আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) - ৩য় পর্ব
Email
0 বিভিন্ন মতামত
0.0 / 5
প্রবন্ধ ›
আহলে বাইত ›
হযরত মোহাম্মদ (সা.)
প্রকাশিত হয়েছে
2013-12-31 13:26:03
মহান আল্লাহ সূরা আহজাবের ৪৬ নম্বর আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)'কে সিরাজুম মুনীরা বলে অভিহিত করেছেন ৷ সিরাজুম মুনীরা শব্দের অর্থ হলো, আলো বিস্তারী বা আলো বিকিরণকারী প্রদীপ ৷ কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, উজ্জ্বল প্রদীপ যে কোনো স্থানে তার চারপাশে আলো ছড়িয়ে দেয়৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) মসজিদ, ঘর, মহল্লার গলি বা অন্য যেখানেই থাকতেন তাঁর সুন্দর আচার-আচরণ ও উন্নত মানের কাজের মাধ্যমে এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশকে আলোকিত করে তুলতেন৷ ফলে অন্ধকার ও অজ্ঞতার পর্দা দূর হয়ে যেত৷ রাসূল (সা.)'র আলোকোজ্জ্বল চিন্তা ও কর্ম যুগে যুগে চিন্তাবিদদের হৃদয় জয় করেছে এবং সেই একই আলোর ঝর্ণাধারা আজো সমুজ্জ্বল৷ আর এসব-ই সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে বিশ্বনবী (সা.)'র সমস্ত তত্প্রতা, ও কথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তাঁরই সেবায় নিবেদিত ছিল ৷
আধুনিক যুগের অজ্ঞ ব্যক্তিরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)'র আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু দেখা গেছে বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও যুক্তির দিকে মানুষ যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই তারা বিশ্বনবী (সা.)'র প্রতি বেশী শ্রদ্ধাশীল হচ্ছেন৷ রাসূল (সা.)'র আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল দীপ্তি বড় বড় চিন্তাবিদ ও গবেষকদের অভিভুত করছে৷ ইসলাম ধর্ম বিস্তারে বিশ্বনবী (সা.)'র সাফল্যের কিছু কারণ আজ আমরা তুলে ধরবো৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত ও অনুগত বান্দা৷ মহান আল্লাহর সবচেয়ে নিবেদিত-প্রাণ দাস ছিলেন বলেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ আচার-আচরণ, সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাধারা ও সর্বশ্রেষ্ঠ গুণাবলী অর্জন করতে পেরেছেন৷ আর এজন্যেই মুসলমানরা সব সময়ই নামাজে তাশাহুদ পড়ার সময় এ মহাসত্যের স্বীকৃতি দেন যে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) অন্য সব কিছুর আগে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত বান্দা বা দাস৷ আর এরপরই মুসলমানরা নামাজে বলেন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল৷
মহান আল্লাহর প্রতি রাসূল (সা.)'র ভালোবাসা ছিল সবচেয়ে গভীর ও সর্বোচ্চ ৷ মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর এই গভীরতম ভালবাসা ও আস্থায় কখনও বিন্দুমাত্র চিড় ধরে নি৷ ইসলাম যখন আরবের সর্বোচ্চ শক্তিতে পরিণত হয়, তখনও তাঁর খোদাপ্রেম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল সর্বোচ্চ এবং যখন মক্কায় মুসলমানরা ছিল সবচেয়ে নিপীড়িত তখনও তাঁর খোদাপ্রেম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ছিল সর্বোচ্চ৷ সর্বাবস্থায় তিনি আল্লাহকে সর্বোত্তম সহায় ও বন্ধু মনে করতেন৷ মোটকথা প্রিয় নবীজী (সা.) এক মুহূর্তের জন্যেও আল্লাহকে ভুলে থাকতেন না এবং আল্লাহর জন্যে সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন৷ মহান আল্লাহর প্রতি গভীর প্রেমের কারণেই বিশ্বনবী (সা.) রাতের অধিকাংশ সময়ই এবাদত বন্দেগী এবং আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও কাকুতি মিনতিতে কাটিয়ে দিতেন৷ এভাবে তিনি মহান আল্লাহর সাহায্য চাইতেন এবং আল্লাহর নেয়ামতের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন৷ বিশ্বনবী (সা.)'র গভীর ঈমান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে রাসূল তা বিশ্বাস করে৷
বিশ্বনবী (সা.)'র স্ত্রী উম্মে সালমা (সাঃ আঃ) একবার গভীর রাতে জেগে ওঠে দেখেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) এবাদত ও কান্নাকাটিতে মশগুল৷ তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! মহান আল্লাহ আপনাকে এতো ভালোবাসেন, তবুও আপনি কেন এভাবে কাঁদছেন? জবাবে প্রিয় নবী বললেন, আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লে কে আমাকে রক্ষা করবে? রাসূলে খোদা (সা.) আরো বলেছেন, যে আল্লাহ আমাকে এতো নেয়ামত দিলেন, আমি কি সে জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হব না? এভাবে তিনি খোদাপ্রেমের মাধুর্য তুলে ধরেছেন৷ তিনি সাহাবীদের বলতেন, বিপদ-আপদে মুক্তির ওসিলা সম্পর্কে তোমরা কি জানতে চাও? মুক্তির মাধ্যম বা ওসিলা হলো আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কাছে কাকুতি-মিনতি করা৷ এ জন্যেই দেখা গেছে, জিহাদসহ বিভিন্ন সময়ে, দূরদর্শী পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনার পাশাপাশি আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রার্থনার হাত উঁচু করে মহান আল্লাহর মহত্ত্বের ও একত্বের গভীর প্রশংসায় মগ্ন হয়ে তাঁর সাহায্য ভিক্ষা করতেন৷ মহান আল্লাহও তাঁকে কঠিনতম বিপদে সহায়তা করতেন৷
মক্কায় রাসূল (সা.)'র সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর আবুল লাহাব বনী হাশেম বংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন৷ তিনি ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)'র কঠোর শত্রু৷ তার অত্যাচার উত্পীিড়ন সহ্য করতে না পেরে তিনি ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী তায়েফে যান৷ তায়েফের জনগণ তাকে ঠাট্রা-বিদ্রুপ করে এবং পাথর মেরে শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ ব্যথিত নবী শহরের কাছে একটি বাগানে আশ্রয় নেন৷ সেখানে তিনি একটি গাছের নীচে বসে প্রার্থনা করছিলেন, হে দয়ালুদের মধ্যে সর্বোত্তম দয়ালু! তোমার পথে যে কোনো কষ্ট সয়ে নেব, কিন্তু হে মহান প্রতিপালক, তোমার সাহায্য আমার জন্যে বেশী প্রিয়৷ হে আল্লাহ! তোমার কাছেই আশ্রয় চাইছি, তোমার আলো সমস্ত অন্ধকার নিমূর্ল করে৷
বাগানের মালিকরা রাসূলের অবস্থা বুঝতে পেরে অদাস নামের এক খৃষ্টান গোলামের মাধ্যমে তাঁর জন্যে এক ঝুড়ি আঙ্গুর পাঠিয়ে দিল৷ রাসূল (সা.) আঙ্গুর উঠিয়ে মুখের কাছে নেয়ার সময় বলললেন, (ইকো) বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম৷ অর্থাৎ পরম করুনাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি৷ বিস্মিত অদাস বললো, এই শহরের লোকেরা তো এ ধরনের কথা বলে না! আপনি কি লাত ও ওজ্জা নামের মূর্তির নাম নিয়ে কাজ শুরু করেন না? বিশ্বনবী মোস্তফা (সা.) বললেন, সব কিছুর মালিক সেই প্রভু যিনি প্রতিপালক ও দয়ালু৷ বিশ্বনবী প্রশ্ন করলেন, আপনি কোন্ অঞ্চলের অধিবাসী? অদাস বললোঃ আমি নিনেভার অধিবাসী৷ হযরত ইউনুস (আ.) ও ছিলেন ঐ অঞ্চলের অধিবাসী৷ মহানবী (সা.) বললেন, আমার ভাই ইউনুস (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন যেমনিভাবে আমি নিজে আল্লাহর নবী৷ এরপর তিনি হযরত ইউনুস (আ.) পবিত্র কোরআনের আয়াতের কিছু অংশ তেলাওয়াত করেন৷
অদাসকে রাসূল (সা.)'র সাথে কথাবার্তায় মশগুল দেখে বাগান মালিকরা তার ওপর মহানবী (সা.)'র সম্ভাব্য প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হলেন৷ তারা হস্তক্ষেপ করতে চাইলেন৷ কিন্তু ততক্ষণে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)'র বাণী অদাসের অন্তরে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে৷ পরিবর্তিত ও অভিভূত অদাস রাসূল (সা.)কে বললেন, আপনিই তো সেই নবী যাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ হযরত ঈসা (আ.) দিয়ে গেছেন৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে কত যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন তার একটা দৃষ্টান্ত এই ঘটনা থেকে ফুটে উঠেছে৷ ইসলামী আদর্শ প্রচারের জন্যে রাসূল (সা.)'র ত্যাগ ও ধৈর্য ছিল নজীরবিহীন৷ আর এটাই ছিল ইসলাম প্রচারে তাঁর সাফল্যের অন্যতম রহস্য৷ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে চারদিক থেকে শত্রুদের অসহনীয় চাপের মুখে রাসূলের কোনো কোনো সাহাবা শত্রুদের সাথে আপোস করতে রাসূল (সা.)কে পরামর্শ দিতেন৷
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) মক্কায় ১৩ বছর ধরে ইসলাম প্রচারের কারণে যারপরনাই দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন৷ এজন্যেই কয়েক বছর ধরে তাঁকে অর্থনৈতিক অবরোধ সহ্য করতে হয়েছে৷ প্রাণঘাতি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যে মরুভূমিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে৷ তাঁর সাহাবীগণও নির্যাতিত হয়েছেন৷ রাসূলের ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারী 'আসহাবে সুফফা' নামে পরিচিত সাহাবীরা এতই অভাবের মধ্যে ছিলেন যে তাঁরা কখনও কখনও নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ একে অপরকে ধার দিতেন৷ তাঁরা কখনও কখনও একটি মাত্র খেজুর চুষে বিভিন্ন জিহাদে অংশ নিয়েছেন৷ ওহোদের যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে রাসূল (সা.)'র কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল৷ এ দৃশ্য তাঁর অনেক সাহাবীকে ব্যথিত ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট করেছে৷ তখন কোনো কোনো সাহাবী নবী (সা.)কে বলেছেন, হে রাসূল! আপনি শত্রুদের অভিশাপ দিন৷ কিন্তু রহমত ও দয়ার অতুল মহামানব রাসূল(সা.) বললেন, আমি মানুষকে অভিশাপ দিতে আসিনি, আমি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানোর জন্যেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি৷
এরপর তিনি মহান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে বললেন, হে আল্লাহ! আমার জাতিকে হেদায়াত করুন, তারা বুঝতে পারছে না৷
এভাবেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) সত্য প্রচারের ময়দানে সবসময় দৃঢ়চিত্ত ছিলেন এবং কখনও মহুর্তের জন্যেও হতাশ হন নি৷ এভাবেই তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অনগ্রসর সমাজে শ্রেষ্ঠ সভ্যতার পতাকা উঁচু করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা.)কে বলেছেন, তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছো তাতে স্থির বা অটল থাকো এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তারাও স্থির থাকুক৷ আসলে মানুষকে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ পথ দেখানোই ছিল রাসূল (সা.)'র নবুওতি মিশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য৷ মানুষ নিজের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন৷ এ অবস্থায় সঠিক পথে অটল থাকার জন্যে বিশ্বনবী (সা.) মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন৷ এসব নির্দেশনার আলোকে তিনি আদর্শ সমাজও গড়ে তুলেছিলেন৷ তাঁর ঐ সমাজের ভিত্তি ছিল ন্যায়বিচার ও একত্ববাদ৷ আর ন্যায়বিচার ও একত্ববাদ ভিত্তিক ইসলাম ধর্ম কিভাবে প্রচার করতে হয় এবং কিভাবে এ পথে ত্যাগ তীতিক্ষার মাধ্যমে অটল থাকতে হয় তাও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) মানবজাতিকে দেখিয়ে গেছেন৷
সত্যিকার নবী-রাসূলদের চেনার একটা উৎকৃষ্ট উপায় হলো তাঁদের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করা। ইসলামের অগ্রগতির একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণই হলো নবীজীর বন্ধুত্বপূর্ণ বক্তব্য আর তাঁর চারিত্র্যিক অসাধারণ গুণাবলী। পবিত্র কোরআনে রাসূলে খোদার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে ‘খুলুকিন আজীম' বা সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী, মেহেরবান, ‘রাউফ' বা ‘উসওয়াতুন হাসানাহ' অর্থাৎ সবচে সুন্দর আদর্শের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছেন। সূরা আল-ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
"তারপর আল্লাহর করুণার ফলেই তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছিলে। আর যদি তুমি রুক্ষ ও কঠোর-হৃদয় হতে তবে নিঃসন্দেহে তারা তোমার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। অতএব তাদের অপরাধ মার্জনা করো, আর তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর তাদের সঙ্গে কাজেকর্মে পরামর্শ করো। আর যখন সংকল্প গ্রহণ করেছো তখন আল্লাহর ওপর নির্ভর করো। নিঃসন্দেহে আল্লাহ নির্ভরশীলদের ভালোবাসেন।"
এ আয়াত থেকে অনুমান করা যায় যে, চারিত্র্যিক সততা ও মাধুর্য আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ। শক্ত বা কঠিন হৃদয়ের মানুষেরা জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে না কিংবা তাদের হেদায়াত করার ক্ষেত্রে সফলকাম হয় না। মানুষের সাথে সদয় আচরণ করা নেতৃত্বের আসন দৃঢ় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাসূলে কারীম (সা.) মানুষের সাথে বন্ধুত্বকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ বলে মনে করতেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের সাথে যে ব্যক্তির মেলামেশা বেশি, সে-ই সবার চেয়ে বুদ্ধিমান।' নবীজীর দৃষ্টিতে উত্তম চরিত্র হলো এমন একটা পুঁজির মতো, যার কোনো সময় কিংবা স্থানগত সীমাবদ্ধতা নেই। সর্বাবস্থায় অন্যদের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা যায়। রাসূল (সা.) যখন মুশরিকদেরকে সত্য দ্বীন তথা ইসলামের দিকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে বললেন ‘আমি তোমাদের জন্য রহমত হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছি। যে-ই অন্যদের প্রতি সদয় হবে, আল্লাহও তার প্রতি সদয় হবেন।' নবীজী ছিলেন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। মানুষের দুঃখ-কষ্টকে নিজের দুঃখ-কষ্ট বলে মনে করতেন। মানুষের কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন। নবীজীর এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সূরা তাওবার ১২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘এখন তো তোমাদের কাছে একজন রাসূল এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে, তাঁর পক্ষে এটি দুঃসহ যা তোমাদের কষ্ট দেয়, তোমাদের জন্যে তিনি পরম কল্যাণকামী, বিশ্বাসীদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র, বিশেষ কৃপাময়।'
