নুষ হিসেবে সৃষ্টির শুরু থেকেই মৌলিক কিছু বিষয়ের প্রতি মানুষের ঝোঁক বা প্রবণতা রয়েছে।কোনো কালেই মানুষ এই প্রবণতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না,থাকবেও না। এরকম অনিবার্য একটি মানবীয় প্রবণতা হচ্ছে দ্বীনের প্রতি তার ঝোঁক। বিশ্ব স্রষ্টাকে চেনা এবং স্রষ্টার প্রার্থনা করার প্রয়োজনীয়তা মানুষের মাঝে সবসময়ই ছিল। যুগে যুগে এই প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে দ্বীন বা ধর্ম। তথ্য প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ বর্তমান বিশ্বেও দ্বীনের প্রতি মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। এই আগ্রহের কারণেই মানুষ আজও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে। আমরা এরকম কজন দীক্ষিত মুসলমানের কথা শোনার চেষ্টা করবো এই আসরে। আপনারা আমাদের সাথেই আছেন যথারীতি এ প্রত্যাশা রইলো।
ইউরোপে রেনেসাঁস এবং শিল্প বিপ্লবের পর জ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথেসাথে অনেকেই দ্বীনকে মানব জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কিংবা তাকে অপ্রয়োজনীয় বলে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য কোনোভাবেই মানুষের এই আধ্যাত্মিক চাহিদা কোনোভাবেই মেটাতে পারে নি। এ কারণে আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মানুষ বিচিত্র সমস্যার মুখে পড়ে। মার্কিন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ "বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে আমরা যান্ত্রিক দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি ও সক্ষমতা অর্জন করেছি কিন্তু লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দিক থেকে ফকির হয়ে গেছি। আজকের মানব সমাজ তার আত্মার তুলনায় বস্তুর ওপর অনেক বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে বা বলা চলে আধিপত্য বিস্তার করেছে।"
অন্যভাবে বলা যায় প্রকৃতি বিজ্ঞান জ্বলন্ত বাতির মতো অন্ধকারের অন্তত একটি অংশকে মানুষের সামনে আলোকিত করে তুলতে পেরেছে অর্থাৎ মানুষ আগে যে সম্পর্কে জানতো না সে বিষয়ে জানতে পেরেছে। কিন্তু এই বাতি সর্বপ্রকার অন্ধকার দূর করতে সক্ষম হয় নি। মানুষ যতোই বিজ্ঞানে উন্নতি করছে, ততোই নতুন নতুন অজানার সাথে পরিচিত হচ্ছে ঠিকই, তবে আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতা ক্রমশ ম্লান হচ্ছে, আর আধ্যাত্মিকতার ম্লানিমায় নৈতিকতাহীনতা, দুর্নীতি আর আত্মপরিচয়হীনতার সংকটে বিশ্ব ভরে গেছে। ব্রাজিলের বিখ্যাত লেখক খুজুয়ে দোক্যাস্ট্রো এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ "বিশ্ব শিল্প ও বিজ্ঞানে ব্যাপক উন্নতি করেছে কিন্তু বিশ্ব নীতি সেই হিংস্রতার যুগ অতিক্রম করছে।"
বর্তমান বিশ্ব বিচিত্র সংকটের মুখোমুখি। আধুনিক সমাজ নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক দিক থেকে ভয়াবহ দারিদ্রের শিকার। এই সংকটের কারণ বা উৎস পর্যালোচনা করতে গিয়ে বহু চিন্তাবিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সৌভাগ্য ও মর্যাদার আকাশে উড়তে গেলে মানুষের দুটি পাখার প্রয়োজন রয়েছে। একটি পাখা হলো বিজ্ঞানের অপরটি আধ্যাত্মিকতার। দ্বীন এবং ঐশী শিক্ষাগুলো বাতির মতো জীবন পথের অন্ধকার গলিগুলোকে আলোকিত করে তোলে, যাতে বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুগত উন্নয়ন মানুষকে তার সৌভাগ্যের পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। বর্তমানকালে দ্বীন এবং আধ্যাত্মিকতা মানুষের চোখের সামনে আলোর দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছে। ইসলাম এবং তার শ্বাশ্বত শিক্ষাগুলো এর পেছনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতায় ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষেরা তাদের জীবন জিজ্ঞাসার ভুরি ভুরি প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে ইসলামকেই তারা তাদের পথ চলার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। তারা লক্ষ্য করেছে ইসলাম তাদের চাওয়া