রাসূলে খোদার স্ত্রী খাদীজা (সা.) ছিলেন মহানবীর ওপর ঈমান আনয়নকারী এবং ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম মহিয়সী নারী ৷ নবীজীর ওপর যে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়েছিল ঐসব আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলকে আদেশ দিয়েছেন, তিনি যেন জনগণকে পরকালীন ভয়-ভীতির কথা বলে এবং উপদেশ দিয়ে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান ৷ রাসূলের ওপর যখন সূরায়ে মুদ্দাস্সিরের প্রথম চার আয়াত নাযিল হয়, তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর ওপর অর্পিত জনশুদ্ধির মহান দায়িত্ব পালনের কাজ শুরু করার সময় এসে গেছে এবং আল্লাহ চান জনগণের মাঝে হেদায়াতের আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক ৷ সূরা মুদ্দাসসিরে বলা হয়েছে :"হে চাদরাবৃত ! উঠুন, বিশ্ববাসীকে সতর্ক করুন এবং আপনার প্রতিপালকের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন ! এবং আপনার পোশাক পবিত্র করুন !"
পুরুষদের মাঝে যিনি রাসূলের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন তিনি হলেন হযরত আলী (আ.) ৷ তাঁর বয়স ছিল তখন এগারো বছরের মতো ৷ রাসূল যখন হযরত আলী (আ.) কে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, আলী (আ.) অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে তাঁর ছোট্ট হাত দুটো রাসূলের পবিত্র হাতে সঁপে দিলেন৷ রাসূল (সা.) আলতোভাবে আলীর হাতে চাপ দেন ৷ আলী এ সময় উত্ফুটল্ল মনে তাঁর ঈমানের সাক্ষ্য দিয়ে বললেন : আশহাদুআল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াশহাদুআন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ৷ হযরত আলী (আ.) আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুহাম্মাদ (সা.) এর রেসালাতের সাক্ষ্য দিয়ে ইসলামের ওপর প্রথম ঈমান আনলেন ৷ শাহাদাতের মুহূর্ত পর্যন্ত এই ঈমানের ওপর অটল থেকে ইসলামের খেদমতে তিনি সাধ্যমতো নিয়োজিত ছিলেন ৷ এভাবেই তিন ব্যক্তি সমন্বয়ে ইসলামের প্রাথমিক সমাজটি মক্কা শহরে গড়ে উঠেছিল ৷ এ সমাজটির মূল ভিত্তি ছিল একত্ববাদ ৷ তাই মূর্খতা এবং শেরেকির সাথে তাঁদের সংগ্রাম শুরু হয়ে যায় ৷
মুহাম্মাদ (সা.) দৃঢ় সংকল্পের সাথে তৌহিদ বা একত্ববাদের দাওয়াতী কাজ শুরু করেন৷ নবুয়্যতির দায়িত্ব পাবার পর থেকে আল্লাহর রাসূল খাদীজা ও আলীকে সঙ্গে নিয়ে ফেরেশতা জীব্রাঈল (আ.) এর শিক্ষা অনুযায়ী নামায আদায় করেন ৷ রাসূলে খোদা (সা.) একটানা তিন বছর দাওয়াতী কাজ চালান ৷ এ সময় তিনি প্রকাশ্যে দাওয়াতী কাজ করার পরিবর্তে গোপনে গোপনে তৌহিদের পথে মানুষকে আহ্বান করাটাকে কল্যাণময় ও শ্রেয় মনে করলেন ৷ আলী (আ.) এর পর যায়েদ বিন হারেসা হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি রাসূলের ওপর ঈমান আনেন ৷ এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্যরা ইসলাম ও রাসূলের ওপর ঈমান আনে ৷ রাসূল (সা.) অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এবং সচেতনভাবে দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন ৷ তিনি তাঁর অন্তর্চক্ষু দিয়ে যাকে উপযুক্ত দেখেছেন তাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন ৷ এই তিন বছরে যে স্বল্পসংখ্যক লোক মুসলমান হয়েছিল কুরাইশ নেতারা তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ দেখায় নি ৷ কিন্তু যেদিন রাসূল বিশেষ দাওয়াতী কাজ অর্থাৎ তাঁর নিকটাত্মীয়দের মাঝে গণদাওয়াত দেওয়ার কাজ শুরু করলেন, এবং শের্ক ও মূর্তি পূজার সমালোচনা করলেন, সেদিন থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাসূলের বিরোধিতা শুরু হয়ে যায় ৷
নিঃসন্দেহে যে সমাজে কুসংস্কারের বীজ গভীরে প্রোথিত ঐ সমাজের আমূল সংস্কার করতে হলে দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ প্রথমত কথা বলা বা ব্যাখ্যা দেওয়ার শক্তি খুবই প্রয়োজন৷ জনগণের সামনে এমনভাবে নতুন চিন্তাদর্শন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে যাতে জনগণের চিন্তায় ঐ বক্তব্য বা ব্যাখ্যা গভীর প্রভাব ফেলে ৷ ফলে জনগণ নতুন চিন্তাদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে ৷
দ্বিতীয়ত প্রতিরক্ষামূলক শৃঙ্খলা বিধান করা, যাতে বিরোধীদের অত্যাচারের বিপরীতে যথার্থ প্রতিক্রিয়া দেখানো যায় ৷
তো রাসূলের বাচনভঙ্গী এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছিল সর্বোত্কৃরষ্টমানের ৷ তাঁর বাচনভঙ্গী এতো বেশি হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, তাঁর কথা শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত ৷ অলঙ্কারপূর্ণ এবং প্রাঞ্জল বাচনভঙ্গীতে তিনি কোরআনের অদ্ভুত সুন্দর আয়াতগুলো মানুষের সামনে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন ৷ কোরআনের এই আয়াতগুলো এতো বেশী চিত্তাকর্ষক ছিল যে, মুশরেকদের কেউ কেউ যখন রাসূলের কাছে আসতো, তারা চমত্কালর চমত্কাশর ওইসব আয়াত শুনে ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়তো ৷
কিন্তু দাওয়াতী কাজের প্রাথমিক দিনগুলোতে মুসলমানদের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না ৷ কারণ তিন বছরের গোপন দাওয়াতী কাজের ফলে মাত্র চলি্লশজন ইসলাম গ্রহণ করেছিল ৷ রাসূল (সা.) আল্লাহর আদেশক্রমে প্রকাশ্যে তাঁর গণদাওয়াতী কাজ শুরু করলেন নিকটাত্মীয়দেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদানের মধ্য দিয়ে ৷ নিকটাত্মীয়দের মাঝে দাওয়াতী কাজের সূক্ষ্ম দর্শনটি এই ছিল যে, তারা যদি নবীজীর ওপর ঈমান না-ও আনে, তারপরও গোত্রগত এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর প্রতিরক্ষায় হয়তো এগিয়ে আসবে ৷ কেননা রাসূলের নিকটাত্মীয়রা ছিলেন মক্কার মধ্যে খুবই প্রভাবশালী ৷
প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত :
পবিত্র কোরআনের সূরা শুয়ারার ২১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ও আনজির আশিরাতাকাল আকরাবীন.....অর্থাত এবং নিকটাত্মীয়দেরকে উপদেশ দিন এবং সতর্ক করুন ৷ এই আয়াত নাযিলের পর রাসূল (সা.) তাঁর নিকটাত্মীদের মধ্য থেকে ৪৫ জনকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের সামনে নিজস্ব রহস্য উন্মোচিত করবেন ৷
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছিল আর মেহমানদের আসার সময়ও ঘনিয়ে এসেছিল ৷ আলী (আ.) মেহমানদের অভ্যর্থনার স্থানের দিকে একটু তাকালেন ৷ সবকিছুই প্রস্তুত ছিল ৷ বনী হাশেম গোত্রের মুরুব্বীরা যাঁদের মাঝে রাসূলের অধিকাংশ চাচারাও ছিলেন, একেক করে সবাই প্রবেশ করছিলেন ৷ আবু তালেব, হামযা, আব্বাস, আবু লাহাব এবং এমনকি রাসূলের সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ চাচা হারেসও এই আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন ৷ রুমের ভেতর বিশাল দস্তরখান পাতা হলো ৷ দস্তরখানের দুইপাশে ফিরোযা রঙের মাটির তৈজস বা পাত্র এনে রাখা হলো ৷ আলী এবং যায়েদ সুস্বাদু অথচ খুবই সাধারণ খাবার দাবার মেহমানদের পরিবেশন করলেন ৷ খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর এবার তাঁর আসল কথা বলার সুযোগ আসলো ৷ তিনি এবার উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন :
প্রথমেই মহান স্রষ্টার কৃতজ্ঞতা জানাই এবং তাঁর সাহায্য কামনা করছি, এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই ৷ তিনি এক এবং অদ্বিতীয় ৷ তাঁর কোনো শরীক নেই ৷ হে আমার স্বজন ! জেনে রাখুন, আমি আপনাদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ৷ আপনাদের সমৃদ্ধি বা ভালো ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা আমার নেই ৷ আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তাঁরই প্রেরিত রাসূল৷ তোমাদের এবং সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে ৷ খোদার শপথ ! মৃত্যুর পর পুনরায় জাগ্রত হবে, যেভাবে ঘুমানোর পর আবার জেগে ওঠো ৷ সেদিন তোমাদেরকে তোমাদের কাজের প্রতিফল দেওয়া হবে৷ আর প্রতিফল হলো সত্ বা পুণ্যবানদের জন্যে স্থায়ী বেহেশত এবং অসত্ বা পাপীদের জন্যে স্থায়ী দোযখ ৷ আমি সবচে ভালোটাই আমার কাওমের জন্যে নিয়ে এসেছি ৷ আল্লাহ আমাকে আদেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমাদেরকে তাঁরই দিকে আহ্বান জানাই ৷
এ সময় আবু লাহাব রাসূলের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে ঠাট্টা করে বললো : আমরা তোমার উপহার গ্রহণ করার জন্যে ভীষণ আগ্রহী ৷
রাসূল বললেন : আমি তোমাদের জন্যে ইহকাল এবং পরকালীন মঙ্গল ও কল্যাণই উপহার হিসেবে এনেছি ৷ আমি তোমাদেরকে দুটি কথা বলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি ৷ এ্যাক, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, অপরটি হচ্ছে আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল-এ দুটি কথার সাক্ষ্য দেবে ৷ এখন তোমাদের মধ্য থেকে যে এক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করবে, সে আমার পরে তোমাদের মাঝে আমার স্থলাভিষিক্ত ও প্রতিনিধি হবে ৷
এই ঘোষণার পর পুরো মজলিশ নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেল ৷ কেবল আলী (আ.) তাঁকে সাহায্য করবেন বলে ঘোষণা দিলেন ৷ রাসূল তাঁর ঐ আহ্বান আরো দু'বার জানালেন৷ প্রত্যেকবারই কেবল হযরত আলী (আ.) ই সহযোগিতা বা রাসূলের আনুগত্য করার ঘোষণা দিলেন ৷ রাসূল তখন ঘোষণা দিলেন, হে জনগণ, এই যুবক আমার ভাই, তোমাদের মাঝে আমার স্থলাভিষিক্ত এবং আমার দায়িত্বভারপ্রাপ্ত ৷
মজলিশে এক ধরনের গুঞ্জন দেখা দিল ৷ আবু লাহাব আবারো ঠাট্টা-মশকরা শুরু করলো ৷ এমন সময় রাসূলের সহযোগী ও সার্বক্ষণিক পৃষ্ঠপোষক চাচা আবু তালেব উঠে সমাবেশকে শান্ত হবার আহ্বান জানালেন এবং রাসূলকে সম্বোধন করে বললেন : হে প্রিয় বত্স ! তুমি তোমার প্রতিপালকের বার্তা পৌঁছিয়েছো এবং আমরাও শুনেছি৷ এখন আমাদেরকে একটু চিন্তা-ভাবনা করার সময় দাও ! আবু লাহাব আবারো শোরগোল করে পরিবেশটাকে অশান্ত করে তুললো ৷ আবু তালিব এবার সুস্পষ্ট জবাব দিয়ে বললেন : হে বংশের কলঙ্ক ! ক্বাবার খোদার শপথ ! আমরা তাকে সহযোগিতা করার জন্যে প্রস্তুত রয়েছি এবং শেষ পর্যন্তও তার সহযোগিতায় থাকবো ৷
সে সময়কার মূর্তি পূজা ও শেরেকি ব্যবস্থার মধ্যে তৌহিদের পথে মানুষকে আহ্বান জানানো খুবই কঠিন কাজ ছিল ৷ এদিকে শুরু থেকেই একটা বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, একটি দল রাসূলের বিরোধী ৷ কিন্তু আল্লাহ চান তাঁর রাসূল যেন এতো শত্রু আর বিরোধীদের দেখে ভয় না পান বরং প্রকাশ্যে এবং সুস্পষ্টভাবে দাওয়াতী কাজ করেন ৷
অতএব আপনি যে ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছেন, মুশরিকদের পরোয়া না করে প্রকাশ্যে তা শুনিয়ে দিন ৷ আপনার পক্ষ থেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের জন্যে আমিই যথেষ্ট ৷
এভাবেই রাসূল (সা.) তাঁর গণ দাওয়াতী কাজ শুরু করেন ৷ এবার তিনি সাফা পর্বতের পাশে সমবেত জনগণকে একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের দিকে আহ্বান জানান ৷ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ব্যাপক দক্ষতার সাথে তিনি মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান ৷ এমনিতেই তাঁর সততা ছিল সর্বজনবিদিত, সুতরাং এখন দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে তাঁর সেই সততা, অবস্থান ও অভিজ্ঞতা কাজে লেগে গেল ৷ রাসূল নিজেই বলেছেন : "তোমাদের মাঝে আমার অবস্থান হলো সেই পর্যবেক্ষণকারী বা পাহারাদারের মতো, যে দূর থেকে শত্রুকে দেখতে পেয়ে নিজের কওমকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায় ৷ হে কুরাইশ গোত্র, নিজেদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও ৷"
রাসূলের এই বক্তব্য শুনে রাসূলের চাচা আবু লাহাব জনগণের মাঝে তীব্র হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল এবং রাসূলে খোদার বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটালো, আর লোকজনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিল ৷
গণ দাওয়াত দিতে গিয়ে নবী করীম (সা.) নতুন এবং স্পর্শকাতর একটি পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হলেন ৷ এরপর থেকেই কুরাইশ কাফেররা প্রকাশ্যভাবে বিরোধিতা শুরু করে দেয় ৷ তারা ইসলামের অগ্রগতি রোধ করতে বিচিত্র ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় ৷ কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় অতি দ্রুতই মুহাম্মাদের ধর্ম আরবের সীমানা ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ৷
