পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত রয়েছে যেগুলো স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে– ধর্ম মানুষ গ্রহণ করবে স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে– জোর-জুলুমের কারণে নয়। এগুলো থেকে একথাও প্রমাণ হয় যে ইসলামের দৃষ্টিকোণ এই নয় যে, লোকদের ওপর আমরা শক্তিপ্রয়োগ করবো এবং বলবো যে হয় মুসলমান হতে হবে নতুবা মৃত্যুবরণ করতে হবে। এ সমস্ত আয়াতগুলো মূলতঃ শর্তহীন আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের ‘আয়াতুল করসির’ (২:২৫৫–২৫৭) একটি খুবই পরিচিত "লা ইকরাহা ফি দ্দ্বীন, ক্কাদ-তাবাইয়্যানার রুশদো মিনাল গাইয়্যে”–"অর্থাৎ ধর্মে কোন জোর-জুলুম নেই, কেননা সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করে দেখানো হয়েছে।” এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে যে আমরা মানুষের নিকট সত্য ও সঠিক পথকে স্পষ্ট করে তুলে ধরবো তার বাস্তবতাকে প্রকাশ করে দেব। ধর্মে জোর-জবরদস্তি করার কোন সুযোগ নেই –জোর করে কাউকে ইসলাম গ্রহণ করানোও যেতে পারে না। এ আয়াতটি বক্তব্যের দিক থেকে পবিত্র কোরআনের একটি স্পষ্ট আয়াত। কোরআনের বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থসমূহে এ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, একজন আনসারের দু’জন পুত্র ছিলো যারা পূর্বে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলো। এ দু’পুত্র খৃষ্টধর্মের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করে এবং এর জন্যে নিষ্ঠাবান হয়ে যায়। একন তাদের পিতা মুসলমান হয়েছে এবং তিনি তার পুত্র খৃষ্টান হওয়ার কারণে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যান। তিনি মহানবীর (সা.) কাছে গেলেন এবং বললেন: হে রাসূলুল্লাহ্! আমি আমাদের দু’সন্তান সম্পর্কে কি করতে পারি যারা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে? যতই আমি চেষ্টা করেছি তারা মোটেই ইসলাম গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। আপনি কি আমাকে এ অনুমতি দেবেন যে আমি শক্তি প্রয়োগে তাদেরকে ধর্ম ত্যাগ করতে ও মুসলমান হতে বাধ্য করবো?” নবী (সা.) বললেন: না; "লা-ইকরাহা ফি দ্দ্বীন” –ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই।
যেসব পটভূমিতে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো তাও লিপিবদ্ধ রয়েছে। আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় মদীনায় বাস করতো এবং তারাই ছিলো মদীনার অধিবাসী। ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে তারা কতিপয় ইহুদী গোত্রের সঙ্গে মিলে-মিশে বাস করতো। ঐসব ইহুদী গোত্রসমূহ পরবর্তীকালে মদীনায় আসে। গোত্রগুলোর মধ্যে একটি ছিলো বনি নাযল অপরটি ছিলো বনি খারেজা। তাছাড়াও অন্য আর একটি বড় ইহুদী গোত্র বাস করতো।
