয়াকুব বলল, আমি আমার অসহনীয় বেদনা, আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর নিকট নিবেদন করছি এবং আমি আল্লাহর নিকট থেকে যা জানি তোমরা তা জান না।" (১২:৮৬)
পবিত্র কুরআনের অন্যান্য আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে,নবী-রাসূলগণ যে কোনো সমস্যা ও বিপদে আল্লাহর ওপর নির্ভর করতেন, তার সাহায্য কামনা করতেন, সব কিছু আল্লাহর কাছেই নিবেদন করতেন। যেমন-হযরত মুসা (আ.) অভাব অনটনের কথা আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আ.) রোগ মুক্তির আবেদন করেছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আ.)ও তেমনি অত্যধিক স্নেহভাজন শিশু পুত্রকে হারানোর বিষয়টি আল্লাহর ওপরই সোপর্দ করেছিলেন।