বাঙ্গালী
Wednesday 27th of November 2024
0
نفر 0

হযরত যয়নাব (সাঃ)'র মৃত্যুবার্ষিকী

১৫ ই রজব ইসলামের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কষ্টের ভার যিনি ধৈর্যের সাথে সহ্য করেছেন অথচ ইসলামকে রক্ষার স্বার্থে যিনি বিন্দুমাত্র নিজস্ব লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হন নি,তিনি আর কেউ নন,স্বয়ং নবী কারিম (সা.) এর প্রিয় নাতনী যয়নাব (সা.)। ১৫ ই রজব তাঁর ঐতিহাসিক মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি এমন এক মহিয়সী রমনী ছিলেন, যাঁর সম্মান-মর্যাদা আর সাহসী ভূমিকার ঐশ্বর্যে ইসলামের ইতিহাসের পাতা স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছে। আমরা তাঁর এই কালজয়ী জীবনের আদর্শ নিয়ে আজকের আসরে কিছুটা আলোচনা করে নিজেদের জীবন ধন্য করার চেষ্টা করবো।

মহান ব্যক্তিত্বদের সাহচর্যে থেকে থেকে হযরত যয়নাব (সা.)র ব্যক্তিত্বও সেইসব মহান ব্যক্তিত্বদের মতোই সমৃদ্ধ হয়েছে। কারা সেইসব মহান মনীষী আর মহিয়সী নারী? তাঁরা আর কেউ নন,স্বয়ং হযরত মুহাম্মাদ (সা.),হযরত ফাতেমাতুয যাহরা (সা.),হযরত আলী (আ.) এর মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ। পরশ পাথরের স্পর্শে সবাই সোনা হয়ে উঠবে-এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে! যয়নাব (সা.) ও তেমনি নিখাদ সোনায় পরিনত হয়েছেন। যেই পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেছেন সেই পরিবার ছিল প্রেম এবং ভালোবাসায় পূর্ণ রহমতের বাগান। এই পরিবারে বেড়ে উঠে তিনি হয়েছেন সাহসী,বীরাঙ্গনা এবং ইবাদাতের সৌন্দর্যে মহীয়ান। কেবল যয়নাব (সা.) নন,বরং এই পরিবারের প্রতিটি সন্তানই ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের সুষমায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। কী নীতি-নৈতিকতা,কী জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আর কী দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা-যাই বলি না কেন এই পরিবারের ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশে বেড়ে উঠে প্রতিটি সন্তানই হযরত আলী (আ.) এবং হযরত ফাতেমা (সা.) এর আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। কেননা এঁরা সবাই মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহানবীর শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন।

হযরত যয়নাব (সা.) সেই শৈশব থেকেই ছিলেন জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে ব্যাপক উৎসাহী। স্বয়ং রাসূল (সা.) যাঁকে বলেছেন জ্ঞান নগরীর দ্বার সেই আলী (আ.) এর জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে সাধ্যমতো আহরণ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছেন হযরত যয়নাব (সা.)। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যয়নাব (সা.) কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সরাসরি কিছু কিছু জ্ঞান দান করা হয়েছে। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তাঁর ফুফুকে উদ্দেশ্য করে একবার বলেছেন-তুমি আল্লাহর অনুগ্রহে এমন এক মহান চিন্তাবিদ যার কোনো শিক্ষক নেই। যয়নাব (সা.) কোরআনের ব্যাখ্যাকার ছিলেন। যখন তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ.) কুফায় ছিলেন,তখন যয়নাব (সা.) নিজ ঘরে আলোচনা সভার আয়োজন করতেন এবং সে সভায় কোরআনের চমৎকার তাফসির করতেন।

তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আরেকটি বড়ো নিদর্শন হলো-কুফা এবং সিরিয়ায় দেওয়া তাঁর ভাষণ। বহু গবেষক তাঁর এই ভাষণগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। ইসলামী শিক্ষায় তাঁর কতোটা গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যে ছিল বিশেষ করে কোরআনের ব্যাপারে তিনি যে কতোটা জ্ঞানী ছিলেন এইসব ভাষণে তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ইবাদাতের ব্যাপারে তাঁর ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। তিনি কঠিনতম বিরুপ পরিস্থিতিতেও এমনকি ওয়াজিব এবং মুস্তাহাব ইবাদাত পর্যন্ত করতে ভুলতেন না। রাত জেগে ইবাদাত করাটা তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিনত হয়েছিল। কোনোরকম প্রতিবন্ধকতাই তাঁকে একাজ থেকে ফেরাতে পারতো না। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বন্দী জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে যয়নাব (সা.) র আধ্যাত্মিকতার একনিষ্ঠতা সম্পর্কে বলেছেন, "আমার ফুফু যয়নাব (সা.) কুফা থেকে সিরিয়া যাবার পথে ওয়াজিব এবং মুস্তাহাব নামাযগুলো আদায় করতেন এবং কোনো কোনো জায়গায় ক্ষুধার কারণে এবং ব্যাপক তৃষ্ণার কারণে নামাযগুলো বসে বসে পড়তেন। ইমাম হোসাইন (আ.) যয়নাব (সা.) র আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তিনি তাঁর শেষ বিদায়ের সময় বোনকে বলেছিলেন হে বোন আমার! রাতের নামাযে তুমি আমার কথা ভুলে যেও না।"

যয়নাব (সা.) এর স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ছিলেন সে সময়কার খুবই ভালো এবং সম্ভ্রান্ত এক ধনী ব্যক্তি। কিন্তু যয়নাব (সা.) কখনোই পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি কোনোরকম আগ্রহী ছিলেন না। তিনি যখন আল্লাহর দ্বীন বিচ্যুতির মুখে পড়ার বিপদ উপলব্ধি করলেন তখন সবকিছু ছেড়ে তাঁর ভাই ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথে সফরসঙ্গী হয়ে প্রথমে মক্কায় এবং তারপরে কারবালায় যান। তিনি কারবালায় অংশগ্রহণ করাকে মদীনার সাবলীল জীবনযাপনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে উন্নত মানবীয় শিক্ষার কিছু আদর্শ নিদর্শন স্থাপন করেন। তাঁর সেই বীরাঙ্গনার ভূমিকা কারবালা বিপর্যয়ের পর উন্মোচিত হয়। এমন এক সময় তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যখন উমাইয়া শাসকদের অত্যাচারে সবার মুখ ছিল বন্ধ।

ইমাম হোসাইন (আ.) পর আর কারো সাহস ছিল না উমাইয়াদের মুখোশ উন্মোচন করার মতো। কেবলমাত্র হযরত যয়নাব (সা.)ই উমাইয়া শাসকদের অন্যায়গুলোকে ফাঁস করে দেন। তিনি জালেম শাসক ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে বলেন- "হে ইয়াযিদ! হুকুমাত,মানবিকতাকে তুই জলাঞ্জলি দিয়েছিস। তুই জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত,তুই নিপাত যা। তুই একটা মূল্যহীন অপদার্থ। তুই রাসূলে খোদার দ্বীনের সাথে সংগ্রাম করিস। কিন্তু তুই মনে রাখিস! যতো চেষ্টাই তুই করিস না কেন,আমাদের দ্বীন অস্তিত্বহীন হবে না, ক্বেয়ামত পর্যন্ত দ্বীনের ধারা অব্যাহত থাকবে,কিন্তু তুই থাকবি না।"

হযরত যয়নাব (সা.) তাঁর পিতা ইমাম আলী (আ.) থেকে শুনেছিলেন যে- মানুষ ঈমানের হাকিকত উপলব্ধি করতে পারে না,যতোক্ষণ না তার মাঝে তিনটি বৈশিষ্ট্য না থাকে।দ্বীনের ব্যাপারে সচেতনতা,দুর্দশায় ধৈর্য ধারণ করা এবং সৎ জীবন যাপন করা। এই মহিয়সী নারী কঠিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং ধৈর্যের অলংকার দিয়ে তিনি তাঁর মন এবং আত্মাকে সাজিয়েছেন। যয়নাব (সা.) র দৃষ্টিতে সত্যের পথে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর পথে জীবন বিলানো এমন এক সৌন্দর্য যেই সোন্দর্য মানবতার চিরন্তন প্রশংসার দাবিদার। এজন্যেই তিনি আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনার পর অত্যাচারী শাসকদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন-"আমি তো সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কিছু দেখি না।"

যয়নাব (সা.) কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনার পর এমন কিছু কাজ করেছেন যাতে ইমাম হোসাইন (আ.) এর আদর্শ ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে না যায়। যয়নাব (সা.) যদিও কারবালার ঘটনার পর খুব বেশিদিন বেঁচে ছিলেন না,তারপরও এই অল্প সময়ের মধ্যে ইসলামী উম্মাহকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে এবং তাঁদের মাঝে জাগরণ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সেই ভূমিকার কারণেই প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.) এর আদর্শের কথা বিস্তৃতি পেয়েছে। কারবালার ঘটনার পর যয়নাব (সা.) মাত্র দেড় বছর বেঁচে ছিলেন। ৬২ হিজরীর ১৫ ই রজব তারিখে তিনি পরকালের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।

মহিয়সী এই নারীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের উচিত তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে সাহস সঞ্চয় করা। নিজের জীবনকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে নির্বিঘ্নে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা। কায়েমি স্বার্থবাদীদের সাথে দ্বীনের ব্যাপারে কোনোরকম আপোষ না করার শিক্ষা লাভ করা এবং পার্থিব জগতের ধন-সম্পদকে তুচ্ছ জ্ঞান করে পরকালীন স্বার্থকে জীবনের সর্বোত্তম প্রাপ্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং তা অর্জনের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া। সকল কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দিন। (রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ইমাম মাহদি(আ.)'র বাবার কয়েকটি ...
আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) - ১ম ...
হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মবার্ষিকী-২০১২
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবনী-১১তম পর্ব
যদি কেউ দাড়ি না রাখে তাহলে সে কি ...
বাংলাদেশের নিম গাছ আরাফাতের ...
মহানবীর ওফাত দিবস এবং ইমাম হাসান ...
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত-পূর্ব ...
কে হযরত আলী (আ.) কে শহীদ করেছে? তার ...
আল কোরআনের অলৌকিকতা (৬ষ্ঠ পর্ব)

 
user comment