নবীজী সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) এর অত্যন্ত মেধাবী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি বলেন, তাঁকেই দক্ষ ডাক্তার বলা হয়, যিনি সহৃদয় মহানুভবতার সাথে নিজেই রোগীদের কাছে চলে যান। যদিও স্বাভাবিক নিয়ম হলো কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে অসুস্থ বলে মনে করেন, তখন তিনি নিজেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। হযরত আলী (আ.) এ সম্পর্কে বলেন : ‘নবীজী হলেন এমন এক ডাক্তার, যিনি রোগীদের চিকিৎসার জন্যে তাদের খুঁজে বেড়াতেন। তাঁর নিরাময়কামী দাওয়া অন্ধ-বধিরদের সুস্থতার জন্যে ছিল সদাপ্রস্তুত। এখানে অন্ধ বলতে বোঝানো হচ্ছে তাদেরকে যারা সত্যকে উপলব্ধি করতো না, দেখেও না দেখার ভান করতো, আর বধির বলতে বোঝানো হচ্ছে তাদেরকে যারা সত্যের বার্তাকে কানে তুলতো না।'
কোনো সমাজের সাংস্কৃতিক কুসংস্কার, বোধ ও বিশ্বাসগত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কেউ যখন সংস্কারকাজ চালান, তখন তাঁর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে বিচিত্র রকমের অভিযোগ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। এখন সংস্কারক যদি ঐসব অন্যায় অভিযোগের জবাব দিতে যান তাহলে তিনি কঠিন বাধার সম্মুখিন হয়ে পড়বেন। তাই যথার্থ কাজ হলো অশোভন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে সন্ধিচুক্তি স্থাপন করা, অথবা তা এড়িয়ে যাওয়া কিংবা প্রতিপক্ষকে পরিত্যাগ করা। কোরআনেও এ ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে পরামর্শ দিয়েছেন যাতে মুশরিকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও পদক্ষেপ সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো না হয়। মুশরিকরা অনেক সময় নবীজীকে বিরক্ত করার জন্যে মসজিদুল হারামে বসে কোরআনের আয়াতকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের সুরে আবৃত্তি করতো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তখন নবীজীকে বলেছেন তাদের কথায়-কাজে কর্ণপাত না করে তাদেরকে পরিত্যাগ করতে। সূরা আরাফের ১৯৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলের কর্মপন্থা নির্ধারনের তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। এ্যাক, ক্ষমাশীল এবং সদয় হওয়া। দুই, মানুষকে ন্যায়ের পথে আহ্বান জানানো। এবং তিন, অশিক্ষিত মূর্খদের মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করা এবং তাদের আচরণ উপেক্ষা করে চলা।
বলাবাহুল্য, রাসূলের এই কর্মকৌশল বিশেষ করে তাঁর এই নম্রতা ও চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের কারণে বহু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। বিরোধীদের অন্যায় ও অসম্মানজনক আচরণ তিনি এড়িয়ে যেতেন। তবে কেউ যদি আল্লাহর ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করতো কিংবা আল্লাহর বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করতো, তাহলে তিনি ছাড়তেন না। ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোরকম আপোষ বা শৈথিল্য প্রদর্শন করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ন্যায়-নীতির প্রতিষ্ঠাই হলো সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নবীজীবনের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো তাঁর চারিত্র্যিক সারল্য ও আচরণগত সহজতার কারণে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা কিংবা আধ্যাত্মিক মহিমা বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায় নি।
রাসূলে খোদার সাথে জনগণের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর স্বাভাবিক বিনয় ও ভদ্রতা। তাঁর সৌজন্যবোধ এবং বিনয় এতো বেশি ছিল যে তিনি কী ফকির আর কী ধনী-সবার সাথেই তিনি সমানভাবে সদয় ও বিনয়ী আচরণ করতেন। তিনি এমনকি বাচ্চাদের সামনে গিয়ে তাদেরকে সালাম দিতেন। তিনি যে মজলিসেই যেতেন অন্যদেরকে তাঁর সামনে উঠে দাঁড়াতে অনুমতি দিতেন না। তাঁর এই বদান্যতা সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেছেন-"অন্যদের সাথে রাসূলে খোদার ব্যবহার ছিল নম্র, সহাস্য এবং প্রশান্ত। কেউ তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হতো না। নবীজী তিনটি জিনিস ত্যাগ করেছিলেন। এক, কথাবার্তা বলার সময় বিতর্ক বা ঝগড়া করা, দুই, বাচালতা এবং তিন, যে কাজের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই সেকাজে হস্তক্ষেপ করা।"
রাসূলের (সা.) বাস্তব জীবনে তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের হাজার হাজার উদাহরণ দেখতে পাওয়া যাবে। এগুলো যেন তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্য-সাগরের এক-একটি বিন্দু। আলোচনার এ পর্যায়ে তাঁর জীবনের সুন্দর একটি গল্প শোনা যাক।
হিজরী নবম সালে উদ্ধত তেই গোত্র যখন মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পন করলো তখন এই গোত্রের সুপরিচিতদের একজন হাতেম তাঈয়ের পুত্র ওদাই সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার বোন সেফানাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে আসা হয়। একদিন এই সেফানা রাসূলের কাছে আবেদন জানালেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার পিতা হাতেম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার অভিভাবক বলতে এখন আমার ভাই ওদাই। সেও এখন পলাতক। যদি সমীচীন মনে কর, তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও। আমার মহামান্য পিতা দাসদের মুক্ত করতেন, প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নিতেন, বিপদ-আপদে মানুষদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন এবং সুস্পষ্টভাবে সালাম দিতেন।'
নবীজী সেফানাকে বললেন, তুমি তোমার পিতার ব্যাপারে যেসব গুণাবলীর কথা বলেছো, সেগুলো সত্যিকারের মুমিনদের গুণাবলী। তোমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমরা তাঁর ব্যাপারে সদয় হতাম। তারপর তিনি সেফানাকে তার বাবার চারিত্র্যক গুণাবলীর খাতিরে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কেবল তাই নয়, সেফানাকে নতুন জামা-কাপড় দেওয়ার আদেশ দিলেন এবং সিরিয়া পর্যন্ত তার যাতায়াত খরচ তাকে দিয়ে দিতে বললেন। তারপর নবীজী সেফানাকে কয়েকজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন।
ওদাই ইবনে হাতেম বললো-আমার বোনকে দেখলাম যথাযথ মর্যাদার সাথে সিরিয়ায় ফিরে এলো। আমি যেহেতু তাকে একা ফেলে রেখে পালিয়ে এসেছিলাম সেজন্যে সে আমাকে র্ভৎসনা করলো। কয়েকদিন পর আমার ঐ বুদ্ধিমতী বোনটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ লোকটাকে অর্থাৎ ইসলামের নবীকে কেমন দেখেছিস ? সেফানা বললো, খোদার শপথ ! লোকটাকে আমার অসম্ভব মর্যাদাবান বলে মনে হয়েছে। তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাটাই শ্রেয়। তাহলে মনে হবে যেন সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ এক বিশ্বের সাথে তোমার আত্মীয়তা ঘটেছে। ওদাই আরো বলেন, এর কিছুদিন পর মদীনায় গেলাম। পয়গাম্বরকে দেখার কৌতূহল হলো। তিনি মসজিদে ছিলেন। তাঁর কাছে গেলাম। সালাম দিলাম। তিনি প্রশান্তচিত্তে আমার সালামের জবাব দিলেন। পরিচয় দিলাম। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় যাবার পথে এক দরিদ্র বৃদ্ধাকে দেখতে পেলাম। সে কিছু বলতে চাইলো।
নবীজী সেখানে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ালেন, বৃদ্ধার অভাব-অভিযোগের কথা শুনলেন এবং সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তি কিছুতেই বাদশাহ হতে পারে না। কারণ রাজা-বাদশাহদের নিয়ম-কানুন এরকম নয় যে, কোনো মাধ্যম ছাড়াই বা কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই তারা সরাসরি এভাবে কথা বলতে পারবে। রাসূলের ঘরে ঢোকার পর তিনি আমাকে যথাযথ সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানালেন। আমার জন্যে তিনি গালিচা বিছিয়ে দিলেন আর তিনি নিজে বসলেন মাটিতে। তিনি যে সত্যিই নবী ছিলেন, এই আচরণ থেকে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। আমার জীবনের যে বিষয়টি রহস্যের মতো আবৃত ছিল, সে সম্পর্কে যখন তিনি ইঙ্গিত করলেন, তখন বুঝতে পারলাম যে, তিনি গভীর রহস্যজ্ঞানী। এইসব ঘটনা এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের ঐশ্বর্য আমাকে মুহাম্মাদের দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করলো এবং সেখানেই আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।
"কে আহমাদ ?
বিশ্বের নূর, নক্ষত্রের আলোর উত্সত
চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-তারা সকল কিছুই
সেজদাবনত হয়ে আলোকিত তাঁরই আলোয়৷"
সুপ্রিয় পাঠক! এবার আমরা রাসূলের (সা.) স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন সম্পর্কে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো ৷
ফ্রান্সের বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী মিশেল ফুকোর মতে, যুগে যুগে শক্তিশালী ও দক্ষ দলগুলো সবসময়ই অন্যদের সাথে যুদ্ধ করে করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও আত্মপরিচয় অর্জন করেছে৷ তারা অন্যদেরকে অবাঞ্ছিত ও নিন্দনীয় গুণাবলীর সিম্বল বা প্রতীক বলে মনে করতো এবং নিজেদেরকে মনে করতো পরিপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শস্থানীয়৷ ফিলিস্তিনী দার্শনিক এডওয়ার্ড সাইদও ফুকোর দৃষ্টিভঙ্গির মতোই নিজস্ব মতামত দিয়ে বলেছেন রেনেসাঁসের পর পাশ্চাত্য অন্ধকার ও মূর্খতার প্রতীক হিসেবে মনে করে প্রাচ্যকে, আর পক্ষান্তরে নিজেদেরকে মনে করে তার বিপরীত৷ এই বিপরীত পরিচয়ের সুবাদে নিজেরা এক ধরনের পরিচয় অর্জন করে৷
এই চিন্তাবিদদের মতে শক্তিশালী দলগুলো দুর্বলদেরকে অবজ্ঞা করার মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে৷ তবে এই বিষয়টি নবী-রাসূলদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামের নবীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যখন নবুয়্যতি লাভ করেন, তখন তিনি নিজস্ব মর্যাদা ও বড়োত্বের কারণে অন্যদেরকে মোটেই অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টি কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন নি ৷ এ কারণেই তিনি অতি দ্রুত মহান ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷ এটা ছিল রাসূলের গণসংযোগ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা পদ্ধতি৷ তিনি ধনী-গরীব, সাদা-কালো, দুর্বল-সবল নির্বিশেষে সবার সাথেই সমানভাবে মিশতেন এবং সবাইকে সমানভাবে গ্রহণ করতেন ৷ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি সবসময় চেষ্টা করেছেন অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ৷ সেইসাথে প্রাণসঞ্চারী আল্লাহর মহান বার্তা তাদের দেহমনকে যেন উজ্জীবিত করে তোলে, সেই প্রচেষ্টাও চালাতেন৷ এইসব গুণাবলীর কারণেই নবীজী অন্যদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন৷
রাসুলে খোদার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পরিপাট্যও মানুষকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতো৷ বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ সৌন্দর্য পছন্দ করেন৷ নবীজী তাই আল্লাহর চমত্কাটর সব নিয়ামতকে প্রদর্শন করানোর জন্যে মানুষকে বিশ্বের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট করাতে চেয়েছেন৷ তিনি সমাজের পছন্দনীয় একটি ঐতিহ্য 'বাহ্যিক সাজসজ্জা'কে একটা উত্তম গুণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায় বলে মত দিলেন৷ ইসলাম হচ্ছে একটা পরিচ্ছন্নত বা পবিত্রতার ধর্ম৷ এই ধর্ম ইসলামের অনুসারীদের সুসংবাদ দিচ্ছে যে, বেহেশতে যারা যাবে তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷ রাসূল (সা.) পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন৷ তিনি বলেছেনঃ 'যে-কোনোভাবেই হোক, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত৷ কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিচ্ছন্নতার ভিত্তির ওপর ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷'
রাসূলে খোদা (সা.) ছোটোবেলা থেকেই মক্কা শহরের শিশুদের বিপরীতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি ছিলেন৷ তিনি কৈশোর এবং যৌবনে চুলগুলোকে সুন্দরভাবে আঁচড়িয়ে রাখতেন৷ নবুয়্যতি লাভ করার পরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তাঁর সুনাম ছিল৷ জামাকাপড়ে তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন নিয়মিত৷ ঘরের মধ্যে এক বাটি পানিকে তিনি আয়না হিসেবে ব্যবহার করতেন৷ ঐ পানির আয়নাতেই তিনি চেহারা দেখতেন৷ একদিন নবীজীর ঘরে এক ব্যক্তি এলেন তাঁর সাথে দেখা করতে৷ তো যখন নবীজী ঐ দর্শনাথীর্র সাথে দেখা করতে আসবেন তখন তিনি বড়ো একটা পানির পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে চেহারা এবং চুলগুলোকে সুন্দর করে আঁচড়ে নিলেন৷ হযরত আয়েশা (সা.) আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'ঐ লোকটার সাথে দেখা করার জন্যে এভাবে সাজগোজ করলেন কেন?' মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর কথার জবাবে বললেন, 'যখন কোনো মুসলমান তাঁর কোনো ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায়, তখন সেজেগুজে যাওয়াকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পছন্দ করেন৷'
