ইসলামের আধ্যাত্মিক আকর্ষণ বহু চিন্তাশীল মানুষকে এ ধর্মে দীক্ষিত করছে স্বেচ্ছায়। চিলির নও-মুসলিম খলিল সাহওয়ারি এমনই এক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। অনেক গবেষণা ও পড়াশুনার পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
খলিলের জন্ম হয়েছিল চিলিতে। কিন্তু তার পরিবার ছিল মূলত অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বেথেলহাম এলাকার অধিবাসী। এই এলাকা জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাসের খুব কাছে অবস্থিত। খলিলের পূর্ব পুরুষরা প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে এ এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের পরিবার হিজরত করে চিলিতে চলে আসেন। খলিল বড় হয়েছেন অর্থোডক্স খ্রিস্টান পরিবারে। খ্রিস্টানরা একই আল্লাহর তিন অস্তিত্বে বিশ্বাসী। অর্থাত তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহ একইসঙ্গে পিতা,পুত্র ও পবিত্র আত্মা। অবিকৃত কোনো ধর্মেই এমন অদ্ভুত বিশ্বাস দেখা যায় না।
খোদ হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন এক আল্লাহর বিশ্বাসী। তিনি এক আল্লাহর এবাদত করতেন। হযরত ঈসা (আ.) একত্ববাদ প্রচার করার বহু বছর পরে খ্রিস্ট ধর্ম ত্রিত্ববাদী ধর্মে পরিণত হয়। আর এই ত্রিত্ববাদ অনেক খ্রিস্টানের কাছেই অগ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দেয় অনেক প্রশ্ন ও প্রতিবাদ। ত্রিত্ববাদ নিয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হয় সেসবের কোনো সদুত্তর দেখা যায় না খ্রিস্ট ধর্মে। অর্থাত বিনা যুক্তিতেই অন্ধের মত ত্রিত্ববাদ মানতে বাধ্য করা হয় খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীদেরকে। 'খলিল সাহওয়ারি'র কাছে খ্রিস্ট ধর্মের ত্রিত্ববাদকে একটি অযৌক্তিক ও অস্পষ্ট বিষয় বলে মনে হয়েছে। তাই তিনি এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। খলিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
"আমি কৈশোরেই বাইবেল পড়া শুরু করেছিলাম। আমি দুই বছর ধরে এ ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করেছি। এরই মধ্যে আমি এই ধর্মের কিছু ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করলাম যা আমার প্রকৃতি মেনে নিচ্ছিল না। পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মাকে এক খোদা হিসেবে দাবি করা এমনই এক বিষয় যা আমার প্রকৃতি গ্রহণ করছিল না। আমার মন বলছিল, খোদা বা প্রভু কেবল একজনই হবেন। এটাও অনুভব করতাম যে আল্লাহর কোনো পুত্রের দরকার নেই। তাই কিশোর বয়সী হওয়া সত্ত্বেও এটা অযৌক্তিক মনে হয়েছিল যে ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র।
'খলিল সাহওয়ারি' আরো বলেছেন, আমার পরিবার বংশ পরম্পরায় এক হাজার ৫০০ বছর ধরে বেথেলহামে বসবাস করে এসেছে। এই বেথেলহামেই জন্ম নিয়েছিলেন হযরত ঈসা (আ.)। তাই এই মহান নবীর প্রতি গভীর ভালবাসা জন্মেছিল আমার মধ্যে। তাই প্রকৃত একত্ববাদ খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু বাইবেলের মধ্যে পেলাম না আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর। অবশেষে ইউহানা’র লিখিত বাইবেলের একটি শব্দ আমাকে সত্যের পথে এগিয়ে নিল। শব্দটি হল, প্যারাক্লিটাস। এই গ্রিক শব্দটির অর্থ হল, প্রশংসিত। একজন পাদ্রির কাছে এই শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে সঠিক জবাব দেননি। বাইবেলের মূল ভাষা ছিল হিব্রু। হিব্রু থেকে তা গ্রিস ভাষায় অনূদিত হয়। এরপর অনূদিত হয় ল্যাটিন ভাষায়। 'প্যারাক্লিটাস' শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে ল্যাটিনে অনূদিত হওয়ার পরই তা ওই মূল শব্দেই থেকে যায়। আমি একাধারে গ্রিক, আরবী,স্প্যানিশ ও ল্যাটিন ভাষায় অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞকে প্রশ্ন করলে তিনি আমায় বলেন যে,প্যারাক্লিটাস শব্দটির গ্রিক অর্থ হল আহমদ।
অতীতের ধর্ম গ্রন্থগুলোতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী এবং তাঁর নাম ও নানা বৈশিষ্ট্যের কথা এসেছে। তাওরাত ও বাইবেল বা ইঞ্জিলেও এ প্রসঙ্গে আলোচনা রয়েছে। পবিত্র কুরআনও স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছে যে ইঞ্জিল ও তাওরাতের অনুসারীরা যদি এ দুটি ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে তাহলে তারা ইসলামের নবীর বৈশিষ্ট্য তাতে খুঁজে পাবে। সুরা আরাফের ১৫৭ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: তাদের কাছে যে লিখিত তাওরাত ও ইঞ্জিল রয়েছে তাতে [ মুহাম্মাদ (সা.)’র] তাঁর বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবে।
