কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ও নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.আ.)'র কন্যা হযরত যয়নাব (সা.আ.) সহ অন্যান্য বন্দীদের কুফার আমীর ইবনে যিয়াদের প্রাসাদের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দীদেরকে আমীরের প্রাসাদে নিয়ে আসার পর যাতে সরকারের শক্তি ও ক্ষমতার প্রদর্শনী করা যায় সে লক্ষ্যে ইবনে যিয়াদের সেবাদাসরা সাধ্যানুযায়ী এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইবনে যিয়াদ ধারণা করেছিল যে,সে বিজয়ের পথে যাত্রা শুরু করেছে এবং এ পথের শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়া পর্যন্ত তার এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে। কারণ সে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সকল পুরুষ অনুসারীকে এবং তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে। অতএব,অবশ্যই সব কিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকবে। এখন সে হচ্ছে বিজয়ী এবং তার ধারণায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হচ্ছেন পরাজিত পক্ষ।
বন্দীদেরকে ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের সামনে আনা হলে সে ঔদ্ধত্যের সাথে দম্ভ প্রকাশ করে বলল : “আল্লাহর শুকরিয়া,তিনি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে,তোমরা যা কিছু দাবী করতে তা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”
কিন্তু কেবল ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল একজন স্বৈরাচারী শাসককে যখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য,উপহাস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয় তখন তার জন্য এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কী হতে পারে? হযরত যয়নাব (সা.আ.) অত্যন্ত শান্তভাবে ও দৃঢ়তার সাথে এ নিম্নমানের উক্তির জবাব দিলেন। মনে হচ্ছিল যেন তিনি কোনরূপ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন নি এবং তাঁর কোন স্বজন শহীদ বা বন্দী হন নি। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিলেন এবং তীক্ষ্ণ কথা-বাণে বিপর্যস্ত করছিলেন যার হাতে তাঁকে এবং অন্যান্য বন্দীকে তখনই ও সেখানেই হত্যা করার নির্দেশ দানের ক্ষমতা আছে বলে মনে হচ্ছিল না। তিনি বললেন :
“শুকরিয়া সেই আল্লাহ্তায়ালার জন্য যিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর রাসূল মনোনীত করে আমাদের পরিবারকে মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
সীমা লঙ্ঘনকারীরা ব্যতীত কেউ মিথ্যা বলে না এবং যারা পাপাচারী তারা ব্যতীত কেউ জনসমক্ষে লজ্জিত হয় না,আর আমরা এ দুই দলের কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত নই।”
এতে ইবনে যিয়াদের মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছিল,কিন্তু সে জোর করে আগের চেয়েও তার মাথা উঁচু করল। এরপর সে হযরত যয়নাব (সা.আ.)-কে একটি মোক্ষম জবাব দিয়ে পরাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কারণে সে হযরত যায়নাবের জ্বালাময়ী প্রাঞ্জল ভাষণে বাধা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিল এবং বলল : “তুমি দেখেছ আল্লাহ্ তোমার ভাইয়ের সাথে কেমন আচরণ করেছেন?”
