বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

কাবার পথে যাত্রা

কাবার পথে যাত্রা

মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো বার্ষিক সমাবেশ বা মিলনমেলা হলো হজ্জ্ব। জিলহজ্জ্ব মাস এগিয়ে এলেই ওহী নাযিলের অন্যতম স্থান মক্কার রহমতের মৌচাকের দিকে ছুটে যায় বিশ্বের সকল প্রান্তের রহমত প্রত্যাশী মুসলমান মৌমাছিগণ। আধ্যাত্মিকতার মধুময় বহমান ঝর্ণাধারা থেকে সাধ্যমতো পান করার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চলে তাদেঁর। কাবাঘরকে ঘিরে বৃত্ত রচনা করে তওয়াফ করার জন্যে তৌহিদে বিশ্বাসী মুসলিম জনগোষ্ঠির ঢল নামে। নবী করিম (সা) বলেছেনঃ 'জ্বিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম দশ দিনের মতো কোনো দিন নেই যে সময় আল্লাহ চান মানুষেরা ইবাদাতে মশগুল হোক।' হজ্জ্বের মৌসুম এলেই ইবাদাত বন্দেগির একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। মক্কা এবং মদিনার বিভিন্ন শহরে ঈমান ও প্রেমের নূর লক্ষ্য করা যায়।
গভীরভাবে একটা বিষয় ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়,তা হলো পৃথিবীতে এমন কোন্ আইন আছে যে আইন সত্যকামী সকল মানুষকে এক আত্মা ও অভিন্ন সুরের অঙ্গনে এনে সমবেত করতে পারে? নূরানী কেবলার পথের পথিকদের চোখগুলো অশ্রুসজল আজ,হাতগুলো তাদের উর্ধ্বলোকে আল্লাহর দিকে মুনাজাতে রত। খোদার ঘর যিয়ারতকারীদের মুখে গুঞ্জরিত ধ্বনি লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি তোমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি, আমি উপস্থিত। যিয়ারতকারীগণ এসেছেন ইবাদাত ও প্রেমের বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। ইমাম আলী (আ) এই সমাবেশকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ তৃষ্ণার্ত মানুষেরা যেভাবে পানির ঝর্ণার দিকে ধেয়ে যায়,হজ্জ্ব যাত্রীরা কাবার আকর্ষণে ঠিক সেভাবেই কবুতরের মতো ছুটে যেতে থাকে। তারা নবীদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে দাঁড়ায় এবং ফেরেশতারা যেভাবে আরশের চারদিকে তওয়াফ করে সেভাবে যিয়ারতকারীগণ কাবাকে ঘিরে তওয়াফ করে। তাঁরা ইবাদাতের বাজারে মুনাফা অর্জন করে এবং ক্ষমা লাভের প্রতিশ্রুত স্থানগুলোর দিকে অগ্রসর হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কাবাকে ইসলামের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করেছেন এবং আশ্রয় প্রার্থীদের জন্যে নিরাপদ স্থান হিসেবে কাবা নির্মাণ করেছেন।
হজ্বের জাঁকজমকপূর্ণ এই সমাবেশ ইব্রাহিম (আ) এর দোয়া কবুলের স্থান। যেদিন তাঁর নিজের স্ত্রী হাজেরা এবং নিজের সন্তান ইসমাঈলকে পবিত্র এই ভূখণ্ডে নিয়ে এসেছিলেন,সেদিন তিনি আল্লাহর দরবারে এভাবে দোয়া করেছিলেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কয়েকজনকে তোমারই পবিত্র ঘরের পাশে তৃণহীন পানিহীন এক অনুর্বর ভূমিতে বসবাস করিয়েছি যাতে তারা নামায কায়েম করে। তুমি একটি দলের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করিয়ে দাও এবং ফলফলাদি দিয়ে তাদের রুযির ব্যবস্থা করো! যাতে তারা তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কয়েক শতাব্দী পর এখন লক্ষ লক্ষ যিয়ারতকারী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আন্তরিক প্রেম ও ভালোবাসাপূর্ণ হৃদয় নিয়ে খোদার ঘরের আকর্ষণে মক্কার দিকে ছুটে যাচ্ছে হজ্জ্বের মহান কল্যাণ থেকে উপকৃত হবার জন্যে। হজ্জ্বের মাধ্যমে এক আল্লাহর ইবাদাত করা এবং তৌহিদের ইতিহাসও বাস্তবে পরিক্রমণ করা হয়। হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতাগুলোতে মূলত হযরত ইব্রাহীম (আ),হযরত হাজেরা (সা) এবং হযরত ইসমাঈল (আ) এর মতো স্বাধীন ব্যক্তিত্বদের জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোই অনুশীলিত হয়।
যে-ই হজ্জ্ব করতে মক্কা সফরে যাবে,সে অবশ্যই আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে,যেমনিভাবে ইব্রাহীম (আ) এবং ইসমাঈল (আ) আল্লাহর বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) নিজ পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানী করার জন্যে আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মনিবেদন করলেন। সন্তানের প্রতি যে মায়া তা দুনিয়াবী,তিনি দুনিয়াবী এই গভীর মায়ার বন্ধন অন্তর থেকে ছিন্ন করলেন। প্রিয় সন্তানকে মিনার মাটিতে শুইয়ে দিলেন আল্লাহর আদেশ পালন তথা কোরবানী করার জন্যে। ইব্রাহিমের কাজে কোনো রকম ত্রুটি ছিল না,আবার ইসমাঈল (আ)ও আল্লাহর আদেশের কাছে নির্দ্বিধায় নতি স্বীকার করলেন। কিন্তু আল্লাহরই ইচ্ছায় ছুরি ইসমাঈলের গলা কাটলো না। বরং ঐশী আওয়ায এলো-হে ইব্রাহীম!তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছো! আমি এভাবেই পুণ্যবানদের পুরস্কৃত করে থাকি। ইব্রাহীম (আ) এর ঘটনা থেকে যে বিষয়টি বোঝা যায় তাহলো কোরবানী করাটা এক আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা কাবা যিয়ারত তথা হজ্জ্ব করতে যান তাদেরও উচিত নিজেদের জীবনকে ইব্রাহীম (আ) এর আদর্শে সাজানো এবং যেসব বিষয় পূর্ণতার পথে প্রতিবন্ধক,সেগুলোকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে
হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালন করাটা এমন যে,একটা পর্বের পর আরেকটা পর্ব পালন করতে করতে মানুষের ভেতরটা পরিবর্তিত হয়। যারা আন্তরিকতার সাথে হজ্জ্ব পালন করতে যায় তারা তো সাদা রঙের কাপড় পরে এহরাম বাধেঁ। এভাবে যিয়ারতকারীগণ নিজেদেরকে রঙীন পৃথিবীর মায়া থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। মানুষ বহু কারণে নিজেদেরকে বড়ো বলে মনে করে। কখনো পেশাগত কারণে,কখনো পদ-নেতৃত্ব বা সম্পদের কারণে মানুষ নিজেদেরকে বড়ো ভাবে। সাধারণ এক টুকরো সাদা কাপড়ের এহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজের মধ্যকার শ্রেষ্ঠত্ব চিন্তাকে ভুলে যায়। হজ্জ্ব আরো বহু ইতিবাচক ও গঠনমূলক শিক্ষা দেয় যাতে নিজের আচার-ব্যবহার,চিন্তাদর্শ পরিবর্তন করতে পারে। একজন যিয়ারতকারী বিশাল এই জনসমাবেশে অন্যদের সাথে নিজের একটা সম্পর্ক অনুভব করে। স্বেচ্ছাচার এবং আত্মপ্রদর্শনী থেকে দূর থাকা, তাকওয়ার ঐশ্বর্যে সজ্জিত হওয়া,অর্থ দান করা সবই একটা সামাজিক ও সামগ্রিক সহধর্মিতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
হজ্জ্ব করার ইচ্ছা যাদের আছে তাদের উচিত পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে খোদাপ্রেমিক এই জনসমুদ্রে এসে মিলে যাওয়া। এটা এমন এক আমন্ত্রণ যা আল্লাহর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এসেছেঃ জনগণকে হজ্জ্বের গণদাওয়াত দাও! যাতে তারা পায়ে হেঁটে কিংবা দ্রতগামী উটের পিঠে চড়ে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে নিজেদের বিচিত্র উপকারের বিষয় প্রত্যক্ষ করে। এখানে যেসব ব্যতিক্রমধর্মী জীবনাদর্শ শেখার সুযোগ হয় তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর ইবাদাত করা এবং হামবড়া ভাব পরিত্যাগ করা বা স্বাতন্ত্র্য চিন্তা পরিহার করা। হজ্জ্ব থেকে শান্তি,বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার শিক্ষা লাভ করে। মানুষ তো বটেই এমনকি পশুপাখি,গাছ-গাছালির ব্যাপারেও উদার এবং সদয় হবার শিক্ষা পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক ফায়দা তো রয়েছেই এর বাইরেও আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহু শিক্ষা হজ্জ্বের আনুষ্ঠানিকতা থেকে পাওয়া যায়। হজ্জ্ব মুসলমানদের মাঝে রহমত ও উদারতাপূর্ণ সম্পর্ক শক্তিশালী করে। একজন হাজী সমাজের দুঃখ-কষ্টকে নিজস্ব দুঃখ-কষ্ট বলে মনে করে তাই সমাজের সমস্যা দূর করাকে নিজের সমস্যা দূর করার মতো বলে মনে ক'রে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এই উদার পরোপকারী মানসিকতা নিয়ে একজন হাজি নিজের দেশে ফিরে যায়।
ইমাম সাদেক (আ) এর একটি বক্তব্য দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের এই আলোচনা। তিনি বলেছেনঃ প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের মানুষ এক মিলনমেলায় অংশ নিয়ে যাতে একে অপরকে চিনতে পারে সেজন্যেই হজ্জ্বের বিধান দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের মালামাল নিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়ে মুনাফা অর্জন করে তেমনি আল্লাহও হজ্জ্ব করার বিধান দিয়েছেন যাতে মানুষ নবীজীর রেখে যাওয়া আদর্শ ও কৃষ্টির সাথে পরিচিতি লাভ করার মধ্য দিয়ে উপকৃত হয় এবং নবীজীর স্মৃতি বিস্মৃত না হয়। মানুষ যদি কেবল তার নিজস্ব বংশ গোত্র বা এলাকাতেই বসে থাকতো তাহলে সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, শহরগুলো বিরান হয়ে যেত এবং এভাবে তাদের আয়-রোজগার হতো খুবই কম। তাদের খবরাখবর ঢাকা পড়ে থাকতো।
যাই হোক,আল্লাহর আমাদের সবাইকে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করার তৌফিক দিন-আমিন!(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আল্লাহর প্রতি ইমান
মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
বারজাখের জীবন
সূরা ইউনুস;(১৬তম পর্ব)
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
দোয়া কবুলের মাস

 
user comment