রাসূল (সা.) এর পবিত্র কণ্ঠে যখন কোরআনের প্রাণস্পর্শী আয়াতগুলো উচ্চারিত হতো তখন ঐসব আয়াতের আকর্ষণে মানুষের অন্তরাত্মা বিমোহিত হয়ে যেত ৷ আর রাসূল মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদাত তথা তৌহিদের পথে আহ্বান জানাতেন ৷ নবীজী প্রায় প্রতিদিনই মূর্তি পূজা, দাসপ্রথা, সুদখাওয়া এবং জাহেলিয়াতের কুপ্রথাগুলোর সমালোচনা করে কথা বলতেন এবং এসব ব্যাপারে কোরআনের আয়াত অর্থাৎ ওহী নাযিল হতো ৷ এই ব্যাপারটা মুশরিক নেতাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ মক্কার লোকজন দিন-দিন,যেভাবে ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে তাতে মূর্তিপূজক কুরাইশ নেতারা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রথমে নবীজীকে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করে ৷ তাদের নয়জন নেতা আবু সুফিয়ানের সাথে রাসূলের চাচা আবু তালেবের কাছে গিয়ে তাঁকে অনুরোধ করে-তিনি যেন মুহাম্মাদকে তাঁর দাওয়াতী কাজ থেকে বিরত রাখেন ৷ আবু সুফিয়ান বললো : হে আবু তালিব ! তোমার ভাতিজার কর্মকাণ্ড বন্ধ করাও ৷ মুহাম্মাদ যদি তার দাওয়াতী কাজ বন্ধ করে তাহলে সে যতো ধন-সম্পদ, শক্তি কিংবা ক্ষমতা চায় তাকে দেওয়া হবে ৷ তা না হলে তার সাথে এবং তার সমর্থক যেহেতু তুমি সেহেতু তোমার সাথে আমরা লড়বো ৷
আবু তালেব যখন মুশরিক নেতাদের বার্তা রাসূলকে জানালেন, রাসূল তাদের বার্তার জবাবে বললেন, "আল্লাহর শপথ ! তারা যদি আমাকে আমার কাজ থেকে বিরত রাখার জন্যে আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্রও এনে দেয়, তারপরও আমি আমার দাওয়াতী কাজ কখনোই বন্ধ করবো না ৷ এপথে যতোদিন আমি মারা না যাচ্ছি কিংবা একাজের জন্যে আমার ওপর যতোদিন আল্লাহর আদেশ আছে ততোদিন আমি এই দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাবোই ৷" রাসূলের এই দৃঢ়তায় মুশরিকরা তাদের দেখানো প্রলোভনের কার্যকারিতার ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেল ৷
কোরআনের সীমাহীন আকর্ষণ এবং প্রভাবের কারণে মুশরিকরা কোরআনের মোকাবলা করা অর্থাৎ মানুষের ওপর কোরআনের প্রভাব হ্রাস করার উপায় খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৷ বলা যায়, রাসূলের নবুয়্যতের পুরো সময়টাতে মুশরিকদের মোকাবেলায় তাঁর সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে হাতিয়ারটি ছিল তা হলো এই কোরআনের আয়াতগুলো ৷ কোরআনের অলঙ্কার সমৃদ্ধ আয়াতগুলোর প্রাঞ্জলতা এবং ছন্দময় সুরের যে ব্যঞ্জনা তা মক্কার মুশরিকদেরকে এইসব আয়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অক্ষম করে দিত ৷ মুশরিকদের অনেকেই যখন রাসূলের পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাদের কানগুলো বন্ধ করে রাখতো, যাতে কোরআনের আয়াতের প্রভাব তাদের ওপর না পড়ে৷ তারা কোরআনের আয়াতের চমত্কাোরিত্ব, প্রাঞ্জলতা এবং যৌক্তিকতার সামনে দাঁড়াতে অক্ষম ছিল ৷ তাই তারা মুসলমানদের ওপর কেবল চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই পবিত্র এই ধর্ম বিস্তারের পথ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিল ৷
অত্যাচার নির্যাতন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ :
ইসলামের বিপরীতে মুশরিকদের যুক্তি ছিল গায়ের জোর, অত্যাচার আর ভয়-ভীতি প্রদর্শনের যুক্তি ৷ যারা মুসলমান হয়েছিল, বিশেষ করে মুসলমান দাসদের ওপর মুশরিকরা ব্যাপক অত্যাচার চালিয়েছিল ৷ তারা তাঁদেরকে ক্ষুধার্ত রেখে কষ্ট দিয়েছিল, তৃষ্ণার্ত রেখে কষ্ট দিয়েছিল ৷ এদেরই একজন ছিলেন হাবশা বা বর্তমান ইথিওপিয় দাস বেলাল ৷ তিনি ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালাফের দাস ৷ উমাইয়া যখন জানতে পারলো যে বেলাল মুসলমান হয়েছে, তখন জনসমক্ষে তার ওপর সে অত্যাচার চালিয়েছিল ৷ উমাইয়া বেলালকে গ্রীষ্মের সবচে গরম দিনগুলোতে মক্কার আশপাশের তপ্ত বালুর ওপর খালি গায়ে শুইয়ে দিয়ে বুকের ওপর বিশাল পাথরচাপা দিয়ে মুহাম্মাদ এবং তাঁর আল্লাহর ওপর বিশ্বাস পরিত্যাগ করতে বলতো ৷ কিন্তু বেলাল কেবল একটি বাক্যেরই পুনরাবৃত্তি করতেন-আহাদ ! আহাদ !! অর্থাৎ আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় ৷ তারপরও বেলাল আত্মসমর্পন করলেন না ৷ অবশেষে মক্কার এক বিত্তশালী লোক বেলালকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেয় ৷ বেলাল মুক্তি পেয়ে রাসূলের খেদমতে হাজির হয় ৷
আম্মার এবং তার বাবা-মা ইয়াসির ও সুমাইয়ার ওপরও ব্যাপক অত্যাচার চালানো হয়েছিল ৷ ইয়াসির এবং সুমাইয়া ইসলামের ওপর ঈমান আনার কারণে মুশরিকরা তাদের ওপর এতো অসহনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল যে তাদের অত্যাচারে তাঁরা দু'জনই শহীদ হয়ে যান ৷ ইয়াসিরকে ইসলামের প্রথম শহীদ বলে অভিহিত করা হয় ৷ মুসলমানদের আটক করা বা বন্দী করাও মুশরিকদের আরেক ধরনের অত্যাচার ছিল ৷ মুসলমানদের ওপর এইসব অত্যাচারের ঘটনায় রাসূল খুবই কষ্ট পেতেন ৷ কিন্তু তাঁর ওপর অবতীর্ণ কোরআনের মর্মস্পর্শী আয়াত দিয়ে মুসলমানদেরকে তিনি প্রতিরোধের আহ্বান জানাতেন এবং তাঁদেরকে এই প্রতিরোধযুদ্ধে বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিতেন ৷ রাসূল নিজেও সবসময় মুশরিকদের ভয়-ভীতি আর উত্পীুড়নের মুখে ছিলেন ৷
রাসূলকে মুশরিকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণত ঠাট্টা-মশকরা বা অপবাদ, উপহাস করেই উত্পীাড়িত করতো৷ তাদের অপবাদ আর উপহাসের মাত্রা এতো বেশি ছিল যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে সূরা হিজ্রের ৯৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন : 'ঠাট্টাকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্যে যথেষ্ট ৷'
মুশরিকরা রাসূলকে বিদ্রুপ করে এবং তাঁকে যাদুকর, পাগল ইত্যাদি বিচিত্র অপবাদ দিয়ে এমনকি তাঁর পবিত্র মস্তকে কাঁটা এবং বালি ছিটিয়ে তাঁকে উত্যক্ত করতো, আর এভাবে মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে চাইতো ৷ কিন্তু রাসূল (সা.) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে কেবল আল্লাহর জন্যেই মুশরিকদের সকল অত্যাচার, ঠাট্টা-বিদ্রুপ আর অপবাদ মুখ বুজে সহ্য করেছেন ৷ মুসলমানদের ওপর মুশরিকরা অবরোধ আরোপসহ এতো বেশি চাপ বৃদ্ধি করেছিল যে,তাদের একটা অংশ হাবশায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন ৷ কিন্তু মুসলমানরা যতোদিন হাবশায় ছিলেন, ততোদিন সেখানকার তত্কাযলীন বাদশাহর আনুকূল্যে খুব ভালোভাবেই জীবন যাপন করেছেন ৷
রাসূলের নবুয়্যত প্রাপ্তির সাত বছর কেটে গেল ৷ ইসলামের ডাক মক্কাসহ প্রায় সমগ্র আরবেই পৌঁছে গেল ৷ মুশরিকদের অত্যাচার-উত্পী ড়ন তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি ৷ ইসলাম, ওহীর স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা থেকে সৃষ্ট জীবনদায়ী নদীর মতো বয়ে গেছে, তার চলার পথে পথে সত্য-সঠিক ও বাস্তবতার জন্যে অপেক্ষমান তৃষ্ণার্তদের তৃষ্ণা মহান আল্লাহর শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানের রহমত দিয়ে নিবারণ করেছে ৷ হাবশায় মুসলমানদের যে দলটি হিজরত করেছিল, তাঁরাও বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল ৷ মুশরিকরা তাদেরকে ফিরিয়ে আনার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল ৷ এমতাবস্থায় আরবের মূর্তি পূজক নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বোণে ৷ এবার তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ৷ এ ব্যাপারে তারা চুক্তি করে এবং চুক্তিপত্র একটা বাক্সে ঢুকিয়ে কাবার ভেতরে ঝুলিয়ে দেয় ৷ এই চুক্তি অনুযায়ী তারা মুসলমানদেরকে বয়কট করে ৷ তারা চুক্তিবদ্ধ হয় যে, মুসলমানদের সাথে তারা কোনোরকম লেনদেন বা বেচা-কেনার সম্পর্ক রাখবে না এমনকি তাদের সাথে কোনোরকম পারিবারিক সম্পর্কও রাখবে না ৷ এই ঘটনার ফলে পরিস্থিতি মুসলমান এবং রাসূলের জন্যে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷ তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, মক্কা ছেড়ে শহরের নিকটবর্তী কোনো এক উপত্যকায় গিয়ে মাথা গোঁজাবেন ৷ পরবর্তীকালে এই উপত্যকাটি শোয়াবে আবু তালিব নামে পরিচিতি পায় ৷
শোয়াবে আবু তালিবে মুসলমানরা দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছিল ৷ অধিকাংশ দিনই একজন মুসলমান কেবল একটিমাত্র খুরমা খেতে পেত ৷ প্রায়ই ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না শোনা যেত ৷ রাসূল (সা.) এরকম পরিস্থিতিতেও অত্যন্ত শান্ত এবং নম্রতার সাথে মুসলমানদেরকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান ৷ আর অধিকাংশ সময়েই তাঁর জন্যে বরাদ্দকৃত খাবার অন্যদেরকে দিয়ে দিতেন ৷ কঠিন ঐ দিনগুলোতে রাসূলের বিশ্বস্ত স্ত্রী খাদীজা (সা.) এবং তাঁর চাচা আবু তালিব নবীজীর সবচে বড়ো পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ৷ আর শোয়াবে আবু তালিবেই হযরত খাদীজা চির নিদ্রায় শায়িত হন ৷ এই ঘটনা ছিল রাসূলের জন্যে যার পর নাই কষ্টকর একটি বিষয় ৷
অবরোধের তিন বছর পর জিব্রাঈল (আ.) রাসূলকে জানালেন যে, মুশরিকদের চুক্তিপত্রটি উইপোকা খেয়ে ফেলেছে ৷ আবু তালিব মুশরিকদেরকে এই খবর জানিয়ে দিলেন ৷ তারা বললো-মুহাম্মাদ মিথ্যা কথা বলছে ৷ শেষ পর্যন্ত তারা আবু তালিবের সাথে বাজি ধরলো যে, যদি তোমাদের কথা মিথ্যা সাব্যস্ত হয় তাহলে মুহাম্মাদকে আমাদের কাছে সঁপে দেবে ৷ আর যদি তোমাদের কথা সত্য হয় তাহলে তোমাদের ওপর থেকে আমরা অবরোধ তুলে নেবো ৷ অবশেষে যখন রাসূলের কথা সত্য বলে প্রমাণিত হলো, সবাই হতবাক হয়ে গেল ৷ এমনকি ঠিক ঐ সময়েই বহু মুশরিক রাসূলের ওপর ঈমান এনেছিল ৷ তারপরও মূর্তি পূজক নেতৃবৃন্দ তাদের আক্রোশ প্রকাশ করতে লাগলো ৷ এভাবে মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের আরোপিত অবরোধ শেষ হয় এবং মুসলমানরা তাদের নিজ নিজ বাসাবাড়িতে ফিরে যায় ৷ এরপরও মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার চলতে থাকে ৷ এরিমধ্যে রাসূলের চাচা আবু তালেব দুনিয়া ত্যাগ করেন ৷ ফলে রাসূল তাঁর দুই বৃহত্ পৃষ্ঠপোষককে হারান ৷ মুশরিকরা এবার রাসূলকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে ৷ রাসূল (সা.) তাই মুসলমানদের নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেনে ৷ এটাই ছিল রাসূলের ঐতিহাসিক হিজরত ৷ মদীনায় ইসলামের ইতিহাসের নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা হয় ৷
"আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সালাম যারা হেদায়াত লাভ করেছে এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের ওপর ঈমান এনেছে আর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি ব্যতীত আর কোনো খোদা নেই। আমি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইসলামের পথে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি।"
কোরআনের দৃষ্টিতে রাসূলে খোদা (সা.) হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। ‘খাতামুন নাবিয়্যিন' বা সর্বশেষ নবী হিসেবে তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল এক মহাদায়িত্ব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহুবার তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেন, "হে মুহাম্মাদ ! আমরা তোমাকে বিশ্বমানবতার জন্যে প্রেরণ করেছি ! তুমি তাদেরকে খোদায়ী পুরস্কারের সুসংবাদ দাও এবং তাঁর শাস্তির ব্যাপারে ভয় দেখাও !"( সাবা-২৮ )
অন্যত্র বলা হয়েছে ‘এই কোরআন বিশ্ববাসীর জন্যে উপদেশ বা জাগরণের মূল উৎস।
( কলম-৫২ )
বহির্বিশ্বকে ইসলামের দাওয়াত :
কুরাইশদের সাথে সংঘাতের কয়েক বছর পর হিজরী সপ্তম বছরে রাসূল (সা.) বৃহৎ দেশগুলোর শাসক, খ্রিষ্টান নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন গোত্রের নেতাদেরকে চিঠি লিখে ইসলাম গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। এই আমন্ত্রণ জানানোর পর মদীনায় মুসলমানদের অবস্থান কিছুটা স্থিতিশীল হয়। রাসূল (সা.) বিভিন্ন শাসক বা বাদশাহকে এবং আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পদস্থ কর্মকর্তাদেরকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তা থেকে ইসলাম প্রচারে তাঁর টেকনিক বা কর্মকৌশল কিছুটা ফুটে ওঠে। বর্তমানে ইসলাম প্রচারের জন্যে লেখা তাঁর ১৮৫টি চিঠি সংরক্ষিত আছে। এইসব চিঠি থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সা.) সবসময় যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে পরকালীন সুসংবাদ ও ভীতির কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীর কানে ইসলামের বার্তা পৌঁছাতেন। রাসূল (সা.) বিভিন্ন দেশের শাসকবৃন্দকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে একটা পরামর্শ সভায় বসেন এবং সবার সামনে তাঁর ঐ কর্মসূচি তুলে ধরেন। তারপর একদিন ফজরের নামায শেষে তাঁর ঐ কর্মসূচি বাস্তবায়নকল্পে যাঁদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেইসব প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠালেন এবং বললেন :