হযরত যায়নাব দাঁতভাঙ্গা কথা দ্বারা ইবনে যিয়াদের এ ঘৃণ্য কথার জবাব দিলেন। তিনি বললেন : “আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই নি। আমার ভাই এবং তাঁর সঙ্গীরা সে পথেই গিয়েছেন আল্লাহ্ তাঁদের জন্য যে পথ পছন্দ করেছেন। তাঁরা গর্বের সাথে শাহাদাতকে বেছে নিয়েছেন এবং এ মহাসম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু হে ইবনে যিয়াদ! তুমি যে অপরাধ করেছ সে কারণে তোমাকে এক কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।”
ইবনে যিয়াদ বুঝতে পারল যে,এভাবে হযরত যায়নাবের বক্তব্যে অসময়োচিত বাধা দেয়ার ফলে সে নিজেই এক বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেছে। সে নিজেকে পুরোপুরি পরাজিত ও বিপর্যস্ত অনুভব করল। এ কারণেই সে সাধারণভাবে নির্বোধদের দ্বারা ব্যবহৃত সর্বশেষ অস্ত্রটি তুলে নিল। সে আল্লাহর নামে শপথ করে বলল : “আল্লাহ্ তোমার বিদ্রোহী ভাইকে হত্যার মাধ্যমে আমাকে আনন্দ দিয়ে আমার আহত হৃদয়কে নিরাময় করেছেন।”
তখন হযরত যায়নাব বললেন : “হে ইবনে যিয়াদ! তুমি আমাদের নেতাকে হত্যা করেছ এবং আমাদের পুরুষ আত্মীয়-স্বজনদের বেঁচে থাকতে দাও নি। তুমি আমাদের শিশু সন্তানদের হত্যা করেছ এবং আমাদের হৃদয়গুলোকেও ভেঙ্গেছ;এতেই যদি তোমার হৃদয়ের ক্ষত নিরাময় হয়ে থাকে,তাহলে সত্যিই তুমি নিরাময় হয়েছ।”
ইবনে যিয়াদ হযরত যায়নাবের বক্তব্যে আবার বাধা দিল। সে বলল : “ যায়নাব ছন্দের ভাষায় কথা বলছে। আমার প্রাণের শপথ,তার বাবা আলীও তা-ই করত।”
হযরত যয়নাব (সা.আ.) তার কথা খণ্ডন করে বললেন : “হে ইবনে যিয়াদ! আমার কথার সাথে ছন্দের কী সম্পর্ক? আর ছন্দ রচনার জন্য কী চমৎকার উপযুক্ত পরিবেশ!”
দামেশকের অধিবাসীদের কেউই রাসূল (সা.)-কে দেখে নি বা তাঁর কথা শ্রবণ করে নি। তেমনি মদীনার লোকেরা যেভাবে ইসলাম পালন করতেন তাও সেখানে প্রবেশ করে নি। মহানবী (সা.)-এর মাত্র একশ’তের জন সাহাবী এ ভূখণ্ডটি দখলের অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা এখানে ক্রমান্বয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ ব্যক্তিদের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করলে একটি সত্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে,তাঁদের মধ্য থেকে অল্প কয়েকজন বাদে বাকী সকলেই রাসূল (সা.)-এর সাহচর্যে খুব অল্প সময়ই কাটিয়েছিলেন। তাঁরা রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে অল্প সংখ্যক হাদীস শ্রবণ করে তা মনে রেখেছিলেন। আর এঁদের মধ্যকার বেশিরভাগ সাহাবীই আমীরে মুয়াবিয়ার ক্ষমতা দখলের বেশ পূর্বে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলীফার শাসনামলে ইন্তেকাল করেন। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার সময় এই একশ’তের জন সাহাবীর মধ্য থেকে মাত্র এগারো জন জীবিত ছিলেন এবং তাঁরা দামেশকে বসবাস করতেন।
এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে,দামেশকে ইয়াযীদের সমবয়সী প্রজন্ম ইসলাম সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানত না। আসলে মহানবী (সা.)-এর বংশধর কারা,সে সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা ছিল না। সুতরাং কতক ইতিহাসবিদ যেমন লিখেছেন যে,বন্দীদেরকে যেদিন দামেশকে নিয়ে আসা হয় সেদিন সেখানকার জনগণ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিহত হবার খবরে উল্লসিত হয়ে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠেছিল;এ খবরের সত্যতায় সন্দেহের কোন কারণ নেই।
এমনকি ইয়াযীদের সামনেও হযরত যায়নাব বিরাট শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি ইয়াযীদের পরিষদবর্গকে জানিয়ে দেন যে,ইয়াযীদ নিজেকে যে রাসূল (সা.)-এর খলীফা বলে দাবী করে সিরিয়ার জনগণের ওপর শাসনকার্য চালাচ্ছে,জিঞ্জির দিয়ে বেঁধে দামেশকে নিয়ে আসা বন্দীরা হচ্ছেন সেই রাসূল (সা.)-এরই বংশধর।
ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নাব (সা.আ.) যে ভাষণ দেন তাতে তিনি দামেশকের জনগণের সামনে ইয়াযীদের আসল চেহারা তুলে ধরেন। এর ফলে অন্তত তাদের মধ্যকার কতক লোক বুঝতে পারে যে,তারা যে ধর্ম পালন করছিল,ইসলাম তা থেকে আলাদা এবং সত্যিকারের মুসলিম নেতা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া নয়,অন্য কেউ।