“আর তোমাদের মধ্যে এমন এক দল থাকা আবশ্যক যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে আর অসৎ কাজের নিষেধ করবে, এরাই হল সফলকাম।” (সূরা-আল-ইমরান, আয়াত-১০৪)
“আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়িয়ে ধর পরস্পর বিচ্ছিন্ন (ফেরকাবন্দী) হইও না।” (সূরা-আলে ইমরান, আয়াত-১০৩)
ইসলাম; অর্থ শান্তি ও আত্মসমর্পণ। ইসলাম গ্রহণ করার পর ধর্মের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছা-চিন্তা-চেতনার কোন প্রকার প্রবেশ ঘটানোর কোন অবকাশ নাই। প্রতিটি কর্ম হতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। সেটা নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, খুমস্, কোরবানী কিংবা অন্য যে কোন আমল হোক না কেন, নিজের ইচ্ছা প্রকাশের কোন অবকাশ নেই। মানুষ মানেই আল্লাহর দাস, (বান্দা) দাস কখনো আল্লাহর উপর হুকুম চালাতে পারে না। দাস আবার দু’প্রকারের-এক বাধ্যগত, দুই অবাধ্য। যারা বাধ্যগত দাস, তারা আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ মাথানত করে পালন করে থাক। আর যারা অবাধ্য দাস, তারা আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশ অমান্য করে নিজের মনমত ইজমা -কিয়াস করে আল্লাহর নির্দেশের সীমালঙ্ঘন করে জাহান্নামের চির বাসিন্দা হয়।
কিন্তু অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে ! আজকে আমরা পবিত্র ইসলামে, মুসলিম উম্মাহর মাঝে, যে ফেরকাবন্দী বা দল বিভক্তি দেখছি, তা আল্লাহ, রাসূল (সাঃ) কিংবা পবিত্র কোরআনকে কেন্দ্র করে হয়নি, হয়েছে খিলাফত বা ইমামতকে হস্তক্ষেপ করার কারনে। মহানবী (সাঃ)-এর পর উম্মতে মুহাম্মদীকে “সিরাতে মুস্তাকিমের” পথে পরিচালিত বা দিকনির্দেশনা দিবে তা নিয়ে, রাসূল (সাঃ) আজকের দিনের অবস্থা সম্পর্কে ভালো ভাবে অবগত ছিলেন। কেননা একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মতেরা আমার পর ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, এদের মধ্যে ১টি দল পরকালে মুক্তি পাবে, আর বাকি দলগুলো পথভ্রষ্ট বা তারা জাহান্নামী হবে”। সূত্রঃ-মুসতাদরাকে হাকেম, খঃ-৩, পৃঃ-১০৯; মুসনাদে হাম্বাল, খঃ-৩, পৃঃ-১৪; তিরমীজি, খঃ-৫, হাঃ-২৬৪২, (ই,ফাঃ);“মহানবী (সাঃ) এটাও বলেগেছেন-আমার উম্মতের একটি দল (মাযহাব) সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। সূত্রঃ- সহীহ্ মুসলিম, খঃ-৫, হাঃ-৪৭৯৭, (ই,ফাঃ); সহীহ তিরমীজি-(সকল খণ্ড একত্রে) পৃঃ-৬৯৩, হাঃ-২১৯০, (তাজ কোং); সহীহ্ বুখারী (সকল খণ্ড একত্রে) পৃঃ-১১১৩, হাঃ-৬৮০৪, (তাজ কোং)।
মহানবী (সাঃ)-এর উম্মত হওয়ার পরও আমরা কেন জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবো ? কারণ শুধু এটাই যে, মহানবী (সাঃ)-কে মুখে মানবো, ধর্ম পালন করবো নিজের মনমতো, আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) যাদেরকে অনুসরণ করতে বলেছেন, আমরা তাদেরকে আমলেই নিচ্ছি না। এবং রাসূল (সাঃ) অন্যত্র বলেছেন, “আমার পর এমন সব ইমাম হবে (নেতা হবে) যে আমার হেদায়েত অনুসারে আমল করবে না এবং আমার সুন্নাতকে আমলের উপযুক্ত মনে করবে না এবং শীঘ্রই তাদের মধ্যে হতে এমন লোকরা উঠে দাড়াবে, যাদের দেহ হবে মানুষের মত কিন্তু অন্তর হবে শয়তানের”। সূত্রঃ- সহীহ্ মুসলিম, খঃ-৬, পৃঃ-২০, (আরবি); সহীহ্ মুসলিম-(সকল খণ্ড একত্রে), পৃঃ-৭৫১, হাঃ-৪৬৩৩; (তাজ কোং)।