মানুষের প্রতি রাসূলে খোদার যেসব বাণী বা নির্দেশনা ছিল, সেগুলোর সবই ছিল সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের স্বার্থে৷ ইবনে আব্বাস বলেছেন, 'রাসূল (সা.) এমন দৃঢ়তা ও আনন্দের সাথে পথ চলতেন যে, তাঁর মধ্যে কোনোরকম অসুস্থতা বা আলস্য পরিলক্ষিত হতো না৷' তিনি অত্যন্ত সাদামাটা এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, তারপরও যখন সফরে যেতেন তখন চিরুনি, আতর এবং সুরমাদানী সাথে নিয়ে যেতেন৷ প্রতিদিন বেশ কয়েকবার দাঁত মাজতেন৷ অন্যদেরকেও অজু করার আগে দাঁত মাজতে উত্সাযহিত করতেন৷ তিনি বলেছেন, 'জিব্রাঈল (আ.) আমাকে মেসওয়াক করা অর্থাৎ দাঁত মাজার ব্যাপারে এতো বেশি বেশি বলেছেন যে, মনে হয়েছিল মেসওয়াক করাটা হয়তো ওয়াজিবই করে দেওয়া হতে পারে৷' ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, 'রাসূলের একটা মেশ্কদানী ছিল, ওজু করার পরপরই তিনি ঐ মেশ্কদানী হাতে নিতেন এবং সুগন্ধি মাখতেন৷ এ কারণেই তিনি যখন ঘর থেকে বের হতেন সারারাস্তা সুগন্ধিতে মৌ মৌ করতো৷ সুগন্ধির ব্যাপারে নবীজীর আগ্রহ এতোবেশি ছিল যে, ইতিহাসবিদগণ বলেন, তাঁর খাওয়া খরচের চেয়ে আতরের খরচ ছিল বেশি৷'
পোশাক তথা জামা-কাপড়ের পছন্দনীয় ডিজাইনের ব্যাপারে মানুষের চিরন্তন একটা কৌতূহল রয়েছে৷ সেইসাথে জামার রং, কাপড়ের ধরন, এবং কাপড়ের স্টাইল প্রভৃতি দেখে মানুষ পোশাক পছন্দ করে যাতে দেখতে সুন্দর লাগে৷ কিন্তু রাসূলে খোদা (সা.) অত্যন্ত সাদামাটা পোশাক পরতেন৷ যদিও সবসময় নতুন জামা তাঁর গায়ে ছিল না, তারপরও সর্বাবস্থায় সেগুলো ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ তিনি জামা পরার সময় সর্বদাই বলতেন-'আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি আমাকে জামা-কাপড় পরিয়েছেন যাতে আমার সৌন্দর্য রক্ষিত হয়৷'
নবীজীর সঙ্গী-সাথী এবং আশেপাশের লোকজন রাসূলের পূত-পবিত্রতা এবং সুস্থ সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন দেখে ভীষণ উত্ফুাল্ল হতো, উদ্বুদ্ধ হতো ৷ গরমের সময় রাসূলে খোদা (সা.) তাঁর জামাগুলোকে পাতিলের ভেতর গরম পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে ধুয়ে নিতেন ৷ তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকেও বলতেন তারা যেন তাদের জামা-কাপড় পরিষ্কার করে রাখে ৷ রাসূল (সা.) সাদা এবং সবুজ জামা পরতে পছন্দ করতেন ৷ তিনি বলতেন উজ্জ্বল রং দূষণকে সহজেই পরিস্ফুটিত করে৷ নবীজীর দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্নতা হলো একটি মৌলিক বিষয়৷ কেবল ব্যক্তিগত সুস্থতার জন্যেই নয় বরং সামষ্টিক সুস্থতার জন্যেও পরিচ্ছন্নতা খুব জরুরী৷ একদিন নবীজী দেখতে পেলেন এক লোক মসজিদের এক কোণের কিছুটা জায়গা ময়লা করে ফেলেছে ৷ তিনি অনতিবিলম্বে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললেন ৷
রাসূলে খোদা কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথাই বলতেন না, বরং তিনি জনগণকে চেহারার সৌন্দর্যের পাশাপাশি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের কথাও বলতেন ৷ তিনি চাইতেন মানুষ যেন তাকওয়া-পরহেজগারীর সৌন্দর্য দিয়ে নিজেদের ভেতরটা অলংকৃত করে৷ এভাবে তিনি নৈতিকতা ও সামগ্রিক শৃঙ্খলা বিধানের মাধ্যমে মদীনার ছোট্ট একটি সমাজে একটা শৃঙ্খলাবোধ, একটা সৌন্দর্যবোধ চালু করেন৷ নবীজীর একজন বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেছেন, 'আমি নবীজীর চেয়ে দয়ালু, সহযোগী, বীরত্বপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর কোনো ব্যক্তিকে দেখি নি৷'
অমুসলিম চিন্তাবিদরাও নজীরবিহীন এই ব্যক্তিত্বের গুণাবলীগুলো পর্যালোচনা করেছেন৷ ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন ডিউন পোর্ট বলেছেন-পবিত্রতা এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী৷ তিনি যখন কথা বলতে শুরু করতেন, তখন শ্রোতা বা শ্রোতাবৃন্দ তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যেতেন, সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো৷ তাঁর বাচনভঙ্গী, তাঁর মৃদু হাসিমুখ, তাঁর অসম্ভব দুরীদর্শী বক্তব্যে সবাইকে বিমোহিত হয়ে যেত৷ তিনি যেমন চিন্তার দিক থেকে ছিলেন প্রাগ্রসর তেমনি ছিলেন বাস্তব কাজ-কর্মেও শক্তিমত্তার অধিকারী৷
ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক দেইসুনও বলেছেন, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং চারিত্র্যিক সৌন্দর্য এতোটাই দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল যে, তিনি যখন কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, তখন তাঁর ব্যবহার কিংবা নৈতিকতার ব্যাপারে কারো মনেই কোনোরকম প্রশ্ন জাগতো না৷ তিনি যেমন ছিলেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তেমনি ছিলেন সত্ এবং সলাজ৷ কোনো বিষয় যদি তাঁর পছন্দ না হতো, তাহলে তা তাঁর চেহারা মোবারকে ফুটে উঠতো৷ তাঁর সাহাবীগণ নবীজীর চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতেন৷ সবসময় মৃদুহাস্য ছিলেন৷ সেজেগুজে থাকতেন৷ কেউ আমন্ত্রণ জানালে কবুল করতেন, আবার কেউ কোনো কিছু উপহার দিলেও গ্রহণ করতেন৷ সত্যের মানদণ্ডে তিনি সবাইকে সমান চোখে দেখতেন৷
আমরা সবাই জানি যে, বস্তুগত কিংবা সামরিক কোনোধরনের শক্তি ছাড়াই এমনকি রাসূলের নিকটাত্মীয়দের অনেকেরই ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রাথমিক পর্বে ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়েছিল৷ যারাই ইসলাম গ্রহণ করতো তারাই বিচিত্র সমস্যা ও চাপের মুখোমুখি হতো৷ এই চাপের মুখেও দিনের পর দিন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছিল৷ নিঃসন্দেহে এমন কোনো একটা শক্তি ছিল যার ফলে নতুন এই ইসলামী সমাজে প্রাণ ও শক্তির সঞ্চার হয়েছিল এবং ইসলাম দিনের পর দিন বিকাশ লাভ করেছিলো৷ গবেষকগণ এই শক্তি বলতে রাসূলে কারীম (সা.) এর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন৷ সেইসাথে তাঁর নৈতিক চরিত্র, তাঁর নেতৃত্বের গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর পরিচালনাশক্তির প্রভাবকেও ইসলামের বিস্তার ও উন্নয়নের নেপথ্য শক্তি বলে মনে করেন গবেষকমহল৷ তাঁর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো কিংবা তাঁর আচার-ব্যবহার যাঁরা কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাই যে কেবল নবীজীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তাই নয় বরং যাঁরা তাঁদের কাছ থেকে রাসূলের কথা শুনেছেন তাঁরাও বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছেন৷
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর উন্নত রুচিবোধ ও আচার ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধকেই সবার সামনে ফুটিয়ে তুলতেন ৷ তলোয়ারের জোরে যদি ইসলামকে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে সবার আগে সেই কাজটি করতেন স্বয়ং নবীজী (সা.)৷ অথচ তিনি তা না করে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে, সুন্দর ব্যবহার দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন৷ যারা তাঁর সাথে দীর্ঘ বিরোধিতাও করেছেন, তাকেও তিনি নিরাপত্তা দিয়েছেন৷ ইসলামী রাষ্ট্রে সে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করেছেন৷ ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্যে রাসূলের ওপর যেসব যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ইসলামের স্বার্থে মানুষের জন্যে সত্য ও হেদায়াতের পথ সুগম করার স্বার্থে সেসব যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প ছিল না৷ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধি নয়াভারত নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ "একথা জ্ঞাতব্য যে, সামপ্রতিককালে যেই মহান ব্যক্তিত্ব তর্কাতীতভাবে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন, তিনি হলেন মুহাম্মাদ৷ আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, জনগণ তলোয়ারের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করে নি৷ মুহাম্মাদ সাদামাটা জীযনযাপন করতেন৷ তিনি অন্যান্য নবীর মতোই তাকওয়াবান এবং পরহেজগার ছিলেন৷ কঠোর আমানতদার অর্থাৎ বিশ্বস্ত ছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে তিনি নিজেই বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বেশি যেতেন৷ আমি যখন ইসলামের নবীর জীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড পড়লাম, খুব দুঃখ হলো এই ভেবে যে, কেন আমি এই নবীর জীবনী সম্পর্কে আরো বেশি জানতে পারলাম না৷"
সততা এবং সত্য কথা বলাটা নবী ব্যক্তিত্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ৷ এই বৈশিষ্ট্য জনগণকে ইসলামে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷ নবীজী সবসময় লোকজনের সাথে সততার সাথে কথা বলতেন৷ তাঁর ওপর যেসব ওহী নাযিল হতো, সেসব তিনি কোনোরকম পরিবর্তন বা পরিবর্ধন না করে হুবহু লোকজনের সামনে তুলে ধরতেন৷ এছাড়া জনগণের কাছে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাও ছিল শুভ স্মৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ সে কারণেই রাসূলে খোদা যেদিন জনগণকে সুস্পষ্টভাবে ইসলামের দাওয়াত দিলেন সেদিন তাদেরকে নবীব্যক্তিত্বের সেইসব বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন-'হে জনগণ ! তোমরা কি আজ পর্যন্ত আমাকে কোনোরকম মিথ্যা কথা বলতে শুনেছো?' সবাই তখন একবাক্যে বললো যে, তুমি সবসময় সত্যবাদী ছিলে এবং সবসময় সঠিক কাজটিই করেছো ৷ ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, "রাসূলে খোদা সবকিছুকেই সুন্দর ও মহত্ দৃষ্টিতে দেখতেন৷ দৈহিকভাবে তিনি ছিলেন লম্বা ৷ পথচলার সময় অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে চলতেন৷ যখন কোনোকিছু বুঝতে পারতেন, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন ৷ কিন্তু জনগণের দিকে অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে তাকাতেন৷ যার কাছেই যেতেন সালাম দিতেন, সবসময় তিনি জনগণের পথপ্রদর্শক ছিলেন৷ পার্থিব কোনো সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলে তিনি মোটেও রাগান্বিত হতেন না৷ তাঁর কাছে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিল সে-ই, যিনি অন্যদের প্রতি বেশি বেশি সদয় ছিলেন৷ লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর অন্যতম গুণ, ঔদার্য ছিল তাঁর সহজাত প্রকৃতি৷ আল্লাহ তাঁকে পছন্দ করলেন, নির্বাচন করলেন, তারপর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করলেন৷ তাঁকে নবুয়্যতি দান করলেন যাতে তিনি পৃথিবীর বুকে বয়ে আনেন রহমতের বসন্ত৷"
এমন এক পরিস্থিতিতে নবীজীর আবির্ভাব হয়েছিল যখন মানুষের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছিল৷ যেই সময়টায় আত্মগৌরবের লড়াই, মারামারি-হানাহানি, প্রতারণা ও ভণ্ডামি এবং বিচিত্ররকমের বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত ছিল মানুষ, সেইসময় নবীজী সামাজিক এইসব বিশৃঙ্খলা দূরীভূত করবার জন্যে প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেন৷ কিন্তু এই কাজ সহজসাধ্য ছিল না মোটেই৷ স্রোতের বিপরীতে তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে-এটাই ছিল সবচে কষ্টকর৷ এই পরিস্থিতিতে তাঁকে ধৈর্য ধারণ করতে হয়েছে অনেক বেশি, সংযত হতে হয়েছে অনেক বেশি৷ আমরা জানি যে, ধৈর্যই হলো সাফল্যের চাবিকাঠি৷ নিঃসন্দেহে যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে প্রয়োজন ধীর স্থিরভাবে অগ্রসর হওয়া৷ নবীজী মক্কায় তেরোটি বছর বহু অত্যাচার-উত্পীকড়ন সহ্য করেছেন৷ মদীনাতেও দশ বছর বিভিন্ন সমস্যা উত্তীর্ণ করে নতুন একটি সমাজ ব্যবস্থা ইসলামের প্রবর্তন করেন৷ এতোসব চড়াই-উত্রা ইয়ের মধ্যেও যে শক্তি তাঁকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সহযোগিতা করেছে তা হলো তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও উন্নত আধ্যাত্মিক সত্ত্বা৷ দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে নবীজী এতোবেশি আলোকিত হয়েছেন যে, তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের কথা সর্বসাধারণের মুখে মুখে ছিল প্রবাদের মতো৷ তিনি নিজেই বলেছেন-'নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন মুমিনগণ তাঁদের পর্যায়ে উপনীত হন যাঁরা রাতভর ইবাদাতে কাটান আর দিনভর রোযা রাখেন৷'
এ সম্পর্কে আমরা নবীজীবনের আরেকটি গল্প বলবো যেখানে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠবে৷
মদীনায় যায়েদ নামে এক ইহুদি তাঁর নিজের একটা ঘটনা নবীজীকে এভাবে বললো-'একদিন একাকী ঘরে বসে ছিলাম৷ তৌরাত পড়ছিলাম৷ তৌরাতের এক জায়গায় সর্বশেষ পয়গাম্বরের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়লাম৷ একটা বৈশিষ্ট্য হলো নম্রতা ও সহিষ্ণুতা৷ নিজে নিজে ভাবলাম, মন্দ নয়, মুহাম্মাদের এই বৈশিষ্ট্যটা পরীক্ষা করে দেখবো এবং কিছুক্ষণ তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণ লক্ষ্য করবো৷ তৌরাতে পড়েছিলাম যে রাগের ওপরে তাঁর ধৈর্য বিজয়ী৷ এই বিষয়টা দেখার জন্যে আমি মদীনার মসজিদের দিকে রওনা হলাম৷ ঘটনাক্রমে ঠিক সেই সময়েই মরুবাসী আরবদের দেখলাম মুহাম্মাদের কাছে এসে তাদের নওমুসলিম গোত্রের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে বলছে৷ তারা মুহাম্মাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতারও আবেদন জানায়৷ মুহাম্মাদ তাদের কথা শোনার পর হযরত আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এমন কোনো মালামাল কি আছে এদেরকে দেওয়ার মতো?' আলী (আ.) বললেন, আপাতত কিছুই নাই৷ ঠিক সে সময় আমার প্ল্যান অনুযায়ী বললাম এই টাকাটা আমি ঋণ হিসেবে তোমাকে দিচ্ছি৷ তবে এই টাকার বিনিময়ে আমাকে খুরমার একটা অংশ দিতে হবে৷ মুহাম্মাদ আমার প্রস্তাব গ্রহণ করলো এবং আমার কাছ থেকে একটা অঙ্কের টাকা ঋণ নিল৷ সেই টাকা দিয়ে মরুবাসী ঐ আরবদের প্রয়োজন মেটালো৷