এভাবে 'খলিল সাহওয়ারি' প্যারাক্লিটাস শব্দটির মাধ্যমে ইসলামের কাছাকাছি চলে আসেন। খলিল যখন বুঝতে পারেন যে, 'প্যারাক্লিটাস' শব্দটির অর্থ ইসলামের মহানবী (সা.)'রই নামের অর্থ, অথচ খ্রিস্টান পাদ্রি তাকে সঠিক কোনো জবাব দেননি তখন তিনি ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা ও পড়াশুনা শুরু করেন। যদিও তার কাছে যথেষ্ট বই-পুস্তক বা তথ্যের উতস ছিল না।
'খলিল সাহওয়ারি' সত্যকে জানার জন্য দর্শন সংক্রান্ত বিতর্কগুলোও অধ্যয়ন করতে থাকেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা সমাজে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেয়া হয়। তাদেরকে সন্ত্রাসী বা হিংস্র হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রায়ই। আর কেউ সত্য উদঘাটন করতে চাইলেও যথেষ্ট বই-পুস্তক বা তথ্যের উতস হাতে পান না তারা। সত্যকে পাওয়ার জন্য অশেষ তৃষ্ণা নিয়ে তিনি আবারও ধর্মগ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এর পাশাপাশি তিনি নিতসে ও মার্কসের দর্শনও পড়তে থাকেন।
'খলিল সাহওয়ারি' নিতসের বইগুলো পড়তে গিয়ে জরথুস্ত ও ইরান প্রসঙ্গে উপনীত হলেন। খলিল যখন জানতে পারলেন যে, ইরানিদের বর্তমান ধর্ম ইসলাম এবং তাদের নেতা ইমাম খোমেনী (র.) তখন তিনি বেশ পুলক অনুভব করেন।
হাজার বছরের ইতিহাসের বিস্ময় ও বিশ্বকে নাড়া দেয়া ব্যক্তিত্ব ইমাম খোমেনী (র.)'র বরকতময় অস্তিত্ব লাখ লাখ মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করছে এবং কোটি কোটি মুসলমানকে দেখাচ্ছে সঠিক পথের দিশা। সত্য-পিপাসু খলিল সাহওয়ারি তার মনের অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন এই মহান ইমামের বক্তব্যের মধ্যে। তিনি বলেছেন, আমি ইমাম খোমেনী (র.)'র বক্তব্যের মধ্যে পরকাল, একত্ববাদ বা তৌহিদ, ন্যায়বিচার, বাস্তবতা ও সাহসিকতা সম্পর্কে বিস্ময়কর অনেক কিছু পেয়েছি এবং পেয়েছি আমার অনেক প্রশ্নের জবাব। ইরানের এই নেতার ব্যক্তিত্ব আমার কাছে এতই আকর্ষণীয় ও উন্নত মনে হয়েছে যে তাঁর ব্যক্তিত্ব হযরত ঈসা (আ.)'র ব্যক্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
একজন ফিলিস্তিনি মুসলমান 'খলিল সাহওয়ারি'-কে একটি কুরআন উপহার দেন। কুরআন পেয়েই তা অধ্যয়ন শুরু করেন খলিল। তিনি বলেছেন,"যখন আমি কুরআন খুলে পড়লাম তখন আমার হৃদয়ে সৌন্দর্যের এক অপূর্ব অনুভূতি অনুভব করলাম। আমি প্রথম যে সুরাটি পড়ি তা ছিল সুরা ইউসুফ। আমি বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে মুসলমানরাও তাহলে হযরত ইউসুফ (আ.)-কে নবী হিসেবে মানেন! এরপর কুরআনের সুরার তালিকায় সুরা নুহ, ইব্রাহিম ও সুরা মরিয়মও দেখে খুবই অবাক হলাম। আর আমি তখনই বুঝলাম যে ইসলাম তো কোনো নতুন ধর্ম নয়। আল্লাহ বা স্রস্টা এক জন এবং পবিত্র কুরআন ও ইসলাম ধর্ম আল্লাহরই পক্ষ থেকে এসেছে। কুরআন পড়তে পড়তে যখন সুরা মরিয়মে উপনীত হলাম তখন যেন আমার হৃদয়টা পুরোপুরি খুলে গেল। মনে হল যেন জীবনের সবচেয়ে ভাল সংবাদটি শুনলাম। প্রতি দিনই কুরআন পড়তাম। যখন সুরা হামদ পড়লাম তখন আবারও বিস্মিত হলাম। একইভাবে বিস্মিত হলাম সুরা ইখলাস পড়ে। খুবই সংক্ষিপ্ত অথচ কত স্পষ্ট ও শক্তিশালী বক্তব্য রয়েছে এই সুরায়। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি এ সুরায়। আমার মন সত্যকে পেল এবং বুঝলাম যে একত্ববাদ ইসলামের সুন্দরতম মূল নীতি। ফলে আমি ১৫ হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও ইরানে বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের ও ইমাম খোমেনী (র.)'র নূর দেখতে সক্ষম হই। এভাবে আমি ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করি।
'খলিল সাহওয়ারি' এখন ইরানের পবিত্র কোম শহরে ইসলামী শিক্ষার বিষয়ে পড়াশুনা করছেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কারণে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের পক্ষ থেকে অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন খলিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের অনেক সদস্যই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,আমার পরিবার বলত,খলিল পাগল হয়ে গেছে বলেই এ ধরনের কথা বলছে। কিন্তু আমি গোপনে ওজু করতাম, কুরআন পড়তাম ও নামাজ আদায় করতাম। আমি কুরআনের শেষের দিকের সুরাগুলো মুখস্থ করতাম। কিন্তু এক বছর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আমার পরিবার ইসলামের শিক্ষাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আমি মুসলমান হওয়ার এক বছর পর আমার ছোট ভাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আরো কয়েক বছর পর আমার মাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তারা শিয়া মাজহাবকে মাজহাব হিসেবে বেছে নেন। এভাবে আল্লাহ আমাদেরকে সত্য ও মুক্তির পথে পরিচালিত করেছেন।(রেডিও তেহরান)