কিন্তু প্রশ্ন হল? এই অবস্থা থেকে মুক্তি বা “সিরাতে মুস্তাকিমের” সত্যপথ পাওয়ার কোন দিকনির্দেশনা কি তিনি দিয়ে যাননি? যদি তিনি পথনির্দেশনা দিয়ে থাকেন, তাহলে তা আমাদের অবশ্যই অনুসন্ধান করা উচিত। আর যদি কোন পথনির্দেশনা না দিয়ে থাকেন, তবে বেশ কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাড়াবে। যথাক্রমে তিনি তাহলে কিভাবে রাহমাতাল্লিল্ আলামিন হলেন? যিনি উম্মতের সমস্যাকে শনাক্ত করতে সক্ষম, কিন্তু সমাধান দিতে পারেন না! কিয়ামতের দিন আমরা মহান আল্লাহর দরবারে অজুহাতের স্বরে বলতে পারবো যে, “ইয়া রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে আমরা বিভিন্ন দলের বা মাযেহাবের দেখানো পথের অনুসরণ করেছি। কোন পথে চলতে হবে সেক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)-এর কোন দিকনির্দেশনা পাইনি। তাই আমরা জন্ম সূত্র বাপ-দাদাদের কাছে যে মাযহাব পেয়েছি, তারই অনুসরণ করেছি”। কিন্তু এরকম সকল প্রকারের বাহানার ভিত্তিকেই মহান আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বাতিল করে দিয়েছেন-“সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে রাসূলদের আমি এজন্য প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলদের আগমনের পর আল্লাহর সামনে, মানুষের কোন ওজর আপত্তি না থাকে” (সূরা-নিসা, আয়াত-১৬৫); “আমিই আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আর এমন কোন উম্মত ছিল না, যাদের মধ্যে কোন সতর্ককারি আসেনি” (সূরা-ফাতির, আয়াত-২৪); “আপনি তা কেবল সতর্ককারী মাত্র। আর প্রত্যেক কওমের জন্য আছে পথ প্রদর্শক” (সূরা-রাদ, আয়াত-৭); “আমি এ কিতাবের (কোরআনের) অধিকারী (ওয়ারিশ) করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে পছন্দ করেছি”(সূরা-ফাতির, আয়াত-৩২)।
আল্লাহ্ সব সময় তার বান্দার মঙ্গল কামনা করে থাকেন। আল্লাহর ইচ্ছা তার বান্দারা যাতে পথভ্রষ্ট না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি রেখে তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর মারফত, বিদায় হজ্বে একলক্ষ বিশ হাজার সাহাবীদের মাঝে এরশাদ করেছিলেন।
হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি ভারি বস্তু রেখে যাচ্ছি, যদি এ দু’টিকে আঁকড়ে ধরে থাক (অনুসরণ কর) তাহলে কখনই পথভ্রষ্ট হবে না।” আর যদি একটিকে ছাড় তাহলে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। তার প্রথমটি হচ্ছে “আল্লাহর কিতাব (কোরআন) দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার ইতরাত, আহলে বাইত” [(আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আঃ)] এ দু’টি কখনই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না, যেতক্ষণ না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে। তাদের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ কর, এটা আমি দেখবো । সূত্রঃ- সহীহ্ মুসলিম, খঃ-৫, হাঃ-৬০০৭, ৬০১০, (ই, ফাঃ); সহীহ মুসলিম, খঃ-৫, পৃঃ- ৩৭৪-৩৭৫, হাঃ-৬১১৯-৬১২২, (আহলে হাদীস লাইব্রেরী); সহীহ্ তিরমীজি, খঃ-৬, হাঃ-৩৭৮৬- ৩৭৮৮, (ই,ফাঃ); মেশকাত, খঃ-১১, হাঃ-৫৮৯২-৫৮৯৩, (এমদাদীয়া); তাফসীর মাজহারী, খঃ-২, পৃঃ-১৮১, ৩৯৩, আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপথি (ইফাঃ); তাফসীর হাক্কানী (মাওলানা শামসুল হক ফরীদপূরি) পৃঃ-১২-১৩ (হামিদীয়া); তাফসীর নূরুল কোরআন, খঃ-৪, পৃঃ-৩৩, খঃ-২২, পৃঃ-১৭ (মাওলানা আমিনুল ইসলাম); মাদারেজুন নাবুয়াত, খঃ-৩, পৃঃ-১১৫, (শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী); ইযাযাতুল খিফা (শাহ ওয়ালিউল্লাহ), খঃ-১, পৃঃ-৫৬৬; সিলসিলাত আল আহাদিস আস সাহীহাহ্, নাসিরউদ্দিন আলবানী, কুয়েত আদদ্বার আস সালাফীয়া, খঃ- ৪, পৃঃ-৩৫৫-৩৫৮, হাঃ-১৭৬১, (আরবী); (নাসিরউদ্দিন আলবানীর মত এই হাদীসটি সহীহ্)।
বিদায় হজ্ব মহানবী (সাঃ) তার উম্মতকে “কোরআন ও ইতরাত, আহলে বাইত”(আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আঃ)-কেই অনুসরণ করতে হুকুম করে গিয়েছেন। এত কোন সন্দেহের অবকাশ নাই। কিন্তু পরবর্তীতে আরো একটি হাদীসের কথা শোনা যাচ্ছে। “কোরআন ও হাদীস বা সুন্নাহ্”। মহানবী (সাঃ) নাকি এটাও বলে গিয়েছেন, কিন্তু কোরআন ও হাদীস দুইটিই বধির, কথা বলতে পারে না।
কোরআনে আবার দু’ধরণের আয়াত আছে। স্পষ্ট ও অস্পষ্ট। যাদের মনে বক্রতা আছে তারা এর মনগড়া ব্যাখ্যা করে ফেতনা সৃষ্টি করবে। আর হাদীস?
