আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ যা আজ ‘নাহজুল বালাগাহ্’ নামে আমাদের হাতে বিদ্যমান তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট কোন ক্ষেত্র বা বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ইমাম আলী কেবল একটি ময়দান বা ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেন নি, বরং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেছেন যা ছিল কখনো কখনো পরস্পর বিপরীতধর্মী। ‘নাহজুল বালাগাহ্’ একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকর্ম, তবে তা উপদেশ, বীরত্বগাথা অথবা প্রেমগীতি ও প্রেমোপাখ্যান অথবা প্রশংসা গীত ও ব্যঙ্গ কাব্যের মত নির্দিষ্ট একটি মাত্র বিষয় ও ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিষয়কে কেন্দ্র করেই রচিত।
যেহেতু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তবে যদিও একটি ক্ষেত্র বা বিষয়ে লিখিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় খুব বেশি নয়, বরং সীমিত, যা হোক, এতদ্সত্ত্বেও তা আছে। আর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের পর্যায়ে নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ মানগত পর্যায়ে রচিত একক সাহিত্যকর্মের সংখ্যাও প্রচুর। তবে যে বাণী শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরং সকল ক্ষেত্র ও বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট তা হচ্ছে ‘নাহজুল বালাগাহ্’।
আমরা পবিত্র কোরআনের কথা বাদই দিলাম। কোন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে কি যা ‘নাহজুল বালাগা’র মত বৈচিত্র্যময়? ভাষা বা কথা আত্মারই প্রতিনিধি। প্রত্যেক ব্যক্তির ভাষা ঐ জগতের সাথে সম্পর্কিত যার সাথে ঐ ভাষা বা বাণীর কথকের আত্মাও জড়িত। স্বভাবতই যে বাণী বা কথা বহু জগতের সাথে জড়িত তা এমন এক মনোবল ও মানসিকতার নির্দেশক যা কোন একটি নির্দিষ্ট জগতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। যেহেতু আলীর আত্মা কোন নির্দিষ্ট জগতের সাথে জড়িত নয়, বরং তা সকল জগতেই উপস্থিত; আর আধ্যাত্মিক সাধকদের পরিভাষায় তাঁর আত্মা ইনসানে কামিল, একটি সামগ্রিক মহাবিশ্ব ও পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বজগৎ, সকল মাননীয় সত্তাগত গুণের আধার এবং সকল পর্যায় সমন্বিত, সেহেতু তাঁর বাণীও কোন নির্দিষ্ট জগতে সীমাবদ্ধ নয়। ইমাম আলীর বাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, আমাদের এ যুগের বহুল প্রচলিত পরিভাষা অনুসারে তা বহুমাত্রিক এবং তা একমাত্রিক নয়।
ইমাম আলীর বাণী ও তাঁর আত্মার বহুমাত্রিক হবার বিশেষত্বটি এমন কোন বিষয় নয় যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা এমনই এক বিষয় যা ন্যূনতম পক্ষে ১০০০ বছর আগে থেকেই বিস্ময়াবোধের সৃষ্টি করেছিল। সাইয়্যেদ রাযী যিনি ১০০০ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন তিনি এ বিষয়টি অনুধাবন করেছেন এবং এ ব্যাপারে তীব্র অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, “আলীর অত্যাশ্চর্যজনক বিষয়াদি যা কেবল তাঁর মাঝেই সীমাবদ্ধ এবং কেউই এ ক্ষেত্রে তাঁর শরীক ও সমকক্ষ নয়, তা হচ্ছে, দুনিয়াবিমুখতা, সদুপদেশ ও সতর্কীকরণ সংক্রান্ত তাঁর যে সব বাণী আছে সেগুলো নিয়ে যদি কেউ স্বতন্ত্র ও গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সাময়িকভাবে ভুলে যায় যে, এ বাণীর (নাহজুল বালাগাহ্ গ্রন্থের) রচয়িতা নিজেই এক বিরাট ও সুমহান সামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাঁর নির্দেশ সকল স্থানে কার্যকর এবং তিনি নিজেই তাঁর যুগের একচ্ছত্র অধিপতি, তাহলে সে মোটেও সন্দেহ করবে না যে, এসব বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি তাকওয়া- পরহেজগারী ও দুনিয়াবিমুখতা ব্যতীত আর কিছুই চেনেন না এবং মানেন না, ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির করা ব্যতীত যাঁর আর কোন কাজ নেই, যিনি গৃহের কোণ অথবা পাহাড়ের পাদদেশকে একাকী নিভৃতে ইবাদত করার জন্য বেছে নিয়েছেন, যিনি নিজের কণ্ঠ ও স্বরধ্বনি ব্যতীত আর কিছুই শুনতে পান না, নিজ সত্তা ব্যতীত আর কিছুই যাঁর দৃষ্টিগোচর হয় না এবং যিনি সমাজ ও সমাজ জীবনের কোলাহল সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।
কেউ বিশ্বাস করবে না যে, দুনিয়াবিমুখতা, সতর্কীকরণ ও সদুপদেশের ক্ষেত্রে এসব সুন্দর কথা ও বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সেনাদলের মাঝে অনুপ্রবেশ করেন, রণক্ষেত্রে যাঁর (নাঙ্গা) তলোয়ার ঝিলিক দেয় এবং শত্রুদের মাথা কাটার জন্য প্রস্তুত, যিনি বীরদেরকে ধরাশায়ী করেন, যাঁর তরবারি থেকে শত্রুদের রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে, অথচ ঠিক এ অবস্থায়ই তিনি আবার সাধক পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী এবং ইবাদতকারী বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইবাদতকারী।”