‘‘আল্লাহর বান্দাদেরকে নসীহত করবে। যারা জনগণের দায়িত্বশীল হয়েও জনগণকে সঠিক পথ প্রদর্শন করায় না,আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের জন্যে বেহেশত হারাম করে দিয়েছেন। তোমরা উঠে দাঁড়াও ! রাসূলের দূত হিসেবে দূর-দূরান্তে তৌহিদের বার্তা বয়ে নিয়ে যাও। বিশ্ববাসীর কাছে তৌহিদের ঐ বার্তা পৌঁছে দাও।"
রাসূল রূপার আংটি দিয়ে একটা সীল বানানোর নির্দেশ দেন যাতে প্রত্যয়নের স্বার্থে ঐ আংটি বা সীলকে তাঁর নামের ওপর ব্যবহার করা যায়। তিনি চিঠিগুলোতে সীল লাগালেন এবং চিঠির খামগুলোকে একটা বিশেষ মোম দিয়ে আটকালেন। তারপর কয়েকজনকে তাঁর দূত হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠালেন। রাসূলের দূতগণ একদিনে ইরান, রোম, ইথিওপিয়া,মিশর, ইয়ামামা, বাহরাইনসহ আরো বহু অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সাসানী যুগের প্রতাপশালী শাসক খসরু পারভেজকেও চিঠি লেখা হয়েছিল। রাসূলে খোদা তাঁর এক চিঠিতে খসরু পারভেজকে পারস্যের বড়ো কেসরা বলে অভিহিত করে লিখেছেন : ‘আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইরানের মহান কেসরা কে, তাদের প্রতি দরুদ যারা বাস্তবতা ও সত্যকামী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে আর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি ছাড়া অন্য কোনো খোদা নেই, তাঁর কোনো সমকক্ষ বা শরীক নেই, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা এবং রাসূল। আমি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তোমাকে তাঁর দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি আমাকে সকল মানুষের হেদায়াতের জন্যে প্রেরণ করেছেন যাতে তাদেরকে আল্লাহর ভয় সম্পর্কে অবহিত করি এবং কাফেরদের সামনে তাঁর হুজ্জাত বা যুক্তি-প্রমাণাদি তুলে ধরি। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলে তুমি নিরাপদ, আর যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকো, তাহলে অগ্নিপূজারীদের পাপের দায়ভার তোমার ওপর।'
রাসুলের এই চিঠি পড়া শেষ না হতেই কেসরা উত্তেজিত হয়ে চীৎকার করে উঠলো এবং চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললো। আর বাজান নামের তার এক সভাসদকে আদেশ দিলো নবুয়্যতের দাবীদার মক্কার ঐ কুরাইশ বংশীয়কে যেন তার ঐ দাবীর জন্যে তওবা করতে বাধ্য করা হয়। যদি তওবা না করে তাহলে যেন তার মস্তক কেটে তাকে পাঠানো হয়। কিন্তু ইতিহাস বলছে যে, বাজান নাকি রাসূলের চিঠি পড়ার পর কেসরার আদেশ পালন না করে উল্টো রাসূলে খোদার জন্যে উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দেয়।
মিশরের শাসক মাকুকাসকে আরেকটি চিঠি লিখেছেন রাসূল। মাকুকাস ছিল খ্রিষ্টান। সেজন্যে তাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে চিঠিটাকে এই আয়াত দিয়ে অলঙ্কৃত করলেন : "হে আহলে কেতাব বা ঐশীগ্রন্থধারীগণ! এসো তোমাদের এবং আমাদের মাঝে যে কথাটি অভিন্ন বা সমানভাবে গ্রাহ্য, তার অনুসরণ করি। আর তাহলো আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো উপাসনা করি না এবং কোনো কিছুকেই তাঁর শরীক করি না। আর আমাদের কেউ অন্য কাউকে খোদা হিসেবে গ্রহণ করে না।"( আল-ইমরান : ৬৪ )
হাতেব নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই চিঠিটি মিশরের খ্রিষ্টান বাদশাহর হাতে পৌঁছে। মাকুকাস অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে চিঠিটা পড়েন এবং দূতকে বলেন রাসূলের অবয়ব সম্পর্কে বর্ণনা দিতে। তারপর বললেন যে, নবীর আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিলেন ঠিকই তবে ভেবেছিলেন নবী হয়তো সিরিয়া থেকেই আবির্ভূত হবেন। কেননা পূর্ববর্তী বহু নবী সিরিয়াতেই আগমন করেছিলেন। মাকুকাস রাসূলে খোদার কাছে একটা চিঠি লিখলেন এবং সেইসাথে দুইজন দাসী পাঠালেন রাসূলের খেদমতে। রাসূল ঐ দুই দাসীকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
রোমের কায়সারকেও রাসূল চিঠি লিখেছিলেন। রাসূলের চিঠি যখন কায়সারের হাতে গিয়ে পৌঁছে, তখন তিনি ইরানের সেনাবাহিনীর ওপর বিজয়ী হওয়ার আনন্দে শোকর আদায় করার উদ্দেশ্যে বাইতুল মোকাদ্দাস যিয়ারতে যাচ্ছিলেন। কায়সারকে লেখা রাসূলের চিঠিটি শুরু হয়েছিল এভাবে :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রোমের মহান হেরাকেল কে......।
কায়সার যখন চিঠির উপরাংশে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম দেখতে পেলো ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললো-‘আমি হযরত সোলায়মান (আ.) এর চিঠি ছাড়া আর কারো চিঠি এ পর্যন্ত খোদার নামে শুরু হতে দেখি নি। মক্কায় যারা উপস্থিত ছিল বা বসবাস করতো, তাদের কাছ থেকে তিনি মুহাম্মাদ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। কায়সার নিজেও নবীজীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল। তাই এ সম্পর্কে রোমের এক জ্ঞানী পণ্ডিতের কাছ থেকে জানতে চাইলো। ঐ পণ্ডিত কায়সারের উদ্দেশ্যে লিখলেন : ‘তিনি সেই পয়গম্বর বিশ্ব যাঁর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।'
কায়সার একটা আশ্রম বা মঠে রোমের নেতাদের একটি সমাবেশের আয়োজন করেন এবং রাসূলের পাঠানো চিঠিটা তাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করে বলেন : তাঁর ধর্ম ও কর্মসূচি কি তোমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত? কায়সারের এই প্রস্তাবে সমাবেশে গোলযোগের সৃষ্টি হয় এমনকি তাঁর প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। তাই দ্রুত তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন : এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাদের পরীক্ষা করা। যাই হোক, রোমের বাদশা শেষ পর্যন্ত রাসূলের দূতকে যথাযোগ্য সম্মান জানালেন এবং উপহার সামগ্রীসহ রাসূলের চিঠির জবাব দিলেন। চিঠিতে তিনি রাসূলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি প্রতিবিম্বিত করলেন।
ইয়ামামার শাসকের উদ্দেশ্যেও রাসূল (সা.) একটি চিঠি লিখেছিলেন। তিনি রাসূলের চিঠি পড়ার পর এবং রাসূলের দূতের সাথে কথাবার্তা বলার পর ভীষণভাবে প্রভাবিত হন এবং এক চিঠিতে তিনি নবীজীকে লেখেন : "আমাকে আপনি সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মের দাওয়াত দিয়েছেন ! আমি একজন কবি এবং বক্তা। আরব জাতির মাঝে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আমি তোমার ধর্ম গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছি এই শর্তে যে, আমাকে আপনি ধর্মীয় বড়ো কোনো কর্মকর্তা বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ দেবে।" ইয়ামামার শাসকের পক্ষ থেকে এই পত্র সহ রাসূলের কাছে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানা হলো। কিন্তু রাসূল (সা.) ঐ পত্রের জবাবে বললেন : "তার ঈমান যদি শর্তসাপেক্ষে হয়, তাহলে হুকুমাত বা খেলাফতের কোন যোগ্যতা তার নেই, আল্লাহ আমাকে তার বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা করুন।"
বড়ো বড়ো দেশগুলোর প্রধানদেরকে রাসূলে খোদা (সা.) এর এই চিঠি লেখা থেকে প্রমাণিত হয় যে ইসলামের আহ্বান বা দাওয়াত একটা বিশ্বজনীন ব্যাপার। অন্যদিকে আমরা রাসূলের কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো যে, জনগণকে কিংবা নেতাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মৌলিক পদ্ধতি ছিল, তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে সবকিছু উপস্থাপন করতেন এবং তাদের চিন্তাশক্তি জাগিয়ে তুলতেন। রাসূলের নবুয়্যতির দায়িত্ব পালনের পুরো সময়টায় এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অনুসৃত হয়েছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় উপদেশ কিংবা কোরআনের দাওয়াত দিয়েছেন। মদীনা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এভাবেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে। মদীনার লোকজনও এই পদ্ধতির অনুসরণ এবং কোরআনের আয়াতের চমৎকারিত্বে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। যেমনটি প্রসিদ্ধি আছে যে, কোরআনের মাধ্যমেই মদীনা জয় হয়েছিল।
রাসূল (সা.) একদিন মসজিদে গিয়ে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ একটা পরিবেশ অনুভব করলেন ৷ তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টি মসজিদের প্রতি নিবদ্ধ ছিল ৷ তিনি দেখতে পেলেন মসজিদের ভেতর দুটি দল বৃত্ত তৈরী করে আছে৷ একদল ছিল আল্লাহর জিকির-আজকার আর দোয়া-দরুদে মশগুল, অন্যদল জ্ঞানের বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ৷ রাসূলে খোদা (সা.) এই দুটি দলের দিকেই তাকিয়ে বললেন-দুটি দলই মঙ্গল ও কল্যাণের পথে রয়েছে,কিন্তু আমি সেই দলটির সাথেই বসবো যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছে ৷
যতোই দিন যেতে লাগলো, রাসূল (সা.) ততোই বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রতিভাবান এবং আগ্রহীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন ৷ নিঃসন্দেহে এটা ছিল রাসূলের ওপর একটা কঠিন দায়িত্ব ৷ তদুপরি তিনি এমন একটা অসচেতন ও পশ্চাদপদ সমাজের মুখোমুখি হলেন, যেই সমাজে পূর্ববর্তী ধর্মের ভিত্তিতেই জীবনকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হতো ৷ তাদের কাছে যে-কোনো কিছুর সত্যতা বা যথার্থতা নির্ণয়ের ভিত্তি ছিল পূর্ববর্তীদের অনুসৃত মানদণ্ড ৷ আর এ বিষয়টাই তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৷ তারা তাদের কৃষ্টি-কালচারে কোনোরকম পরিবর্তনকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না ৷ অন্যদিকে অজ্ঞতা তাদেরকে তৌহিদে বিশ্বাস এবং এক আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করা থেকে ফিরিয়ে রেখেছিল ৷ তারা কেবল চোখে যা দেখতো তা-ই গ্রহণ করতো ৷ কিন্তু সেই সত্যের প্রতি তারা ঈমান আনতো না, যেই সত্য চিন্তা-চেতনা বা বোধ-উপলব্ধি তথা প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধিযোগ্য ৷
সেই সমাজে চিন্তা-চেতনা,জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির চর্চার বিষয়টিই ছিল অজানা ৷ কারো মর্যাদার বিষয়টি নিরূপিত হতো তরবারীর শক্তিতে ৷ সমাজের এই কঠিন ও স্পর্শকাতর অবস্থাই প্রমাণ করে যে রাসূলের কাজ কতোটা কঠিন ছিল ৷ রাসূলে পাক (সা.) তাই সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে প্রথমত বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনটাকেই প্রাধান্য দিলেন ৷ কোরআনের চিত্তাকর্ষক আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টিরাজ্যের ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ৷ রাসূলের ওপর প্রথম যে আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, তাতে পড়া,শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে ৷ রাসূল (সা.) বলেছেন, অজ্ঞতা এবং মূর্খতার ওপর বিজয় লাভের উপায় হলো প্রশ্ন করা ৷ রাসূল মানুষের অন্তরে কোরআনের আদর্শ ও শিক্ষাগুলোকে সঞ্চারিত ও প্রোথিত করতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ৷
হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করিম ( দঃ ) বলেছেন, আল্লাহর ঘরে যারা কোরআন শেখার জন্যে সমবেত হয়, এবং এ লক্ষ্যে নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা করে, তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তির ধারা বর্ষিত হয় ৷ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং জ্ঞানার্জন করার জন্যে বারবার উপদেশ দেওয়ায় তত্কাালীন সমাজের লোকজনের মাঝে যেন ঝড়ের সৃষ্টি হলো, তারা সবকিছুর আগে জ্ঞান অর্জন করাটাকে অগ্রাধিকার দিল ৷ রাসূলের সাহাবীগণ সবসময় তাঁর কাছ থেকে বেশী বেশী জানার জন্যে ব্যাকুল ছিলেন ৷ মদীনায় হিজরতকারী একজন মুসলমান বলেন, আমি এবং আমার প্রতিবেশীর মাঝে কথা হয়েছিল যে, একদিন আমি যাবো রাসূলের খেদমতে, আরেকদিন সে যাবে ৷ তো রাসূলের কাছ থেকে ওহীর যেসব শিক্ষা আমরা লাভ করবো, তা পরস্পরকে জানাবো ৷
রাসূল (সা) মোয়ায নামে তাঁর একজন সাহাবীকে বললেন, হে মোয়ায ! জেনে রাখো, তোমার প্রচেষ্টায় আল্লাহ যদি কোনো ব্যক্তিকে হেদায়াত দান করেন, তা হবে দুনিয়ার সকল বস্তুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মূল্যবান ৷ উল্লেখ্য যে, রাসূল ( দঃ ) জনগণের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে একবার এই মোয়াযকে কোনো এক এলাকায় পাঠিয়েছিলেন ৷
