ইমাম আলী (আ) এর চিন্তাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক গ্রন্থ নাহজুল বালাগায় আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়ে হযরত আলী বিন আবি তালিবের একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। নাহ্জুল বালাগ্বা গ্রন্থে সংকলিত উক্ত বক্তব্যের গুরত্বপূর্ণ কিছু অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো :
“সমস্ত প্রশংসা আর গৌরব আল্লাহর-যাঁর গুণ ও গুরুত্ব কোন যুগের কোন বাগ্মীই বর্ণনা করে শেষ করতে পারবে না। যাঁর করুণা আর বদান্যতার হিসাব করতে সর্বযুগের হিসেবী আর গণিতজ্ঞরাও হবে ব্যর্থ,শত চেষ্টা করেও তাঁর প্রতি যথাযোগ্য কৃতজ্ঞতা জানানো সম্ভব নয় কারো পক্ষে। যত কঠোর শ্রমই করা হোক না কেন,কেউ-ই বুঝতে বা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে না তাঁর অস্তিত্ব ও সত্তা। যুক্তি-বিবেচনা দিয়ে তাঁর নাগাল মিলে না। বুদ্ধি,বোধশক্তি ও বিদ্যার গভীরতা দিয়ও উপলব্ধি করা যায় না আল্লাহর জাতের। মানব মনীষার বোধ,বোধি,উপলব্ধি আর পান্ডিত্য তাঁকে দেখতে অক্ষম। তাঁর সিফাতকে (গুণাবলীকে) করা যায় না নির্দিষ্ট,সীমিত-আর কোন রকম সংজ্ঞায় বাঁধা। পৃথিবীর কোন ভাষায় এমন শব্দ নেই,যা দিয়ে তাঁর সিফাত (গুণাবলী) আর জাত (সারসত্তা) বর্ণনা করা যায়। তিনি চিরন্তন ও চির বিদ্যমান ---তাই করা যায় না তাঁর সূচনার সময় নির্দেশ বা তাঁর বিদ্যমানতার সময়-সীমা নিরূপণ। বিশ্ব সৃষ্টি,বায়ু মণ্ডলের বিশ্বব্যাপী বিস্তার,তরল মাটি ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে পাহাড় পর্বতে পরিণতি,যা বিশ্ব-দেহে খুটির কাজ করছে ---এ সবই আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন। ধর্মের পথে প্রথম পদক্ষেপ হলো আল্লাহকে স্বীকার করে,বুঝে নিজের প্রভু হিসেবে মেনে নেয়া। বিশ্বাস আর দৃঢ়-স্বীকৃতিতেই নিহিত ঈমানের পূর্ণাঙ্গতা। সত্যকার বিশ্বাস হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই,তা আন্তরিকতার সাথে মেনে নেয়া। তৌহিদে বিশ্বাসের সত্যকার রূপ হচ্ছে-আল্লাহ্ সম্পূর্ণ পাক আর স্বভাব বা প্রকৃতির ঊর্দ্ধে,তাঁর সাথে যেমন কিছুই যোগ করা যায় না,তেমনি যায় না কিছু বিয়োগ করাও,এমনকি তাঁকে উপলব্ধি করাও।
উপলব্ধি করা চাই যে,আল্লাহর জাত আর তাঁর সিফাত বা গুণাবলীতে কোন পার্থক্য নেই,আর এ দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য করা অন্যায় ও অনুচিত। তাঁর জাত থেকে তাঁর সিফাতকে (গুণাবলীকে) যে পৃথক মনে করে,বুঝতে হবে সে আল্লাহর একত্ব বিসর্জন দিয়ে দ্বিত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে।
এরকম মানুষই আল্লাহর খণ্ড অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। এ রকম বিশ্বাস যে পোষণ করে,তার পক্ষে আল্লাহর সত্যকার উপলব্ধি সম্ভব নয়---সে অজ্ঞ,সে সব সময় নিজের কোন কাল্পনিক বস্তুকেই দেবতা ভাবতে চেষ্টা করে। যে কেউ এমন বিশ্বাস পোষণ করে,সে আল্লাহর অস্তিত্ব সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে---সে চাইবে তাঁকে স্থানে বা বিশেষ বিশেষ ক্ষমতায় বা সিফাতে (গুণাবলীতে) আবদ্ধ করে রাখতে। এভাবে সে নিজেই আল্লাহকে নিজের সৃষ্ট বস্তুর সমস্তরে নামিয়ে আনে।
তিনি কোন স্থান বিশেষের গুণে গুণান্বিত এ ধারণা করে সেভাবে তাঁকে নির্দেশ করা অথবা তিনি কোন বিশেষ অবস্থা বা ঘটনায় আবদ্ধ বিশ্বাস করা বা তাঁকে ছাড়াই কোন বিশেষ কাল বা স্থান থাকতে পারে মনে করার অর্থ তাঁর সর্বজ্ঞতা,আর সর্ব উপস্থিতিকেই অস্বীকার করা এবং সে ধারণাকেই রদ্ (বাতিল) করে দেওয়া। এরকম সব ধারণার ফলে আল্লাহর অস্তিত্ব সংখ্যাভিত্তিক ঐক্যে পরিণত হবে (অর্থাৎ সংখ্যার মতো যার যোগ-বিয়োগ ও গুণ-ভাগ চলে)।
আল্লাহর জন্যে স্থান নির্দেশ করা-কোন স্থান বিশেষে বা তার উপরে তিনি আছেন মনে করা,মানে তাঁকে স্থানে সীমিত করা আর স্থান থেকে তাঁকে খাটো করা। আর এতে এও বুঝা যায় যে তাঁকে ছাড়া অর্থাৎ তাঁর চির উপস্থিতি বা অবস্থানের বাইরেও স্থান থাকা সম্ভব।
তাঁর অস্তিত্ব চিরন্তন-কোন নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর আবির্ভাব ঘটেনি আর তিনি নন কারো দ্বারা সৃষ্ট। তাঁর অস্তিত্বও আসেনি অনস্তিত্ব থেকে। প্রত্যেক বস্তুর সঙ্গেই তিনি আছেন--তবে শারীরিক বা দৈহিকভাবে নয়,তিনি সব কিছু থেকে দূরে--তার মানে দৈহিক দূরত্বে নয় বা তিনি নন্ নির্লিপ্ত কি উদাসীন সব কিছু সম্বন্ধে। তিনি সক্রিয় ও কর্মরত,তবে তার কর্মে কি ক্রিয়ায় দৈহিক কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গ সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না--প্রয়োজন হয় না কোন যন্ত্রপাতি বা হাতিয়ারের। দেখার মত সৃষ্ট বস্তু যখন ছিলো না তখনো তিনি দেখতেন। তিনি এক ও নিঃসঙ্গ -কারণ,তাঁর কোন সঙ্গী নেই,যিনি তাঁকে সঙ্গ দেবেন বা যার সঙ্গের অভাব তিনি বোধ করবেন।
তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একই সময় আর একই সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন। সে সবকে আর তাতে যা কিছু আছে সবই অতি নিখুত আর চমৎকারভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন। কোন রকম দুর্ভাবনা ছাড়াই তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার ফলাফল দেখে,নিজের পরিকল্পনাকে শোধরিয়ে তিনি কিছু করেন নি-প্রয়োজন হয়নি তাঁর তেমন কোন প্রক্রিয়ার। এ জন্যে তাঁর অস্তিত্বকেও করতে হয়নি ক্রিয়াশীল। আগাম কোন পরিকল্পনা করে,সযত্নে তার কার্যকারিতা দেখে নিয়ে তবে বিশেষ কোন কর্মসূচী বাস্তবায়নে হাত দিতে তিনি বাধ্য হননি। অর্থাৎ সে সব মানবীয় প্রক্রিয়া তাঁর হয়নি কোন দরকার .............।”( নাহ্জুল বালাগ্বা,খুতবা নং-১)