যায়েদ আরো বললোঃ খুরমা তোলার আর অল্প কদিন বাকি ছিল৷ কিন্তু আমি মুহাম্মাদের ধৈর্য পরীক্ষা করবার জন্যে তাঁর কাছে গেলাম৷ আমি জানতাম যে আমার ঋণ পরিশোধ করবার এখনো কিছুদিন বাকি আছে৷ তারপরও ঝগড়াটে মনোবৃত্তি নিয়ে বললাম'হে মুহাম্মাদ জনগণের সম্পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা করো কেন ? 'আমি একদম বেপরোয়াভাবে অসৌজন্যমূলক ভাষায় কথা বললাম, অথচ উনি এতো শান্ত এবং মার্জিত ছিলেন যে, এরকম ধৈর্য আমি আর কারো মাঝে দেখি নি৷ মুহাম্মাদ খালি শুনলোই আর আমি কেবল অসৌজন্যমূলক আচরণই করে যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় মুহাম্মাদের সঙ্গীদের একজন রেগেমেগে আমার কাছে আমাকে গালি দিল৷ মুহাম্মাদ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো-'শান্ত হও ! উত্তেজিত হবার প্রয়োজন নেই৷ বরং যায়েদকে ধৈর্য ধারণ করতে বলা উচিত৷' অবশেষে যখন খুরমা পাকলো এবং আমার ঋণ পরিশোধ করার সময় হলো, তখন তিনি আদেশ দিলেন আমার প্রাপ্য খুরমাকে অন্যভাবে প্রস্তুত করতে৷ যখন খুরমাগুলো গ্রহণ করলাম বুঝতে পারলাম আমার প্রাপ্য যতোটুকু তারচে বেশি খুরমা আমাকে দেওয়া হয়েছে৷ জিজ্ঞেস করলাম এই অতিরিক্ত খুরমাগুলো কীজন্যে? বললেন-'যেহেতু তুমি নবীজীর এক সঙ্গীর উত্তেজিত কণ্ঠের কারণে কষ্ট পেয়েছো, সেজন্যে রাসূলে খোদা আদেশ দিয়েছেন তোমার সন্তুষ্টির জন্যে, তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে অতিরিক্ত কিছু খেজুর তোমাকে দিয়ে দিতে৷' যায়েদ বললো-আমি মুহাম্মাদের নজীরবিহীন চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হলাম এবং আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদের রেসালাতের সাক্ষ্য দিলাম৷ অবশেষে মুসলমানদের কাতারে নিজেও অন্তর্ভুক্ত হলাম ৷
রাসূলে খোদার অবয়ব গঠন ছিল খুবই সুন্দর৷ এমনিতেই তাঁর চেহারা দেখার সাথে সাথে আনন্দে ছল ছল করে উঠতো সবার চোখ ৷ চাঁদের মতো তাঁর পবিত্র মুখখানি সবার কাছেই ছিল প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ৷ তিনি না খুব হালকা-পাতলা ছিলেন, না ছিলেন খুব মোটা ৷ চোখ ছিল কালো এবং বড়ো বড়ো, ভ্রুগুলো ছিল চিকন চিকন এবং পরস্পরে যুক্ত ৷ দুই কাঁধ বরাবর চুলের মাঝখানে নবুয়্যতির সিল দেখা যেত ৷ আনন্দ বা তুষ্টিতে তাঁর চেহারা জ্বলজ্বল করতো ৷ পথ চলার সময় তাঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি থাকতো সামনের দিকে ৷ হাঁসলে তাঁর দাঁতগুলো শিলাবৃষ্টির শিলার মতো দেখা যেত তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শ্বেতশুভ্র দাঁতগুলো ঠোঁটের নিচে হারিয়ে যেত ৷ তিনি যখন বাসায় যেতেন, তাঁর সময়গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করতেন ৷ একাংশ আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে, একাংশ নিজের এবং জনসাধারণের কাজের জন্যে এবং বাকি অংশ পরিবারের লোকজনের সাথে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করার জন্যে বরাদ্ধ করতেন ৷ হযরত আয়েশা বলেন, 'নবীজী তাঁর পরিবারের মাঝে সবচে কোমল, সবচে মহানুভব এবং সবচে হাঁসিখুশি ছিলেন ৷'
বিয়ে হলো একটা পবিত্র বন্ধন এবং উন্নতি ও অগ্রগতির উপায় ৷ ইসলাম তাই বিয়ে করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে ৷ নবী করীম (সা.) এর দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে বিয়ের চেয়ে প্রিয়তর আর কোনো বন্ধন পছন্দনীয় নেই৷ তিনি চাইতেন বিয়ে করার মাধ্যমে জনগণ একটা নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলুক, পবিত্র বংশ পরম্পরার একটা স্থায়ী ধারার প্রবর্তন করুক৷ এভাবে নবীজী পারিবারিক একটা নিয়ম-নীতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন৷ রাসূলে খোদা চাইতেন স্বামী-স্ত্রী তাদের দাম্পত্য জীবন আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে কাটাক৷ কারণ একটা পরিবার হলো শিশুর সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠার প্রথম পাঠশালা৷ নবীজীর দৃষ্টিতে দয়া, শান্ত-নম্রতা ও মার্জিত স্বভাব হলো চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের লক্ষণ৷ ঘরের ভেতর এইসব গুণাবলীর উপস্থিতি থাকলে ঐ ঘরের পরিবেশটাই অন্যরকম সুন্দর হয়ে যায় ৷ তাই নবীজী বলেছেন : 'মুসলমানদের মধ্যে তিনিই উত্তম যিনি তাঁর পরিবারের জন্যে সর্বোত্তম ৷'
পরিবারের অভ্যন্তরে রাসূল (সা.) কে সর্বপ্রথম যিনি এই সুস্থতা ও নিরাপত্তা উপহার দিলেন এবং ইসলামের দাওয়াতি কাজে নবীজীর দিকে সহযোগিতার হাত সমপ্রসারিত করলেন, তিনি হলেন হযরত খাদিজা (সা.) ৷ মহিয়সী এই রমনী খুবই সম্পদশালী ছিলেন৷ তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন ৷ মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনে যখন তিনি প্রবেশ করেন, তখন তিনি যেন মধুময় এক নতুন জীবন উপভোগ করতে শুরু করেন ৷ তিনি তৌহিদের কালেমার সৌজন্যে তাঁর সকল সম্পদ নবীজীর খেদমতে উত্সশর্গ করেন ৷ নবীজীও সবসময় খাদিজা (সা.) কে যথাযোগ্য সম্মান দেখাতেন ৷ খাদিজা (সা.) এর মৃত্যুর পর রাসূল তাঁকে স্মরণ করে বলতেন-তিনি আমাকে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছেন ৷ যে সময় লোকজন আমাকে অপমান করেছিল এবং আমাকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল, তখন খাদিজা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল ৷
পরিবারের অভ্যন্তরে নবীজীর আচরণ এতো ভদ্র, নম্র ও মার্জিত ছিল যে, সেই যুগের একটা উগ্র ও নির্দয় সমাজে তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ৷ এমনিতে নবীজীর ওপর ছিল ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব প্রদানের গুরুদায়িত্বভার ৷ তারপরও তিনি নিজ ঘরে এতো নম্র ও ভদ্র আচরণ করতেন ৷ নবীজী সবসময়ই ভালো কাজ করবার জন্যে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্যে সবাইকে অনুপ্রেরণা দিতেন ৷ হযরত আয়েশা (সা.) বলেনঃ একদিন রাসূলে খোদা আমার ঘরে ছিলেন ৷ যা কিছু রান্না-বান্না হয়েছিল সাফিয়া তাঁর জন্যে পাঠিয়ে দিল ৷ চাকরের হাতে যখন খাবার দেখলাম, তার হাত থেকে সহসা খাবারের বাটিটা নিয়ে এক পাশে ছুঁড়ে মারলাম ৷ আমার এই কাণ্ড দেখে রাসূলে খোদা (সা.) বিস্মিত হলেন ৷ আমার আচরণে তিনি যে বেশ নাখোশ হলেন তা তাঁর চেহারা মুবারকে ফুটে উঠেছিল ৷ তাঁকে বললাম-ইয়া রাসূলাল্লাহ! আশা করি আমাকে ভর্ত্সহনা করবেন না ৷ নবীজী তাঁর স্বাভাবিক প্রশস্ত হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে বললেনঃ 'তাওবা করো!' আমি বললাম, আমি কীভাবে এর ক্ষতিপূরণ দিতে পারি? নবীজী বললেনঃ 'সাফিয়া যেরকম খাবার তৈরি করেছিল এবং তার খাবারের বাটিটা যেরকম ছিল, ঠিক সেরকম খাবার এবং সেরকম বাটির ব্যবস্থা করে তার কাছে পাঠিয়ে দাও ৷'
ইসলামের মহান নবী নারীদের সাথে সদ্ব্যবহারকে নবীচরিত্র্যের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন ৷ তিনি মনে করেন সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তির পরিচয় ফুটে ওঠে নারীদের প্রতি তাদের সম্মান প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ৷ তাঁর ভাষায়ঃ 'সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী মানুষেরা নারীদেরকে সম্মান দেয় আর কদাকার চরিত্রের লোকেরা নারীদেরকে মর্যাদাহীন বা তুচ্ছ জ্ঞান করে ৷'
রাসূলের একজন সাহাবী পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ৷ নবীজী তাঁর নামাযে জানাযায় শরীক হলেন এবং একটা বিশেষ উপায়ে নিজ হাতে তাকে কবরে শায়িত করলেন ৷ তার মা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো তোমার জন্যে কাঁদবো না বাবা, কেননা নবীজীর হাতে তুমি কবরে শায়িত হয়েছো, নিশ্চয়ই তুমি পরকালীন জীবনে সৌভাগ্য ও মর্যাদার অধিকারী হবে৷ মৃতের মা যখন চলে গেল, তখন নবীজী সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'কবর তাকে এমন চাপ দিয়েছে যে, তার পাঁজরের হাড়গুলো গুঁড়িয়ে গেছে৷' সবাই আশ্চর্য হয়ে বললো, কেন তাকে এরকম শাস্তি দেওয়া হলো ? অথচ সে তো ভালো মুসলমান ছিল ! নবীজী বললেনঃ 'তা ঠিক ৷ তবে সে তার নিজ ঘরে উগ্র আচরণ করতো, চারিত্র্যিক স্বভাব তার বাজে ছিল ৷'
পরিবার এবং স্ত্রীদের সাথে নবীজী এমন বিনম্র ও সদয় আচরণ করতেন যে, কখনো কখনো দেখা যেত তাঁর সাথে অন্যরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতো ৷ তাদের ধৃষ্টতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, ঘরের ভেতরকার কথা পর্যন্ত ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল ৷ শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের হুশিয়ার করে দেওয়ার জন্যে সূরা তাহরীমের তিন থেকে পাঁচ নম্বর আয়াত নাযেল করা হয়েছিল ৷
বনী কোরাইযা গোত্রে সাথে যুদ্ধে মুসলমানরা গনীমাতের মালের অধিকারী হয়েছিল৷ এই যুদ্ধের পর হাফসা এবং আয়েশা খানিকটা বিলাসী জীবন চিন্তা করেছিল৷ তারা নবীজীর কাছে কিছু গয়না-গাটি চেয়েছিল৷ কিন্তু নবীজী তাদের দাবী না মেনে বরং বললেন, 'আমি ইসলাম এবং মুসলমানদের নেতা৷ আমার জীবন অত্যন্ত সাদামাটা ও অনাড়ম্বর এজন্যে যে যাতে গরবী-দুখিগণ নিজেদের অসহায় বোধ না করে৷' কিন্তু তারা দু'জন নাছোড়বান্দা৷ নবীজী অবশ্য ক্ষিপ্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না৷ তবে হাফসার পিতা ওমর এবং আয়েশার পিতা আবু বক্বর তাদের নিজ নিজ কন্যাদেরকে তিরষ্কার করলেন৷ কিন্তু নবীজী তাঁর শ্বশুরদের আচরণে অসন্তুষ্ট হলেন এবং মজলিস ত্যাগ করলেন৷ অল্প পরেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আহযাবের ২৮ এবং ২৯ নম্বর আয়াত নাযিল করলেন৷ সেখানে রাসূলে খোদার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ 'হে প্রিয় নবী ! আপনার স্ত্রীদের বলুন-'তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার শোভা-সৌন্দর্য কামনা করো, তাহলে এসো, আমি তোমাদের ভোগ্যবস্তুর ব্যবস্থা করে দেবো এবং তোমাদের বিদায় দেবো সৌজন্যময় বিদায়দানে ৷ আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে এবং আখেরাতের আবাস কামনা করে থাকো, তাহলে আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যকার সত্ক র্মশীলদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন বিশাল প্রতিদান ৷'
হযরত আলী (আ.) বলেন, রাসূলে খোদা একদিন ঘরে প্রবেশ করলেন ৷ এ সময় হযরত ফাতেমা (সা.) রান্না করছিলেন আর আমি ডাল পরিষ্কার করছিলাম৷ রাসূলে কারীম (সা.) আমাকে যখন এ অবস্থায় দেখলেন, তখন বললেন, 'হে আলী! শোনো ! আল্লাহ যা আদেশ করেছেন, আমি তার বাইরে অন্যকিছু বলবো না৷ যে ব্যক্তি ঘরে তার স্ত্রীকে সহযোগিতা করে এবং বদমেজাজি বা খারাপ আচরণ না করে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নামকে শহীদদের তালিকাভুক্ত করেন এবং তাকে শাহাদাতের পুরস্কার দেবেন৷ স্ত্রীকে সহযোগিতা করার সময় যে ব্যক্তি কোনোরকম অহমিকা বা বাজে আচরণ না করে, সে বিনা হিসাবে বেহেশ্তে প্রবেশ করবে ৷'
স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে নবীজী নিজেই ছিলেন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ৷ নবীজী ঘরের ভেতর নিজের জামা-কাপড় এবং জুতা নিজেই সেলাই করতেন ৷ নিজেই দুম্বা এবং উটের দুধ দোহন করতেন ৷ গম ভানতো যে, তাকে সঙ্গ দিতেন এবং সে ক্লান্ত হয়ে গেলে নিজেই ঐকাজে সহযোগিতা করতেন৷ আল্লাহর দেওয়া হালাল রুযি পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং যারা কাজ করতো তাদের সবাইকে নিয়ে একসাথে খেতেন৷ বহু লোকজন নিয়ে একসাথে খাওয়া খেতে তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন৷ তিনি যেহেতু প্রাজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী ছিলেন, সেহেতু স্বামী-স্ত্রীর প্রতি তিনি আহ্বান জানাতেন, তারা যেন পরস্পরের প্রতি তাদের ভালোবাসা নিবেদন করেন৷ দম্পতিরা যেন একে অপরকে তাদের ভালোবাসা নিবেদন করে তার ওপর তিনি ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন ৷ কোনো পুরুষ যদি এই কাজ করে, তাহলে তার স্ত্রীর মন থেকে তার প্রতি ভালোবাসা কোনোদিন যাবে না ৷
নিজের সন্তানদের ওপর নবীজীর ব্যাপক ভালোবাসা ও মায়া-মমতা ছিল৷ এমনিতেও তিনি শিশুদের প্রতি ছিলেন সদয়৷ শিশুদের বিনোদিত করতে অর্থাৎ তাদের মনে আনন্দ দেওয়ার জন্যে তাদের সাথে খেলতেন৷ জাবের বলেন, একদিন দেখলাম হাসান এবং হোসাইন নবীজীর পিঠে চড়ে বসেছে৷ নবীজী হাত-পা চালিয়ে এগুচ্ছেন আর বলছেন, ভালো বাহন পেয়েছো, তোমরাও খুব ভালো চালক৷ কিন্তু যখন এ আয়াত নাযিল হলো ' নিজেদেরকে যেভাবে তোমরা ডাকো, নবীজীকে সেভাবে ডেকো না অর্থাৎ সম্বোধন করো না ৷' নবীজীর আগমন ঘটায় ফাতেমা (সা.) সামনে এসে বললেন 'হে আল্লাহর রাসূল ! তোমার প্রতি সালাম! রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয়কন্যা ফাতেমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং বললেন, ' না মেয়ে ! তুমি আমাকে বাবা বলো ৷ এই ডাক আমার খুবই প্রিয় ৷'
হ্যাঁ ! আল্লাহর সর্বশেষ দূত রাসূলে খোদা (সা.) সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরকমই অনন্য ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন ৷
আল্লাহর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বিরল পরিচালনা শক্তি দিয়ে সমাজে যে ন্যায়-নীতি ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা অন্যদের জন্যেও ছিল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ৷ নবীজী তাদের জন্যে ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমে একটা পরিপূর্ণ আদর্শ প্রদর্শন করেছেন৷ গত পর্বেও গৃহাভ্যন্তরে নবীজীর আচার-ব্যবহারের সৌন্দর্য সম্পর্কে কথা বলেছি আমরা ৷ শিশুদের সাথে রাসূলে খোদার ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা যখন কথা বলবো, তখন দেখবো যেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর মুখোমুখি হয়েছি যিনি তাঁর পুরো জীবনটাকেই মানবাত্মার খেদমতে কাটিয়েছেন৷ এই বৈশিষ্ট্যগুলো নবীজীকে মানব সমাজে ব্যতিক্রমধর্মী একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে৷ ফ্রান্সের বিখ্যাত মনীষী সিদুয়া বলেছেন, 'শিশুদের প্রতি তাঁর ছিল ব্যাপক অনুগ্রহ৷ তিনি তাদের প্রশান্তি চিন্তা করতেন সবসময়৷ বিশেষ করে ইয়াতিম শিশুদের নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন তিনি৷ শিশুদের আদর-স্নেহ করতে ভালবাসতেন ৷ মুহাম্মাদ কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম বলে ঘোষণা দেন৷ পিতা-মাতা এবং শিশুদের ভালোবাসার ব্যাপারে নবীজীর বক্তব্য কতো সুন্দর এবং অমায়িক ৷