নবীজীর দৃষ্টিতে জ্ঞান হলো মানুষের অন্তরে আলো ও সজীবতার উত্স ৷ তিনি অন্যত্র বলেছেন 'জ্ঞান হলো মুমিনের হারানো সম্পদ৷' মানুষ যদি কিছু হারায় তাহলে তা উদ্ধার করার জন্যে সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালায় ৷ জ্ঞান হলো মুমিনের সেই হারানো বস্তু, তাই এই জ্ঞানকে উদ্ধার করার জন্যে অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো উচিত৷ জ্ঞান হলো মূল্যবান সেই মণিমুক্তোর মতো,যা যতোই জমানো হয় সাধ মেটে না৷ রাসূল (সা.) এই বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে : 'মুমিনের হারানো বস্তু হলো জ্ঞান৷ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই হলো যতোই তা শেখা হয় ততোই আরো শেখার চাহিদা বেড়ে যায় ৷'
চিন্তা-চেতনা বিকাশে রাসূলের গৃহীত নীতির ফলে জনগণও চিন্তার স্বাধীনতা পেয়ে যায় ৷ তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য এবং লোকাচারের অন্ধত্ব ও গোঁড়ামীর স্থলে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ পায় এবং তারা জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও যুক্তির ভিত্তিতে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে৷ এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটির কারণে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ উপলব্ধির পথ সুগম হয়৷ কেননা, অন্তদৃষ্টি, জ্ঞান ও সচেতনতা ছাড়া ইসলামকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব নয় ৷ সাফওয়ান ইবনে গাস্সান বলেন :
'রাসূলের খেদমতে হাজির হয়ে বললাম,হে রাসূল ! আমি জ্ঞান অর্জন করার জন্যে মসজিদে এসেছি ৷ রাসূলে খোদা আমাকে বললেন : খুব ভালো ! জ্ঞান অর্জনের পেছনে লেগে থাকো ! ফেরেশতারা জ্ঞান অন্বেষণকারীদেরকে তাদের পাখা এবং পালক দিয়ে আশ্রয় দেয় এবং তাদের চারপাশে ভালোবাসা ও প্রেমের এমন একটা বৃত্ত তৈরী করে যেমন আকাশ পৃথিবীকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখে ৷'
একদিন রাসূলে খোদা (সা.) জনসমাবেশে বললেন : 'বেহেশতের বাগিচায় ভ্রমণ করো, নিজেকে তার অনুগ্রহ বা নেয়ামত দিয়ে পূর্ণ করো ! জনগণ বললো-হে রাসূলে খোদা ! বেহেশতের বাগিচা মানে কী ? রাসূল বললেন: আলাপ-আলোচনার বৈঠক ৷ কেননা আল্লাহর এমন কিছু ফেরেশতা রয়েছেন যারা ঘুরে ঘুরে জ্ঞান বিষয়ক আলাপ-আলোচনার বৈঠক খুঁজে বেড়ায় ৷ তারা এ ধরনের বৈঠকে প্রবেশ করে বৈঠককারীদের ঘিরে রাখে ৷'
রাসূলে খোদা ( সাঃ ) তত্কানলীন জনগণের অবস্থাকে এতো নম্র ও এতো দক্ষতার সাথে এমন সুন্দরভাবে বর্ণনা করতেন যে, তারা তাদের অজ্ঞতা বা মূর্খতা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে উজ্জীবিত হতো ৷ রাসূলের এই চিন্তা ও সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার ফলে অজ্ঞ এবং মূর্খ একটি জাতির মধ্য থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ একটি সমাজের সৃষ্টি হলো ৷ জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলের ছোট্ট একটি বক্তব্যই যথেষ্ট ৷ তিনি বলেছেন : জ্ঞান হলো আমার এবং আমার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ ৷
একইভাবে তিনি জ্ঞানীদেরকে আঁধার রাতের পথিককে পথ-প্রদর্শনকারী আকাশের তারার সাথে তুলনা করে বলেছেন : পৃথিবীর বুকে জ্ঞানীদের অবস্থান আকাশের তারার মতো৷ এই তারার মাধ্যমে জল-স্থলের সকল আঁধার দূরীভূত হয়ে যায় ৷ এই তারাগুলো যদি হারিয়ে যায়,তাহলে পথের সন্ধান লাভকারীগণ পুনরায় পথ হারিয়ে বসতে পারে ৷
কোরআনের মোহনীয় মাধুর্যতা ও অলৌকিকতা :
রাসূল যখন ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন,তখন কুরাইশ মুশরিকরা রাসূলের বিরুদ্ধে সকল প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। এমনকি তারা রাসূলের কাছে যাতে কেউ আসতে না পারে সেজন্যে মানুষজনকে বাধা দিত। কিন্তু মুশরিকদের এতো বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও মানুষ কোরআনের মোহনীয় মাধুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে যেত। এরফলে মুশরিকদের মনে একটা প্রশ্ন জাগলো যে, এমন কী আছে কোরআনে যে, যে-ই শোনে সে-ই মুগ্ধ হয়ে যায়। মক্কার মুশরিকদের মধ্যে অন্যতম ক'জন ছিল আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান এবং আখনাস। এরা দিনের বেলা ঠিকই অন্যদেরকে রাসূলের কাছে যেতে বাধা দিত আর রাতের বেলা নিজেরাই গোপনে গোপনে কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্যে রাসূলের ঘরের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকতো।
একরাতে এদের তিনজনই যার যার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কোরআন তেলাওয়াত শুনলো। তেলাওয়াত শোনার পর যখন তারা বেরিয়ে এলো, তখন সবার সাথে সবার দেখা হলো এবং সবার কাছেই সবার গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়লো। ফলে পরস্পরকে তিরস্কার করতে লাগলো এবং তারা শপথ করলো যে এই ঘরে আর কখনো আসবে না। মুখে বললেও তাদের কাছে কোরআনের আয়াতের আকর্ষণ ছিল শপথের অনেক উর্ধ্বে। তাই পরের রাতেও তিনজনই রাসূলের নিজ মুখে আল্লাহর বাণী শোনার জন্যে বাইরে বেরিয়ে এলো। পরপর তিনবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল এবং প্রত্যেকবারই তারা শপথ নিয়েছিল যে এই তল্লাটে আর পা রাখবে না। এগুলো আসলে কোনো কাহিনী বা গল্পের প্লট নয়, বরং এটা হলো বাস্তব ইতিহাস। আর সেই বাস্তবতা হলো, মক্কার মুশরিকরা কোরআনের আয়াতের বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও অলঙ্কারিত্বে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা এর সত্যতা বুঝতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের ঈর্ষাপরায়নতা ও গোঁড়ামির কারণেই সেই সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল।
অন্যান্য নবীদের মতো মুহাম্মাদ (সা.) এরও মোজেযা বা অলৌকিকত্ব ছিল, যাতে ঐ মোজেযা দেখে জনগণ তাঁর বার্তা বা দাওয়াতের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারে। কিনতু যারা অলৌকিকত্ব দেখার অপেক্ষায় ছিল রাসূল সবকিছুর আগে কোরআন এবং কোরআনের জীবন্ত শিক্ষার দিকে তাদের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তিনি মক্কার পরিবেশটাকে কোরআনের আধ্যাত্মিক সুগন্ধিতে ভরপুর করে দেন। আসলে কোরআনের আধ্যাত্মিকতা এবং গভীর আকর্ষণই ইসলামের আহ্বানে জনগণের সাড়া দেওয়ার প্রধান কারণ। সে সময় আরবের লোকেরা সাহিত্য বা কবিতার ক্ষেত্রে ভীষণ বাকপটু ছিল। সাহিত্যের শৈলীগত বৈচিত্র্য এবং আলঙ্কারিক দিক থেকে তারা ছিল খুবই দক্ষ। সে কারণেই যখন কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা হতো, তখন তারা কোরআনের সাহিত্যিক মাহাত্ম্য এবং আলঙ্কারিক ঐশ্বর্যের বিষয়টি বুঝতে পারতো। তারা এটাও বুঝতো যে কোরআনের আয়াতের অলৌকিকত্ব কেবল এর শব্দ বা বাণী দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কোরআনের শব্দমালার সুরেলা বিন্যাস এবং এর আয়াতের সাহিত্যিক মূল্যই শ্রোতার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করতো।
রাসূল (সা ) সবসময়ই কোরআনের আয়াতগুলোকে মুখস্থ করা এবং জনগণের সামনে সেগুলো তেলাওয়াত করার চেষ্টা করতেন। ওহীর আয়াতগুলো শেখার ওপর তিনি ভীষণ গুরুত্ব দিতেন এবং খুব দ্রুতই সেগুলো আয়ত্ত করে ফেলতেন। রাসূলের ওপর যখন কোরআনের আয়াত নাযিল হতো, তখন অনেক সাহাবী স্বেচ্ছায় কিংবা রাসূলের নির্দেশে সেই আয়াতগুলোকে কাঠ, খেজুর পাতা, পাথর কিংবা চামড়ার ওপর লিখে রাখতেন। এভাবে আয়াতগুলোকে সংরক্ষণ করা হতো। রাসূল যখন মসজিদে বসতেন, সাহাবীগণ তাঁকে ঘিরে অধীর আগ্রহ ও কৌতূহল সহকারে আন্তরিকতার সাথে বৃত্ত তৈরী করতেন, তবে পেছনে কেউ বসতেন না। ধীরে ধীরে কোরআন শেখার এই আসর বা বৃত্ত বড়ো হতে লাগলো। রাসূল বলেছেন : "তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে কোরআন শেখে এবং অপরকে শেখায়।" তিনি এর গুরুত্ব বোঝাতে বলেছেন, এমনকি তুমি যদি অন্তত একটি আয়াতও জানো, তা-ই অপরের কাছে পৌঁছে দাও এবং প্রচার করো।
যে সমাজকে জাহেলিয়াতের গোঁড়ামি আর অজ্ঞতা পরিপূর্ণভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল, কোরআনে কারীমের মাধ্যমে রাসূল সেই সমাজে তৌহিদের বার্তা প্রচার করলেন। কোরআনের সূরাগুলো মানুষকে নোংরামি আর কদর্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখে মনুষ্যত্ব, স্বাতন্ত্র্যচেতনা বা নিজেকে চেনা এবং জীবনের সঠিক বোধ ও উপলব্ধি এককথায় জীবনের সঠিক মাপকাঠির দিকে আহ্বান জানালো। একইভাবে কোরআনের আয়াতগুলো চমৎকার প্রকৃতি যেমন সূর্য ওঠা ভোর, তারাভরা রাতের আকাশ, ভূমি ও আকাশ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় বা স্তর প্রভৃতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এইসব আয়াতের সাহিত্যিক গুণ যেমন অসাধারণ তেমনি এগুলোর জ্ঞানগত মূল্যও বিস্ময়কর। রাসূলের মতো একজন নিষ্পাপ ও মহান ব্যক্তিত্বের মুখে যখন এইসব আয়াত উচ্চারিত হতো, তখন আয়াতের ঐশ্বর্য সবাইকে আন্দোলিত করতো।
কোরআনের আয়াতের বার্তা দিয়ে রাসূল জনগণের দৃষ্টি খুলে দিলেন। কোরআন হলো চিন্তা-গবেষণার জন্যে অলৌকিকতাপূর্ণ একটি গ্রন্থ, সে কারণেই মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোরআনের দর্শনীয় প্রভাব পড়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোরআন একদিকে যেমন মানুষকে আল্লাহর পথ দেখিয়েছে, অপরদিকে মুসলমানদের উন্নতিও নিশ্চিত করেছে। কোরআনের আয়াতের আলো দিয়েই রাসূল তাঁর দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন এবং এভাবেই একটা বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়।
রাসূলের নজীরবিহীন বক্তব্যের প্রভাব জনগণের ওপর এতো বেশী মাত্রায় পড়তে শুরু করে যে, মক্কার মুশরিকরা তা বন্ধ করতে ওয়ালিদের কাছে যায়। ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক। তাই সে ভাষার গুণমান, বক্তব্যের গুরুত্ব প্রভৃতি খুব ভালোভাবেই বুঝতো। তো কুরাইশদের একটি দল এই ওয়ালিদকে একদিন নিয়ে গেল রাসূলের কাছে। তারা অপেক্ষায় ছিল এই বুঝি ওয়ালিদ রাসূলকে পরাস্ত করে বসলো। রাসূল কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন। ওয়ালিদ প্রথম দিকে অহঙ্কারের সাথে আয়াত শুনছিলো। কিন্তু পরক্ষণে দেখা গেল রাসূলের মুখে তেলাওয়াতের শব্দ যতোই বৃদ্ধি পেতে লাগলো,ওয়ালিদ ততোই শান্ত এবং আত্মসমর্পিত হতে শুরু করলো। ওয়ালিদ বললো : "কী মধুর ! এটা কিছুতেই মানুষের বানানো বক্তব্য হতে পারে না।" আয়াতের মাধুর্য ওয়ালিদের ভেতর এতোটাই প্রভাব বিস্তার করলো যে, সে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মুশরিকরা তাকে ভয় দেখালো,সাবধান করে দিল। কিন্তু ওয়ালিদ বললো, "মুহাম্মাদের কাছ থেকে যেসব কথা আমি শুনেছি, সেসব কথা এতো আকর্ষণীয় যে অন্য কারো কথার সাথে তার তুলনা হয় না। তার বক্তব্যকে ঠিক কবিতাও বলা যায় না, আবার গদ্যও বলা যায় না, গদ্য-পদ্যের উর্ধ্বে তাঁর বক্তব্য গভীর অর্থপূর্ণ, মিষ্টি-মধুর, কল্যাণময় ও প্রভাব বিস্তারকারী। তাঁর বক্তব্য এতোই উচ্চমার্গের যে, কোনোকিছুই তারচেয়ে উন্নত হতে পারে না।"
আর এ কারণেই ইসলামের শত্রুরা পর্যন্ত কোরআনের আকর্ষণে বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। কালের পরিক্রমায় যদিও তারা রাসূলের বিরুদ্ধে, কোরআনের বিরুদ্ধে কেবল অপবাদ আর কুৎসাই রটিয়েছে,তারপরও রাসূলের অগ্রযাত্রা, কোরআনের অগ্রযাত্রা কিন্তু ব্যাহত হয় নি। বরং শত্রুদের ষড়যন্ত্রই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কেননা আল্লাহর ভাষ্য অনুযায়ী কোরআনে কোনোরকম মিথ্যা বা সন্দেহের স্থান নেই। রাসূলের পরেও কোরআনের আয়াতগুলো নিষপ্রাণ অন্তরগুলোকে সুগন্ধি স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ বুলিয়েছিল। মানব উন্নয়ন তথা জ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে কোরআনের অজানা রহস্যগুলোও একের পর এক উন্মোচিত হয়েছে। ইমাম সাদেক (আ.) যেমনটি বলেছেন-‘কোরআন চিরন্তন ও জীবন্ত। কোরআন কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না।বহমান কালের মতো কিংবা সূর্যের আলোর মতো চিরদিন এই কোরআন থাকবে এবং বিশ্ববাসীকে নিরন্তর আলোকিত করে যাবে।
আজকাল অমুসলিম চিন্তাবিদদের মাঝেও যাঁরা কোরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা মনে করেন যে,এই গ্রন্থটি হলো কর্ম ও নীতির প্রজ্ঞাপন এবং কোরআনের বার্তা বা শিক্ষাগুলো হলো ইসলামের বিকাশ ও উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। মার্কিন চিন্তাবিদ ইরভিং বলেছেন-"এই গ্রন্থ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সকল জনগণকে শান্তি ও সুখ-সমৃদ্ধির পবিত্র ছায়াতলে আশ্রয় দিয়েছে।"
