সূরা রা’দ; আয়াত ১-৩
সূরা রা'দ মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে এবং এই সূরায় মোট ৪৩টি আয়াত রয়েছে। এই সূরায় মূলত কুরআন শরীফের সত্যতা, তাওহীদ বা একত্ববাদ,রিসালাত এবং সৃষ্টি জগতের রহস্য ও প্রকৃতিতে বেঁধে দেয়া নিয়ম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে,
المر تِلْكَ آَيَاتُ الْكِتَابِ وَالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ الْحَقُّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يُؤْمِنُونَ
"পরম করুণাময় ও দাতা আল্লাহর নামে। আলিফ-লাম-মীম-রা, এগুলো (ঐশী) গ্রন্থের আয়াত বা বাক্য। যা কিছু আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, তা সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এতে বিশ্বাস স্থাপন করে না।" (১৩:১)
আলিফ-লাম-মীম-রা, এগুলো খণ্ডিতবর্ণ বা হরুফে মুকাত্তায়া। পবিত্র কুরআনের ২৯টি সূরা এ ধরনের খণ্ডিতবর্ণ দ্বারা শুরু হয়েছে। এসবের অর্থ আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। উম্মতকে এর অর্থ বলা হয়নি। মুফাস্সিরদের কেউ কেউ বলেছেন,এসব শব্দের পর সাধারণত কুরআন বা কুরআন সম্পর্কিত কথা বলা হয়েছে, ফলে সাংকেতিক এসব শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ হয়ত বলতে চেয়েছেন, এই কুরআন চিরন্তন ঐশী গ্রন্থ হলেও তা আরবী বর্ণমালার মাধ্যমেই লিখিত হয়েছে। যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায় তাহলে তোমরা আরবী বর্ণমালা ব্যবহার করে কুরআনের অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনা করে দেখাও। মুমিন মুসলমানদেরকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এই আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কুরআনের আয়াত বা বাক্যগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকেই পয়গম্বর (সা) লাভ করেছেন, আর নবী করিম (সা.) এর ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়, তা সম্পূর্ণ সত্য। সমাজের অধিকাংশ মানুষকে দেখা যায় যে, তারা আল্লাহর বাণী অগ্রাহ্য করে চলছে ফলে এর অর্থ এই নয় যে এতে ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। বরং খামখেয়ালী এবং অন্ধ বিদ্বেষের কারণে এসব মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
এই আয়াতের একটি শিক্ষা হচ্ছে, মুসলমানদের এমন ভাবা উচিত নয় যে, দুনিয়ার সকল মানুষই সত্যকে গ্রহণ করে মুমিন মুসলমান হয়ে যাবে। বরং অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে তারা সত্য ধর্মকে উপেক্ষা করছে কিংবা তার যথার্থ মূল্যায়ন করছে না। কাজেই বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্ম বিশ্বাসে উপনীত হতে হবে, এক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞান ও যুক্তিই হবে মানদণ্ড। কোন ধর্ম বা মতবাদের অনুসারীদের আধিক্য সেই ধর্ম বা মতবাদের সত্যতা প্রমাণ করে না। কারণ অনেক সময় দেখা গেছে নানা কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইতিহাসে এর বহু নজির খুঁজে পাওয়া যাবে।
সূরা রা’দের ২নং আয়াতে বলা হয়েছে,
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ
“আল্লাহই উর্ধ্বদেশে স্তম্ভ ছাড়া আকাশমণ্ডলী স্থাপন করেছেন-যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো। অতঃপর তিনি আরশে অধিষ্ঠিত হলেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করলেন, প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন। যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পারো।" (১৩:২)
পবিত্র কুরআনকে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান এবং মানুষের প্রতি স্রষ্টার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হিসেবে বর্ণনার পর এই আয়াতে মহান আল্লাহর মাহাত্ম্য ও সৃষ্টিজগতে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে, আকাশমণ্ডলীর কথা, মহাশূন্যে ভাসমান অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের কথা যারা আবর্তিত হচ্ছে নির্দিষ্ট কক্ষপথে। কোথাও কোন অনিয়ম নেই, দুর্ঘটনা নেই, এ নিয়ে ভাবলে মনে হয় অদৃশ্য স্তম্ভের ওপর ভর করে এসব গ্রহ-উপগ্রহ অদৃশ্য পথে আবর্তিত হচ্ছে। আসলে এসবই সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতারই নিদর্শন। অনন্ত ক্ষমতা ও সামর্থের অধিকারী আল্লাহ ছাড়া কারো পক্ষে সৃষ্টি জগতে এ ধরনের শৃংখলা বিধান করা সম্ভব নয়। তিনি একক সামর্থ বলে বিশ্ব জগত পরিচালনা করছেন, এমন নয় যে তিনি বিশ্বজগত সৃষ্টি করে তা উদ্দেশ্যহীনভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। বরং সকল সৃষ্টিই তাঁর নিয়ন্ত্রণের অধীনে, তাঁর নির্ধারিত গণ্ডির বাইরে যাওয়া করো পক্ষেই সম্ভব নয়।
সকল সৃষ্ট বস্তুই গতিশীল ও চলমান। আর এই গতি ও চেতনার সঞ্চালক হলেন মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়,তা হলো এ জগতকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্শ্বিজগত সৃষ্টি করেছেন। আর এই উদ্দেশ্য হচ্ছে এই জগতের অবসানের পর আখেরাত বা পরকালীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গোটা সৃষ্টি জগত সে লক্ষেই এগিয়ে যাচ্ছে।
এই সূরার ৩নং আয়াতে বলা হয়েছে,
وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
“তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং এতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক ফল সৃষ্টি করেছেন দুই প্রকারের। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। এতে অবশ্যই চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।" (১৩:৩)
আকাশ সৃষ্টির কথা বলার পর এ আয়াতে ভুতল সৃষ্টি ও তা সম্প্রসারিত হওয়া, পর্বত ও নদী-নালার সৃষ্টি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে,তিনিই মানুষের প্রশান্তি নিশ্চিত করতে দিন ও রাত্রির আবর্তনের ব্যবস্থা করেছেন। এর ফলে গাছ-পালা তরুলতা বা উদ্ভিদের জন্ম ও বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে। আর এসব গাছ পালা থেকে আহরিত ফল মূল মানুষের সুষম খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাজেই বিশ্ব জগতের সৃষ্টি এবং প্রতিটি বস্তু নিয়ে চিন্তা করলে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার অসীম ক্ষমতার বিষয়টিই প্রমাণিত হবে।