ইহুদীগণ ইহুদীবাদ ও একটি ঐশী গ্রন্থের অধিকারী হওয়ার কারণে সে সমাজের শিক্ষিত হিসেবে কম-বেশী সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ছিলো। অন্য দিকে মদীনার আদি অধিবাসীরা ছিলো পৌত্তলিক এবং নিরক্ষর। অবশ্য তাদের মধ্যে একটি ছোট্ট দল লেখাপড়া জানতো। ইহুদীগণ তাদের উন্নতি, সংস্কৃতি, প্রসারিত চিন্তাধারার কারণে মদীনার মূল অধিবাসীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিলো। আউস এবং খাজরাজ গোত্রের ধর্ম ইহুদীদের চেয়ে ভিন্নতর হওয়া সত্ত্বেও ধ্যান-ধারণা ও ভাবধারা দ্বারা তারা প্রভাবিত ছিলো। ফলশ্রুতিতে তারা কখনও কখনও তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে ইহুদীদের নিকট লেখাপড়া করতে পাঠাতো এবং ইহুদীদের পরিবেশ থেকে ঐসব সন্তানরা পৌত্তলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ইহুদী হয়ে যেত। যখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদীনায় আসলেন, এসব ছেলেদের একটি অংশ ইহুদীদের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হচ্ছিলো এবং তারা ইহুদী ধর্মকে তাদের জন্যে পছন্দ করে নিয়েছিলো। অবশ্য এক অংশ স্বীয় ধর্ম পরিত্যাগে রাজী ছিলো না। এখন পিতা-মাতাগণ ইসলাম গ্রহণ করা সত্ত্বেও এসব সন্তানগণ ইহুদী ধর্ম পরিত্যাগ করতে রাজী হলো না। যখন এটা সিদ্ধান্ত হয় যে, ইহুদীগণ (তাদের নৈরাজ্য সৃষ্টি ও ষড়যন্ত্রের কারণে) মদীনা ত্যাগ করে চলে যেতে হবে তখন ঐসব সন্তানগণও তাদের ইহুদী সঙ্গীদের সঙ্গে চলে যায়। তাদের পিতাগণ রাসূলুল্লাহ্র (সা.) নিকট আসলেন এবং তাদের সন্তানদেরকে ইহুদীদের থেকে পৃথক করে দিতে এবং তাদেরকে ইহুদী ধর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদেরকে এ অনুমতি দেননি। তারা বলেন, "হে রাসূলুল্লাহ্! আমাদেরকে অনুমতি দিন যেন আমরা তাদেরকে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করতে ও ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারি।” মহানবী (সা.) তাদেরকে বললেন –না, যখন তারা ইহুদীদের সঙ্গে যাওয়াটাই পছন্দ করেছে তখন তাদেরকে তাদের সঙ্গে যেতে দাও।” মুফাস্সিরগণ বলেন যে তখনই এ আয়াত নাযিল হয়, "লা ইকরাহা ফি দ্দ্বীন, ক্কাদ-তাবাইয়্যানার রুশদো মিনাল গাইয়্যে।”
অন্য একটি প্রসিদ্ধ আয়াত হচ্ছেঃ "তোমার রবের দিকে ডাকো হিকমত ও সদোপদেশ সহকারে এব উত্তমভাবে তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর।” (সূরা নাহল: ১২৫)
লোকদেরকে তাদের রবের পথে আহবান জানাও। কিন্তু কিভাবে শক্তি প্রয়োগ করে? "উত্তম নসিহত সহকারে এবং সুন্দরভাবে তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর...” যারা আমাদের সঙ্গে মতবিরোধ করবে তাদের সঙ্গে উত্তমভাবেই মতবিরোধ কর। একইভাবে এ আয়াতে ইসলামের জন্যে একমাত্র গ্রহণযোগ্য পন্থাও বলে দিচ্ছি।
অন্য আর একটি আয়াতে বলা হয়েছে "তোমার রবের পক্ষ থেকে সত্য এসেছে এখন যার ইচ্ছে তা গ্রহণ করুক আর যার ইচ্ছে একে প্রত্যাখ্যান করুক।” (১৮:২৯) যে ঈমানদার হতে চায় সে ঈমানদার হবে আর যে কাফের হতে চায় সে কাফের হবে। এ আয়াতও এটাই বলে দিচ্ছে যে, বিশ্বাস ও প্রত্যাখ্যান ঈমান ও কুফর ব্যক্তি নিজেই বাছাই করবে, এগুলো জোর করে কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে না। অতএব ইসলাম কাউকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করতে বলে না। যদি কেউ মুসলিম হতে চায় এটা ভালো কিন্তু যদি কেউ মুসলমান না হতে চায় তাহলে তাকে হত্যা করা চলবে না –কারণ গ্রহণ করা না করা তাদের পছন্দের ব্যাপার। ইসলাম বলছে যে কেউ ঈমানদার হতে চায় তা করতে পারে আবার যে কেউ করতে না চায় তাও পারে।