"হযরত আলী (আ.) বলেছেন,‘মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর মনোনীত নবী এবং রহমতের রাসূল....বস্তুত রাসূল আকরাম (সা.) কে নেতা হিসেবে গ্রহণ করাই তোমার জন্যে যথেষ্ট.....রাসূল হলেন পূত-পবিত্রতম মানুষ,তাঁর অনুসরণ কর,কেননা; তাঁর নীতি-পদ্ধতি এমন একটা আদর্শ যে, সবার জন্যেই এই আদর্শ অনুসরণযোগ্য.....আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা তিনিই যিনি তাঁর রাসূলের আদর্শ গ্রহণ করেন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।"
বিগত আসরগুলোতে আমরা নবীজীর একত্ববাদ বা তৌহিদের দাওয়াত দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা জেনেছি যে, রাসূল ( দঃ )এর স্বভাবগত ভদ্রতা এবং নম্রতার কারণেই জনগণের অন্তরে ইসলামী আদর্শ ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। আভিজাত্যবাদী একটা শ্রেণী আছে, যারা সমাজে সম্পদ এবং শক্তির মূল অংশ, রাসূল (সা ) তাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তো আভিজাত্যবাদ বিরোধী রাসূলের এই সংগ্রামের ধরণ বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
বিশ্বে সবসময়ই লক্ষ্য করা গেছে যে, যারা আশরাফ বা অভিজাত তথা সম্পদশালী, তাদের হাতেই ক্ষমতা সবসময় কুক্ষিগত ছিল। সাধারণত যারাই সম্পদশালী অর্থে অভিজাত, সমাজে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব তাদেরই বেশী থাকে। অভিজাতদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে বিলাসিতা ও উচ্চাভিলাষ জেঁকে বসে। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আপামর জনসাধারণ থেকে তাই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আসলে সুযোগ-সুবিধা অন্বেষণ এবং বিলাসিতা একটা সামাজিক ক্ষত বা ব্যাধি। কোনো ব্যক্তি কিংবা সমাজের কোনো একটি অংশেও যদি এই বিলাসিতার ব্যাধি গ্রাস করে, তাহলে তা ধীরে ধীরে পুরো সমাজেই সংক্রমিত হয়ে পড়ে এবং সামাজিক সুস্থতাকে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে যে, অভিজাত সমাজ সাধারণত ভোগবাদী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে থাকে। তারা নিজেদেরকে সমাজে তুলে ধরার জন্যে এবং অন্যদের সম্মান আদায় করার জন্যে আভিজাত্যবাদকে ধারাবাহিকভাবে কিংবা বলা যেতে পারে বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ ও বিকাশ ঘটিয়ে থাকে।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে বিলাসিতা এবং আভিজাত্যবাদের প্রচলিত অবক্ষয়ের বিষয়টি সমাজ বিজ্ঞানী এবং ধর্মীয় নেতাগণ পর্যালোচনা করেছেন। মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী ভেবলান মনে করেন, আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মতো ব্যক্তিত্ব খুবই বিরল, একেবারেই হাতে গোণা। তিনি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাব-চরিত্র দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে সকলের কাছে নিজস্ব সম্মান ধরে রাখতে পেরেছেন। যে সমাজে সম্পদশালী ব্যক্তির অভাব ছিল না, যে সমাজে জনসাধারণের কাছে সম্পদশালীদের উচ্চ মর্যাদা এবং যথার্থ স্থান ছিল এবং এমনকি যেসময় আভিজাত্যবাদের ব্যাপক প্রচলন ছিল, সে সময় রাসূলের এই গ্রহণযোগ্যতা সত্যিই বিস্ময়কর। মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আভিজাত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং মানুষের মাঝে শ্রেণীবৈষম্য দূর করে দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণীবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ ছিল খুবই ভালো। জাহেলি সমাজের গোত্র, পরিবার, সমপ্রদায় এবং সম্পদের আভিজাত্যের ওপর মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করতো। রাসূল (সা) তাঁর নিজস্ব সমপ্রদায়ের উদ্দেশ্যে আভিজাত্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-‘কুরাইশ গোত্রে অভিজাত বলতে তাদেরকেই বোঝাতো,যাদেরকে দেখে জনগণ ভয় পেত এবং ঐ অভিজাতরা লোকজনকে যা-ই আদেশ করতো, তারা তা-ই করতো। এই অভিজাতরা আত্মপ্রদর্শন বা খ্যাতি কুড়াবার জন্যে যুদ্ধের খরচ বহন করতো এবং ধন-সম্পদ লুটতরাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতো। তারপর সেই বীরত্বগাঁথাকে মহাকাব্য আকারে স্মরণীয় করে রাখতো। রাসূল (সা.) যখন সিদ্ধান্ত নিলেন খারাশ বিন উমাইয়া কা'বী নামের সমাজের একজন অনভিজাত ব্যক্তিকে অভিজাত সম্প্রদায়ের সাথে আলোচনার জন্যে পাঠাবেন, তখন খারাশ উদ্বিগ্ন হয়ে রাসূলের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যেন একজন খ্যাতিমান লোককে পাঠানো হয়, যাতে অভিজাত সমপ্রদায়ের পক্ষ থেকে কোনোরকম প্রতিবাদ না আসে। কিন্তুরাসূল খারাশকে নির্বাচন করে বোঝালেন যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো মেধা-প্রতিভা এবং যোগ্যতা। মক্কা বিজয়ের পরও ইথিওপীয় দাস বেলাল কাবার ছাদে গিয়ে আযান দিয়েছিলেন। বেলালের আযানের শব্দ শুনে কুরাইশ অভিজাতদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, তা প্রমাণ করেছিল যে, তাদের মাঝে আভিজাত্যের চেতনা কতোটা ভয়াবহ রকমের ছিল। একটা নীচু শ্রেণীর লোক এভাবে কাবার ওপরে উঠে আযান দেবে-এটা কুরাইশদের অভিজাত সমপ্রদায়ের অনেকে কল্পনাই করতে পারে নি। তাই তাদের চেহারায় বিরক্তির সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অন্যদিকে রাসূল (সা.) বেলালকে দেখে খুশি হলেন এবং বললেন-হে বেলাল ! তোমার আযানের মাধ্যমে আমাদের প্রশান্ত ও প্রফুল্ল করো।
শ্রেষ্ঠত্বের এই অহঙ্কারী দৃষ্টিভঙ্গিকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করার জন্যে রাসূল (সা) প্রথমে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের সংস্কৃতিকে গোত্রীয় ও আভিজাত্যমূলক মূল্যবোধের জায়গায় স্থান দিলেন। রাসূলে খোদা তাঁর এক ভাষণে বলেছেন : ‘এক মুমিনের সাথে অপর মুমিনের সম্পর্ক হলো শরীরের সাথে মাথার মতো, কেননা কোনো অংশে ব্যথা হলে তা সমস্ত শরীরেই অনুভূত হয়।' রাসূল (সা.) মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি তিনি নিজে নবী হবার পরও অর্থাৎ অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সমাজের বাদবাকী জনগণের তুলনায় কোনোরকম অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ছিলেন না। মদীনায় যখন মানুষের মাঝে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছিল, তখন রাসূল এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমা অন্যদের সমানই গ্রহণ করেছেন। এভাবে আমরা লক্ষ্য করবো যে, একটা সমাজের মানুষকে যে বিষয়টি একই বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার মাঝে অভিন্ন মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটায়,তাহলো ইসলামের নবীর সেইসব শিক্ষা যার প্রচার প্রসারে তিনি নিরন্তর চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
রাসূলের আবির্ভাবের সময় আভিজাতরা কিছু নিয়মনীতিতে বিশ্বাসী ছিলো, যেমন তারা মনে করতো তৎকালীন সমাজের মহিলারা-তারা যেই শ্রেণীর লোক, সেই শ্রেণীর বাইরে অন্যকোনো শ্রেণীর পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার তাদের নেই। রাসূল (সা.) এই ভ্রান্ত প্রথাটিকে বাতিল করার জন্যে এবং শ্রেণীগত দূরত্ব কমানোর জন্যে রাসূলের আযাদকৃত গোলাম যায়েদের সাথে আব্দুল মুত্তালিবের নাত্নী যেইনাবের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এবং সেই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রেণীভেদ প্রথা বা আভিজাত্যবাদের বিরুদ্ধে রাসূলের সংগ্রামের আরেকটি কৌশল ছিল আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা। রাসূল (সা.) তাকওয়া-পরহেজগারী এবং ঈমানকে সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি বলে মনে করতেন এবং কর্মস্পৃহা, উদ্যম ও চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়ে অলসতা বা কর্মবিমুখতাকে সমাজ থেকে দূর করেছেন। রাসূলের চাচা আব্বাস যখন নবীজীর কাছ থেকে একটা কাজের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন, রাসূল তখন জবাবে বলেছিলেন : "তোমাকে এমন একটা কাজের দায়িত্ব দেবো যে কাজ থেকে তোমার কোনো আয় হবে না, বরং ঐ কাজের জন্যে তোমার আরো খরচ হবে।"
ইসলামী সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী হয়েও রাসূল (সা.) সর্বপ্রকার গর্ব-অহংকার এবং আভিজাত্যকামিতা থেকে দূরে ছিলেন। তিনি একেবারেই সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং অপরাপর লোকজনের মতো তিনি নিজেও উৎপাদনধর্মী কাজকর্ম করতেন। যাতা চালাতেন, গর্ত বা পরীখা খনন করতেন এবং মসজিদ তৈরীর ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে সহযোগিতা করতেন। আভিজাত্যবাদী চেতনার সাথে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে রাসূলের পদ্ধতি ছিল কর্মোদ্যম ও চেষ্টা-প্রচেষ্টার সংস্কৃতির সাথে অভিজাত সম্প্রদায়ের পরিচিতি ঘটানো। তিনি এই ধরনের লোকজনকে পতিত জমি দিতেন যাতে সেখানে তারা কাজ করে এবং তাদের হাতেই যেন ঐ জমি আবাদ হয়। আভিজাত্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিশিষ্ট কবি হাসসান বিন সাবেত আনসারীকে রাসূল একবার পতিত জমি দিয়েছিলেন যাতে তিনি ঐ জমিতে আবাদ করেন।
এভাবে মানব সমাজের প্রতি আল্লাহর সর্বশেষ দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর শিক্ষা ছিল এই যে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষের উচিত যুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা এবং সকল প্রকার অপব্যায় ও উগ্রতা পরিহার করা। একইভাবে মানুষ যাতে নিজিকে গর্ব অহংকারের ফাঁদে আটকে না ফেলে, সেইসাথে রুটি-রুযি যেন নিজস্ব চেষ্টায় এবং সঠিক পন্থায় অর্থাৎ হালাল উপায়ে উপার্জিত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন-রুটি রুজির ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের জন্যে হালাল এবং হারামের বিধান দিয়ে দিয়েছেন,ফলে যারাই হারাম বা অপছন্দনীয় বস্তুগুলোকে পরিহার করে, তারা মূলতঃ নিজস্ব মর্যাদা ও ধর্মকেই হেফাজত করেছে।
ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আপনারা যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, সপ্তম হিজরীতে কুরাইশ প্রতিনিধিবৃন্দ এবং রাসূলে খোদার মাঝে হুদাইবিয়া নামক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই শর্তে যে, কোনো পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়াবে না। চুক্তিপত্র অনুযায়ী না মুসলমানরা কুরাইশ বা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালাবে, না কুরাইশরা মুসলমান বা তাদের স্বজনদের ওপর আক্রমণ করবে । কিন্তু কুরাইশরা এই চুক্তি লঙ্ঘন করে। তারা তাদের মিত্র একটি গোত্রকে মুসলমানদের ওপর হামলা করতে লেলিয়ে দেয়। তাদের হামলায় বিশজন নিহত হয়েছিলো। অবশ্য একাজের জন্যে কুরাইশরা ঐ গোত্রটিকে প্রচুর টাকা-পয়সা দিয়েছিলো। কাপুরুষোচিত এই হামলার পর রাসূল (সা.) তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মক্কায় চলে যান।
ইসলামের সিপাহীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে,পতাকা উড়িয়ে মক্কার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলে খোদা (সা.) সূরায়ে ফাত্হ তেলাওয়াৎ করছিলেন। তেলাওয়াত করতে করতে সোজা মাসজিদুল হারাম তাওয়াফ করলেন। কুরাইশ জনগণ এবং মক্কার উদ্ধত নেতারাও ভীত ও কম্পমান হৃদয়ে সারিবদ্ধ হলো এবং তাদের ভাগ্যে যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা জানার অপেক্ষায় ছিল। এই লোকেরা অতীতে বহু অপরাধ করেছিল। রাসূলে পাক (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের ওপর অনেক অত্যাচার করেছিল। যুদ্ধের আগুন জ্বালানো, ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি, খুন-খারাবি করা প্রভৃতি কাজে তারা লিপ্ত ছিল। সেজন্যে তারা নিজেরাও জানতো যে, নবী করিম (সা.) যদি তাদের অত্যাচারের কঠিন প্রতিশোধও নেন,তাহলেও তা অন্যায় কিছু হবে না। তারা যখন এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করছিলো, তখন রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর সাহাবীদের বললেন ঘোষণা দিতে যে, যারা ঘরের ভেতরে আছে,তারা যেন হয় মসজিদে না হয় আবু সুফিয়ানের বাসায় যায়। তারা সবাই নিরাপদ। দয়ার নবী যখন কুরাইশদের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখলেন, তখন তাদের বললেন, "তোমাদের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন,তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল। তোমরা যাও ! তোমাদেরকে মুক্ত করে দিলাম!"