নবীজী একদিন তাঁর এক সন্তানকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন-'শিশুদের ঘ্রাণটা বেহেশতি ৷ তোমাদের সন্তানদের বেশি বেশি চুমু দেবে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমার জন্যে বেহেশতে উত্তম একটি স্থান দান করবেন ৷'
এমন সময় জাহেলি সমাজের একজন অভিজাত ব্যক্তি রাসূলের কাছে এলো ৷ শিশুদের প্রতি রাসূলে খোদার স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার প্রকাশ দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো ৷ সে বললো-'আমার দশটা ছেলে আছে ৷ এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই একটিবারও আমি চুমু দেই নাই ৷' নবীজীর চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল ৷ বিরক্তির সাথে তিনি বললেন, "অপরের জন্যে যার কোনো দয়ামায়া নেই, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তার জন্যে সদয় হবেন না ৷ আমি কী করতে পারি, আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া তুলে নিয়েছেন ৷"
কোনো এক ঈদের নামায পড়ার জন্যে নবীজী ঘর থেকে বের হলেন৷ রাস্তায় কয়েকটি শিশু আনন্দের সাথে খেলাধুলায় মত্ত ছিল৷ হঠাত্ তাঁর দৃষ্টি পড়লো দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোণো জামা-কাপড় পরা কান্নারত একটি শিশুর ওপর ৷ নবীজীর অন্তরটা কেঁদে উঠলো৷ তিনি সদয় হৃদয়ে শিশুটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কেন ওদের সাথে খেলছো না ?" আক্রোশের সাথে ছেলেটি বললো, 'আমার বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৷ তাই আমি যেহেতু অন্য বাচ্চাদের মতো নই সেহেতু আমি তো তাদের কাতারে মিশতে পারবো না ৷' নবীজী তার হাতটা ধরে অত্যন্ত দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, "আচ্ছা, আমি যদি তোমার বাবা হই আর আমার মেয়ে ফাতেমা যদি তোমার বোন হয়, আলী যদি তোমার চাচা হয় এবং হাসান-হোসাইন যদি তোমার ভাই হয়, তুমি কি সন্তুষ্ট হবে ?" শিশুটি সেই মুহূর্তে নবীজীকে চিনতে পারলো ৷ সে ভীষণ খুশি হয়ে গেল ৷ অনেক অনেক আশা এবং বিশ্বাস তার বুকে আসন গেড়ে বসলো ৷ ঠোঁটে-মুখে তার হাসির রেখা ফুটে উঠলো ৷ নবীজী শিশুটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা পরালেন, খেতে দিলেন এবং ইয়াতিম চিন্তাটি তার মন থেকে মুছে দিলেন ৷ শিশুটি এবার প্রশান্ত হৃদয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করে দিল ৷ এই শিশুটির ব্যাপারে নবীজী এরপরেও কোনোদিন উদাসীন হন নি ৷
শিশুদের জন্যে তাদের বাবা-মায়ের দিক-নির্দেশনা খুবই প্রয়োজন ৷ তাদের মৌলিক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে পারিবারিক পরিসরে৷ সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাবা-মায়ের রুচিবোধ যতো উন্নত হবে, তাদের সন্তানও ততোটাই উন্নতভাবে লালিত পালিত হবে ৷ উন্নত রুচিবোধসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ লোকজন সমৃদ্ধ কোনো একটি সমাজ সেইসব পরিবারের কাছে ঋণী যারা তাদের সন্তানদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে ৷ মহানবী (সা.) বলেছেন, যদি কেউ তার সন্তানকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা তাদের বেড়ে ওঠা তথা লালন-পালন করার ক্ষেত্রে তোমাকে অনুসরণ করে, তাহলে তা তোমার জন্যে প্রতিদিন দান-সদকা করা থেকে উত্তম ৷
শিশুদের কচিমনের প্রতি নবীজী ছিলেন ভীষণ মনোযোগী ৷ তিনি শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্যে তাদের সামনে গিয়ে সালাম করতেন এবং তাদের ভুলগুলো পরিহার করতেন ৷ তিনি বলেন, 'যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদেরকে ভালো কাজ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে, আল্লাহর রহমত তাদের ওপর বর্ষিত হোক ৷'
একব্যক্তি নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, 'নিজের সন্তানদেরকে কীভাবে সহযোগিতা করবো? ' নবীজী বললেন' তোমার শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী তাদের বরণ করো, তারা যতোই ধৈর্যভঙ্গকারী কাজ করুক না কেন, উপেক্ষা করো ৷' একদিন এক মা তার সন্তানকে নবীজীর কোলে বসালেন, অমনি শিশুটি নবীজীর জামা-কাপড় নষ্ট করে দিল ৷ শিশুটির মা অস্থির হয়ে রাসূলে খোদার কোল থেকে শিশুটিকে নিয়ে নিতে চাইলো ৷ অথচ নবীজী অত্যন্ত শান্তমনে শিশুটির মাকে ইঙ্গিতে বললেন, তাকে যেন শান্ত থাকতে দেয় ৷
মূলত শিশুদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী হওয়া দরকার৷ অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীই বিশ্বাস করেন যে, শিশুরা ছয় বছর বয়সে স্থান-কাল এবং কোন্ কাজের কী পরিনতি তা বুঝতে সক্ষম ৷ নবীজী তাই বলেছেন, এ বয়সেই যেন শিশুদেরকে দ্বীনী আদর্শ ও শিক্ষাগুলো মিষ্টিভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় ৷ তিনি বলেছেন, 'যখন তোমাদের সন্তান ছয় বছর বয়সে পৌঁছে, তখন তাদেরকে রুকু এবং সেজদা শেখাও ৷ সাত বছর বয়সে ওজু করার জন্যে তাকে প্রস্তুত করাও এবং তাকে নামায পড়তে উত্সা হিত করো ৷ শিশুদেরকে আল্লাহর নাম শেখানো হলে আল্লাহ শিক্ষক এবং বাবা-মায়ের আযাব মাফ করে দেন ৷'
শিশুদের অধিকার রক্ষার ওপর রাসূলে খোদা ভীষণ গুরুত্বারোপ করেছেন ৷ শিশুর জন্যে সুন্দর একটি নাম নির্বাচন করাও তার অধিকারভুক্ত বলে তিনি উল্লেখ করেন ৷ সেইসাথে শিশুদের মাঝে সমানাধিকার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ওপরও নবীজী গুরুত্ব দিয়েছেন ৷ এক ব্যক্তি তার দুই সন্তানের মাঝে একটিকে আদর করে চুমু খেলো অপরটিকে খেলো না-এই দৃশ্য দেখে নবীজী তাকে রাগের সাথে বললেন, কেন তুমি তোমার সন্তানদের মাঝে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করছো না ৷ নোমান ইবনে বাশীর নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার বাবা একদিন আমাকে একটা উপহার দিলেন, কিন্তু আমার অন্য ভাই-বোনদের কিছুই দিলেন না ৷ এ ঘটনায় আমার মা, বাবার ওপর রাগ করলেন এবং বাবাকে বললেন, আমি এই বৈষম্য পছন্দ করি না, যদি না রাসূল তোমার এই কাজকে সঠিক বলে অনুমোদন করেন ৷ এরপর আমার বাবা নবীজীর কাছে গিয়ে বললেন, হে রাসূলে খোদা ! আমি আমার সন্তানকে একটা উপহার দিয়েছি ৷ এখন আমার স্ত্রী এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছেন৷ নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি তোমার সকল সন্তানকে উপহার দিয়েছো? ' আমার বাবা বললেন, না ৷ নবীজী বললেন-'আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করো ৷ আমি কখনোই এই অন্যায় আচরণকে অনুমোদন করবো না ৷'
শিশুরা টেপ-রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরার মতো তাদের বাবা-মায়ের আচরণগুলোকে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের স্মৃতিতে রেকর্ড করে রাখে বা চিত্রায়িত করে রাখে এবং তাদের আচরণে সেরকম চিত্র আঁকার চেষ্টা করে ৷ রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে ছেলেমেয়েদের আচার-ব্যবহার সরাসরি তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া ৷ তাই তিনি সবসময় বাবা-মাকে তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে সত্য কথা বলা, তাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এবং তাদের যথার্থ সম্মান করার কথা বলতেন ৷ তিনি বলেন, 'যখনই তোমার সন্তানদের স্মরণ করবে এবং তাদের নাম নেবে, অবশ্যই সম্মানের সাথে করবে ৷ মজলিসে তাদের জন্যে বসার আসন রেখে দেবে এবং তাদের সাথে সহাস্য মুখে ব্যবহার করবে ৷'
নবীজী সবসময় শিশুদেরকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানাতেন এমনকি তিনি তাঁর আসন থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন, সহাস্যমুখে তাদের স্বাগত জানাতেন৷ তিনি জানতেন যে, শিশুদের পৃথিবীটা হাসি-আনন্দ আর খেলাধূলাপূর্ণ৷ তাই তিনি যতোক্ষণ শিশুদের সানি্নধ্যে কাটাতেন, ততোক্ষণ তাদের সাথে শিশুসুলভ অর্থাৎ তাদের মতোই আচরণ করতেন৷ শিশুদের সাথে শিশুদের ভাষায় কথা বলতেন৷ রাস্তায় যখন শিশুরা আবদার করতো তাদের খেলা দেখার জন্যে রাসূল তখন তাদের খুশির জন্যে কিছুটা সময় দিতেন ৷ শিশুদের সাথে নবীজীর আচরণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বহু চিন্তাবিদ ৷ এমিল ডরমিংহাম নামের ফরাশি এক মধ্যপ্রাচ্যবিদ রাসূলে খোদার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন-'মুহাম্মাদ শিশুদেরকে ভালবাসতেন ৷ তাঁর দুই নাতি হাসান এবং হোসাইনকে নামাযের সময় তাঁর পিঠে চড়তে দিয়েছেন এবং বক্তৃতা দেওয়ার সময় মিম্বারের ওপর খেলতে দিয়েছেন ৷
একদিন হলুদ জামা পরা ছোট্ট একটি শিশুকন্যাকে রাসূলের কাছে আনা হলো ৷ শিশুটি খেলতে শুরু করলো ৷ তার মা চাচ্ছিলো দুষ্টুমিতে মগ্ন শিশুটিকে রাসূলের কাছ থেকে নিয়ে নিতে ৷ কিন্তু নবীজী দিলেন না ৷ তিনি ইয়াতিম কন্যাশিশুদের উপহার সামগ্রী বা গলার চেইন দিতেন ৷ রাসূল (সা.) আশ্চর্য হয়ে যেতেন এইভেবে যে, আরবরা কেন তাদের কন্যাদের আদর করতো না....মানবতার মুক্তির দূত এরকমই ছিলেন ৷ তাঁর প্রাণবন্ত কথাবার্তা যে-ই শুনতো, তারই অন্তর প্রশান্তিতে ভরে যেত ৷'
যে-কোনো সমাজেই যুবকদেরকে মনে করা হয় উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান এবং অনুপ্রেরণার মূলশক্তি ৷ শিল্প কল-কারখানা ও উত্পানদনের চাকা তাদের হাতেই ঘোরে৷ সংকট মোকাবেলায় গঠনমূলক প্রচেষ্টা চালানো তাদেরই কাজ ৷ আজ আমরা দেখবো যুবকদের ব্যাপারে নবীজীর দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং নবীজীবনে যুবকদের সাথে তাঁর আচার-ব্যবহার কেমন ছিল ৷
ইসলামের মহান নবী যুবকদেরকে মনে করতেন একটা সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পুঁজি ৷ তাদেরকে তিনি ভীষণ সম্মান করতেন ৷ এই সম্মানের ফলে বহু যুবক রাসূলের প্রতি ঝুঁকেছিল ৷ যুবকদের সহযোগিতা আর নবীজীর মেধাবি নেতৃত্বের সুবাদে ইসলাম ব্যাপক উন্নতি লাভ করে ৷ নবীজী বলেছেন-'আমি যখন ইসলামের দাওয়াতী কাজ শুরু করলাম, তখন যারা আমার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল এবং যারা আমাকে সহযোগিতা করেছিল তারা ছিল যুবক ৷ অনেকে আবার আমাকে অস্বীকারও করেছিল-যদিও এটা ছিল সমকালীন স্বাভাবিকতা ৷'
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যুবকদেরকে পূত-পবিত্র স্বভাব-প্রকৃতি, শক্তিমত্তার উদ্দীপক এবং উচ্চতরো লক্ষ্যাধিকারী বলে মনে করতেন ৷ আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহের সাহায্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার বৃক্ষকে তারা নিজেদের ভেতরে লালন ও উন্নয়ন ঘটাতে পারে৷ যৌবন পর্বের এই বৃহত্ পুঁজির প্রতি ইঙ্গিত করে নবীজী বলেছেন-'যুবকদের ব্যাপারে তোমাদেরকে সদুপদেশ দিচ্ছি ৷ কেননা তারা নরম অন্তর ও মানসিকতার অধিকারী ৷'
নবীজী তাঁর নবুয়্যতকালে কী মক্কায় কী মদিনায় যুবকদেরকে বিশেষ আনুকূল্য দিয়েছিলেন ৷ এমনকি তিনি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বহু দায়িত্বভার যুবকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন ৷ এই বক্তব্যের প্রমাণ হলেন মাসআব ইবনে ওবায়েদ৷ তিনি মক্কায় বসবাস করতেন ৷ দেখতে তিনি এতো সুদর্শন ও যৌবনদীপ্ত ছিলেন যে, তাঁর কথা প্রায় সর্বত্রই ছিল সবার মুখেমুখে ৷ জনগণের সাথে কাজ-কারবারের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন যথার্থ ও সুশৃঙ্খল ৷ তিনি যখন নবীজীর ঐশী বক্তব্যে আপ্লুত হলেন, অতি দ্রুত ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করলেন এবং ঈমান আনলেন ৷
ঈমান আনার ফলে তাঁকে আপন লোকজনদের পক্ষ থেকেও অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ৷ তারপরও তিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়ান নি ৷ রাসূলে খোদা তাই মাসআবের চেয়ে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও যুবক মাসআবকেই মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিলেন ইসলাম প্রচার করার জন্যে ৷ মাসআব নবীজীর কাছ থেকে যা যা শিখেছিল, সেইসব শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে, নিজস্ব চারিত্র্যিক মাধুর্য দিয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোর যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মদীনার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন ৷ এই মাসআবই মদীনায় রাসূলের হিজরতের ব্যবস্থা করেছিলেন ৷
যৌবন কালটা হলো জীবনের সোনালী অধ্যায়৷ পৃথিবীও যুবকদের উদ্যমের মধ্য দিয়ে সবুজ-সতেজ হয়ে ওঠে ৷ যৌবনের বৈশিষ্ট্যই হলো আনন্দ-ফুর্তি করা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো, অনুসন্ধিত্সুএ হওয়া, নতুনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা, সহযাত্রী হওয়া ইত্যাদি৷ যৌবনকে বলা হয় জ্ঞানার্জনের বসন্তকাল ৷ এ কারণেই নবী করিম (সা.) জনগণকে বিশেষ করে যুবকদেরকে জ্ঞানার্জনের জন্যে উত্সাাহিত করতেন, অনুপ্রাণিত করতেন ৷ যুবকদের প্রতি রাসূলে খোদার ছিল ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি, তাদের ব্যক্তিত্বের প্রতি ছিল অকৃত্রিম সম্মান এবং তাদের প্রকৃত চাওয়া-পাওয়াগুলোর ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সতর্ক ৷ তিনি অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে সচেতন হবার জন্যে পরামর্শ দিতেন ৷ নবীজী চাইতেন যুবকদের মাঝে সবসময় হাসি-খুশি অবস্থা এবং কর্মচাঞ্চল্য বিরাজমান থাকুক ৷ রাসূলের আন্তরিকতাপূর্ণ সুকোমল আচার-ব্যবহারের কারণে যুবকরা তাঁর চারপাশে মোমবাতির বৃত্তের মতো ঘিরে থাকতো ৷ তাঁর কথা যুবকদের অন্তরগুলোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতো ৷ তাঁর সহাস্য চেহারা যুবকদের আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াতো ৷
যৌবন হলো মহামূল্যবান একটা সময়, তবে তা সীমিত ৷ জীবনের এই মূল্যবান পুঁজির ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা ৷ যৌবনকে গনীমত হিসেবে মনে করার জন্যে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, ' যৌবনকে বার্ধক্যের আগে গনীমত মনে করো ৷ মানুষ যখন কেয়ামতের দিন উপস্থিত হবে, তখন তাকে তার যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, কীভাবে যৌবনকে কাজে লাগিয়েছে ?'
