বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয়

ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয়

অপচয় ও অপব্যয়, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় উভয়ই নিষিদ্ধ। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয়ই হলো ইসরাফ বা অপচয়। বাংলায় অপচয় ও অপব্যয় শব্দ দুটি অনেক ক্ষেত্রে সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এ দুইয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাত্রায় ব্যয় করার নামই অপচয়, যা আরবীতে ‘ইসরাফ' বলা হয়। অন্যদিকে, অপব্যয় হচ্ছে অন্যায় ও অযৌক্তিক উপায়ে সম্পদের অপব্যবহার, যাকে আরবীতে ‘তাবযীর' বলা হয়। পবিত্র কোরানে তাবযীর বা অপব্যয় সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। সূরা বনী ইসরাইলের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।'
ইমাম আলী (আঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার জন্য অনুপযুক্ত ও বেমানান কিছু কেনে বা পরিধান করে সে হলো অপচয়কারী'। কাজেই যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু ব্যয় করলে তা অপচয় হবে না এবং ব্যক্তি বিশেষে এই ব্যয়ের পরিমাণে তারতম্য হতে পারে। অনেক সময় ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের উপরও তার ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করে। এছাড়া এ ক্ষেত্রে সামর্থ্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইরানি জাতিকে অপব্যয় ও অপচয় থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে চলতি ফার্সি বছরকে ‘মিতব্যয় বর্ষ' হিসেবে নামকরণ করেছেন। তিনি অপচয় ও অপব্যয় সম্পর্কে বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অপচয়ের অর্থ হলো বিনা কারণে সম্পদ ব্যয় করা। অন্য কথায় বলা যায়, সম্পদ নষ্ট করার নামই অপচয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ধন-সম্পদ হচ্ছে মানুষের কাছে আল্লাহর আমানত। আলী(আঃ) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ সম্পদ হচ্ছে আমানত'। কাজেই কোন ভাবেই এই আমানতের খিয়ানাত করা যাবেনা এবং তা সঠিক কাজে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করতে হবে। এখন কেউ যদি এই সম্পদকে সঠিক পথে কাজে না লাগিয়ে তা অপচয় ও অপব্যয় করে তাহলে সে পাপী হিসেবে গন্য হবে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরানের সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, "এবং আহার কর ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না" এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহতায়ালা চান তার দেয়া নেয়ামতগুলোকে সঠিক ও সর্বোত্তম ভাবে ব্যবহৃত হোক এবং যারা আল্লাহর নেয়ামাতকে বিনষ্ট ও অবমূল্যায়ন করে আল্লাহ তাদের উপর অসন্তুষ্ট।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখন মানুষকে অপচয় ও অপব্যয়ে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রচার চালানো হচ্ছে। আর এসব প্রচারণায় এখন অনেক উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসীরাও উৎসাহিত হচ্ছে,যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। পাশ্চাত্যের বৃহৎ কোম্পানিগুলো বেশি বেশি পণ্য বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভের লক্ষ্যে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষকে অপচয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোন কোন মার্কিন কোম্পানির এখন এমন দশা যে, মানুষ যদি অপচয় না করে তাহলে ঐসব কোম্পানি টিকে থাকতে পারবেনা। এ কারণে ঐসব কোম্পানি মিডিয়ার সহযোগিতায় এ ধরনের অপসংস্কৃতি চালুর নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশ্চাত্যের মোনাফালোভী কোম্পানিগুলো তাদের চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণকেও এক্ষেত্রে আকৃষ্ট করছে। এর ফলে গোটা বিশ্ব তাদের বাজারে পরিণত হচ্ছে। আর এভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি পাশ্চাত্যের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অপচয় সব সময় মানুষকে পরনির্ভরশীল করে রাখে। রাসূল (সাঃ)-র পবিত্র বংশধর ইমাম সাদেক (আঃ) অপচয়, অপব্যয় ও পরনির্ভরশীলতা সম্পর্কে বলেছেন, মুসলমানরা যতদিন পর্যন্ত অপচয় না করবে, বিজাতীয়দের মতো পোশাক পরিধান না করবে ও তাদের মতো খাদ্য গ্রহণ না করবে ততদিন পর্যন্ত কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে থাকবে। কিন্তু এর ব্যত্যয় ঘটলে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিশ্বে বিশেষকরে উন্নত দেশগুলোতে মোটা বা অতিরিক্ত ওজনের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে বারবারই সতর্ক করে দিচ্ছেন। শরীরের মধ্যে অতিরিক্ত মেদ-চর্বি জমাকেই স্থূলতা বলে। এ ধরনের মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। একারণে চিকিৎসকরা স্থুলতা বা মুটিয়ে যাওয়াকে রোগ হিসেবে গণ্য করে থাকেন। মুটিয়ে যাওয়ার নানা কারণের মধ্যে একটি হলো অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ। অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা না করা। ইসলাম ধর্মে বারবারই অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসও রয়েছে। রাসূল (সাঃ) মুসলমানদের বলেছেন, ক্ষুধার্ত না হওয়া পর্যন্ত আহার করবে না এবং পেট খাদ্যে পরিপূর্ণ হবার আগেই উঠে পড়। তিনি আরও বলেছেন, মানুষের পেট হলো অসুখ-বিসুখের বাসা এবং অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই হলো সর্বোত্তম ওষুধ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে একজন খ্রীষ্টান চিকিৎসক মুসলমানের কাছে এ হাদিসটি শুনে এটা স্বীকার করেন যে, পান্ডিত্যপূর্ণ এই হাদিস এবং অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত কোরানের আয়াতগুলো বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ গ্যালেনাসের স্থানকে একেবারে ম্লান করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি বা অপচয়, মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ যে মানুষের জন্য ক্ষতিকর,তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও প্রমাণিত।
অন্যদিকে কেউ কেউ ভোগ-বিলাসিতার মাধ্যমে অহরহ অপচয় ও অপব্যয় করছে। আর বিশ্বব্যাপী এ প্রবনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিলাসিতা এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করাকে অপচয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আমরা ভোগ বিলাসিতার জন্য অর্থ অপচয় করি কিন্তু এই অর্থই উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে, পুজিবিনিয়োগে কাজে লাগানো যেতে পারে, দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং তা দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করা যেতে পারে। আমরা চক্ষুলজ্জা ও খেয়ালের বশে অর্থ অপচয় করে থাকি। অনেকেই নিজেকে সম্পদশালী এবং অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার জন্য চড়াদামের জিনিসপত্র ক্রয় করে থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে তার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তির ঈমান-আকিদা, চরিত্র, আচার-আচরন এবং মানবিকতার উপরই তার ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি নির্ভর করে। দামি জিনিসপত্র ও চাকচিক্য ইসলামের কাছে কখনোই মানদন্ড নয়। নিজেকে বড় হিসেবে তুলে ধরার মনোভাব ও অহংকার কখনোই সৎ গুণাবলী হতে পারেনা।
বর্তমানে নব নব প্রযুক্তির আবিস্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিচ্ছে। ইসলাম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধী নয়। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরপরই ঘরের নতুন আসবাবপত্র ও গাড়ী পাল্টে সর্বশেষ মডেলের আসবাবপত্র ও গাড়ী কেনা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় লোক দেখানোর মানসিকতাই প্রাধান্য পায়। মনে রাখতে হবে কোনো সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার না করাও অপচয়। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাভাষী একজন কবি এ সম্পর্কে "যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশুগৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।" অর্থাৎ আজ যে অপচয়কারী ও বিলাসী, কাল সে ভিখারী ও পরমুখাপেক্ষী। এটা ব্যক্তি জীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেও সত্য।
অপচয় ও অপব্যয়ে কোন প্রাপ্তি না থাকলেও মানুষ এ থেকে বিরত থাকছে না। মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন অত্যন্ত জরুরি। এসব ছাড়া মানুষ জীবনধারণ করতে পারে না, তাই এগুলোকে মানুষের মৌলিক চাহিদা বলা হয়। ধনী-দরিদ্র,নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ছোট-বড় সকলেরই এসব প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক ভিন্নতার কারণে সকল মানুষ সমভাবে এসব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। কাজেই আমরা যদি অপচয় ও অপব্যয় পরিহার করে সেই অর্থ ঐসব মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যয় করি,তাহলে সমাজ যেমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে তেমনি আমরাও মানষিক প্রশান্তি পাব। এছাড়া পরকালে এর পুরস্কারতো রয়েছেই।
পাঠক! আমরা কেউই অপচয় ও অপব্যয় করব না এবং পাশাপাশি কৃপণতা থেকে দূরে থাকব,এ প্রত্যাশা রেখে আজকের আসর এখানেই শেষ করছি।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কোরআনের ঐতিহাসিক অলৌকিকতা
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (২য় ...
মানুষ তার কর্মের ব্যাপারে ...
শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ...
ঈদুল ফিতর: ইসলামী ঐক্য ও ...
আল কোরআনের অলৌকিকতাঃ পৃথিবী
Apakah manusia dalam perbuatannya memiliki pilihan? Bila benar, sejauh manakah batas ...
শিয়া-সুন্নি বিরোধ কেন? শিয়ারা কি ...
ধর্মে কোন জোর-জুলুম নেই

 
user comment