এ প্রবন্ধে আমরা খোদা পরিচিতির সংক্রান্ত একটি ভূমিকা, পরিচিতির শ্রেণী, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচিতি এবং ফিতরাতগত পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করবো)
ভূমিকা
আমরা জানি যে, দ্বীনের মূলনীতিগুলো বিশ্ব-সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকে রূপ পরিগ্রহ করে এবং ঐশী বিশ্বদৃষ্টি ও বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির মধ্যে মূল পার্থক্যও এ বিশ্বাসের (সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব) উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে।
অতএব, সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্যে সর্বপ্রথমেই যে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হয় এবং সর্বাগ্রেই যার সঠিক উত্তর জানতে হয় তা হল, খোদার অস্তিত্ব আছে কিনা? আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়–চাই তার ফল হোক ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক।
যদি এ অনুসন্ধানের ফল ইতিবাচক হয়, তবে খোদা সংক্রান্ত খুটনিাটি বিষয়গুলোকে (একত্ব, ন্যায়বিচার এবং খোদার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য) বিবেচনার পালা আসে। অনুরূপভাবে যদি অনুসন্ধানের ফল নেতিবাচক হয় তবে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর তখন দ্বীন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গৌণ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচিতি
মহান আল্লাহ্ সম্পর্কে দু’ধরনের পরিচিতির ধারণা পাওয়া যায়: একটি হল প্রত্যক্ষ পরিচিতি এবং অপরটি হল পরোক্ষ পরিচিতি।
প্রত্যক্ষ পরিচিতি
খোদার প্রত্যক্ষ পরিচিতি বলতে বুঝায়-মানুষ মস্তিষ্কগত ভাবার্থের সাহায্য ব্যতিরেকেই এক ধরনের অন্তর্জ্ঞান ও অভ্যন্তরীণ অনুভূতির মাধ্যমে খোদার সাথে পরিচিত হয়। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, যদি কেউ খোদা সম্পর্কে সচেতন অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে (যেরূপ অনেক উচ্চপর্যায়ের আরেফরা দাবী করে থাকেন তবে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু (যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে) এ ধরনের প্রত্যক্ষজ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান সাধারণ কোন ব্যক্তির জন্যে কেবলমাত্র তখনই সম্ভব যখন সে আত্মগঠন ও আধ্যাত্মকি সাধনার পর্যায়গুলো অতিক্রম করবে। তবে এর দুর্বল পর্যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উপস্থিত থাকলেও যেহেতু সচেতন অবস্থায় নেই, সেহেতু তা সচেতন বিশ্বদৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়।
পরোক্ষ পরিচিতি
পরোক্ষ পরিচিতি বলতে বুঝায় যে, মানুষ সামগ্রিক ভাবার্থের (সৃষ্টিকর্তা, অমুখাপেক্ষী, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞা) মাধ্যমে মহান আল্লাহ সম্পর্কে মস্তিষ্কগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও এ ধরনের ‘অদৃশ্যগত’ অর্থ অনুধাবন করে থাকে। আর এভাবে সে বিশ্বাস করে যে, এ ধরণের অস্তিত্ব বিদ্যমান (যিনি এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন)। অতঃপর, অন্যান্য পরোক্ষ পরিচিতি এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে বিশ্বদৃষ্টির সাথে সংগতিপূর্ণ একশ্রেণীর বিশ্বাস প্রবর্তিত হয়ে থাকে। যা সরাসরি বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিক যুক্তি-প্রামাণের মাধ্যমে অর্জিত হয় তা-ই হল পরোক্ষ পরিচিতি। কিন্তু যখন এ ধরণের পরিচিতি অর্জিত হয় কেবলমাত্র তখনই মানুষের জন্যে স্বাগতিক প্রত্যক্ষ পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকে।
ফিতরাতগত খোদা পরিচিতি
ধর্মীয় নেতাগণ, আরেফগণ এবং মনীষীগণের অধিকাংশ বক্তব্যেই আমরা খুঁজে পাই যে, খোদা পরিচিতি ফিত্রাতগত, অর্থাৎ মানুষ ফিত্রাতগতভাবেই খোদাকে চিনে থাকে। সুতরাং উপরোক্ত বিবরণসমূহের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়ার নিমিত্তে ‘ফিত্রাত’ শব্দটির ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে করি।
ফিত্রাত, একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হল ‘সৃষ্টি প্রকরণ (ধরণ)’ এবং কোন বিষয় ফিত্রাত সংশ্লিষ্ট (ফিত্রাতের সাথে সম্বন্ধযুক্ত) বলে পরিগণিত হবে তখনই, যখন বিদ্যমান সৃষ্টি এদেরকে ধারণ করবে। সুতরাং এদের জন্যে তিনটি বিশেষত্ব বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. প্রত্যেক শ্রেণীর ফিত্রাতগত বিশেষত্ব ঐ শ্রেণীর সকল সদস্যের মধ্যে পাওয়া যায়, যদিও তীব্রতা ও ক্ষীণতার দৃষ্টিকোণ থেকে এদের মাত্রাভেদ পরিলক্ষিত হয়।
২. ফিতরাত্গত বিষয়সমূহ তাদের ইতিহাস পরিক্রমায় সর্বদা অপরর্বিতনীয় এবং এমন নয় যে, ইতিহাসের একাংশে সৃষ্টির ফিতরাত এক বৈশিষ্ট্যের অধকিারী, আর অন্য অংশে অপর কোন বৈশিষ্টের।
৩. ফিতরাত্গত বিষয়সমূহ যে দৃষ্টিকোণে ফিত্রাতসম্বন্ধীয় এবং সৃষ্টিপ্রকৃতি কর্তৃক ধারণকৃত সে দৃষ্টিকোণে শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নেই, যদিও এদের দৃঢ়ীকরণ ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মানুষের ফিত্রাতগত বিশেষত্বকে দু’শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে:
১. ফিত্রাতগত পরিচিতি, যার সাথে প্রত্যেক মানুষই কোন প্রকার শিক্ষা-দীক্ষা ব্যতিরেকেই পরিচিত হয়ে থাকে।
২. ফিত্রাতগত প্রবণতা ও চাহিদা, যা সৃষ্টির প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই বিদ্যমান।
অতএব, যদি এমন এক ধরনের খোদা পরিচিতি প্রত্যেকের মধ্যেই থেকে থাকে যে, প্রশিক্ষণ ও আয়ত্তকরণের প্রয়োজন নেই তবে, তাকে ‘ফিত্রাতগত খোদা পরিচিতি’ নামকরণ করা যেতে পারে। আর যদি, খোদার প্রতি এবং খোদার উপাসনার প্রতি এক ধরনের প্রবণতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, তবে তাকে ‘খোদার ফিত্রাতগত উপাসনা’ বলা যেতে পারে।
খোদা পরিচিতিও মানুষের ফিতরাতগত চাহিদারূপে জ্ঞাত হয়েছে। কিন্তু ‘খোদার ফিত্রাতগত উপাসনা’ যেমন সচেতন প্রবণতা নয় তেমনি ‘ফিতরাতগত খোদা পরিচিতিও’ সচেতন পরিচিতি নয় যে, কোন সাধারণ ব্যক্তিকে খোদার শনাক্তকরণের জন্যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা থেকে অনির্ভরশীল করবে।
তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যেহেতু প্রত্যেকেই অন্ততঃ এক ক্ষীণ মাত্রায় ফিতরাতগত প্রত্যক্ষ পরিচিতির অধিকারী সেহেতু সামান্য একটু চিন্তা ও যুক্তির অবতারণাতেই খোদার অন্তিত্বকে স্বীকার করে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে অবচেতন স্তরের অন্তর্জ্ঞান ভিত্তিক পরিচিতিকে সুদৃঢ় করে সচেতন স্তরে পৌঁছাতে পারে।
উপসংহার
উপসংহারে বলা যায়, খোদা পরিচিতি ফিত্রাতগত হওয়ার অর্থ হল এই যে, মানুষের অন্তর খোদার সাথে পরিচিত এবং তার আত্মার গভীরে খোদার সজ্ঞাত পরিচিতির জন্যে এক বিশেষ উৎস বিদ্যমান, যা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হতে সক্ষম। কিন্তু এ ফিত্রাতগত উৎস সাধারণ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এমন অবস্থায় নেই যে, তাদেরকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি থেকে অনির্ভরশীল করবে।
খোদা পরিচিতির সরল উপায়
(এ অংশে আমারা খোদাকে চিনার উপায়সমূহ, সরল উপায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ, পরিচিত নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করবো।)
খোদাকে চিনার উপায়সমূহ
মহান প্রভুকে চিনার জন্যে একাধিক উপায় বিদ্যমান। দর্শনের বিভিন্ন বইয়ে, কালামশাস্ত্রে, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন ভাষ্যে এবং ঐশী কিতাবসমূহেও এগুলো (উপায়) সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ যুক্তি-প্রমাণসমূহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পারস্পরিকভাবে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন: কোন কোন ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়সমূহ প্রতিজ্ঞা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে; যেখানে অন্য কোন ক্ষেত্রে খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়সমূহ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি প্রজ্ঞাবান প্রভুর অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন; যেখানে অন্যান্যরা শুধুমাত্র এমন এক অস্তিত্বময়কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যার অস্তিত্ব অপর কোন অস্তিত্বময়ের উপর নির্ভরশীল নয় (অর্থাৎ অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব) এবং তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিত করার জন্যে অপর এক শ্রেণীর যুক্তির অবতারণা করে থাকেন।
এক দৃষ্টিকোণ থেকে খোদা পরিচিতির যুক্তি-প্রমাণসমূহকে কোন এক নদী পারাপারের জন্যে বিদ্যমান বিভিন্ন পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এগুলোর কোন কোনটি কাঠের তৈরী সাধারণ পুল যা নদীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে এবং লঘু ভারবিশিষ্ট কোন ব্যক্তি খুব সহজেই একে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আবার কোন কোনটি হল প্রস্তর নির্মিত সুদৃঢ় এবং সুদীর্ঘ পুলের মত যার অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশী। কোন কোনটি আবার আঁকাবাঁকা, উঁচু-নীচু এবং সুদীর্ঘ টানেল বিশিষ্ট রেলপথের মত, যা গুরুভারের ট্রেনের জন্যে তৈরী করা হয়েছে।
যে সকল ব্যক্তি মুক্ত মস্তিষ্কের (خالي الذهن) অধিকারী, তারা অত্যন্ত সহজ উপায়েই আপন প্রভুকে চিনে তাঁর (প্রভুর) উপাসনায় নিয়োজিত হতে পারে। কিন্তু যদি কেউ সন্দেহের গুরুভার স্কন্ধে ধারণ করে, তবে তাকে প্রস্তর নির্মিত পুল অতিক্রম করতে হবে। আবার যদি কেউ সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দের বোঝা বহন করে চলে, তবে তাকে এমন কোন পথ নির্বাচন করতে হবে যা শত উঁচু-নীচু ও আঁকা-বাঁকা হলওে মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্মিত।
আমরা এখানে সর্বপ্রথমে খোদা-পরিচিতির সরল পথের প্রতি ইঙ্গিত করব। অতঃপর কোন একটি মাধ্যম সম্পর্কে বর্ণনা করব। কিন্তু দর্শনের মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আঁকা-বাঁকা পথটি শুধুমাত্র তাদেরকেই অতিক্রম করতে হবে, যাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য সন্দেহের দ্বারা সন্দিগ্ধ হয়ে আছে। অথবা তাদের মস্তিষ্ককে সন্দেহ মুক্তকরণের মাধ্যমে পশ্চাদ্ধাবন ও পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সরল উপায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ
খোদা-পরিচিতির সরলপথের একাধিক বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো গুরুত্বপূর্ণ:
১. এ পথ কোন প্রকার জটিল ও কৌশলগত প্রতিজ্ঞার (مقدمة) উপর নির্ভরশীল নয় এবং সরলতম বক্তব্যসমূহই এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। ফলে, যে কোন স্তরের ব্যক্তিবর্গের পক্ষেই অনুধাবনযোগ্য।
২. এ পথ প্রত্যক্ষভাবে প্রজ্ঞাবান ও পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র দিকে পরিচালিত করে থাকে, যা অনেক দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রগত যুক্তি-পথের ব্যতিক্রম। ঐ সকল কালামশাস্ত্র ও দার্শনিক যুক্তিতে সর্বপ্রথমেই ‘অনিবার্য অস্তিত্ব’ নামে এক অস্তিত্বময় বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারপর তার জ্ঞান, শক্তি, প্রজ্ঞা, সৃজনক্ষমতা, প্রতিপালকত্ব এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে অপর কোন যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করা আবশ্যক।
৩. এ পথ, অন্য সকল কিছুর চেয়ে ফিতরাতকে জাগ্রত করা ও ফিত্রাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণের ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। এ (ফিত্রাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণ) বিষয়গুলোর উপর চিন্তার ফলে এমন এক ইরফানী অবস্থা (আধ্যাত্মকি অনুভূতি) সৃষ্টি হয় যা মানুষের দিকে হস্ত প্রসারিত করে যার দ্বারা সে খোদার হস্তকে বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অবলোকন করে থাকে-সেই হস্ত যার সাথে তার ফিতরাত পরিচিত।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং ঐশী ধর্মসমূহের প্রবক্তাগণ এ পথকে সাধারণ জনসমষ্টির জন্য নির্বাচন করেছেন এবং সকলকে এ পথ অতিক্রম করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন; আর অন্যান্য পদ্ধতিসমূহকে, হয় বিশেষ কোন ক্ষেত্রের জন্য একান্তভাবে নর্ধিারণ করেছেন, অথবা নাস্তিক চিন্তাবিদ ও বস্তুবাদী দার্শনিকদের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময় প্রয়োগ করেছেন।
বিশ্বের সুনিপুণ বিন্যাস ব্যবস্থার প্রমাণ
খোদা পরিচিতির সরল পথ হল, এ বিশ্বে বিদ্যমান খোদার নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করা এবং কোরানের ভাষায় "আল্লাহ্র আয়াতসমূহ সম্পর্কে চিন্তাকরণ”। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল বিষয়বস্তু এবং মানব অস্তিত্বে উপস্থিত বিষয় গুলো যেন পরিচিতির কাঙ্খিত নিদর্শন এবং মানব মানসের সূচক, সে অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুর দিকে পথ নির্দেশ করে, যে অস্তিত্ব সর্বদা সর্বস্থলে উপস্থিত।
পাঠকমণ্ডলী, যদি কোন বই এখন আপনাদের হাতে থাকে তাও তাঁর (আল্লাহ্র) নিদর্শনসমূহেরই একটি। যদি তা-ই না হবে তবে কেন এ বইটি পড়ার সময় এর সচেতন ও অভিপ্রায়ী লেখক সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারছেন? কখনো কি এটা সম্ভব বলে মনে করেছেন যে, এ বইটি এক শ্রেণীর বস্তুগত, উদ্দেশ্যহীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে অস্তিত্বে এসেছে এবং এর কোন অভিপ্রায়ী লেখক নেই? এটা ভাবা কি বোকামী নয় যে, কোন একটি ধাতব খণিতে বিস্ফোরণের ফলে ধাতব কণিকাগুলো বর্ণমালায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ঘটনাক্রমে পত্রপৃষ্ঠে সন্নিবেশিত হয়ে লিখনের সৃষ্টি হয়েছে; অতঃপর অপর একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুশৃংখলিত ও বাঁধাইকৃত হয়ে একশত খণ্ডের একটি বিশ্বকোষের উৎপত্তি হয়েছে? কিন্তু জ্ঞাত ও অজ্ঞাত রহস্যময় ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ এ মহাবিশ্বের উৎপত্তির ঘটনাকে নিছক আকস্মকি এক ঘটনা বলে মনে করা উপরোল্লিখিত বিশ্বকোষের উৎপত্তির ঘটনার চেয়ে সহস্রবার বোকামীর শামিল।
হ্যাঁ, প্রতিটি পরিকল্পিত বিন্যাস ব্যবস্থাই তার পরিকল্পনাকারীর নিদর্শনস্বরূপ। আর এ ধরনের বিন্যাস ব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় এবং সর্বদা এমন এক সামগ্রিক শৃঙ্খলাই প্রকাশ করে যে, এক প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তা একে অস্তিত্বে এনেছেন এবং সর্বাবস্থায় তিনি এর পরিচালনায় নিয়োজিত। ফুলগুলো যে পুষ্পকাননে ফুটেছে, আর মাটি কর্দমার মাঝে রঙ বেরঙ সাজে ও সুগন্ধি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ থেকে ফলবৃক্ষ যে অঙ্কুরিত হচ্ছে এবং প্রতিবছর অজস্র সংখ্যক সুবর্ণ, সুগন্ধ ও সুস্বাদু ফল ধারণ করছে; তদ্রূপ নানা বর্ণ, নানা বিশেষত্ব ও নানারূপের অন্যান্য বৃক্ষরাজি ইত্যাদি সকল কিছুই তাঁরই (খোদার) অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে। অনুরূপ, পুষ্পশাখায় বুলবুলি যে গান গেয়ে যাচ্ছে; ডিম থেকে বের হয়ে মুরগীছানা যে পৃথিবীতে বিচরন করছে; নবজাতক গোবৎস যে মাতৃস্তন চোষণ করছে; দুগ্ধ মাতৃস্তনে নবজাতকের পানের জন্যে যে সঞ্চিত হচ্ছে ইত্যাদি সর্বদা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ বহণ করে থাকে। সত্যিই, কি এক আশ্চর্য যোগসূত্র ও বিস্ময়কর অভিসন্ধি রয়েছে যুগপৎ শিশুজন্ম ও মাতৃস্তনে দুগ্ধ সঞ্চারের মধ্যে।
মৎসসমূহ যে প্রতিবছর ডিম পাড়ার জন্যে শত শত কিলোমিটার পথ প্রথমবারের মত অতিক্রম করে; সামুদ্রিক প্রাণীসমূহ যে অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদের মাঝে আপন নীড়কে চিনে নেয়, এমনকি একবারের জন্যেও ভুলবশতঃ অপরের বাসায় প্রবেশ করে না, মৌমাছি যে, প্রত্যহ প্রাতে মৌচাক থেকে বের হয়ে যায় আর সুগন্ধযুক্ত ফুলে-ফলে বিচরণ করার জন্যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর গোধুলী লগ্নে যে পুনরায় স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে ইত্যাদি তাঁরই নিদর্শন।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল, যেমনি মৌমাছিরা তেমনি দুগ্ধবতী গাভী ও ছাগলরা প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের প্রয়োজনের চেয়েও অধিক মধু ও দুগ্ধ উৎপাদন করে থাকে, যাতে করে মানুষ এ সুস্বাদু উপাদেয় থেকে উপকৃত হতে পারে! কিন্তু পরিহাস, অকৃতজ্ঞ মানুষ নিজ বৈভবের পরিচিত মালিককে অপরিচিত বলে মনে করে এবং তাঁর সম্পর্কে তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়!
স্বয়ং এ মানবদেহেও বিস্ময়কর ও সুনিপূন কীর্তির প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট অঙ্গের মাধ্যমে শরীরীয় সংগঠন; সংশ্লিষ্ট উপাঙ্গের মাধ্যমে অঙ্গ সংগঠন; সংশ্লিষ্ট মিলিয়ন মিলিয়ন বিশেষ জীবন্ত কোষের মাধ্যমে উপাঙ্গ সংগঠন; প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের নির্দিষ্ট পরিমাণের সমন্বয়ে কোষ সংগঠন; শরীরের যথাস্থানে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সংস্থাপন; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের অভিপ্রেত কর্মতৎপরতা। যেমন: ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ ও লোহিত রক্তকণিকার মাধ্যমে তা দেহের বিভিন্ন কোষে সঞ্চালন, যকৃতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্লুকোজ উৎপাদন, নূতন কোষসমূহের সরবরাহের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের নিরাময় সাধন; শ্বেতকোষের মাধ্যমে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়া ও রোগজীবাণুকে প্রতিহতকরণ; একাধিক গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ, যেগুলো প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশের কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ইত্যাদি সকল কিছু তাঁরই অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে।
এই যে বিস্ময়কর বিন্যাস ব্যবস্থা যার সঠিক রহস্য উদঘাটনে শতসহস্র সংখ্যক বিজ্ঞানী কয়েক দশকাব্দী পথ অতিক্রম করার পরও ব্যর্থ হয়েছে, কার মাধ্যমে তা সৃষ্টি হয়েছে?
প্রতিটি কোষই একটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থার সংগঠনে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এক শ্রেণীর কোষসমষ্টি উপাঙ্গসমূহের সংগঠনে অংশ নেয়, যা অপেক্ষাকৃত এক বৃহৎ ব্যবস্থার সংগঠনে অংশ নেয়; অনুরূপ এ ধরনের একাধিক জটিল ব্যবস্থার সমন্বয়ে অভিপ্রেত শারীরিক সামগ্রিক ব্যবস্থা রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্তু এখানেই এ ঘটনার শেষ নয়, বরং অগণিত প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ অস্তিত্বের সমন্বয়ে বিশ্বপ্রকৃতি নামে অশুল-প্রান্তহীন এক বৃহত্তম ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়, যা একক পাণ্ডিত্যপূর্ণ পরিকল্পনার ছায়াতলে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
﴿إِنَّ اللّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذَلِكُمُ اللّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ﴾
"নিশ্চয় আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটিসমূহকে অঙ্কুরিত করেন, তিনি নিষ্প্রাণ থেকে জীবিতকে বের করেন এবং তিনিই জীবিত হতে নিষ্প্রাণকে বের করবেন; তিনিই আল্লাহ, তবে তোমরা কোন্দিকে (বিভ্রান্ত হয়ে) ফিরে চলেছ।” (সূরা আনআম-৯৫)!
এটা নিশ্চিত যে, মানুষের জ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তার লাভ করবে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে সমন্বয় ও নীতি যতই আবিস্কৃত হবে, ততই সৃষ্টির রহস্য উন্মোচিত হতে থাকবে। তবে প্রকৃতির এ সরল সৃষ্টিসমূহ ও সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করাই নিষ্কলুষ ও নির্মল হৃদয়ের জন্যে যথেষ্ট।
মূল: আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদী রচিত ‘অমুজেশে আকায়েদ’ গ্রন্থ
অনুবাদ: মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীন
সংগ্রহে : মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম
সঙ্কলন ও সম্পাদনা: আবুল কাসেম