যে কত রকম কোরআন ও পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। কাজেই এমন দু’টি জিনিস নবী করিম (সাঃ) দিয়ে যেতে পারেন না। তাই কোরআনের সঙ্গে এমন একজনকে থাকত হবে, যাকে কোরআন পবিত্র ও জ্ঞানী বলে ঘোষণা দেয় এবং তাকে সব সময় উপস্থীত থাকত হবে।
এই দ্বিতীয় হাদীসটি “কোরআন ও হাদীস বা সুন্নাহ্” উম্মতকে কিন্তু বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে। এই বিভ্রান্তি মুসলমানদের ফেরকাবন্দী বা দল বিভক্তির কারণ হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত লেখনীতে আমি মহানবী (সাঃ) তার উম্মতকে “কোরআন ও ইতরাত, আহলে বাইত” (আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আঃ)-কেই অনুসরণ করতে হুকুম করে গিয়েছেন। তা কোরআন-হাদীস ও আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ আলেমগণের উক্তিও প্রমাণ স্বরূপ সুন্দরভাব তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
যারা আহলে বাইতকে বাদ দিয়ে অত্র ‘হাদীস’ খানা (কোরআন ও হাদীস বা সুন্নাহ্) উপস্থাপন করে থাকেন, তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ রইল। ....“যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে প্রমাণ নিয়ে এসো” (সূরা-বাকারা, আয়াত-১১১); আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করব। আর যদি প্রমাণ পেশ করতে অক্ষম হন, তাহলে মেনে নিন যে, নবীজি তার উম্মতকে “কোরআন ও ইতরাত, আহলে বাইতকে-ই অনুসরণ করতে হুকুম করে গিয়েছেন”। ইসলামে ঈমান বা বিশ্বাসের ব্যাপার কোন জোর-জবরদস্তি নেই। যেমন এরশাদ হয়েছে, “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সৎপথ ভ্রান্ত পথ থেকে” (সূরা-বাকারা, আয়াত-২৫৬)। “তাদের অধিকাংশই অনুমানের অনুসরণ করে চলে। সত্যর ব্যাপারে অনুমান কোন কাজেই আসে না...”(সূরা-ইউনুস, আয়াত-৩৬)। ঈমান হচ্ছে, বিশ্বাস, আগ্রহ এবং আমলের একত্রিত নাম সুতরাং শক্তি প্রয়োগের দ্বারা তা অর্জন করা যায় না। এর সঠিক পন্থা হচ্ছে, মানুষের বিজ্ঞতা ও জ্ঞানর নিকট. শান্তি ও আত্মসমর্পণের সুন্দর পরামর্শ ও সদুপদেশের আবেদন জানানো। যুক্তির মাধ্যম আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ)-এর জ্ঞান ও হুকুমকে বাস্তবায়িত ও প্রচারের চাবিকাঠি হচ্ছে, ভদ্রতা প্রদর্শন এবং মানুষের হৃদয়, আত্মা ও চিন্তা শক্তির নিকট হেকমত-এর সাথে ‘দাওয়াহ্’ ও ‘নসিহত’ পেশ করতে হবে। ‘দাওয়াহ্’ ও ‘নসিহত’ পেশ করার, এটাই সঠিক পন্থা। আল্লাহর কাছ প্রার্থনা, আল্লাহ্ যেন সকলকে “সিরাতে মুস্তাকিমের” সত্য পথ বুঝার ও “সিরাতে মুস্তাকিমের” সত্য পথে চলবার তফিক দেন- আমিন। #মোহাম্মাদ নাজির হোসাইন