মক্কা বিজয়ের ঘটনায় এই শহরের প্রায় দুই হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করে। অথচ রাসূল (সা) এদের কাউকেই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেন নি। আসলে মক্কা বিজয়ের ঘটনায় সমগ্র আরবে ইসলাম বিকাশের ধারা বেগবান হয়েছিল। রক্তপাতহীন এই বিজয় ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শ্রেষ্ঠত্বেরই প্রমাণ। বর্তমান বিশ্বে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইসলাম অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী একটি ধর্ম হিসেবে শান্তিও রহমত এবং সহিংসতা বিরোধী বার্তা প্রচার করছে। নবীজীর কর্মপদ্ধতি বিশেষ করে মক্কা বিজয়ের ক্ষেত্রে তাঁর যে কর্মতৎপরতা, তা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারণাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অত্যন্ত কৌশলের সাথে এবং সুন্দর বাচনভঙ্গির মাধ্যমে জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। রাসূলে মাকবুলের সৈন্য-সামন্ত এবং অধিনায়কগণও এই আদর্শেরই অনুসারী ছিলেন। তবে খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যাঁকে রাসূল (সা.) বনী জাজিমা গোত্রের লোকজনকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শ বা পদ্ধতি অনুসরণ না করে তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে কয়েকজন যুদ্ধবন্দিকেও হত্যা করে। রাসূল (সা ) এই ঘটনা জানতে পেরে খালেদের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি আলী (আ) কে ঐ গোত্রে পাঠালেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং নিহতদের রক্তমূল্য দেওয়ার জন্যে।
মানবেতিহাসের প্রাচীন দিনগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো যে, মানুষের মাঝে বিভিন্ন রূপে এবং ব্যাপকভাবেই মত-পার্থক্য বিরাজমান ছিল। এই মতপার্থক্য উত্থিত হিংসা-বিদ্বেষের কারণে সমাজের সুস্থতার জন্যে অনিবার্য শান্তি ও নীরবতা বিঘ্নিত হয় এবং সুবিধাবাদী ও স্বার্থান্বেষী মহল এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অন্যদের ওপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উচ্চাভিলাষী এবং জনগণের ওপর অত্যাচারকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং জিহাদের বিধান দিয়ে বলেছেন : "তোমাদের সাথে যারা অন্যায়ভাবে যুদ্ধ করতে চায় তাদের সাথে তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো, তবে সীমালঙ্ঘন করো না। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।" ( সূরা বাকারা : ১৯০ )
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যে যুদ্ধ করেছেন তা ছিল একদিকে নির্যাতিত ও মজলুম অসহায়দের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার, অপরদিকে পুঁজিপতিদের করালগ্রাস থেকে অত্যাচারিতদের রক্ষা করার উপায় এবং সমাজে নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার মাধ্যম। হিজরতের প্রথম দশ বছরে যেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল আত্মরক্ষামূলক। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উযমা খামেনেয়ী এ সম্পর্কে বলেছেন : ‘রাসূলে খোদার সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক, এর মানে এই নয় যে, রাসূল (সা.) সকল যুদ্ধেই তাঁর ওপর হামলার অপেক্ষায় বসেছিলেন। নবী করীম (সা.) যদি সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ না করতেন এবং শত্রুদের মোকাবেলায় তাঁর সকল শক্তি-সামর্থকে কাজে লাগিয়ে খোদার দুশমনদের ভীত সন্ত্রন্ত না করতেন, তাহলে ইসলামের শত্রুরা সেদিনই ইসলাম, কোরআন এবং ইসলামী সমাজকে ভেঙ্গে-চুরে গুঁড়িয়ে দিতো। সেজন্যেই রাসূল (সা.) যুদ্ধ করতে এবং যুদ্ধের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে বাধ্য হয়েছিলেন।'
যুদ্ধ যাবার আগে রাসূল (সা.) তাঁর লোকজনকে উপদেশ দিয়ে বলতেন : নারী ও শিশুদের ব্যাপারে তারা যেন সদয় হয় আর শত্রুসৈন্যদের সাথে যৌবনদীপ্ত অর্থাৎ সাহসিকতাপূর্ণ আচরণ করে। শত্রুদের খাদ্য এবং পানি সরবরাহে যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা না হয়। কেউ যদি আত্মসমর্পন করে তাকে যেন বরণ করা হয়। ঘোরতর যুদ্ধের মাঝেও যদি কেউ ইসলাম গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়,তাকে যেন বিশ্বাস করা হয় এবং তার ঈমান আনার বিষয়টিকেও যেন মেনে নেওয়া হয়। রাসূলের এই মানবিকতাপূর্ণ ও সদয় আদর্শগুলোই প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন সকল প্রকার প্রতিহিংসা ও সহিংসতার উর্ধ্বে। আনাস ইবনে মালেক বলেন :
"খায়বার যুদ্ধের সময় রাসূলে খোদা রাতে রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন। তিনি কখনোই শত্রুদের ওপর অতর্কিতভাবে নৈশহামলা চালান নি। পরদিন সকালে ইহুদিরা ফলের ঝুড়ি আর বেলচা নিয়ে তাদের দূর্গ থেকে বেরিয়ে এসে যখন জানতে পারলো যে ইসলামের নবী রাতে সেখানে ছিলেন,অথচ হামলা করেন নি, তখন তারা বলে উঠলো এটা নিঃসন্দেহে নবীসুলভ আচরণ।"
আসলে যেসব কাফের রাসূলের কাছে যেত এবং রাসূলের পূত-পবিত্র চেহারা খুব কাছ থেকে দেখতে পেত, তারা রাসূলের ভালোবাসা ও হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহারে তখন লজ্জিত হত। রাসূল (সা.) তাঁর বিনীত ও সৌহার্দপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণের অন্তর জয় করে নিতেন। তিনি এই ভদ্র আচরণের মাধ্যমে জনগণের মাঝ থেকে এমন একটি ঐক্যবদ্ধ দল গঠন করে দিতেন,যারা যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলায় বিজয় ছিনিয়ে আনতেন। এছাড়া তাঁর আচার-ব্যবহারগত সৌন্দর্যের কারণেও বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে।
অবশেষে যুদ্ধ-সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে যায়। বিভিন্ন জাতির জন্যে সেইসব অভিজ্ঞতা এখন দৃষ্টান-মূলক ও শিক্ষণীয় ঘটনা আর সমগ্র মানবতার জন্যে তা পথ-নির্দেশক। ইসলামী সভ্যতা সোনালী দিনের সেই বীরত্ব,রাসূলের দয়া ও ক্ষমাশীলতা এবং যুদ্ধের ময়দানে পর্যন্ত তাঁর সদাচারের স্মৃতির কথা বিভিন্ন প্রজন্মের সামনে প্রতিভাত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বেও যুদ্ধের লেলিহান শিখা, হত্যা-লুণ্ঠন এবং স্বৈরাচারী শাসকদের উল্লম্ফন চলছে। এটা নিশ্চিত যে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার চলছে, ভবিষ্যতে তার বিচার অবশ্যই হবে। সেদিন নবীজীর আদর্শের সেই আলো, তাঁর সেই দয়া ও ভালোবাসার মহিমা কালোত্তীর্ণ উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করবে।
ইসলামের দাওয়াতি কাজের প্রাথমিক দিকে রাসূল (সা.) যেসব কর্মসূচি পালন করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ছিল জাহেলি সমাজে বিদ্যমান মূল্যবোধগুলোর মূলোচ্ছেদ করা। মক্কা শহরে অভিজাতদের একটি দল বাণিজ্য কাফেলাগুলোর মালামাল লুট করে এবং তাদের কাছ থেকে বড়ো অঙ্কের টাকা আদায় করে প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হয়েছিল। অন্য দলটি ছিল গরীব অর্থাৎ সম্পদহীন, এরা ন্যুনতম সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল। এই দুই দলের মধ্যে একটা মধ্যশ্রেণীও রয়েছে। অর্থনৈতিক অসঙ্গতির কারণে জনগণের একটা বিরাট অংশ সমাজে বঞ্চিত ছিল। এই শ্রেণীবৈষম্য সামাজিক একটা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। সমাজে ইথিওপিয় কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো মূল্যই ছিল না। তারা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। জাহেলি সমাজে উপজাতিরা কিংবা দাস-দাসীরা তাদের মনিবদের অনুমতি ছাড়া সামজিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। এমনকি ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারেও তাদের কোনোরকম স্বাধীনতা ছিল না।
এরকম এক পরিস্থিতিতে রাসূলে খোদা তৌহিদ বা একত্ববাদী আদর্শ,ন্যায়কামিতা, মানুষের সমান অধিকার প্রভৃতি সুস্পষ্ট বার্তা নিয়ে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে তৎপর হন। তাঁর এই তৎপরতার ফলে জাহেলি যুগের সকল মূল্যবোধ যেমন বর্ণবাদ, গোত্রপ্রীতি মানুষের কাছে ঘৃণ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সে সময় দুর্বল ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠি বিস্মৃতদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। সমাজে তাদের কোনো স্থান বা অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু নবী করীম (সা.) মানুষের সামনে নতুন এক আদর্শ তুলে ধরেন। জাহেলিয়াতের যুগে বিভিন্ন সমাজে অর্থবিত্ত, বস্তুগত শক্তি-সামর্থ এবং বিভিন্ন গোত্রগত মাপকাঠির ভিত্তিতে যেভাবে মানুষকে মূল্যায়ন করা হত রাসূলের আদর্শে সেইসব ভ্রান্ত মাপকাঠি অনুযায়ী মানুষকে মূল্যায়ন করা হত না। বরং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষই সমানভাবে মূল্যায়িত হত। ইসলামে সকল মানুষই মুক্ত এবং সকলেরই অধিকার আছে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করার। মানুষের সম্মানের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং পার্থিব সম্পদের তুলনায় মানুষকে অনেক বেশি মূল্যবান,সম্মানীয় ও মর্যাদার অধিকারী হিসেবে মূল্যায়ন করা নিঃসন্দেহে ইসলাম এবং নবীজীর জন্যে মর্যাদার একটি বিষয়।
ইসলামী সংস্কৃতিতে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, নবী-রাসূলগণ সবসময় সমাজের আশরাফখ্যাত তথাকথিত সম্পদশালী ও জাহেলদের পরিবর্তে দুর্বল ও অসহায় বঞ্চিতদের পাশেই থেকেছেন, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। নবী-রাসূলদের এহেন কর্মপদ্ধতির ফলে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে গিয়ে অসংখ্য গোত্রের লোকজন মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। চিন্তার জগতে নতুন এই যে বিপ্লব সূচিত হলো, এরফলে নতুন এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার পথ সুগম হলো যেই সমাজে ছিল না কোনোরকম বৈষম্য। তাকওয়া এবং দ্বীনদারীকেই সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে মনে করা হত। এক হাদীসে নবীজী বলেছেন ‘ তোমরা সকলেই মানুষ। আর মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। তাকওয়া ব্যতিত আজম বা অনারবদের ওপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
সেদিনের সেই ন্যায়নীতিহীন নির্দয় সমাজের সামনে রাসূলের এই বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। রাসূলে খোদা মক্কায় দাওয়াতি কাজের সূচনালগ্নে দুর্বল অসহায়দের সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, অতি দ্রুতই তারা কায়সার ও কেসরার হুকুমাতের উত্তরাধিকারী হবে। রাসূলের বন্ধুত্বসুলভ আচার-ব্যবহার ও আন্তরিকতা বঞ্চিত জনগোষ্ঠির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ কারণে তারা ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়। রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন : ‘পৃথিবীর বুকে আমি ভৃত্য এবং গরীব শ্রেণীর সাথে একত্রে বসে আহার করার অভ্যাস কখনোই পরিত্যাগ করবো না।' আল্লাহর রাসূলের এইসব বক্তব্য আর আচার-ব্যবহারের ফলে নিরীহ-বঞ্চিতরা পুনরায় তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। সেই জাহেলি সমাজেও তারা যেন তাদের প্রকৃত অবস্থান খুঁজে পায়।
ভাতৃত্ব ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা.):
ইতিহাসে লক্ষ্য করা যায় যে,নবীজী কখনোই ধনী-গরীবের মাঝে কোনোরকম ভেদাভেদ বা পার্থক্য রয়েছে বলে মনে করতেন না। বাস্তবেও জনগণ তাঁর এই ন্যায়নীতি ও শ্রেণীবৈষম্যহীনতার আস্বাদন লাভ করেছে। রহমতের নবীর এই বৈষম্যহীন ও সাম্যচিন্তা এমনকি তাঁর দৃষ্টিতেও পরিলক্ষিত হত। তিনি তাঁর সাহাবী বা সঙ্গীসাথীদের দিকে তাকানোর ক্ষেত্রেও এই সাম্য বজায় রাখতেন। এরকম প্রতিটি ছোটখাটো ঘটনাই নির্মীয়মান নতুন একটি সমাজে মানবিক সাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিল। বংশীয় পরিচয়কে যারা গর্ব-অহংকারের মাপকাঠি বলে মনে করতো,তাদের ব্যাপারে রাসূল (সা.) সময়মতো যেসব সতর্কতা বা সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, সেসব ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। একদিন হযরত সালমান ফারসি মসজিদে নববীতে বসে ছিলেন। সাহাবীদের আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সে সময় বংশীয় পরিচয় নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। তো সবাই নিজ নিজ বংশ পরিচয় নিয়ে কিছু না কিছু বললো। যখন সালমানের পরিচয় প্রদানের পালা এলো, তখন সালমান বললো : ‘আমি সালমান, খোদার বান্দা, যে বিপথগামীকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুহাম্মাদ (সা.) এর ওসিলায় সঠিকপথে পরিচালিত করেছেন।'
কিছুক্ষণ পর রাসূলে খোদা মসজিদে এলেন এবং সালমান যা বলেছিলেন সে ব্যাপারে অবহিত হলেন। রাসূল কুরাইশ বংশীয়দের ঐ সমাবেশের দিকে ফিরে বললেন, ‘হে কুরাইশবাসী ! মনে রেখ, কারো মর্যাদার বিষয়টি নির্ভর করে তার দ্বীন বা ধর্ম, তার চরিত্র ও সাহসিকতা এবং তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মৌলিকত্বের ওপর।' অবশ্য অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূল বলেছিলেন, ‘যারা তাদের বংশ বা গোত্র নিয়ে অহংকার করে, তাদের পরিহার কর !'
