বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

যাকাত

যাকাত- ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিধান। কুরআন শরীফে আল্লাহ তা'আলা যখনই নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, "নামায কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো"। [দেখুন- ২:৪৩, ২:৮৩, ২:১১০, ২৪:৫৬, ৫৮:১৩ -ইত্যাদি আয়াতগুলো।]
এসব আয়াতের আলোকে যাকাত ইসলামের অন্যতম অপরিহার্য ফরয দায়িত্ব বলে প্রমাণিত হয়; যার অস্বীকারকারী বা তুচ্ছ তাচ্ছিল্লকারী কাফির বলে গণ্য; আর অনাদায়কারী ফাসিক এবং কঠিন শাস্তির যোগ্য। অথচ এ বিধানটাকে আমরা কতই না অবহেলা করি! কুরআনের শরীফের একেবারে শুরুর দিকে, সূরা বাক্বারায়, হেদায়াতপ্রাপ্ত মুত্তাকীদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, "...আমার দেয়া রিযক হতে যাকাত প্রদান করে"। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন করা ও হেদায়াতের পূর্ণতায় পৌঁছুতে যাকাত প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। যে ব্যক্তি যাকাত ফরয হওয়ার পরও তা আদায় করে না, তার পক্ষে পূর্ণ হেদায়াত লাভ করা কখনো সম্ভব নয়। ভাবতে পারেন, হেদায়াত না-ই পেলাম, হেদায়াত আমার কি-ই-বা দরকার; আতর লাগিয়ে শুক্রবার নামাযে যাচ্ছি; সেজেগুজে ঈদের নামাযে হাজিরা যাচ্ছি; ব্যাস.. মুসলমানের দায়িত্ব তো পালন হলোই; বেহেশত তো পাচ্ছিই; হুর-গেলমান তো থাকবেই; ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু না... যাকাত প্রদান করলে যেমন পাচ্ছেন হেদায়াত ও আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য, ঠিক তেমনিভাবে, না আদায় করলেও প্রস্তুত থাকছে ভয়ানক শাস্তি। আল্লাহ তা'আলা বলেন, وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ - يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ "আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহ্র পথে, তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার"। [৯:৩৪-৩৫] ত্রিশতম পারার সূরা হুমাযা পুরোটাই যাকাত প্রদান না করার শাস্তির আলোচনায় উৎসর্গিত। দেখুন, وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ - الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ - يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ - كَلَّا ۖ لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ - وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ - نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ - الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ - إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ - فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ "প্রত্যেক পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর দুর্ভোগ,যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে। সে মনে করে যে,তার অর্থ চিরকাল তার সাথে থাকবে। কখনও না,সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন,পিষ্টকারী কি ? এটা আল্লাহ্র প্রজ্বলিত অগ্নি,যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদেরকে বেঁধে দেয়া হবে,লম্বালম্বি খুঁটিতে"। [১০৪:১-৯] বস্তুত, সীমিত পর্যায়ে ব্যক্তি মালিকানাকে ইসলাম স্বীকার করে নিলেও, এ সুযোগে যেন অশুভ পুঁজিতন্ত্র জন্ম লাভ না করতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে। পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ রোধে তাই যাকাতকে গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি। ইসলাম মনে করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বাদ দেয়ার পর কারো যদি ৫২.৫ তোলা রূপা বা ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা সমমূল্যের সম্পদ এক বৎসর কাল পর্যন্ত সঞ্চিত থাকে, তাহলে সে সম্পদশালী। এ ধরনের সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে রাষ্ট্রের অন্যান্য অভাবী মানুষদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য ঐ সঞ্চিত সম্পদের শতকরা ২.৫ টাকা যাকাত প্রদানের দাবি জানায় ইসলাম। যাকাত আদায়ের বিবিধ উপকারিতা নিম্নরূপ: ১. গরীবের প্রয়োজন পূর্ণ করা; অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটন করা; সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতাকে শেষ করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা। ২. মুসলমানদের সামগ্রিক শক্তি বৃদ্ধি করা; দারিদ্র বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ৩. চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই সহ সবরকম অভাবজনিত অপরাধের মূলোৎপাটন করা। গরীব-ধনীর মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা। ৪. সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি। নবীজী স. বলেন, ما نقصت صدقة من مال - "যাকাতের সম্পদ কমে না"। [মুসলিম:৬৭৫৭, তিরমিযী:২০২৯] - অর্থাৎ, হয়ত দৃশ্যতঃ সম্পদের পরিমাণ কমবে, কিন্তু আল্লাহ তা'আলা এই স্বল্প সম্পদের মাঝেই