এরপর সাইয়্যেদ রাযী বলেছেন, “আমি এ বিষয়টি বহুবার আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে উপস্থাপন করেছি। আর এভাবে আমি তাদের বিস্ময়ানুভূতির উদ্রেক ঘটিয়েছি।” শেখ মুহাম্মদ আবদুহুও নাহজুল বালাগার এই বিশেষ দিক ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ এর বহুমাত্রিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। নাহজুল বালাগায় অন্তরায়সমূহের পরিবর্তন ও বিভিন্ন জগতের দিকে পাঠককে পরিচালিত করার বিষয়টি অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। তিনি এ বিষয়টি ‘নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা’-এর ভূমিকায় ব্যক্ত করেছেন।
আলী (আ.)-এর ভাষা ও বাণীসমূহ ছাড়াও সার্বিকভাবে তাঁর আত্মা ব্যাপক, সর্বজনীন ও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি সর্বদা প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক, রাত্রি জাগরণকারী, ইবাদতকারী। তিনি ইবাদতের মিহরাবে ক্রন্দন করতেন এবং যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল অকুতোভয় সৈনিক। তিনি ছিলেন দয়ালু ও হৃদয়বান অভিভাবক। তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক। তিনি ছিলেন যোগ্য সেনাপতি ও নেতা। তিনি যেমন শিক্ষক ছিলেন তেমনি ছিলেন বক্তা, বিচারপতি, মুফতী, কৃষিজীবী, লেখক অর্থাৎ তিনি ছিলেন ‘ইনসানে কামিল’। মানব জাতির সকল আত্মিক-আধ্যাত্মিক দিক-পর্যায় ও জগৎসমূহ ছিল তাঁর নখদর্পণে। সাফীউদ্দীন হিল্লী (মৃ. ৮ম হিজরী) আলী (আ.) সম্পর্কে বলেছেন,
তোমার গুণাবলীর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয়সমূহ
আর এ কারণেই তোমার প্রতি আকৃষ্ট ও বন্ধু ভাবাপন্ন হয়েছে শত্রুগণ
তুমি ত্যাগী (সাধক), শাসনকর্তা, ধৈর্যশীল, সাহসী
শত্রুনিধনকারী, উৎসর্গকারী, দরিদ্র ও দানশীল
কভু যদি কোন মানবের মাঝে হয় এগুলোর সমাবেশ তাহলে তা হবে কতই না প্রশংসনীয়
এসব বৈশিষ্ট্যের ন্যায় কোন কিছুই কোন মানুষ কভু করে নি অর্জন
তোমার স্বভাব-চরিত্রের কমনীয়তা ভোরের মৃদুমন্দ সমীরণকেও করে লজ্জিত
আর তোমার শক্তি ও সাহসের কাছে কঠিন পাথরও হয় বিগলিত
তোমার মান-মর্যাদা এতটা মহান ও উচ্চ যে, তা কাব্যে করা যায় না প্রকাশ
আর না গণনাকারী তোমার গুণাবলী গণনা করতে সক্ষম।
এ সব কিছু বাদ দিলেও অপর একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এটি যে, আলী (আ.) যদিও আধ্যাত্মিকতা ও অজড় বিষয়াদির ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন তবুও তিনি ভাষার প্রাঞ্জলতা সাবলীলতা, বলিষ্ঠতা ও মাধুর্যকে পূর্ণত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মদ, প্রেমাস্পদ, আত্মগৌরব ও এ ধরনের বিষয়সমূহ ইমাম আলী আলোচনা করেন নি যেগুলোর ব্যাপারে কথা বলা ও আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রয়েছে। অধিকন্তু তিনি কথা বলার জন্য বা নিজের ভাষা ও বাগ্মিতার শৈল্পিক নৈপুণ্য প্রকাশ করার জন্য কথা বলেন নি, বক্তৃতা দেন নি। ভাষা ছিল তাঁর কাছে মাধ্যম; তবে তা উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চাইতেন না এভাবে তাঁর নিজের পক্ষ থেকে একটি শিল্পকর্ম ও একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কীর্তি ও নিদর্শন রেখে যেতে। সর্বোপরি, তাঁর বাণী, কথা ও বক্তব্য সর্বজনীন এবং তা স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর বাণী ও বক্তব্যের উপলক্ষ ‘মানুষ’। আর এ কারণেই তাঁর বক্তব্যের নেই কোন ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই কোন কালভিত্তিক সীমাবদ্ধতা। এ সব কিছু (স্থান-কাল-পাত্র) বক্তার দৃষ্টিতে বক্তৃতা ও বক্তব্যের ক্ষেত্রকে সীমিত এবং স্বয়ং বক্তার ওপরেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। পবিত্র কোরআনের শব্দগত আলৌকিকত্বের ক্ষেত্রে প্রধানতম দিকটি হচ্ছে যদিও পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত অর্থ পুরোপুরি পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হবার যুগের বহুল প্রচলিত বক্তব্য, বাণী ও কথার বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর তা নব্য সাহিত্য-যুগের শুভ সূচনাকারী এবং ভিন্ন জগৎ ও পরিমণ্ডলের সাথেই বেশি সংশ্লিষ্ট, তথাপি এ গ্রন্থের (পবিত্র কোরআন) ভাষাগত সৌন্দর্য, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা আলৌকিক। নাহজুল বালাগাহ্ অন্য সকল দিক ও ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রভাবিত এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে এ গ্রন্থটি (নাহজুল বালাগাহ্) পবিত্র কোরআনেরই সন্তান।