বঞ্চিতদের সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের ঘটনা বিভিন্ন গোত্র এবং সমপ্রদায়ের গোঁড়ামি দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। জাহেলি সমাজে বঞ্চিত জনগোষ্ঠি সাধারণত দাস-দাসী হিসেবেই ছিল। সমাজে তখন যারা কর্তৃত্ব করতো তাদের আদেশ অনুযায়ী এই দাস বা দাসীদেরকে কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়ই পৃষ্ঠপোষকতা বা সাহায্য-সহযোগিতা করতো না। রাসূল (সা.) কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলমানদের প্রতি দাস-দাসীদের মুক্ত দেওয়ার আহ্বান জানালেন। কেবল আহ্বানই জানালেন না,বরং দাসমুক্ত করাকে ঈমানী দায়িত্ব বলে ঘোষণা করলেন। দুর্বলদের অধিকার রক্ষায় রাসূলের বিশেষ দৃষ্টি এতোদূর পর্যন্ত বিসতৃত ছিল যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দাস যায়েদ বিন হারেসা ইসলামী সেনা অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। একইভাবে একজন অনারব সালমান ফারসিকে রাসূল সম্মানিত করেছিলেন এবং সালমান ঈমানের এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলেন যে, রাসূল তাঁকে তাঁর আহলে বাইতের অন্তর্ভূক্ত বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে বেলাল ছিলেন ইথিওপীয় এক কৃষ্ণাঙ্গ, এই বেলালই হয়েছিলেন রাসূলের বিশেষ মুযাযযিন। এই বেলালের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ স্মরণীয়। আমরা তা সংক্ষেপে তুলে ধরবার চেষ্টা করছি।
বেলাল ছিলেন যথেষ্ট পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু এক হাবশি বা ইথিওপীয় কৃষ্ণাঙ্গ দাস। নিজের এবং অন্যান্য দাসদের তিক্ততাপূর্ণ জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। তাই সবসময়ই তিনি দাসদের কষ্ট নিয়ে ভাবতেন। যদিও তিনি কিছুই করতে পারেন নি,তারপরও আশায় বুক বাঁধতেন এই চিন্তা করে যে, একদিন নিশ্চয়ই এই জুলুমের বেসাতির নিরসন ঘটবে। বেলাল যখন রাসূলের তৌহিদী দাওয়াতের ব্যাপারে অবহিত হলেন,তখন অনেক কষ্ট করে নবীজীর কাছে গেলেন এবং হৃদয়মন সঁপে দিয়ে অর্থাৎ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে রাসূলে খোদার বক্তব্য শুনলেন। রাসূল বললেনঃ ‘আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান চাই না। দুনিয়া এবং আখেরাতের সকল শুভ ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার মধ্যে। আমরা সবাই আল্লাহর বান্দা। কেউ কারো চেয়ে বড়ো নয়, তবে হ্যাঁ, যদি তাকওয়া থাকে।'
নবীজীর কথাবার্তা বেলালের মনোপুত হলো, সেসব কথা তাঁর অন্তরে গেঁথে গেল। কালের অত্যাচারে মর্মাহত ও ক্লান্ত ছিলেন বেলাল। তাই মানসিক উপশমের জন্যে সবসময় একটা নিশ্চিত আশ্রয়স্থলের অন্বেষায় ছিলেন। এখন মনে হলো যেন বেলাল তাঁর হারানো সম্পদ ফিরে পেলেন। জুলুমের অবসান হতে পারে এমন একটা আশার ক্ষীণ আলো তাঁর হৃদয়ে জেগে উঠলো। বেলাল নবীজীকে বললেন : ‘ হে আল্লাহর রাসূল ! আমি একজন দাস বৈ ত নই। আপনার কথাগুলো আমার অন্তরকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছে। আপনার কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আল্লাহ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা বা প্রতিপালক নেই এবং আপনি তাঁরই প্রেরিত রাসূল।'
রাসূল যখন বেলালের কৃষ্ণ চেহারার ওপর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু দেখতে পেলেন, তার হাতে মৃদু চাপ দিলেন এবং তাকে ইসলামে বরণ করে নিলেন। বেলালের স্পন্দিত মন চাচ্ছিলো না রাসূলে খোদার মুক্তির তরী থেকে দূরে থাকতে। ইসলাম গ্রহণের কারণে বেলালকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। উমাইয়া যখন বেলালের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনতে পেয়ে বেলালের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন শুরু করে দিল। কিন্তু বেলাল উমাইয়ার এহেন অত্যাচারের জবাবে বললেন : ‘ আমি তোমার দাস, তাই আমার দেহটা তোমার এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু আমার অন্তর এবং আমার বিশ্বাসের বিষয়টি একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমি মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান আনা থেকে বিরত হবো না। তাঁর বাণী সত্যবাণী,তাঁর ঐসব সত্যবাণী আমার অন্তরকে প্রশান্তি দেয়। যারই জাগ্রত অন্তর রয়েছে সে-ই আমার মতো তাঁর প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য।'
বেলাল অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বেশ কয়েক বছর রাসূল ও ইসলামের খেদমতে কাটান। তিনি একজন মুক্ত দাস হয়েও আল্লাহর ঘর কাবার ছাদে দাঁড়াবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন এবং ইসলামের মুয়াযযিন হবার মতো অনন্য গৌরব অর্জন করেছিলেন।
জাহেলিয়াতের ভিত্তিমূল উপড়ে ফেলার ক্ষেত্রে রাসূলের আরো যে পদক্ষেপ ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল তাহলো ভ্রাতৃত্বসুলভ বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন। মদীনায় সর্বপ্রথম এ ধরনের চুক্তি করেছিলেন তিনি। এই চুক্তি মুসলমানদের মাঝে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং সেইসাথে গোত্রীয় বা সামপ্রদায়িক গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। রাসূল মক্কার প্রত্যেক মুহাজির এবং মদীনার প্রতিটি মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করেন। এগুলো,একটা নতুন সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তারি প্রমাণ। আর আল্লাহর ওপর ঈমানের ভিত্তিই ছিল এই নতুন সামাজিক বন্ধনটির মানদণ্ড। এভাবে মুসলমানরা তাদের নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতাপূর্ণ একটা দৃঢ় ও মজবুত সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। রাসূল (সা.) জনগণের মাঝে এই দৃঢ় সম্পর্কের ভিত গড়ে তোলার জন্যে তৎকালীন গোত্রীয় সকল বন্ধনের মতো যেগুলো বাঞ্ছিত বা ইসলাম সমর্থিত ছিল সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন এবং একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করেছেন।
‘সকল মহিমা তাঁর যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলা মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন,আমরা আমাদের কিছু নিদর্শন তাঁকে দেখানোর জন্যে যার পরিবেশ মঙ্গলময় করেছিলাম। নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছুই শোনেন এবং দেখেন।'
মে'রাজ গমণ :
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো তাঁর রাত্রিকালীন উর্ধ্বলোক ভ্রমণ। মক্কায় রাসূলের নবুয়্যতের প্রথম দিকে মুশরিকরা যখন নবুয়্যতির দাবিকে মিথ্যা বলে গণ্য করে তাঁর চরম বিরোধিতা করছিল, ঠিক সে সময়ই উর্ধ্বলোক ভ্রমণের ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘটনাটি রাসূলে আকরাম (সা.) এর জীবনেতিহাসে অলৌকিক বা বিস্ময়কর মোজেযা হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
রাত প্রায় শেষের দিকে। সুবহি সাদিক বা শুভ্র সকাল ঘনিয়ে আসছিল। রাসূলে খোদা আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানির কাছে ওজুর পানি চাইলেন। ওজু করে তিনি ফযরের নামায পড়লেন। তারপর সেই রাতে সংঘটিত মহান ঘটনাটি উম্মে হানিকে জানাবার জন্যে ডেকে পাঠালেন। এই বিস্ময়কর এবং অস্বাভাবিক ঘটনাটির জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাকে নির্বাচন করেছেন।
রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন-"হে উম্মে হানি ! তুমি তো দেখেছো যে আমি এশার নামায এখানে পড়েছি। তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিব্রাঈলকে দিয়ে আমাকে বায়তুল মোকাদ্দাসে নিয়ে গেছে। আমি বায়তুল মোকাদ্দাসে নামায পড়েছি, আবার যেমনটি দেখেছো আমি এখানেই ফযরের নামায পড়লাম।"
উম্মে হানি রাসূলের ওপর আন-রিকভাবে ঈমান এনেছিলেন। তাই নবীজীর বক্তব্যের সত্যতার ব্যাপারে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কিন্তু তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন এই আশঙ্কায় যে, এই ঘটনাকে কুরাইশরা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে পারে। রাসুলে খোদা যখন মুশরিকদের লক্ষ্য করে বললেন যে, রাতের বেলা তিনি মসজিদুল আকসা ভ্রমণ করেছেন তখন তাদের মাঝে একটা গুঞ্জনের সৃষ্টি হলো। মাতাম ইবনে আদ্দি বললো-আপনি মিথ্যা বলছেন। কীভাবে আপনি দুইমাসের পথ একরাতেই অতিক্রম করলেন ? আপনার এই নৈশভ্রমণের প্রমাণ কী ?
রাসূলে খোদা তখন একটা কাফেলার কথা বললেন, যেই কাফেলাটিকে তিনি পথে দেখেছিলেন। ঐ কাফেলা সম্পর্কে তিনি বললেন যে, তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল,তিনি হারানো উটটি পেয়ে তাদেরকে জানিয়েছিলেন। একইভাবে একটি কাফেলার লোক যে তার নিজের পানির পাত্রকে একপাশে ঢেকে রেখেছিল তাও জানালেন। রাসূল আরো বললেন যে,একটা কাফেলাকে মক্কার দিকে আসতে দেখেছি। কাফেলার সম্মুখভাগে ছিল একটা ধূসর রঙের উট। সূর্য ওঠার সময় কাফেলাটি মক্কায় পৌঁছবে। মানুষ তখন দিক-বিদিকে ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। শহরের বাইরে তারা ঐ কাফেলাটির আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে। সূর্য ওঠার পর ঐ কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাটি এসে পৌঁছে। একজন চিৎকার করে বলে ওঠে : এই কাফেলাটির মাঝে সেইসব চিহ্ণ বা নিদর্শনাদি রয়েছে, মুহাম্মাদ যাদের ব্যাপারে বলেছে। কিন্তু কুরাইশ মুশরিকরা সুস্পষ্ট সেইসব নিদর্শন দেখা সত্ত্বেও তারা তাদের ঔদ্ধত্য বা নাফরমানী থেকে বিরত থাকে নি।
ইসলামের নবীর মে'রাজ এমন একটা আধাত্মিক ভ্রমণ, যে ভ্রমণটির কথা কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে এবং কোরআন ঐ ঘটনাটিকে যথার্থ বলে অনুমোদন করেছে। কোরআনে বলা হয়েছে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সৃষ্টিজগতের বিচিত্র নিদর্শন রাসূলকে দেখানো, যাতে তিনি নিজে এগুলোকে দেখে-শুনে উপলব্ধি করে বিশ্বমানবতাকে মুক্তি ও সুখ-সমৃদ্ধির পথ দেখাতে পারেন। পবিত্র কোরআনের সূরা নাজমেও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অত্যন্ত কৌশলে ও দক্ষতার সাথে নবীজীর সত্যতার বিষয়টি অনুমোদন করে বলেছেন-অস্তগামী নক্ষত্রের শপথ ! তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্তও নয়, বিপথগামীও নয়,এবং সে মনগড়া কথাও বলে না।.....সে যা দেখেছে, তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে?
রাসূলের বংশধর ইমাম কাজেম (আ.) কে এক লোক জিজ্ঞেস করেছিল যে, নবীজীকে কেন ঐ ভ্রমণে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁর সাথে কেন কথা বলা হয়েছে? উত্তরে ইমাম কাজেম (আ.) বললেনঃ
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্থান এবং কালের উর্ধ্বে। কিন্তু তিনি ইচ্ছা করলেন যে ফেরেশ্তাগণ এবং আকাশগুলোর অধিবাসীদেরকে তাঁর রাসূলের মাধ্যমে সম্মানিত করবেন, এবং তাঁর সাক্ষাতে এনে নবীজীকে সম্মানিত করবেন,সেইসাথে তাঁর মহত্ব ও বিশালত্বও নবীকে দেখাবেন যাতে তিনি ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে গিয়ে সেসব বিষয়ে মানুষকে অবহিত করতে পারেন।'
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মে'রাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জন ছিল। যেমন সৃষ্টি ব্যবস্থার সাথে বাস্তব পরিচয় ঘটেছে তাঁর, পাপীদের শাস্তি এবং পুন্যবানদের পুরস্কার প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি, মুসলিম উম্মাহর জন্যে তিনি সহজ-সরল বিধি-বিধান নিয়ে এসেছেন এবং হযরত আলী (আ.) কে ইমামতের মর্যাদায় স্থলাভিষিক্ত করার বিষয়টিও ছিল রাসূলের মেরাজের অন্যতম উপহার। মেরাজ সফরে নবীজী সাত-সাতটি আসমান অতিক্রম করেছেন। আকাশের প্রতিটি স্তর থেকেই যখন তিনি ওপরের দিকে যাচ্ছিলেন তখন ফেরেশতারা তাঁকে সালাম এবং সুসংবাদ দিচ্ছিলেন। যেসব স্থানে নবী রাসূলগণ উপস্থিত ছিলেন, জিব্রাঈল দুই রাকাত করে নামায আদায় করতে বললেন। অবশেষে এমন এক স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন যেখানটায় কেবল নূরের ঔজ্জ্বল্যে চারদিক আলোকিত ছিল। সেখানে ওহীর ফেরেশতা জিব্রাঈলের প্রবেশ করার অনুমতি ছিল না। জিব্রাঈল বললো, আমি যদি এরচেয়ে বেশি অগ্রসর হই, আল্লাহর নূরের মহিমায় আমার পাখাগুলো পুড়ে যাবে। হে আহমাদ ! সুসংবাদ তোমার জন্যে, এটা তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালকের সম্মাননা বৈ কি! তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করো ! রাসূলে খোদা (সা.) বলেন :
‘আমি আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরি মহিমা ও মর্যাদাময় এলাকা অতিক্রম করেছি এবং আমার সামনে ৭০ টি পর্দা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। রাসূলে খোদা মেরাজে যা কিছু দেখেছেন, তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে-তিনি বেহেশতে পুন্যবানদের উচ্চ সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, এস্রা বা মেরাজের রাতে আমি বেহেশতে প্রবেশ করেছিলাম, সেখানে লাল ইয়াকুত পাথরের তৈরি একটি প্রাসাদ দেখতে পেলাম। তার ঔজ্জ্বল্য এতোই বেশি ছিল যে বাইরে থেকে তার ভেতরটাও দেখতে পাওয়া যাচিছল। জিব্রাঈলকে জিজ্ঞেস করলাম, এই স্থানটি কাদের জন্যে ? জিব্রাঈল বললো,‘যারা পাপশূন্য পবিত্র ও বিশুদ্ধ কথা বলে,যারা অব্যাহতভাবে রোযা রাখে,অসহায়-গরীবদের জন্যে যারা তাদের দস্তরখান বিস্তার করে এবং মানুষজন ঘুমিয়ে পড়লে যারা রাতকে ইবাদাতের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়।'
আধ্যাত্মিক এই সফরে নবীজী আল্লাহর অপর নবী-রাসূলদের সাথেও দেখা করেন। বায়তুল মোকাদ্দাসে হযরত ঈসা (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত ইব্রাহীম (আ.) প্রমুখের মতো নবীদের সমাবেশ, রাসূলে খোদার নবুয়তের ব্যাপারে তাদের সাক্ষ্য প্রদান ও অনুমোদন এবং তাঁর ইমামতিতে অন্যান্য নবীদের নামায আদায় করার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে,ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সম্মান ও মর্যাদা কতো উচ্চে। এই বিষয়টি সেই ইব্রাহীম (আ.) এর যুগ থেকে মুহাম্মাদ (সা.) এর যুগ পর্যন্ত একত্ববাদী বা তৌহিদী চিন্তাগুলোর অভিন্ন সূত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এবং সেইসাথে তৌহিদী এই ধর্মগুলোর মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক যে ঘনিষ্ঠ-তাও প্রমাণ করে।
রাসূল (সা.) এর সাথে যে অন্যান্য নবীদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল, সে বিষয়টি নবীজী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল হযরত আদম (আ.) এর। যেমনটি রাসূলে খোদা বললেন, "কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর সুন্দর দেহী একজন মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম,তিনি ডানদিকে তাকিয়ে খুশি হলেন এবং বাঁদিকে তাকিয়ে দুঃখিত হচ্ছিলেন। ফেরেশতা জিব্রাঈলকে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে ? জিব্রাঈল বললেন : উনি তোমার পিতা আদম। তাঁর বংশধরদের কেউ যখন বেহেশতে যায় তখন তিনি খুশি হন আর যখনি দেখেন যে তাঁর সন্তানদের কেউ দোযখে যাচ্ছে তখন তিনি ব্যথিত হন। হযরত আদমের ওপর দরুদ পাঠালাম। তিনিও জবাব দিলেন এবং দোয়া করলেন। হযরত আদম বললেন, "স্বাগতম হে সুযোগ্য সন্তান, সুযোগ্য নবী এবং যথার্থ সময়ে নিয়োজিত দূত !"