বেশি সম্পদের কার্যকারী ক্ষমতা দিয়ে দিবেন। ৫. সম্পদের উপকারিতার পরিধি বৃদ্ধি করা। কেননা সম্পদ যখন যাকাতের মাধ্যমে অভাবীদের মাঝে বণ্টিত হয়, তখন এর উপকারিতার পরিধি বিস্তৃত হয়। আর যখন তা ধনীর পকেটে কুক্ষিগত থাকে, তখন এর উপকারিতার পরিধিও সঙ্কীর্ণ হয়। ৬. যাকাত প্রদানকারীর দান ও দয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া; অন্তরে অভাবীর প্রতি মায়া-মমতা সৃষ্টি হওয়া। ৭. কৃপণতার ন্যায় অসৎ গুণ থেকে নিজেকে পবিত্র করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন, خذ من أموالهم صدقة تطهرهم وتزكيهم بها - "তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ করো; যেন তুমি সেগুলোকে এর মাধ্যমে পবিত্র ও বরকতময় করতে পার"। [৯:১০৩] ৮. সর্বোপরি আল্লাহর বিধান পালন করার মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে তাঁর নৈকট্য লাভ করা। যাকাত কখন ফরয হয়: ৭.৫ ভরি স্বর্ণ, ৫২.৫ ভরি রূপা বা সমমূল্যের নিত্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে, এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে। এ হিসাবটাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নেসাব' বলে। অতএব, কারো যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। আজ (১১ই জুন, ২০০৯) -এর হিসাব অনুযায়ী: ১ ভরি রূপা= ৫০০ টাকা .:. ৫২.৫ ভরি রূপা= ২৬,২৫০ টাকা অতএব কেউ ২৬,২৫০ টাকার মালিক হলে এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে, তার উপর যাকাত ফরয হবে। (২৬,২৫০ টাকায় শতকরা ২.৫ টাকা হিসেবে মাত্র ৬৫৬.২৫ টাকা যাকাত আসে। অতএব ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ) কোন কোন সম্পদে যাকাত আসে: ১. নগদ টাকা-পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স, বন্ড ও অন্যান্য ফাইন্যানশিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস ২. সোনা-রূপা; অর্নামেন্ট, বার যা-ই হোক; তা নিত্যব্যবহার্য হলেও। ৩. ব্যবসার সম্পদ; যা ব্যবসার উদ্দেশে ক্রয়কৃত; কিংবা ব্যবহারের উদ্দেশে ক্রয়ের পর বিক্রয়কৃত। ব্যবসার কাঁচামাল, উৎপাদিত বস্তু, বা, উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা বস্তু। শেয়ারও এ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। ৪. অন্যান্য প্রয়োজনোতিরিক্ত সম্পদ। টিভিও এ কাতারে অন্তর্ভুক্ত। কাকে যাকাত দেয়া যাবে: ১. মিসকীন: যার কোনো সম্পদ নেই, মানুষের কাছে হাত পেতে চলে। ২. অভাবী: যার সম্পদ আছে, তবে নেসাব পরিমাণ নেই, কারো কাছে হাতও পাতে না সে, অথচ সে তার প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। এ কাতারে ঋণ আদায়ে অক্ষম ও ভিনদেশী অভাবী মুসাফিরও পড়বে। চিকিৎসা গ্রহণে অক্ষম ব্যক্তিও এ কাতারে শামিল। অর্থাৎ, কেউ যদি এমনিতে সচ্ছল হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে অক্ষম হয়, তাহলে তাকেও যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। তবে শর্ত হলো, চিকিৎসার পর্যায়টা এমন হতে হবে যে, যা না করালেই নয়, এবং যে চিকিৎসা করালে তার সুস্থতাও অনেকটা নিশ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, যে চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব, তা যদি সিরফ বিলাসিতা বশত বিদেশে গিয়ে করাতে চায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। কিন্তু চিকিৎসকরা যদি বলেন যে, তাকে অমুক দেশে নিতেই হবে, এ ছাড়া কোনো গতি নেই, তখন তাকে সাহায্য করা যেতে পারে। মোটকথা, চিকিৎসা যদি কারো সত্যিই প্রয়োজন হয়, এবং এ প্রয়োজন মেটাতে যদি সে সত্যিই অক্ষম হয়, তাহলে সেও এই অভাবীর পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। তবে দুই সম্পর্কের মানুষকে যাকাত দেয়া যাবে না। ১. ঔরসজাত সম্পর্ক। যেমন- পিতা ছেলেকে, বা ছেলে পিতাকে। ২. বৈবাহিক সম্পর্ক। যেমন- স্বামী স্ত্রীকে, বা স্ত্রী স্বামী। এ দুই গ্রুপ ছাড়া অন্য সকল অভাবীকে (উপরোক্ত সংজ্ঞানুসারে) দেয়া যাবে। যাকাত বিষয়ক কিছু জরুরী জ্ঞাতব্য: ১. যাকাতের ক্ষেত্রে নিয়ত করা (যাকাত দিচ্ছি -এই জ্ঞান করা) আবশ্যক। সেটা প্রদান করার সময়ও হতে পারে বা যাকাতের সম্পদ হিসাব করে পৃথক করার সময়ও হতে পারে। ২. প্রতিটা সম্পদের উপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া জরুরী নয়। বরং, বছরের মাঝে যে সম্পদ অর্জিত হবে, তাতেও যাকাত আসবে। ৩. যাকাত আদায়ের তারিখে যে যে সম্পদ থাকবে, সে সে সম্পদের যাকাত আদায় করবে। ৪. যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণে মনগড়া/অনুমাননির্ভর হিসাব করবে না। বরং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে যাকাত আদায় করবে। যেন কোনো ক্রমেই পরিমাণের চেয়ে কম আদায় না হয়। ৫. যাকাত যেদিন হিসাব করে পৃথক করবে, সেদিনের মূল্য ধর্তব্য হবে। ৬. চন্দ্র মাস হিসাব করে যাকাত দিবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বছর রমজানের বা মুহাররমের এক তারিখ যাকাত আদায় করবে।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা

 
user comment