ইসলামের নবী যুবকদের আত্মাকে শক্তিশালী করবার জন্যে সবসময় চেষ্টা করতেন, তাদের অন্তরে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে ৷ পৃথিবীর সকল জটিলতা, দুর্গমতা, সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করবার জন্যে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো এই আশাবাদ ৷ 'আশা' যুবকদের জীবনের সকল উদ্বেগ, হতাশা, সমস্যা উত্তরনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে ৷ নবীজী এই আশাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত বলে মনে করতেন এবং বলতেন-'আমার অনুসারীদের জন্যে আশা হলো রহমত ৷ আশা যদি না থাকতো কোনো মা-ই তার সন্তানকে দুধ দিত না এবং কোনো মালিই গাছ বাগানে লাগাতো না ৷'
যুবকদের ব্যাপারে নবীজীর এই গুরুত্ব প্রদানের পেছনে তাদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখার বিষয়টিই ছিল উদ্দেশ্য ৷ তারা যাতে যৌবনের সীমারেখা লঙ্ঘন করতে না পারে সেজন্যে তাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চিন্তা-চেতনার দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরী বলে তিনি মনে করতেন ৷ কেননা, পাপাচার বা নোংরামি থেকে দূরে থাকলে যুবকদের মন বা চিন্তাশক্তি আল্লাহর দিকে, আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকতে সাহায্য করে ৷ তিনি বলেছেন, 'আল্লাহর কাছে তওবাকারী বা অনুশোচনাকারী যুবকদের চেয়ে পছন্দনীয় অন্য কিছুই নেই ৷'
যুবকদের চিত্তবিনোদনের জন্যে সুস্থ-স্বাভাবিক আনন্দানুষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে৷ এই বিনোদন বিচ্যুতির ঢেউ থেকে যুবককে রক্ষা করবে এবং নিরাপদ উপকূলে নিয়ে যাবে ৷ যুবকদের মাঝে এই সুস্থ ও গঠনমূলক বিনোদনের ব্যবস্থার ওপর নবীজী ব্যাপক গুরুত্ব দিতেন ৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুবকদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যে তাদেরকে খেলাধুলা করতে উত্সাদহিত করেছেন ৷ তিনি যুবকদের মাঝে ঘোড়দৌড়, তীরন্দাজিসহ আরো অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করার পদক্ষেপ নিয়েছেন ৷ যুবকদের সাথে তাঁর এতো বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল যে, তিনি অনেক সময় নিজে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন ৷
ইতিহাসে রাসূলে খোদার জীবন থেকে বহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যুবকদের বক্তব্য শোনার জন্যে ভালো একজন শ্রোতা ছিলেন ৷ কখনো কখনো লম্বা সময় ধরে যুবকদের সাথে বসতেন, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দিক-নির্দেশনা দিতেন ৷ ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী এ কারণেই নবুয়্যতির কঠিন বছরগুলোতে তাঁর অনুসারীদের একটা বিরাট অংশ ছিল যুবক শ্রেণী ৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুবকদের কর্মপ্রচেষ্টার ওপর তাঁর গুরুত্বারোপ ৷ কর্মচাঞ্চল্য যুবকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় এবং তারা সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হয় । রহমতের নবী এ ব্যাপারে বলেছেন, 'তোমরা সবাই কাজ করো, চেষ্টা করো! তবে জেনে রেখো, প্রত্যেককেই কোনো না কোনো কাজের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে ৷ তারা তা সহজভাবে আঞ্জাম দেয় ৷' এখানে কাজের মনস্তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ৷ ভাবতেই অবাক লাগে-সেইযুগে নবীজী এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ৷ বিষয়টা হলো, মেধা এবং পছন্দ অনুযায়ী যুবকদের পেশা নির্বাচন৷
একদিন নবীজী একদল যুবকের সাথে কথাবার্তা বলছিলেন ৷ আলাপ করে বুঝতে পেরেছেন যে, একটি যুবক মসজিদের পাশে ভোর থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে৷ যুবকটি ছিল যথেষ্ট শক্তিমান ও পরিশ্রমী৷ তার হাতের রগগুলো অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে ফুলে উঠেছিল ৷ ঐ রগফোলা হাত দিয়ে সে তার কপালের ঘাম মুছছিল ৷ নবীজী যুবকটিকে খুব ভালো করে দেখছিলেন৷ নবীজীর খেদমতে বসে থাকা একজন ব্যাপারটি লক্ষ্য করে বললো-'এই যুবকটি তার কাজে এতোই মশগুল যে আশেপাশের খবরও তার নেই ৷ কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো তার এই শক্তিকে আল্লাহর পথে কাজে লাগাচ্ছে না, আল্লাহর ইবাদাতে ব্যয় করছে না কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে ব্যবহার করছে না ৷'
নবীজী এবার বক্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন ৷ সবাই তাঁর প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় ছিলেন৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নবীজী বললেনঃ 'হে সাথীগণ! এভাবে বলবেন না৷ শক্তিমান এই যুবকটি-যে আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে-কয়েকটি অবস্থা থেকে বাইরে নয়৷ যদি সে অন্য কারো মুখাপেক্ষী না হবার জন্যে নিজস্ব জীবিকার তাড়নায় কাজ করে থাকে তাহলে সে খোদার পথেই শ্রম দিচ্ছে ৷ যদি তার অক্ষম পিতা-মাতাকে সাহায্য করবার জন্যে কিংবা তার সন্তানদের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলেও সে খোদার পথেই কাজ করে যাচ্ছে ৷ আর যদি সে গরীবদের ওপর বড়াই করার জন্যে নিজের ধন-সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই কাজ করে থাকে তাহলে সে শয়তানের পথে গেছে এবং সত্য-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে ৷
জাফর ইবনে আবি তালিবের স্ত্রী আসমা বিনতে আমিস রাসূলের ওপর ঈমান আনার পর থেকে উন্নত জ্ঞান চর্চা করার কথা ভাবতে থাকেন৷ একজন জ্ঞানী মহিলা এবং হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন৷ আসমা তাঁর স্বামীসহ মোট আশিজন নারী-পুরুষের একটি দল নিয়ে ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন৷ যখন তিনি মদীনায় এলেন, নবীজীর পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-‘মহিলাদের ব্যাপারে কোরআনের কোনো আয়াত কি রাসূলে খোদার ওপর নাযিল হয়েছে? ' নবীপত্নী নেতিবাচক জবাব দিলেন৷ আসমা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে নবীজীর কাছে গেলেন৷ নবীজী তাঁর চাওয়াটা জানতে চাইলেন৷ আসমা বললেন, হে রাসূলে খোদা! মহিলারা তো ক্ষতিগ্রস্ত, কেননা কোরআনে পুরুষদের মতো মহিলাদের ব্যাপারে কোনো ফযীলতের কথা উল্লেখ করা হয় নি৷ নবীজী জবাবে বললেন, ‘ আল্লাহর কাছে নারী-পুরুষের স্থান সমান৷'
এর কিছুক্ষণ পরই নবীজীর ওপর ওহী নাযিল হলো-
মুসলিম নর এবং মুসলিম নারী, ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনকারী পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, অধ্যবসায়ী পুরুষ ও নারী, বিনয়ী পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোযাদার পুরুষ ও নারী, গুনাহ থেকে আত্মরক্ষাকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী পুরুষ ও নারী ! আল্লাহ তাদের সবার জন্যে পরিত্রাণ ও প্রতিদানের ব্যবস্থা করেছেন৷"
ইতিহাসের বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বের মাঝে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছেন, এমনকি তাদেরকে তাদের মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন ৷ রাসূলের সময়ে জাহেলি রীতি-নীতি অনুযায়ী নারীদের ওপর এতো নির্দয় আচরণ করা হতো যে, আরব পুরুষরা মেয়েদেরকে জীবিত রাখার চেয়ে জ্যান্ত কবর দেওয়াকে প্রাধান্য দিত ৷ রাসূলে খোদা (সা.) এই জাহেলি রীতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করলেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিলেন৷ তিনি নারীদের মানবিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন৷ তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মালিকানার অধিকারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ সর্বোপরি সমাজে নারীদেরকে অসম্ভব সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন ৷
নবী করিম (সা.) তাঁর আধ্যাত্মিক ও গঠনমূলক শিক্ষার আলো দিয়ে নারীদের জন্যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির যে ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন, তার ফলে তারা আত্মপরিচয়হীনতা, তুচছ-তাচিছল্য ও দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেল৷ সমাজ থেকে অন্যায় রীতিনীতিগুলো দূর করার জন্যে নবীজী তাঁর ছোট্ট মেয়ে ফাতেমা (সা.) কে হাঁটুর ওপরে বসাতেন, তাকে আদর করে চুমু খেতেন, স্নেহ করতেন, এমনকি তার সম্মানে তিনি উঠে দাঁড়াতেন৷ এভাবেই নবীজীর নীতি আদর্শে নারীদের উচচাসন ও ভূমিকা সুরক্ষিত হলো৷ রাসূলে খোদার সাথীদের একটি দল ছিল পুরুষ৷ আবার নারীদের একটি অংশও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ নবীজী এই নিশ্চয়তা বিধান করেছিলেন যে, নারীরা নবীজীর যথাযথ আনুগত্য করার পরও তাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি দিয়ে নিজেদের সম্মান মর্যাদা তথা আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারে৷ কোরআনে কারীমের সূরা তাহরীমে এ সম্পর্কে ফেরাউনের স্ত্রীর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে৷ কুফুরি ও গোমরাহীতে নিমজ্জিত হবার সমূহ পথ খোলা থাকার পরও তিনি সত্য ও হেদায়েতের পথই বেছে নিয়েছিলেন৷ এটা সম্ভব হয়েছিল এজন্যে যে তিনি তাঁর সকল ক্ষমতা এ পথেই ব্যয় করেছিলেন৷
ইসলামের মহান শিক্ষাগুলোকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাসূলে খোদা (সা.) বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সমাজে নারীদের উপযোগী কাজে তাদের নিজেদের উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে৷ বর্তমানে আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের যে অংশগ্রহণ ও তৎপরতা লক্ষ্য করি, তা নবীজীর ঐ শিক্ষারই ফলাফল৷ ইসলামের আবির্ভাব ও তার বিস্তারের শুরু থেকেই রাসূলের বাইয়াত, হিজরাত এবং জেহাদে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়৷ ইসলামের ইতিহাসে তাই লক্ষ্য করা যায় যে, নারী এবং পুরুষ যে যার উপযুক্ত ক্ষেত্রে যথার্থ সৃজনশীল ভূমিকা রেখেছে৷
হযরত খাদিজা (সা.) সর্বপ্রথম নারী যিনি তাঁর ধন-সম্পদ দ্বীনের খেদমতে সঁপে দিয়েছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাসূলে খোদার খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, তাঁর সবচে উত্তম বন্ধু ও সহযোগী ছিলেন৷ পরবর্তী পর্যায়ে হযরত ফাতেমা (সা.) সবসময় নবীজীর খেদমতে উপস্থিত ছিলেন৷ যুদ্ধ-সংগ্রামেও নবীজী এবং অন্যান্য সংগ্রামীদের সাথে উপস্থিত ছিলেন৷ হযরত ফাতেমা (সা.) এর মর্যাদা এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা এমন এক উচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে, বিভিন্ন রেওয়ায়েতে এসেছে ক্বেয়ামতে বেহেশ্তবাসীদেরকে খবর দেওয়া হবে যে-‘একজন মহিয়সী রমনী পুলসিরাত পার হবেন৷ তোমরা তখন তোমাদের চোখ ঢেকে রেখো, কেননা;পুলসিরাত পার হবার সময় তাঁর নূরের ঔজ্জ্বল্য এতো বেশি হবে যে হাশরবাসীরা তাঁকে দেখার শক্তি রাখবে না৷' সেই মহিয়সী রমনী হলেন নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (সা.) ৷
নবীজীর রেসালাতকালে আকাবায় সর্বপ্রথম বাইয়াত গ্রহণের যে ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে মদীনার পুরুষদের সাথে কয়েকজন রমনীও ছিলেন৷ রমনীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘হাফরা'৷ ইতিহাসবিদদের মতে যে সময় নারীরা তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার থেকে পরিপূর্ণভাবে বঞ্চিত ছিল, সে সময় রাসূলের বাইয়াতে এই নারীদের উপস্থিতি ছিল সমকালীন জাহেলী রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিস্ময়কর৷ এ কারণেই বাইয়াতের এই ঘটনাকে ‘বাইয়াতুন্নেসা' বা নারীদের আনুগত্য নামেও অভিহিত করা হয়েছে৷ এক বছর পর একদল মুসলমানের সাথে ক'জন নারী গোপনে নবীজীর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মীনায়৷ তারা নবীজীর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন৷ বললেন, নিজেদের পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততিদের যেভাবে তারা সুরক্ষা করেন, সেভাবেই তারা তাঁকেও হেফাজত করবেন৷ কা'বের মেয়ে নাসীবাহও ছিলেন নারীদের এই দলে৷ ইসলামী হুকুমাতের জন্যে নবীজীর সামনে যখন বিচিত্র সমস্যা এসেছিল, তখন নবীজীর প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে নাসিবা তার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন৷ অহুদের যুদ্ধে নাসীবা মুজাহিদদের পানি পরিবেশন করার গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ অহুদের যুদ্ধে শত্রুরা যখন যুদ্ধ শেষে চোরাপথে অতর্কিত আক্রমণ করে বসলো, তখন মাত্র দশজন ছাড়া বাকি সবাই পালিয়ে গেলো৷ এই দশজনের মধ্যে নাসিবাহ ছিলেন৷ তিনি নবীজীর প্রাণ রক্ষার্থে অস্ত্রহাতে শত্রুদের মোকাবেলা করতে বীরাঙ্গনার মতো এগিয়ে গিয়েছিলেন৷
নারী এবং পুরুষ আল্লাহর দুই সৃষ্টি৷ মানুষ হিসেবে উভয়ই সমান৷ তবে তাদের নিজ নিজ কর্মের ওপর নিজ নিজ সম্মান ও মর্যাদা এমনকি পুরস্কারের বিষয়টি নির্ভর করে৷ ইসলামের নবী আল্লাহর পক্ষ থেকে নারীদের জন্যে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো আমলকারীর আমলই আমি ধবংস বা বিফল করবো না, চাই সে নারীই হোক কিংবা পুরুষ৷' রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে নারীপুরুষকে আল্লাহ রাববুল আলামীন এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে তারা তাদের পারস্পরিক প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটাতে সক্ষম হয়৷ অর্থাৎ তারা পরস্পরের পরিপূরক৷ এদিক থেকে একজন নারী পুরুষের মতোই সমান মানুষ৷ তবে তাদের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্য এবং দক্ষতা আলাদা এবং স্বতন্ত্র৷ সেজন্যে তাদের কাজগুলোও তাদের বৈশিষ্ট্য এবং মানসিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী বিন্যস্ত৷ মনস্তত্ত্বও প্রমাণ করেছে যে, নারীকে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং যথার্থ যত্নের সাথে৷ তাই যেখানেই নারী তার এই সূক্ষ্মতা এবং স্পর্শকাতরতার সীমা লঙঘন করবে, সেখানেই তার ব্যক্তিত্ব ও সম্মান-মর্যাদা হ্রাস পাবে৷
নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি দিয়েই নবীজী তাদের জ্ঞানগত উন্নতির চেষ্টা চালিয়েছেন৷ তিনি তাঁর স্ত্রী হাফসাকে বলেছেন লেখাপড়া শিখতে৷ অপরদিকে তিনি নারীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন যে, তারা যেন একজন দায়িত্বশীল হিসেবে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে পরিবারের সদস্যদের সম্মান ও যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে শেখে এবং যার যার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি নজর রেখে উপযোগী কাজ ভাগ করে দেয়৷ তবে সন্তানদের প্রতিপালন ও তাদের যথার্থ প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টিকে যেন অগ্রাধিকার দেয়৷ রাসূলে খোদার দৃষ্টিতে ঘরকন্নার কাজ এতোটাই পূণ্যের কাজ যে, তাকে আল্লাহর পথে জিহাদ করার সমতূল্য বলে মূল্যায়ন করা হয়েছে ৷
রাসূলে খোদার সময়কালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সাহসী ও দক্ষতাপূর্ণ উপস্থিতি ইসলামের সমৃদ্ধ ইতিহাসে বৃহৎ একটি অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছে৷ আজো ইসলামের সেই সুমহান শিক্ষাগুলো বিশ্বের নারীদেরকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যাচেছ ৷
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইসলামের ইতিহাসে মক্কা থেকে মদীনায় নবীজীর হিজরতের ঘটনাকে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে মনে করা হয় ৷ মদীনায় নবীজীর প্রবেশের মধ্য দিয়ে এবং সেখানে তাঁর অবস্থান করার মধ্য দিয়ে ঐ সমাজে অভিনব এক পরিবর্তনের সূচনা হয় ৷ নবীজীর ধর্মে অর্থাৎ ইসলামে মানব সংস্কৃতি ও চিন্তার উন্নয়নের জন্যে ব্যাপক ঐশী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি ছিল ৷ এইসব পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন ছিল গণসংহতি ও লিখিত গঠনতন্ত্রের ৷ নবীজীর যদি বুদ্ধিমত্তা, মনোযোগ কিংবা সুষ্ঠু কর্মকৌশল না থাকতো, তাহলো হয়তো ইসলামী হুকুমাত কাঙিক্ষত মানে বাস্তবায়িত হতো না ৷ নবীজীর সামনে সবচে বড়ো যে বাধাটি তখন বিদ্যমান ছিল তাহলো সেই সমাজে ঐক্য বা সংহতি বলতে কিছু ছিল না ৷ প্রত্যেক গোত্র বা সম্প্রদায়েরই ছিল নিজস্ব রীতিনীতি ও সংস্কৃতি ৷ এক সম্প্রদায়ের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য ও বৈপরীত্য ছিল ব্যাপক ৷ এমতাবস্থায় নবীজী অত্যন্ত সুচিন্তিত ও যথার্থ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে ‘মুসলমান ভাইদের মুসলিম নীতি'র প্রবর্তন করেন ৷ তিনি সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সম্প্রদায় বা গোত্রগত সীমারেখা তুলে দেন ৷ নবীজীর এই চমৎকার পরিকল্পনা সেই যুগের সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ৷
মদীনা শহরের লোকজন অর্থাৎ আনসারগণ মক্কার মুহাজিরদের হাতে আন্তরিকতার সাথে হাত মেলালেন ৷ তাদের এই আন্তরিকতা এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, মদীনার লোকজন নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে আসা মুহাজিরদেরকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করেছিলেন ৷ জাতীয় এই সমন্বয়ের পর রাসূলে খোদা মদীনা শহরে একটি মসজিদ তৈরির উদ্যোগ নেন ৷ এই মসজিদটি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মৌলিক ভূমিকা রেখেছিল ৷ এই মসজিদ তৈরিতে সকল মুসলমান এমনকি স্বয়ং রাসুলে কারীম (সা.) ও অংশ নিয়েছিলেন ৷ বলা যেতে পারে যে, মসজিদুন্নবী প্রতিষ্ঠার সময় সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা ছিল ইসলামী সমাজে জনগণের সমষ্টিগত অংশগ্রহণের প্রাথমিক দৃষ্টান্ত ৷ নবীজীর পরিকল্পনায় সৃষ্ট এই মসজিদ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ৷ এই মসজিদ একদিকে যেমন আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, তেমনি সামাজিক-মানবিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ৷ নবীজীর এই মানবকল্যাণকামী মৌলিক পদক্ষেপ জনগণের মাঝে ইসলামী শাসনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে সহযোগিতা করেছিল৷ ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ীঃ একদিন সৌদিআরবের সবচে দূরে অবস্থানকারী এক আরব মদীনা শহরে এসেছিল ৷ নবীজীর সামনে এসে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর সমালোচনা করে বললো-‘হে মুহাম্মাদ ! ন্যায়নিষ্ঠ হও ৷' সে স্বাধীনভাবে নবীজীর সাথে কথা বললো ৷ নবীজীর সঙ্গীসাথীদের অনেকেই বিরক্ত হচিছল কিন্তু নবীজী তাদেরকে শান্ত হবার জন্যে এবং সদাচারী হবার জন্যে বললেন ৷ এমনকি নবীজী ঐ লোকটিকে উপহার পর্যন্ত দিলেন ৷
মুসলিম উম্মাতের নেতার সামনে মত প্রকাশের এই স্বাধীনতার ঘটনা ইসলামের ব্যাপারে সমাজের সাধারণ জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস বাড়িয়ে দিলো ৷ নবীজী ছিলেন জনগণের পৃষ্ঠপোষক৷ তাঁর এই আন্তরিকতা ইসলামী শাসনের ভিত্তিকে মজবুত করেছিল৷ বলা যেতে পারে, জনগণ যে নবীজী এবং তাঁর হুকুমাতের নজীরবিহীন আনুগত্য করলো, তার কারণ হলো, নবীজী সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং জনগণের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন ৷ নবীজী এই কর্মকৌশলের মাধ্যমে জনগণ এবং হুকুমাতের মাঝে এমন একটা সুন্দর ও সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যার ফলে একটি আস্থাশীল, বিশ্বাসপূর্ণ এবং সুস্থ ও শান্তিময় পরিবেশের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল৷ রাসূল (সা.) ইসলামী হুকুমাতের ঐ সুন্দর পরিবেশে সবাইকে অংশ গ্রহণ করার আহবান জানান এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরকেই রচনা করতে বলেন ৷ নবীজী সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, কেবল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই নয় বরং সমাজ এবং রাষ্ট্রের ব্যাপারে সকলকেই সতর্ক ও যত্নবান হতে হবে ৷ এরফলে জনগণের মাঝে একটু একটু করে দায়িত্বানুভূতি জেগে উঠেছিল ৷
জনগণের অংশগ্রহণ এবং তাদের মতামতকে কাজে লাগানো অর্থাৎ মানুষকে মূল্যায়ন করার বিষয়টি ছিল নবীজীর সমকালীন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক একটি দিক ৷ নবীজী চাইতেন মানুষ যেন ঐক্যের ছায়াতলে এসে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ৷ মানুষের রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার-এই বাণী প্রচার করে নবী করীম (সা.) মানব জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ সুগম করে দিয়েছেন ৷ কেননা প্রকৃতিতে মানুষের উন্নতি অগ্রগতির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল উপকরণই দেওয়া আছে ৷ সেইসব উপাদান থেকে উপকৃত হবার জন্যে মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন ৷ এই সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয় নি ৷ যদি না তা সমাজ কিংবা অন্যদের জন্যে কোনোরকম ক্ষতির কারণ না হয় ৷ এই ঘোষণার ফলে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, মদীনার ইহুদী এবং অন্যান্য অমুসলিমরা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে আশ্রয় নেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা রাসূলে খোদার সাথে সহযোগিতাও করে ৷
জনগণের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ রাসূলে খোদার জন্যে বিভিন্ন দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ প্রথমত নবীজী এই পরিকল্পনার মাধ্যমে জনগণকে তাঁর অনুসারীদের ব্যাপারে সংবেদনশীল করে তোলেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাসকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন ৷ এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে মানুষ নিজেদেরকে আর সঙ্কুচিত ভাবলো না ৷ নিজেদের জীবনকে নিরর্থক মনে করলোনা ৷
দ্বিতীয়ত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে মূল্যায়ন করার ফলে নবীজী তাদের মধ্য থেকে কে অভিজ্ঞ, সচেতন আর উপযুক্ত তা যাচাই করতে পারতেন এবং উপযুক্ত লোককে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্যে নির্বাচন করতে পারতেন ৷ এই ঘটনা সমাজ এবং ইসলামী হুকুমাতের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো বেশি শক্তিশালী করেছে ৷
নবীজী ছিলেন সমাজের সবচে অগ্রসর চিন্তাশীল ব্যক্তি ৷ তিনি সর্বজনগ্রাহ্য যেসব পরামর্শ দিতেন সেগুলো মূলত আল্লাহই তাঁকে বাতলে দিতেন ৷ কোরআনের আয়াতেও সেসবের কথা অনেক সময় এসেছে৷ কোরআনে এই পরামর্শের বিষয়টিকে মানুষের একটি উন্নত গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে৷ রাসূলে খোদার পবিত্র জীবনে লক্ষ্য করা গেছে যে তিনি বেশি বেশি পরামর্শ করতেন ৷ তবে আল্লাহ-রাসূল এবং দ্বীন সম্পর্কিত যেসব বিষয়-আশয় বা হুকুম-আহকাম সুস্পষ্ট ছিল সেসব ব্যাপারে পরামর্শ করার প্রয়োজন ছিল না ৷ পরামর্শের প্রয়োজন ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসহ উম্মাত এবং ইসলামী সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নবী করীম (সা.) কোনো একটি এলাকায় ইসলামের দাওয়াতী কাজের উদ্দেশ্যে কাকে পাঠাবেন বা কার ওপর দায়িত্বভার অর্পন করবেন সে ব্যাপারে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতেন ৷
উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধ শুরু হবার আগে শহরের বাইরে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আনসার তথা মদীনাবাসীদের অনুমোদন অর্থাৎ রাজি হবার অপেক্ষায় ছিলেন ৷ কারণ মদীনার অধিবাসীদের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, সে অনুযায়ী তারা রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের হেফাজতের দায়িত্ব নেবেন শহরের অভ্যন্তরে, শহরের বাইরে নয় ৷ কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শহরের বাইরে প্রতিরক্ষার বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল ৷ এ কারণেই রাসূলে খোদা (সা.) যুদ্ধ যাবার আগে আনসারদের মতামতের অপেক্ষায় ছিলেন ৷ অবশেষে সা'দ ইবনে মোয়াযের কন্ঠে যখন আনসারদের ইতিবাচক দৃষ্টির কথা শুনলেন, নবীজীর চেহারা তখন আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠেছিল ৷
তো শহর থেকে বেরুবার জন্যে এবং শহরের বাইরেও প্রতিরক্ষার জন্যে বদর কূপের পাশে যেহেতু এই ঘটনার উদ্রেক হলো, তাই নবীজী বললেনঃ ‘তোমাদের জন্যে সুসংবাদ! আল্লাহ রাববুল আলামীন বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷'
এই যুদ্ধে রাসূলে খোদা এমনকি শরণার্থী শিবির স্থাপন করার ব্যাপারেও তাঁর সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করেছেন এবং ঐ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে যার ভালো জানা আছে তার দৃষ্টিভঙ্গিও জানতে চেয়েছেন ৷ বিজয় লাভ করার পরও তিনি বন্দীদের ব্যাপারসহ অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সাহাবীদের মতামত চেয়েছেন৷ খন্দক যুদ্ধের সময়ও মদীনা শহর প্রতিরক্ষার কৌশল নিয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন৷ সালমান শত্রুদের হামলার আগে বা যুদ্ধ শুরু করার আগে মদীনা শহরের দূর-দূরান্তে গর্ত খোঁড়ার প্রস্তাব করেছিলেন ৷ পরামর্শ বৈঠকে সালমানের প্রস্তাব গৃহীত হলো ৷ এটা নবীজীর দূরদর্শী ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ নেতৃত্ব এবং সঠিক পরিচালনা নীতি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত ৷
