রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে আবারও ফিরে এসেছে পবিত্র রমজান। এই মাস আত্মশুদ্ধির মাস এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনসহ সারা জীবনের জন্য পাথেয় ও পরকালের সম্বল অর্জনের মাস। জীবনকে উন্নত ও অর্থবহ করার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্যও এই মাসের রোজাগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
আসলেই পবিত্র রমযান মাসের কর্মসূচী মানুষ গঠনের পরিকল্পনার । অর্থাৎ কর্মসূচীর উদ্দেশ্য এটাই যে,এ মাসে ত্রুটিযুক্ত মানুষ নিজেকে ত্রুটিহীন মানুষে এবং ত্রুটিহীন মানুষ নিজেকে পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে। এ পবিত্র মাসের পরিকল্পনা নাফ্স বা প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধি,মানবীয় ত্রুটি ও অপূর্ণতার সংশোধন,প্রবৃত্তির জৈবিক তাড়নার উপর বুদ্ধিবৃত্তি,ঈমান ও ইচ্ছা শক্তির বিজয় ও নিয়ন্ত্রণ।
এর জন্য দোয়ার কর্মসূচী,সত্যের পথে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে উড্ডয়ন,আত্মার উন্নয়নের জন্য কর্মসূচী,আত্মাকে বিকাশমান ও গতিশীল করার পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে। যদি এমন হয় যে,পবিত্র রমযান মাস এল,মানুষ ত্রিশ দিন ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত ও নিদ্রাহীন থাকল,উদাহরণস্বরূপ রাত্রিগুলোতে অনেক সময় জেগে থাকল,এখানে ওখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল,তারপর ঈদ আসলো,কিন্তু রমযানের পূর্বের দিন থেকে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি,তাহলে ঐ রোযা তার জন্য কোন উপকারই বয়ে আনেনি। ইসলাম তো এটা চায় না যে,মানুষ এমনিই মুখ বন্ধ করে রাখবে। মানুষ মুখ বন্ধ করুক আর না করুক ইসলামের জন্য কোন পার্থক্য নেই,বরং রোযা রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা যে,মানুষ সংশোধিত হবে। কেন হাদীসসমূহে এমন এসেছে,প্রচুর রোযাদার আছে যারা রোযা থেকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করে না,তাদের রোযা শুধু ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া কিছুই নয়। হালাল খাদ্য থেকে মুখ বন্ধ করার অর্থ মানুষ এ ত্রিশ দিন একনাগাড়ে অনুশীলন করবে হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখার,গীবত না করার,মিথ্যা না বলার ও গালি না দেয়ার।
রোযা যে বাতেনী,আধ্যাত্মিক ও আত্মিক তার প্রমাণ- একদিন এক রোযাদার মহিলা রাসূল(সা.)-এর নিকট আসল। রাসূল দুধ অথবা অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বললেন,“নাও পান কর।” সে বলল,“ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি রোযা আছি।” রাসূল বললেন,“তুমি রোযা রাখনি এবং এ বলে পুনরায় তাকে খেতে নির্দেশ দিলেন।” মহিলা বলল,“আসলেই আমি রোযা আছি।” (যেহেতু তার বিবেচনায় রোযা আছে বলে মনে করল,যেমন বাহ্যিক রোযা আমার রাখি)। রাসূল বললেন,“তুমি কেমন রোযা রেখেছ যে,কিছুক্ষণ পূর্বেই তোমার মুমিন ভাই বা বোনের মাংস খেয়েছ (অর্থাৎ গীবত করেছ)। তুমি কি দেখতে চাও যে,মাংস খেয়েছ। ভেতর থেকে এখনই তা উল্টিয়ে ফেল।” তখনই সে বমি করল ও এক টুকরা মাংস তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল। মানুষ রোযা রেখে গীবত করে। ফলে যদিও তার মুখকে হালাল খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে,কিন্তু তার আত্মার মুখকে হারাম খাদ্য দ্বারা পূর্ণ করে।
কেন আমাদের উদ্দেশ্যে এটা বলা হয়েছে যে,যদি মানুষ একটা মিথ্যা বলে তবে তার মুখের দুর্গন্ধে সপ্ত আসমান পর্যন্ত ফেরেশতারা কষ্ট পান। যেমন বলা হয় যখন মানুষ জাহান্নামে থাকবে তখন জাহান্নাম প্রচণ্ড দুগন্ধ ছড়াবে। এ দুগন্ধ প্রকৃতপক্ষে এ দুনিয়াতেই আমরা সৃষ্টি করেছি মিথ্যা কথা বলা,গালি দেয়া,অপবাদ ও পরনিন্দা চর্চার মাধ্যমে।
পরনিন্দা ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ গীবত থেকেও খারাপ,যেহেতু পরনিন্দার মাধ্যমে যেমন মিথ্যাও বলা হয় তেমন গীবতও করা হয়। কিন্তু যে মিথ্যা বলে সে শুধু মিথ্যাই বলে,গীবত করে না। তাই পরনিন্দায় দু’টি কবীরা গুনাহ এক সঙ্গে আঞ্জাম দেয়া হয়।
এটা কি উচিত,রমযান মাস শেষ হয়ে যায়,অথচ এ মাসে আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে নিন্দা ও অপবাদ আরোপ করতে থাকি? রমযান মাস এজন্য যে,মুসলমানরা বেশি বেশি সমবেত হবে,সম্মিলিতভাবে ইবাদত করবে,মসজিদে একত্র হবে। এজন্য নয় যে,একে অপরকে দূরে সরানোর জন্য এ মাসকে ব্যবহার করবে।