পাওয়াগুলো বিশেষ করে তাদের জীবনের সাথে মোটেই সাংঘর্ষিক নয়,বরং ইসলাম তাদের সৌভাগ্যের চূড়ায় ওঠার সহায়ক সঙ্গী। তারা তাই ইসলামকেই এখন তাদের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎপর আন্তর্জাতিক ইসলামী গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলাম নিয়ে পড়ালেখার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এই সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী পশ্চিমারা তাদের জীবন জিজ্ঞাসার জবাব খুজেঁ বেড়াচ্ছে যেমন মানুষ কী কিংবা মানুষের ভবিষ্যৎ কী ইত্যাদি জাতীয় প্রশ্ন। পশ্চিমা মতবাদগুলোতে তারা তাদের প্রশ্নের যথার্থ কোনো উত্তর খুজেঁ না পেয়ে ইসলাম নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেছে এবং ইসলামে সেসব জবাব পেয়ে তারা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। আসলে ইসলামের যে চমৎকৃতি রয়েছে তা-ই এই ধর্মের বিস্তারের জন্যে যথেষ্ট। ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শ্রেষ্ঠতম আকর্ষণটি ছিল এর নৈতিক সৌন্দর্যের দিকটি। সেই সূচনালগ্ন থেকেই ইসলামের এই সৌন্দর্য ছিল এবং এখনো আছে। আর এই চমৎকৃতি এবং আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আলকোরআন। ইসলামের উদার চিন্তাভাবনা এবং তার উন্নত ও শক্তিশালী শিক্ষা মানুষকে তার দিকে স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যায়েদ শাকের নাম এক ভদ্রলোক। তিনি এখন সেখানকার মুসলমান সমাজের ধর্মীয় উপদেষ্টা হিসেবে কর্মতৎপর রয়েছেন। পশ্চিমা সমাজে যারা ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদেরই একজন তিনি। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান বিভিন্ন ধর্ম ও আকিদা বিশ্বাস নিয়ে গবেষণা করার পর যায়েদ শেষ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। যায়েদ নিজে বলেছেনঃ "আমি মূলত জীবনার্থের গভীরতা এবং জীবন বাস্তবতার সন্ধানে ছিলাম। যখন আমি যৌবনে পা রাখলাম,খুব দ্রুতই টের পেলাম যে জীবন আসলে বস্তুতান্ত্রিকতার অনেক উর্ধ্বে। সেজন্যে আমি আমার নিজের ভেতরে এবং আমার চারপাশে বিরাজমান যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে অন্য এক ভূবনে হারিয়ে যেতাম, যতোই চিন্তা ভাবনা করতাম কোনো কূলকিনারা পেতাম না। সত্যের সন্ধান করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা করতে লাগলাম। প্রথমেই পড়লাম খ্রিষ্টান ধর্ম নিয়ে কেননা আমার পরিবার এবং সমাজও ছিল খ্রিষ্টান। আমি অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না,বিভিন্ন বইপুস্তক পড়ার ফলে ধীরে ধীরে এই ধর্মের ব্যাপারে আমার ভেতরে সংশয়-সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে খ্রিষ্টান ধর্ম নিয়ে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কমিউনিজম নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে বুঝতে পারলাম কমিউনিজমেও প্রচুর অসম্পূর্ণতা রয়েছে। সবশেষে ইসলাম সম্পর্কে একটা বই পড়লাম। ঐ বইটি পড়ে আমার ভেতরের সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম ইসলাম একটি সামাজিক দ্বীন বা জীবন বিধান। ইসলাম নিয়ে আরো কয়েক মাস পড়ালেখা করার পর আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম।" আমি ইসলামে অন্যরকম এক শান্তি ও নিরাপত্তা খুঁজে পেলাম। আল্লাহর জিকির আমাকে প্রশান্তির সেই উৎসের সাথে যুক্ত করে এবং জিকির আমার আত্মার বিকাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম এখন বিকাশ লাভ করছে। পশ্চিমা এক গবেষক মনে করেন আগামি ৫০ বছরে ইউরোপ হবে ইসলাম বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। গবেষণায় দেখা গেছে ইউরোপে এখন ধর্মীয় সচেতনতা অনেক বেশি বিস্তীর্ণ ও বিকাশমান। ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে প্রকাশিত একটি উর্দু দৈনিক জানিয়েছে গত বছর ৫ হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ মুসলমান হয়েছে। ইসলামের মানুষ গড়ার শিক্ষাই তাদেরকে মুসলমান হবার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে।