১৯৫ হিজরীর ১০ই রজব আহলে বাইতের নবম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম মুহাম্মদ,কুনিয়াহ আবু জাফর এবং তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধি হচ্ছে ‘তাকী’এবং ‘জাওয়াদ’। এই মহান ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছ্ ।
ইমাম জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর পিতা ছিলেন অষ্টম ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) এবং তাঁর মাতার নাম ছিল ‘সাবিকাহ’। ইমাম রেজা (আ.) তাঁকে ‘খিযরান’ বলতেন। এই মহীয়ষী রমণী রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী মারিয়া কিবতির বংশের ছিলেন।
ইমাম রেজা (আ.)-এর বোন হাকিমাহ বলেন : ইমাম রেজা (আ.) আমাকে ইমাম মুহাম্মদ তাকী (আ.)-এর জন্মের সময় খিযরানের কাছে থাকার নির্দেশ দেন। নবজাতক জন্মের তৃতীয় দিবসে আকাশের দিকে তাকাল অতঃপর ডানে ও বায়ে দেখল এবং বলল :
(اشهدُ ان لا اله الاّ الله و اشهد انّ محمّداً رسول الله )
‘অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল।’
আমি এই বিস্ময়কর ঘটনা অবলোকন করে তড়িৎ ভাইয়ের কাছে গিয়ে যা দেখেছি তা বর্ণনা করলাম। ইমাম রেজা (আ.) বললেন,‘যা দেখেছ তার চেয়ে আরও বেশি আশ্চর্যজনক ঘটনা ভবিষ্যতে তার থেকে দেখতে পাবে’ (মানাকেব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৯৪)।
আবু ইয়াহিয়া সানয়ানী বলেন : ইমাম রেজা (আ.)-এর খেদমতে ছিলাম। এমন সময় ছোট্ট শিশু ইমাম জাওয়াদকে তাঁর কাছে আনা হলে তিনি বলেন : ‘এই শিশু এমন শিশু যে,শিয়াদের জন্য তাঁর থেকে বরকতময় আর কেউই দুনিয়াতে আসেনি।’
নোফেলি বলেন : ইমাম রেজা (আ.)-এর সাথে একত্রে খোরাসান যাওয়ার পথে তাঁকে সবিনয়ে নিবেদন করলাম : আমার প্রতি কোন আদেশ উপদেশ আছে কি? তিনি বললেন : ‘তোমার প্রতি নির্দেশ হলো : আমার পর আমার পুত্র মুহাম্মদের অনুসরণ করবে। জেনে রাখ আমি এমন এক সফরে যাচ্ছি যেখান থেকে আর কোনদিন ফিরব না (উয়ুনু আখবারুর রেজা,২য় খণ্ড,পৃ. ২১৬)।
ইমাম রেজা (আ.)-এর ব্যক্তিগত লেখক মুহাম্মদ ইবনে আবি ইবাদ বলেন,ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পুত্র ইমাম জাওয়াদকে কুনিয়া ধরে সম্বোধন করতেন। (আরবদের মধ্যে যখন কাউকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয় তখন তাকে কুনিয়া ধরে সম্বোধন করা হয়)। যখন ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছ থেকে কোন পত্র আসত,ইমাম রেজা (আ.) খুশী হয়ে বলতেন,‘আবুজাফর আমাকে লিখেছে.।’ আবার যখন ইমাম রেজা (আ.) আমাকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর কাছে চিঠি লিখতে বলতেন,তাঁকে সম্মানের সাথে খেতাব করতেন। আর ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর পক্ষ থেকে যে সমস্ত পত্র আসত,তা খুবই সুন্দর বাচন ভঙ্গি ও বাক্যালংকারে পূর্ণ থাকত।
মুহাম্মদ ইবনে আবি ইবাদ আরও বলেন,ইমাম রেজাকে বলতে শুনেছি যে,তিনি বলতেন,‘আমার পরে আবু জাফর হচ্ছে আমার উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত’ (উয়ুনু আখবারুর রেজা,২য় খণ্ড,পৃ. ২৪০)।
মুয়াম্মার ইবনে খাল্লাদ বলেন,ইমাম রেজা (আ.) কিছু কথা স্মরণ করে বলেন : আমার থেকে শোনার প্রয়োজন নেই,আবু জাফরকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি,যে কোন প্রশ্ন ও সমস্যা থাকলে তাকে প্রশ্ন করো সে জবাব দিবে। আমাদের পরিবার এমন এক পরিবার যে এ পরিবারের সন্তানরা তাঁদের মহান পিতাগণের কাছ থেকে ইলমের হাকিকাত (জ্ঞানের নিগুঢ় রহস্য) ও মারেফাত পূর্ণরূপে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেন। (উদ্দেশ্য এটাই যে পূর্বের ইমামের সমস্ত মর্যাদা এবং জ্ঞান পরবর্তী ইমামের কাছে স্থানান্তরিত হয়। আর এটা শুধুমাত্র ইমামগণের বেলায় প্রযোজ্য ইমামগণের অন্যান্য সন্তানদের বেলায় নয়। (উসূলে কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২১,এরশাদ,শেখ মুফিদ,পৃ. ২৯৮।)
খাইরানী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন,খোরাসানে ইমাম রেজা (আ.)-এর খেদমতে ছিলাম,কেউ প্রশ্ন করল : যদি আপনি আমাদের মাঝ থেকে চলে যান তাহলে কার শরণাপন্ন হব? ইমাম রেজা (আ.) বলেন : ‘আমার পুত্র আবু জাফরের শরণাপন্ন হবে।’
প্রশ্নকারী হয়ত ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর বয়সকে ইমামতের জন্য উপযুক্ত মনে করেনি এবং মনে করেছিল একটি বালক কিভাবে ইমামতের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে? ইমাম রেজা (আ.) বললেন : ‘আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসাকে শৈশবে দোলনাতেই নবুওয়াত দান করেছেন। আর আবু জাফরতো এখন ৮ বছরের বালক,আল্লাহর কাছে কিছুই অসম্ভব নয়”(উসূলে কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২২,এরশাদে শেখ মুফিদ,পৃ. ২৯৯)।
আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর বলেন,ইয়াহিয়া ইবনে সাফওয়ানের সাথে ইমাম রেজা (আ.)-এর নিকটে উপস্থিত হলাম। সেখানে তিন বছরের বালক ইমাম জাওয়াদও ছিলেন। ইমাম রেজাকে সবিনয়ে নিবেদন করলাম : আল্লাহ না করুন,আপনি যদি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান,তাহলে আপনার উত্তরাধিকারী কে হবেন? ইমাম রেজা (আ.) আবু জাফরের দিকে ইশারা করে বললেন,আমার এ সন্তানই আমার উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত। বললাম : এত কম বয়সে? তিনি বললেন : হ্যাঁ,এ বয়সেই। আল্লাহ্ তায়ালা হযরত ঈসা (আ.)-কে শৈশবেই নবুওয়াত দান করেছেন,অথচ তখন তাঁর বয়স তিন বছরও ছিল না (কেফায়াতুল আছার,পৃ. ৩২৪; বিহারুল আনওয়ার,৫০তম খণ্ড,পৃ. ৩৫)।
ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদ (আ.) তাঁর মহান পিতার শাহাদতের পর ২০৩ হিজরির ১৭ সফর পৃথিবীতে ইমাম ও আল্লাহর খলিফার দায়িত্বশীল হিসাবে নিযুক্ত হন। এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। ইমাম জাওয়াদের বয়স কম হওয়ার কারণে অজ্ঞরা প্রায়ই তাঁকে পরীক্ষা করত। কিন্তু ইমামের খোদায়ী জ্ঞানের দ্যুতি এতই বেশি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত যে,হযরত ইয়াহিয়া ও ঈসা (আ.)-এর শৈশবে নবুওয়াত প্রাপ্তির বিষয়টি প্রমাণের জন্য এই মহান ইমামের দৃষ্টান্ত আনা প্রয়োজন হতো অর্থাৎ তাঁদের নবুওয়াতকে ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর ইমামতের মাধ্যমে প্রমাণ করা হতো।
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর জীবনকাল ছিল তাঁর পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির তুলনায় সংক্ষিপ্ত। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি ইমাম হন আর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। অবশ্য তিনি অনেক সাহিত্য-কর্ম রেখে গেছেন এবং বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তি লাভ করেছেন।
মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে আম্মার বলেন,দু’বছর যাবৎ আমি ইমাম রেজা (আ.)-এর চাচা আলী ইবনে জাফরের নিকটে যেতাম। তিনি তাঁর ভাই ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর কাছ থেকে যে সমস্ত হাদীস শুনতেন,তা আমার কাছে বর্ণনা করতেন,আর আমি তা লিখে রাখতাম। একদা মসজিদে নববীতে একত্রে বসে ছিলাম,এমন সময় ইমাম জাওয়াদ (আ.) প্রবেশ করলেন। আলী ইবনে জাফর উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানালেন এবং তাঁর হস্ত মোবারকে চুম্বন করলেন।
ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাকে বললেন : দাদা বসুন,মহান আল্লাহ্ আপনার উপর রহমত বর্ষণ করুন। তিনি বললেন : কিভাবে বসি হে আমার নেতা,আপনি দাঁড়িয়ে থাকতে আমি বসতে পারি?
যখন আলী ইবনে জাফর নিজের স্থানে ফিরে আসলেন,সকলে তাকে তিরস্কার করে বলল,আপনি তাঁর দাদা,আর আপনি কিনা তাঁকে এভাবে সম্মান দেখালেন?
আলী ইবনে জাফর বললেন : চুপ করুন,আল্লাহ্ আমার মত পাকা দাড়িওয়ালাকে ইমামতের যোগ্য মনে করেন নি। অথচ এই বালককে ইমামতের যোগ্য মনে করেছেন এবং তাঁকে ইমাম বানিয়েছেন। তোমরা বলতে চাও আমি তাঁর মর্যাদাকে অস্বীকার করব? আমি তোমাদের এ সকল কথা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তাঁর গোলাম। (উসূলে কাফী,১ম খণ্ড,পৃ. ৩২২)