করে নারী সমাজে ইসলামের প্রতি ঝোঁক প্রবণতা একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্যের সরকার ও গণমাধ্যমগুলো তাদের সমাজে ব্যাপকহারে মানুষের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করলেও এ ধর্মের প্রতি মানুষের আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমেনি বরং দিন দিন ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে।
পাশ্চাত্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে গবেষণা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে অনেক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট গবেষক এ্যালকোবাইতি নাওল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর আমেরিকায় নারীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের পরিমাণ বেড়ে যাওযার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, একজন মুসলিম পুরুষের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই পাশ্চাত্যের নারীরা ইসলাম গ্রহণ করছে বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা মোটেও ঠিক নয়। বরং পাশ্চাত্যের নারীরা যে পরিবেশে বড় হয় তাতে তারা মোটেও সন্তুষ্ট নয়। নিজ ধর্মের ব্যাপারে অনীহার কারণেই মূলত তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
গবেষক এ্যালকোবাইতি নাওল বলেন, পাশ্চাত্যে বেশিরভাগ নারীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পেছনে এমন বিশেষ অনুভূতি কাজ করে যা এ ধর্মের মধ্যে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইসলাম ধর্মে একত্ববাদের কথা বলা হয়েছে কিন্তু খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসে ‘ত্রিত্ববাদের’ কথা রয়েছে। ত্রিত্ববাদ বলতে এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলনকেই বোঝায়। বর্তমানে বেশিরভাগ খ্রীস্টানই স্রষ্টা সম্পর্কে এই ধারণা পোষণ করে। বিশিষ্ট গবেষক এ্যালকোবাইতি নাওল পাশ্চাত্যে ইসলাম বিস্তারের জন্য রাজনৈতিক কারণকেও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় মুসলমানদের অভিযুক্ত করার এবং ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী প্রচারণা জোরদার হওয়ার পর আমেরিকার জনগণ বিশেষ করে নারীদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে।
নারীরা পরিবত্র কুরআন পড়ার পাশাপাশি ইসলাম নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেছেন। তারা এখন বুঝতে পারছেন, পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোতে ইসলামে নারীদের অবস্থান নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। কারণ পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমে সবসময়ই ইসলামে নারীদেরকে মজলুম, বঞ্চিত ও নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করে পাশ্চাত্যের নারীরা এটা বুঝতে পারছেন যে, খ্রিস্টান ধর্মে নয় বরং ইসলামেই নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
আজ আমরা যে নও মুসলিম নারীর কথা জানবো তার নাম সুসান কারল্যান্ড। তিনি অষ্ট্রেলিয়ার ফেরমন্ট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি বড় হয়েছেন। ওই এলাকায় তার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি রয়েছে। মাত্র সাত বছর বয়সে তার পিতা-মাতা আলাদা হয়ে যায়। তিনি মায়ের সঙ্গে থাকতেন যিনি ছিলেন গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারি। এ ব্যাপারে সুসান কারল্যান্ড বলেন, আমার মা ইউনাইটেড চার্চে যেতেন এবং প্রতি সপ্তায় আমিও চার্চের সাপ্তাহিক ধর্মীয় আলোচনা সভায় অংশ নিতাম। ১২ বছর বয়সে আমি সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং এ সময় ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে আমার মধ্যে কোনো আগ্রহ ছিল না। ১৪ বছর বয়সে গীর্জার এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে যারা দাবি করতেন রাতের বেলায় সৃষ্টিকর্তা তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তাদের এ দাবি আমি কখনই বিশ্বাস করতাম না। আমি আমার সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে রাতের বিভিন্ন উতসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম কিংবা কখনও কখনও লম্বা সফরে যেতাম। সে সময় আমি ধর্ম থেকে নিজেকে পুরোপুরি দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম।
নও মুসলিম সুসান কারল্যান্ড তরুণ বয়সে অনেক আনন্দ- উল্লাস করে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি এক ধরনের শূণ্যতা বা কিছু একটার অভাব অনুভব করতেন। তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উপলব্ধি করতেন। কারণ তিনি বস্তুগত সব সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ডুবে থাকলেও মনে প্রশান্তি ছিল না। এজন্য তিনি সব সময় সত্যের সন্ধানে ছিলেন। এ ব্যাপারে সুসান কারল্যান্ড বলেন, ১৭ বছর বয়সে ঐশী ধর্মগুলো নিয়ে নানা গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম। তবে আমার গবেষণায় ইসলাম ধর্মকে বাদ দিয়েছিলাম। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম ইসলাম একটি সহিংসতার ধর্ম। তাই এ ধর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাকে আমি সমীচীন মনে করিনি। আমার মা ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে এতটাই খারাপ ধারণা পোষণ করতেন যে, তিনি বলতেন একজন মুসলমানের চেয়ে মাদক চোরাকারবারীকে বিয়ে করাই উত্তম।
পাশ্চাত্যে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচারণার ফলে অনেকের মতো সুসান কারল্যান্ডও ইসলাম ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। এমনকি এ ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করতেও তার ঘৃণা হতো। কিন্তু তারপরও যেহেতু তিনি সত্যসন্ধানী ছিলেন তাই হয়ত আল্লাহতালাও তাকে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর বুঝতে পারছিলেন না ইসলাম তাকে খুঁজে পেয়েছে নাকি তিনি ইসলামকে খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখার পর কিছু কিছু পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মে। ইসলাম সম্পর্কে যতই জানার চেষ্টা করি ততই এ ধর্মের ব্যাপারে উতসাহ জাগতে থাকে ও আরো পড়াশুনা করতে উদ্বুদ্ধ হই। আস্তে আস্তে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমার ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বিশেষ করে ইসলামের একত্ববাদ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে। কারণ খ্রিস্টানদের ধর্মবিশ্বাসে ‘ত্রিত্ববাদের’ যে কথা বলা হয়েছে তার কোনো যুক্তি নেই।
সাধারণত যে কেউ নতুন মুসলমান হওয়ার পর প্রথমেই সে তার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের পক্ষ থেকে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা তাদেরকে প্রশান্তি যোগায়, যে কোনো বিপদ-আপদ ও কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্য ও সহ্য ক্ষমতা বাড়ায় এবং জীবনকে সহজ করে দেয়। কারণ তারা জীবনের লক্ষ্য-উদ্দশ্য সম্পর্কে জানেন। সুসান কারল্যান্ডও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর অনেক আপনজনকে হারিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে প্রিয়জনরা আমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি অনেক মূল্যবান জিনিস খুঁজে পেয়েছি। আমি মুসলমান হওয়ার সময় এ ব্যাপারটি আমার পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদেরকে অবহিত করি। ঘটনাক্রমে আমি যে দিন মুসলমান হই সেদিন রাতে আমার মা শুকরের গোশত রান্না করেছিলেন। তিনি যখন শুনলেন আমি মুসলমান হয়ে গেছি এবং ইসলামে শুকরের গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ তখন তিনি খুব কেঁদেছিলেন।
ইসলাম ধর্মে শালিন পোষাক বা হিজাবের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হিজাব মানুষের সৌন্দর্য, নিরাপত্তা ও পূর্ণতার গ্যারান্টি দেয়। ইসলামে নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একজন নও মুসলিম নারী হিজাবের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন। সুসান কারল্যান্ডও ইসলাম গ্রহণের পর হিজাব ব্যবহার শুরু করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, হিজাব ব্যবহারের ফলে মনে হয়, আমি যেন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছি। কিন্তু হিজাবের কারণে অনেক কাছের মানুষও আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি এবং অনেকেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।