নবীজী তাঁর সমগ্র জীবনে তাঁর আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সংকটপূর্ণ অবস্থার মাঝেও পরামর্শের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা খুব ভালোভাবেই নিরসন করা যায় ৷ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচেছ যে, অসম্ভব শক্তিমত্তার অধিকারী শাসকরাও তাদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কারণে ধবংস হয়ে গেছে, কারণ তারা জনবিচিছন্ন হয়ে গিয়েছিল ৷ এ সম্পর্কে রাসূলে খোদার একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে ৷ ‘যেখানেই তোমাদের রাষ্ট্রনায়ক বা শাসকরা সৎ, সাহসী ও শক্তিমত্তার অধিকারী হয় এবং সকল কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়, সেই ভূখণ্ডটি তোমাদের জন্যে বসবাসযোগ্য সর্বোত্তম স্থান ৷ কিন্তু তারা যদি কৃপণদের মধ্য থেকে আসে এবং কাজগুলোকে যদি পরামর্শের ভিত্তিতে না করে তাহলে ঐ ভূখণ্ড জীবনযাপনের অযোগ্য ৷
রাসূলে খোদা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতির জন্যে চিরকাঙ্ক্ষিত বা শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার এক অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন৷ তাঁর প্রবর্তিত আদর্শ রাষ্ট্রের দিক বা বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল অভূতপূর্ব৷ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রে বিশ্বনবী (সা.) কখনও পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করেন নি৷ রাষ্ট্রের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার এবং সব জাতি ও গোত্রের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর লক্ষ্য৷ তিনি চেয়েছিলেন এমন এক রাষ্ট্র কায়েম করতে যেখানে মানুষ এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা এবাদত করবে না ও মহান আল্লাহর মহত্ত্ব কিংবা প্রশংসাসহ কোনো ক্ষেত্রেই কাউকে তাঁর শরীক করবে না৷
ইসলামের প্রথম দিকের একজন মুমিন রাসূলে খোদা (সা.)'র কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমায় সহায়তা করুন৷ রাসূল (সা.) বললেন, কি ব্যাপার? ঐ মুমিন বললেন, মদীনায় ব্যবসা করতে-আসা একদল বনিক আমার সন্তানদের সাথে চলাফেরা করে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে৷ আমি বহু চেষ্টা করেও তাদেরকে ইসলাম ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছি৷ আপনি তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার নির্দেশ দিন৷ সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র চোখ দুটিতে দুশ্চিন্তার সামান্য রেশও দেখা গেল না৷ তিনি অত্যন্ত শান্ত ও নম্রভাবে বললেন, শান্ত হও৷ তুমি কি জাননা আমাদের ধর্ম গ্রহণে জোরজবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই? ইসলাম ধর্ম মুক্তির ও বিভ্রান্তির পথ কি তা স্পষ্ট করে দিয়েছে৷ যারা মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এনেছে তারাই শক্ত রশি আকড়ে ধরেছে৷" এভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী বিশ্বনবী (সা.) বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন, ইসলাম যুক্তি ও বিবেকের ধর্ম, অন্ধ-বিশ্বাস বা জোরজবরদস্তির ধর্ম নয়৷
মহানবী (সা.) তাঁর প্রবর্তিত রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও জন-শৃঙখলাকে এত গভীরভাবে কায়েম করেছিলেন যে তাঁর ওফাতের পরও ইসলাম ধর্ম বিস্তৃত হতে থাকে এবং মুসলমানদের গৌরবময় বিজয় অব্যাহত থাকে৷ এভাবেই ইসলাম বিশ্বের বুকে স্থায়ীত্ব অর্জন করে৷ আর এই ইসলামী জাহানের সব কিছুর মূল বিষয় বা ভিত্তি ছিল বিশ্বাস তথা ঈমান, মানব-প্রেম বা ভালবাসা এবং সচেতনভাবে মত বা পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা৷ ইসলামের আবির্ভাব ও বিস্তৃতির ফলে বিভিন্ন জাতি ও গোত্র নিজ অবস্থান বা মর্যাদা হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে৷ রাসূল (সা.) প্রবর্তিত মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন গোত্র বা জাতির অধিকার ও তাদের জাতির মর্যাদা নির্ধারণের কথা উঠেছিল৷ বিশ্বনবী (সা.) মদীনার সব জাতি ও গোত্রের সাথে চুক্তি বা সমঝোতায় এ বিষয়টি স্পষ্ট করেন এবং মদীনার সব জাতি ও গোত্র নিয়ে একটি মাত্র উম্মাহ বা নতুন জাতি গঠন করেন৷ এভাবে একক বা অভিন্ন জাতি গঠিত হওয়ায় জাতি বা গোত্রগুলোর সমস্ত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের অবসান ঘটে৷
বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের সাথে বিশ্বনবী (সা.)'র সমঝোতা বা চুক্তিপত্রের সূচনাতেই লেখা হয়েছিলঃ বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম ৷ অর্থাৎ পরম করুণাময় ও অনন্ত দাতা মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি৷ মুহাম্মদের পক্ষ থেকে এই লিখিত চুক্তি করা হয়েছে কুরাইশ ও মদীনার মুমিন ও মুসলমান এবং তাদের সাথে জড়িত বা তাদের অনুসারী সবার জন্যে৷ আর এই সবাই-ই একটি মাত্র জাতি বা একক উম্মাহর অংশ ৷" বনি নায্যার ও বনি আউফ নামের দুটি ইহুদি গোত্র এবং বনি সায়েদেহ, বনি হারেস ও অন্য আরো কয়েকটি গোত্রকে এই মহাচুক্তিতে এক জাতি হিসেবে ধরা হয়েছিল৷ ঐতিহাসিক ও নজিরবিহীন ঐ মহাচুক্তিতে বলা হয়েছিল যে এই এক জাতির মধ্যে মুসলমান ও ইহুদিরা নিজ নিজ ধর্মে বহাল থাকবে৷ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ছিল এবং কেউই ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করেনি ৷ বিশ্বনবী (সা.) নিজে এই নতুন জাতির সমস্ত গোত্রের অধিকার রক্ষার জন্যে নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করতেন৷
বিশ্বনবী (সা.)'র যুগের অনেক লিখিত দলিল ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে৷ এসবের মধ্যে রয়েছে চুক্তিপত্র, বিভিন্ন গোত্রের প্রধানের কাছ ইসলামের আহবান সংক্রান্ত চিঠি, রাষ্ট্রীয় ফরমান প্রভৃতি৷ এসব দলীলপত্র থেকে রাসূল (সা.)'র যুগের রাজনৈতিক চরিত্রের চিত্র পুরোপুরি ফুটে উঠে৷ বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ও আইনগত বিষয়েও বিশ্বনবী (সা.)র সঠিক বা নির্ভুল অবস্থানগুলো এসব দলীল পত্র থেকে ফুটে উঠেছে৷ অন্য কথায় এটা বলা যায় যে বিশ্বনবী (সা.)ই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ও এমনকি পরাজিত গোত্রগুলোরও অধিকার রক্ষার জন্যে সচেষ্ট এবং তিনি জনস্বার্থকে সব কিছুর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতেন৷ বিশ্বনবী (সা.) হেজাজ ও ইয়েমেনের সীমান্তে অবস্থিত নাজরানের ৭০ টি গ্রামের খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন তা তাঁর ন্যায় বিচারের এক স্পষ্ট নিদর্শন৷ এ চুক্তি অনুযায়ী রাসূল (সা.) নাজরানের অধিবাসীদের জান ও মালের নিরাপত্তার জামিনদার হয়েছিলেন এবং তিনি তাদের মানবীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতাকে সম্মান করতেন৷
নাজরানের খৃষ্টান প্রতিনিধি দল বিশ্বনবী (সা.)'র সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল৷ বিশ্বনবী (সা.)'র নবুওত যে সত্য তা ঐ প্রতিনিধিদলের কাছে প্রমাণিত হবার পর তারা বিতর্ক বন্ধ করে দেয় এবং তারা নিজের ফলমূল, সোনা-রুপা ও দাস-দাসী রাসূল (সা.)'র কাছে অর্পণ করে৷ কিন্তু তাদের সাথে বিশ্বনবী (সা.)'র সম্পাদিত চুক্তির প্রথম অনুচেছদে দেখা গেছে, রাসূল (সা.) ঐসব সোনা-রুপা, দাস-দাসী ও ফল-মূল তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং শুধু সামান্য কিছু কর আরোপ করেছিলেন৷ এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ঐতিহাসিক ও গবেষকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে৷ চুক্তির এক অংশে লেখা আছে, নাজরানের খৃষ্টানদের যেসব পন্য ও অস্ত্র সামগ্রী ইসলামী সেনাদের কাছে আমানত হিসেবে জমা রাখা হয়েছে, সেসবের যদি কোনো ক্ষতি হয় বা সেগুলো বিনষ্ট বা ধবংস হয়ে যায়, তাহলে রাসূলে খোদা (সা.)'র প্রতিনিধির মাধ্যমে ঐসব জিনিষের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে বলে বিশ্বনবী (সা.) অঙ্গীকার করেছেন৷
একইসাথে ইসলামের নবী (সা.) নাজরানের খৃষ্টানদের জীবন ও তাদের বিধান বা ধর্ম রক্ষার অঙ্গীকার করেন৷ এভাবে তিনি নাজরানের খৃষ্টানদের জীবন ও ধর্মকে আল্লাহর আশ্রয় ও চুক্তি এবং রাসূলে খোদার অঙ্গীকারের আওতায় এনে তাদের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন৷ বিশ্বনবী (সা.) খৃষ্টানদের কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দিতেন এবং খৃষ্টান ধর্ম যাজকদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, কোনো পাদ্রী বা খ্রীস্টান ধর্ম যাজককে তার পদ থেকে সরানো হবে না৷
প্রত্যেক দেশের নাগরিকই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে ৷ বিশ্বনবী (সা.) নাজরানের খৃষ্টানদের বেঁচে থাকার অধিকার ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, নাজরানের খৃষ্টানদেরকে নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে না ও তাদের কাছ থেকে একটি দেরহামও নেয়া হবে না, তাদের দেশকে পদদলিত বা পদভারে জর্জরিত করা হবে না এবং সেখানে সেনাও মোতায়েন করা হবেনা ৷
অবশ্য ইতিহাসে দেখা যায় কোনো কোনো গোত্র বিশ্বনবী (সা.)'র সাথে চুক্তি করার পর তা লংঘন করেছিল৷ এই গোত্রগুলো বদর ও ওহদের যুদ্ধের সময় বিশ্বনবী (সা.)'র শত্রুদের সাথে সহযোগীতা করে চুক্তি লংঘন করে৷ তাই রাসূলে খোদা(সা.)ও এই গোত্রগুলোকে মদীনা থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷
ইরানের শিরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোঃ মাহদী জাফরী বলেছেন, বিশ্বনবী (সা.)'র চুক্তিগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে সেগুলো মুসলিম বিশ্বের অধিকার সংক্রান্ত বিধান প্রনয়নের সমৃদ্ধ উৎস এবং বর্তমান বিশ্বের আন্তর্জাতিক আইন সংস্কারেরও মানদন্ড হতে পারে৷ ডঃ মাহদী জাফরী আরো বলেছেন, মহানবী (সা.) ইহুদি গোত্রগুলোসহ অন্যান্য গোত্রের সাথে সংঘাতে লিপ্ত না হবার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষর করায় বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠী পরস্পর শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে পেরেছে৷ এসব চুক্তি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে প্রতিরক্ষামূলক জোট গঠনের সমতুল্য৷ এইসব চুক্তিতে কথা ছিল কোনো সংখ্যালঘু গোত্র যদি হামলার সম্মুখীন হয় তাহলে মুসলমানরা তার সাহায্য করতে এবং মুসলমানরা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে সংখ্যালঘু অমুসলিমরা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে৷ আসলে বিশ্বনবী (সা.) এসব চুক্তির মাধ্যমে খৃষ্টান ও ইহুদিদের নাগরিক-অধিকারগুলো সংরক্ষণ করেছেন এবং তাদেরকে ইসলামী রাষ্ট্রের সাহায্যের আওতাভুক্ত করেছেন৷ এই চুক্তিগুলোর আওতায় মদীনার বিভিন্ন গোত্র নিজ দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি স্বাধীন ছিল৷ অবশ্য শুধু এসব গোত্রের মধ্যে প্রচলতি কোনো কোনো সাধারণ রীতি- যেমন, প্রকাশ্যে মদপান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমানরা খোমস ও যাকাত এবং ইহুদিরা জিজিয়া কর দিত৷ জিজিয়া কর নামের বার্ষিক কর অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের যাকাত ও খোমসের চেয়েও কম হতো৷ ধর্মযাজক, ৬০ বছর ও তদূধর্ব বয়সের ব্যক্তি, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক বালিকা এবং দরিদ্ররা ছিল করের আওতামুক্ত৷ " এভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর উন্নত মূল্যবোধ ও রুচিবোধের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে এমন এক আদর্শ রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন যেখানে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার সমাজের সংখ্যালঘুসহ সবার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ তাই বলা যায় বিশ্বনবী (সা.) আকাশতুল্য উদারতা ও স্বর্গীয় মহত্ত্ব দিয়ে মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে ভালবাসার স্থায়ী আসন পেয়েছেন৷ আর এটাই যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খুব দ্রুত গতিতে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ার মূল রহস্য৷