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ "তোমার রবের ইচ্ছাই যদি এই হতো (যে জমীনের সব মানুষই মুমিন ও অনুগতই হবে।) তাহলে দুনিয়ার সব অধিবাসীই ঈমান আনতো। তবে তুমি কি লোকদের মুমিন হওয়ার জন্যে জবরদস্তি করবে।” এ আয়াতে নবী করিম (সা.) কে সম্বোধন করা হয়েছে। মহানবী (সা.) সত্যিকারভাবে মানুষকে ভালোবাসতেন এবং তারা সত্যিকার ঈমানদার হোক তা তিনি চাইতেন। পবিত্র কোরআন বলছে যে, ঈমানের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ অর্থহীন। যদি শক্তি প্রয়োগ করা সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হতো তাহলে আল্লাহ্তায়ালা নিজেই তাঁর সৃষ্ট ক্ষমতা বলে সমস্ত মানুষকে ঈমানদার বানাতে পারতেন কিন্তু ঈমান এমন এক জিনিস যা মানুষ নিজেই বাছাই করবে। অতএব যে কারণে আল্লাহ্ তার সৃষ্ট ক্ষমতা বলে জোর করে মানুষকে ঈমানদার হতে বাধ্য করেননি বরং তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়েছেন যে কোন একটি বাছাই করার জন্যে, ঠিক সে কারণেই নবী (সা.) এর উচিত মানুষকে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া। যার ইচ্ছে ঈমানদার হবে যার ইচ্ছে হবে না।
অন্য একটি আয়াতে নবী (সা.) কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে –"তুমি হয়তো এ চিন্তায় প্রাণ বিনষ্ট করে দেবে যে এ লোকেরা ঈমান আনছে না।” (২৬:৩) "হে নবী! মনে হচ্ছে তুমি যেন তারা ঈমান গ্রহণ করছে না এ চিন্তায় নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ। তাদের জন্যে এতটা চিন্তিত হয়ো না। যদি সৃষ্ট ক্ষমতা বলে জোর করেই ঈমান গ্রহণ করাতে চাইতেন তাহলে আল্লাহ্ অতি সহজেই তা করতে পারতেন।” "আমরা চাইলে আকাশ হতে এমন সব নিদর্শন নাযিল করতে পারি যার সম্মুখে তাদের মাথা নত হয়ে যাবে।” (২৬:৪) এখানে আল্লাহ্ বলছেন যে তিনি যদি আকাশ থেকে নিদর্শন পেশ করতে চাইতেন, এ শান্তি আরোপ করতে চাইতেন এবং লোকদেরকে বলতেন হয় তোমরা ঈমানদার হবে নতুবা ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন সমস্ত মানুষ চাপের মুখে ঈমানদার হয়ে যেত কিন্তু তিনি তা চান না কারণ তিনি চান মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেরাই বাছাই করে নিক।
এ সমস্ত আয়াতসমূহ আরো পরিষ্কারভাবে জিহাদ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। ইসলামে জিহাদের লক্ষ্য তা নয় যা একদল স্বার্থপর ও সংকীর্ণমনা লোকেরা মনে করে বসে আছে। এ সমস্ত পরিষ্কার বলে দিচ্ছে যে ইসলামের লক্ষ্য বাধ্য বা জোর করা নয় –এটা মুসলমানদের নির্দেশ দিচ্ছে না যে অমুসলমানদের ওপর তলোয়ার ধরে বলতে হবে যে– ইসলাম, নয় মৃত্যু; নয় তা নয় এবং জিহাদের উদ্দেশ্য এসব কিছু নয়।সূত্র: আল বাসাইর