অবশেষে নবীজী যখন আল্লাহর একেবারে কাছাকাছি কোনো স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন আওয়াজ এলো, "হে আহমাদ ! তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার প্রতিপালক। আমার ইবাদত করো এবং আমার ওপর নির্ভরশীল হও ! তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত, তুমি আমার নূর, তুমি জনগণের মাঝে প্রেরিত আমার রাসূল এবং তাদের কাছে আমার হুজ্জাত বা প্রমাণ।"
মেরাজের এই বিস্ময়কর ঘটনা ইসলামের মহান নবীর নজিরবিহীন ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদাকে আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে। মেরাজের ঐতিহাসিক ভ্রমণে যা কিছুই ঘটেছে,তার সবই ছিল আল্লাহর রাসূলের একনিষ্ঠ ইবাদাতের প্রতিবিম্ব অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহেই ঘটেছে সবকিছু। মেরাজের ঘটনা থেকে বলা যায় যে, মানুষের যোগ্যতা ও মর্যাদা অনেক উর্ধ্বে এবং মানুষের পক্ষে উৎকর্ষের উচ্চমার্গে আরোহন করা সম্ভব। ইব্রাহীম (আ.) এর মতো নবীগণও আকাশ এবং যমীনে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু রাসূলে আকরাম (সা.) আল্লাহর এতো বেশি কাছাকাছি স্থানে পৌঁছে যান যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : ‘তখন তিনি দুই ধনুক কিংবা তারচেয়েও কম ব্যবধানে ছিলেন।'
যুগে যুগে নবী রাসূল এসেছেন মানুষকে অজ্ঞতার আঁধার ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্তি দিতে এবং তাদের মধ্যে জ্ঞান ও দিকনির্দেশনার প্রদীপ্ত মশাল জ্বালাতে। অবশ্য তাঁরা নিজ নিজ যুগের পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী মানুষের কাছে ধর্মের শিক্ষা তুলে ধরেছেন। মানবজাতির জন্যে মহান আল্লাহর সর্বশেষ বাণীবাহক ও পথ প্রদর্শক বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদও (সাঃ) যুগউপযোগী পদ্ধতিতে মানুষের কাছে ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন। ইসলামের বাণী মানুষের চিন্তা ও মননে অপ্রতিরোধ্য বা দুনির্বার আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল যেসব কারণে তার মূলে ছিলো রাসূল (সাঃ)'র নিখুঁত ও দক্ষ উপস্থাপনা এবং এসব বাণীর বিবেক-নাড়ানো অমূল্য শিক্ষা।
পবিত্র কোরআনের বাণীতে রয়েছে জ্ঞানের অফুরন্ত ও অমূল্য সম্পদ। এর বাণী যুক্তি, বিবেক ও প্রজ্ঞা-ভিত্তিক এবং একইসাথে তা হৃদয়স্পর্শী ও চিন্তাউদ্দীপক। পবিত্র কোরআনের বাণীর এই বিশেষত্বের কারণে সব সময়ই তা সত্য ও মুক্তিপিয়াসী মানুষকে আকৃষ্ট করে। বিশ্বনবী (সাঃ)ও তাঁর বাণীগুলোকে যুক্তি ও প্রমাণের শক্তিতে এবং পরিমার্জিত ও চিত্তাকর্ষক ভাষায় অত্যন্ত কার্যকরী পন্থায় তুলে ধরতেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও মনমুগ্ধকর ভাষায় মহান আল্লাহর এবাদতের যুক্তি তুলে ধরেছেন। বিশ্বনবী (সাঃ) এমন এক সত্ত্বার বন্দেগী বা দাসত্ব করতে বলেছেন, যিনি আসমান, জমীন ও সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রায়ই বিশ্বজগতে মহানিপুন আল্লাহর নিদর্শণগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। তিনি তুলে ধরেছেন এমন এক আল্লাহর পরিচয় যিনি মহাপ্রজ্ঞাময় ও অসীম করুণাময় এবং সর্বশক্তিমান শিল্পী। আল্লাহ তাঁর মহাসৃষ্টিশীল কলম দিয়ে তুলির নিখুঁত আঁচড়ে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন সুশৃংখলিতভাবে ও অনন্য শৈল্পিক সুষমা দিয়ে। এভাবে মহানবী (সাঃ) মানুষের মনগুলোকে এক আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট করতেন।
সত্যকামীতা, মুক্তির পিপাসা, ন্যায়কামীতা, মানবিকতা এবং সুস্থ সম্পর্ক বিশ্বনবী (সাঃ)'র শাশ্বত বাণীতে ফুটে উঠেছে। আর এ কারণেই মানুষের প্রকৃতি ও চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এসব বাণী লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, হতাশ ও ব্যথিত মানুষের জীর্ণশীর্ণ প্রাণে শক্তির পুণরুজ্জীবন ঘটিয়েছে এবং এসব বাণী মানুষের অন্তরে তুলেছে মুক্তির কলোরোল ও জাগিয়েছে সৌভাগ্যময় সোনালী জীবনের স্বপ্ন। এভাবেই বিশ্বনবী (সাঃ)'র বাণী বিবেকসম্পন্ন মানুষের মর্মমূলে সহজেই সাড়া জাগাতো। এটা স্পষ্ট যে ইসলামের বাণী ও শিক্ষার এসব বৈশিষ্ট্য্ না থাকলে সেগুলো প্রচার করা সহজ হতো না।
রাসূল (সাঃ) টার্গেটকৃত বা উদ্দিষ্ট শ্রোতা, দর্শক বা জনগণের যোগ্যতা বা বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে তাদের কাছে বাণী তুলে ধরতেন। তিনি জনগণের মাঝেই জীবন যাপন করতেন। বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর সমাজের নিয়ম-রীতি, অসঙ্গতি এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের অবস্থা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। অনেকেই ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর দাওয়াতে প্রথম দিকেই সাড়া দিয়েছিলেন, আবার অনেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলাম থেকে দূরে থেকেছেন বা রাসূল (সাঃ)'র সাথে শত্রুতা অব্যাহত রেখেছেন। এ থেকে বোঝা যায় তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রমের পদ্ধতিগুলোতে বৈচিত্র ও সহনশীলতা ছিল। রাসূল (সাঃ) সব শ্রেণীর মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। তিনি নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবক এবং ধনী-গরীব, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবার কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। কখনও কখনও কোনো ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)'র একটি মাত্র বাক্য শুনেই বা একটি মাত্র ইঙ্গিতেই সঠিক পথের দিশা পেয়ে গেছেন।
রাসূল (সাঃ) যখন আহলে কিতাব বা ইহুদি ও খৃষ্টানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন তখন তিনি এই তিন ধর্মের অভিন্ন বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। কখনওবা প্রিয়নবী (সাঃ)'র আকর্ষণীয় মুচকি হাসি অথবা তাঁর বিশেষ অর্থপূর্ণ সম্মোহিনী দৃষ্টি বুদ্ধিমান মানুষের অন্তরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতো এবং তাঁর যাদুমাখা বাক্য মানুষকে মুক্তির স্পষ্ট পথ দেখিয়ে দিত। এ প্রসঙ্গে আমরা ইয়েমেনের বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী আসাদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা তুলে ধরছি। আসাদ মক্কায় কেনা-বেচা করতে আসতেন। একদিন তাঁর ইচ্ছে হলো রাসূল(সাঃ)কে কাছ দেখে দেখার ও জানার যাতে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা তিনি ইয়েমেনবাসীর কাছে তুলে ধরতে পারেন । কিন্তু তাঁর পরিচিত সবাই-ই তাকে এ কাজে নিরুৎসাহিত করলো। এমনকি একজন মুশরিক তাকে বললোঃ আসাদ, যদি কখনও কাবা ঘরের কাছে যাও তাহলে তোমার কান বন্ধ করে রেখো, কারণ মোহাম্মদের যাদুমাখা বাক্য শুনে তুমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাবে। এ কথা শুনে আসাদ ভয় পেলেও রাসূল (সাঃ)কে দেখার ইচ্ছে ত্যাগ করলেন না। তিনি কাবার কাছে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন। কিছুটা ভীতচকিত মনে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন স্বপ্নের মানুষটির কাছে। তিনি যতই রাসূল (সাঃ)'র কাছাকাছি হচ্ছিলেন ততই মুগ্ধ হচ্ছিলেন। কারণ, মহানবী(সাঃ)'র মুচকী হাসি থেকেও তাঁর দয়ার অনন্য মাধুর্য ফুটে উঠতো এবং তাঁর সম্মোহনী দৃষ্টি ও চোখ দুটি থেকে সততার দীপ্তি ছড়াতো। আসাদ খুব মনোযোগ দিয়ে রাসূল(সাঃ)কে দেখছিলেন এবং তাঁর কথাগুলো শুনছিলেন। আসাদ ইসলাম সম্পর্কে মহানবীকে কিছু বলার অনুরোধ করলে রাসূল (সাঃ) আসাদের মানসিক অবস্থা লক্ষ্য করে তাঁকে পবিত্র কোরআনের সূরা আনআমের ১৫১ থেকে ১৫৩ নম্বর শোনালেন-
" হে নবী, আপনি বলুন, এসো, তোমাদের জন্যে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা তোমাদের পড়ে শোনাই। তোমরা কখনও আল্লাহর কোনো অংশীদার বা শরীক করবে না, বাবা মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্রের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করবে না, আমিই তোমাদের ও তাদের জীবিকা দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে বা গোপনে কখনও অশ্লীল আচরণের নিকটবর্তীও হয়ো না। যাকে হত্যা করা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না। আল্লাহ তোমাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা অনুধাবন কর।" কোরআনের এই আয়াতগুলো শুনে আসাদের চেহারা বদলে গেল। আল্লাহর বাণীর সাথে আরো বেশী পরিচিত হবার দুনির্বার আকাঙ্ক্ষায় আপাদমস্তক ব্যাকুল ও বিমুগ্ধ আসাদ যেন ভাষা হারিয়ে ফেললেন। তিনি রাসূল (সাঃ) কথা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করলেন এবং এমন সুন্দর সত্য কথা জীবনে আর কখনও শোনেননি বলে মন্তব্য করলেন। বিশ্বনবী (সাঃ) কোরআনের বাণী থেকে আরো বলে চললেন, আমি কাউকেও তার সাধ্যাতীত ভার অর্পন করি না, আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন স্বজনের বিরুদ্ধে হলেও ন্যায্য বলবে এবং আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা পূর্ণ করবে, এভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। এবং নিশ্চয়ই এটা আমার সরল পথ। সুতরাং এরই অনুসরণ করবে এবং ভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
রাসূলের পবিত্র মুখে উচ্চারিত কোরআনের এসব অমূল্য বাণী আসাদের অন্তরে পরিবর্তন বা বিপ্লবের ঝড় তুললো। অশ্রুসজল আসাদ রাসূল (সাঃ)'র দিকে হাত এগিয়ে দিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
একগুঁয়ে ও কুসংস্করাচ্ছন্ন আরব বা মুশরিকদের বিশ্বাস পরিবর্তন করা ছিল খুব কঠিন কাজ। ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) বলেছেন, কখনও কখনও মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল বিশ্বাসকে পরিবর্তন করার চেয়ে পাহাড় টলিয়ে দেয়া অনেক সহজ। তাই বিশ্বনবী (সাঃ) এই কঠিন কাজে সফল হবার জন্যে অনেক সূক্ষ্ম বিষয়ে লক্ষ্য রাখতেন। রাসূল (সাঃ) সাধারণ মানুষকে এমনকি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকেও সম্মান করতেন। তিনি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিজ বাণী প্রচারের চেষ্টা করতেন এবং অন্যদেরকে নিজ মতামত বা বিশ্বাস তুলে ধরার সুযোগ দিতেন। অজ্ঞ ও মূর্খ শ্রেণীর লোকদের সাথে কথা বলতে গিয়েও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদেরকে কখনও উপহাস করতেন না। বরং উপযুক্ত কোনো সময়ে তাদের ভুল ধারণা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করতেন। মহানবী (সাঃ) সত্য প্রচারের আলোচনার শুরুতেই এমনসব বাণী তুলে ধরতেন যা প্রতিপক্ষ মেনে নিত। বিশেষকরে, ইহুদি-খৃষ্টান বা খোদায়ী কিতাব-প্রাপ্তদের সাথে আলোচনায় তিনি এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।
বিশ্বনবী (সাঃ) ধর্মের বাণীকে ব্যক্তির যোগ্যতা এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী মানুষের কাছে খুব সহজ করে তুলে ধরতেন যাতে তারা খোলা মনে তা গ্রহণ করতে পারে। পূর্ব পরিকল্পনা বা সম্ভাব্য ফলাফলের চিন্তা না করে তিনি ধর্মের বাণী প্রচার করতেন না। রাসূল (সাঃ) তাঁর কাজের মাধ্যমেও ইসলাম ধর্মের শিক্ষা তুলে ধরতেন। ইসলামের যে কোনো শিক্ষা তিনি অন্য সবার আগে নিজের জীবনে ও কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে গেছেন। সুন্দর, বিনয়ী ও নম্র আচরণের কারণে মানুষ রাসূলের (সাঃ) প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতো। মুয়াজ বিন যাবাল (রাঃ)কে ইয়েমেনে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্যে পাঠানোর সময় বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছিলেন, তুমি এখন ইসলাম প্রচার করতে যাচ্ছ, তাই মানুষের সাথে সহনশীল ও নম্র আচরণ করো, তাদের সাথে কঠোর হয়ো না। কারণ কঠোরতার মাধ্যমে কাউকে পথপ্রদর্শন করা যায় না। মানুষকে সুসংবাদ দিবে এবং ইসলামের সুসংবাদগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরবে। সত্যের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলো, কখনও ভয় দেখিয়ে তাদের মুখোমুখি হয়ো না এবং এমন কোনো কাজ করো না যাতে মানুষ বিতৃষ্ণ বা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।