এইচএম আব্দুর রহিম : ইসলামে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই বরং উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস হিংস্র, নিষ্ঠুর ও বিকৃতমনা মানুষের উদ্ভাবিত পন্থা। সন্ত্রাস শব্দের অর্থ ত্রাস বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা। আর সামাজিক পরিভাষায় যে কোনো কারণ ও উদ্দেশ্যে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জানমালের ক্ষতি সাধন, দেশ-সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুন্ন, স্থাপনা ও স্থাপত্য ধ্বংস ও সর্বস্তরের মানুষকে আতঙ্কিত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন করে তাকেই বলা হয় সন্ত্রাস। ইসলামে ন্যায়নিষ্ঠা, সদাচরণ ও সহানুভূতির আদেশ-নিষেধ রয়েছে। এরূপ অন্যায় সীমা লঙ্ঘনের কারণে আল্লাহ তায়ালা সুরা নাহলের ৯০নং আয়াতে বলেন, "আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা এবং সদাচরণ আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং অসঙ্গত কাজ এবং বিদ্রোহী হতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।" রাসূল (সা.) বলেছেন, "কোনো মুসলিম কর্তৃক অপর মুসলিম ভাইকে আতঙ্কিত করা বৈধ নয়।" (আবু দাউত হা. ৫০০৪) সুতরাং জিহাদের নামে এ রকম সন্ত্রাসী বোমা হামলা চরম অন্যায় ও বর্বরতা, এতে কোনো ন্যায়নিষ্ঠা, সহানুভূতি ও সদাচরণ নেই। বরং এটি অসঙ্গত ও বিদ্রোহমূলক কাজ। ইসলামে এর কোনো স্থান নেই। ইসলাম এসেছে মূল শব্দ ‘সালাম' থেকে যার অর্থ শান্তি। ইসলাম একটি শান্তির জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়িদার ১৬নং আয়াতে বলেন : "যে আল্লাহর আনুগত্য করে সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তার শান্তি ও নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন।" অতএব এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ইসলাম শান্তি, নিরাপত্তায়, স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী মানবজাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত বিধান। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- সমর্থন করে না। সন্ত্রাসীদের জন্য দুনিয়াতে রয়েছে কঠিন শাস্তি আর পরকালে এর পরিণাম হবে আরো ভয়াবহ। ইসলাম মানুষকে শান্তির দিকে আহ্বান জানায় এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রর্দশন করেন। সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে ইসলাম কায়েম করা যায় না। পূর্বেও কেউ করেনি এর নজিরও পাওয়া যায় না। সমগ্র বিশ্বে এটা ইসলামের চ্যালেঞ্জ। মুসলিমরা স্পেন শাসন করেছে আটশ' বছর। সেখানে কোন মানুষকে অস্ত্র ও শক্তি প্রয়োগ করে ধর্মান্তরিত করেছে এমন কথা শত্রুরাও বলতে লজ্জা পাবে। মুসলমানরা ভারত শাসন করেছে প্রায় আটশ' বছর। যদি তারা চাইতো তাহলে তাদের রাজশক্তি ও ক্ষমতার বল প্রয়োগ করে ভারতের প্রতিটি অমুসলিমকে ধর্মান্তরিত করত। আজ শতকরা আশি ভাগের বেশি অমুসলিম ভারতে আছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো তার সামগ্রিক নবুওয়াতের জিন্দেগীতে এরকম কোনো কার্যক্রম করেননি। তায়িফবাসীরা যখন গুরুতর আহত করলেন তখন আল্লাহ তায়ালা তার জন্য পাহাড়ের ফেরেশতা নিয়োগ করলেন এবং সেই ফেরেশতারা বললেন, আপনি যদি চান তাহলে এ দু'পাহাড় তাদের ওপর ফেলে পিশে ফেলি। তিনি তাদের অনুমতি দেননি বরং তিনি তাদের জন্য দোয়া করেন। একসময় সমগ্র আরব ভূখ- তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। তখন তো তিনি কোন কাফেরের ওপর জুলুম বা অত্যাচার করেননি। অথবা পূর্বের কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। সুতারাং এখন কিভাবে ইসলাম সন্ত্রাসী-বোমাবাজি সমর্থন করতে পারে? যারা বোমা বিস্ফোরণের মতো অন্যায় কাজ করছে, যার দ্বারা শিশুরা ইয়াতীম, নারীরা বিধবা, অসংখ্য প্রাণহরণ, অন্তর আতঙ্কিত, সম্পদ বিনষ্ট এবং সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টির মাধ্যমে শান্তি বিনষ্ট করা হচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা কসস-এর ৫০নং আয়াতে বলেন : "সেই ব্যক্তি অপেক্ষা অধিকতর পথভ্রষ্ট কে হতে পারে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দলিল ব্যতীত স্বীয় নফসের অনুসরণ করে চলে।" কোথায় ইসলামের সেই মহানুভবতা। এই বিস্ফোরণকারী দলের লোকেরা কোরআনের অপব্যাখ্যা করে সমাজে আত্মঘাতী হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়ে তথাকথিত জান্নাতের পথ বেছে নিয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)। বরং জান্নাতের দিকে নয়, জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন : "যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার পরিণাম হলো জাহান্নাম, সে এতে চিরকাল থাকবে।" (সূরা নিসা ৯৩)। আল্লাহ তায়ালা হত্যাকা- ঘটাতে নিষেধ করে বলেন : "তোমরা নিজেরা পরস্পরকে হত্যা করো না।" (সূরা নিসা ২৯) ইসলামে অমুসলিমকেও হত্যা করা হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করো না, যাকে হত্যা করা আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন। (সূরা বনি ইসরাঈল ৩৩) ইসলাম আত্মঘাতী হামলার সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, "তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। আর মানুষের সাথে সদাচারণ কর।" (সূরা বাকারাহ ১৯৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করবে জাহান্নামে অনুরূপভাবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে আঘাত করে আত্মহত্যা করবে তাকেও জাহান্নামে অনুরূপভাবে আঘাত করা হবে। যে ব্যক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে তাকে ও জাহান্নামে অনুরূপ শাস্তি দেয়া হবে (সহিহুল বোখারী)। ইসলামে আত্মঘাতী হামলা করার সুযোগ নেই। আল কোরআনের অপব্যাখ্যাকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন : "যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা এটা ঐ অংশের মধ্যে পড়ে যা অস্পষ্ট ধর্ম বিশিষ্ট যোগাযোগ অন্বেষণের উদ্দেশ্যে।" (সূরা আল ইমরান ৭) এ গ্রুপ সম্পর্কে আলী (রা.) কর্তৃক ১৪টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। "মুসলিম জামায়াতের অনৈক্যকালে একটি পৃথক দলের আবির্ভাব ঘটবে, এরা বয়সে তরুণ, কথাবার্তায় যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীদের ভাষায় কথা বলবে। ‘সলাত সিয়ামের ব্যাপারে সাধারণ মুসলিম হতে এদের উঁচুদের শ্রেষ্ঠলোক বলে মনে হবে, কিন্তু বুদ্ধি বিচক্ষণতায় দূরদৃষ্টি ভবিষ্যৎ চিন্তার ব্যাপারে অতি নি¤œমানের হবে। এরা কোরআন পড়বে এবং মনে করবে কোরআন তাদের পক্ষে সমর্থন করছে অথচ কোরআন তাদের মতামতের বৈপরীত্য প্রমাণিত। মা আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, "এরা আমাদের উম্মতের মধ্যে জঘন্য শ্রেণী।"(আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া ৭ম খ- ৩১১ পৃষ্ঠা হতে ৩৩২ পৃষ্ঠায় ঐ হাদিসগুলো বর্ণিত) যারা জিহাদের নামে সন্ত্রাস, ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নামে খুনোখুনি ও মুসলিম হত্যা বৈধ মনে করে, তারা ভুল পথে রয়েছে এ কথা কোরআনের আয়াত ও রসূলের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বরং এটা শয়তানের কুমন্ত্রণা ও ধর্মের বাড়াবাড়ির ফল মাত্র। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন, "দ্বীন নিয়ে কোনো জবরদস্তি নেই, সকল বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা থেকে সরল শুদ্ধ সত্য পথ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। (সূরা বাকারাহ ২৫৬)। আল্লাহ তায়ালা সূরা নাহলের ১২৫নং আয়াতে বলেন, "তোমার বিধাতা প্রতিপালকের পথে জ্ঞানের কথা বুঝিয়েও উত্তমরূপে উপদেশ শুনিয়ে আহ্বান কর, সকলকে আর যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে আলোচনা কর তাদের সাথে এমনভাবে যা সর্বত্তম।" এছাড়া দুর্নীতি আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। সন্ত্রাস দুর্নীতি আমাদের সমাজে শক্তভাবে আসন গেড়ে বসেছে। সমাজের এমন কোনো সেক্টর নেই সেখানে দুর্নীতির ছোবল হানছে না। আমাদের অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) উন্নত চরিত্র অর্জন করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদিস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যার চরিত্র সুন্দর সেই পূর্ণ মু'মিন। তিনি নিজের উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি উন্নত চরিত্র ও মহত গুণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটি জাতিকে শুধু চারিত্রিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত জাতিতে পরিণত করেছিলেন। সুতারাং আমাদের দুর্নীতিমুক্ত চারিত্রিক অবক্ষয় ও অধঃপতন থেকে মুক্ত হতে হবে। আর সে জন্য ধর্মীয় শিক্ষা জরুরি। সন্ত্রাসী কর্মকা- ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হলো সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী কর্মকা- করে পার পেয়ে যায়। তারা শাস্তির সম্মুখীন হয় না। তাদের উপযুক্ত বিচার হয় না। তারা বরং সরকারের প্রশ্রয় পায়। এত একজনের দেখা দেখি অন্যজন সন্ত্রাসী কর্মকা- করতে সাহস পেয়ে যায়। নতুন প্রজন্ম সরকারের সমর্থক হয়ে সন্ত্রাস করার দুঃসাহস দেখায়। তাদের ভরসা হলো কোনো সমস্যা হলে দলের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। যেন ক্ষমতাসীন লোকদের সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাবার অনুমতি আছে। বিচার হবে, যদি বিরোধী দল সন্ত্রাস করে। এ মানসিকতার কারণে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের লোকেরা দেশটাকে লুটেপুটে খায়। এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ইসলামের বিধান হলো, যে অপরাধ করবে তার শাস্তি হবে। সে যত বড় ক্ষমতাসীন ও সম্ভ্রান্ত হোক না কেন। একবার রাসূল (সা.) এর যুগে জনৈকা মহিলার চুরির অভযোগ এলে তিনি তার হাত কাটার নির্দেশ দেন। মহিলা সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়ায় কেউ কেউ তার হাত না কাটার জন্য সুপারিশ করলেন। তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রোধান্বিত হয়ে বলেছিলেন, আমার মেয়ে ফাতেমা যদি আজ চুরি করত তাহলে আমি তার হাত কেটে দিতাম।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক