আমরা জানি যে,আমরা আমাদের এ ক্ষুদ্র জ্ঞানে পরকালের ঘটনা প্রবাহ এবং পরম অদৃশ্য জগৎ সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা লাভ করতে অক্ষম। তাই কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক দলিলের ভিত্তিতে যে একশ্রেণীর সামগ্রিক ধারণা লাভ করতে পারি এবং ওহীর মাধ্যমে পরকালের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বসমূহের যে পরিচয় পাওয়া যায়,তাতেই তুষ্ট থাকব। তবে পরজগতের বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে কখনো কখনো যে সকল পরিভাষা ব্যবহার করা হয় সম্ভবতঃ তা সাদৃশ্যার্থেই ব্যবহার করা হয়। ফলে ঐ সকল পরিভাষা শ্রবণের মাধ্যমে যে ধারণা লাভ হয়ে থাকে সম্ভবতঃ তা বাস্তব দৃষ্টান্তের সাথে সম্পূর্ণরূপে না-ও মিলতে পারে। আর এটা বর্ণনার অপারগতা নয় বরং আমাদের বোধের অক্ষমতার কারণেই হয়ে থাকে। নতুবা আমাদের মস্তিষ্কের কাঠামোকে বিবেচনা করতঃ যে সকল শব্দসমষ্টি ঐ সকল বাস্তবতার প্রদর্শক হতে পারে নিঃসন্দেহে তা ঐ সকল শব্দসমষ্টিই,যা পবিত্র কোরান নির্বাচন করেছে ।
সকল মানুষই মৃত্যুবরণ করবে :
পবিত্র কোরান গুরুতের সাথে উপস্থপন করে যে,সকল মানুষেরই(বরং সমস্ত জীবনেরই) মৃত্যুর সাদ গ্রহণ করতে হবে এবং এ পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ীভাবে থাকবে না ।
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ
যা কিছুই এখানে (পৃথিবীতে) বিদ্যমান,ধবংসপ্রাপ্ত হবে। (আর রাহমান-২৬)
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
প্রত্যেকেই মৃত্যুরস্বাদ আস্বাদন করবে। ( আল্ ইমরান-১৮৫)
মহানবীকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে :
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ
প্রকৃতপক্ষে তুমিও মৃত্যু বরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে। (যুমার-৩০)
وَمَا جَعَلْنَا لِبَشَرٍ مِّن قَبْلِكَ الْخُلْدَ أَفَإِن مِّتَّ فَهُمُ الْخَالِدُونَ
আমি তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করিনি,সুতরাং তোমার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবি হয়ে থাকবে ? (আম্বিয়া -৩৪)
অতএব মৃত্যু প্রত্যেক জীবনের জন্য এক সামগ্রিক ও অব্যতিক্রমধর্মী নিয়ম।
সমস্ত আত্মার হরণকারী :
পবিত্র কোরানে একদিকে আত্মার হরণকারী হিসেবে মহান আল্লাহর কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে :
اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا
আল্লাহই প্রাণ হরণ করেন জীবসমূহের,তাদের মৃত্যুর সময়। (যুমার -৪২)
অপরদিকে মৃত্যুর ফেরেশতাকে রূহ কবজ করার জন্যে আদিষ্ট বলে পরিচয় দেয়া হয়েছে :
قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ
বল,তোমাদের জন্যে নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। (সেজদা -১১)
অপর এক স্থানে প্রাণ হরণকারী হিসেবে ফেরেশতাগণ এবং প্রভু কর্তৃক প্রেরিতগণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে :
حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ تَوَفَّتْهُ رُسُلُنَا
অবশেষে যখন তোমাদের কারও মৃত্যুকাল উপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিতরা তার মৃত্যু ঘটায়। (আনয়াম-৬১)
স্পষ্টতঃই যখন কোন কর্তা,অপর কোন কর্তার মাধ্যমে কোন কার্য সম্পাদন করে,তবে ঐ কার্যের কর্তারূপে উভয়কেই উল্লেখ করা সঠিক। অনুরূপ যদি দিতীয় কর্তাও অপর কোন কর্তার মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে,তবে তৃতীয় কর্তাকে কার্য সম্পাদনকারী হিসেবে গণনা করা সঠিক হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ আত্মাসমূহের হরণকর্ম মৃত্যুর ফেরেশতার (ملک الموت) মাধ্যমে সম্পন্ন করেন এবং তিনিও যেহেতু তার অনুগ্রত ফেরেশতাদের মাধ্যমে উক্ত কর্ম সম্পাদন করেন,সেহেতু উক্ত তিনজনকেই কার্যের সম্পাদনকারী হিসেবে মনে করা সঠিক।
সহজ ও কঠোরভাবে আত্মার হরণ :
পবিত্র কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে যে,আল্লাহর নিযুক্তগণ সকল মানুষের প্রাণ একইভাবে গ্রহণ করেন না। বরং কারও কারও ক্ষেত্রে খুব সহজ ও সম্মানের সাথে এবং কারও কারও ক্ষেত্রে কঠোর ও অপমানের সাথে প্রাণ হরণ করে থাকেন। উদাহরণতঃ মু’মিনগণের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে:
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُم
ফেরেশতাগণ যাদের মৃত্যু ঘটায় আনন্দাবস্থায় (তাদেরকে) ফেরেশতাগণ বলবে,‘তোমাদের প্রতি শান্তি ( ও সম্মান )! ( নাহল -৩২)
আবার কাফেরদের সম্পর্কে বলে :
وَلَوْ تَرَىٰ إِذْ يَتَوَفَّى الَّذِينَ كَفَرُوا الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতাগণ কাফেরদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ হরণ করছে ( আনফাল -৫০)৩৪
মৃত্যুকালে তওবাহ ও বিশ্বাস স্থাপণের কোন মূল্য নেই :
যখন কাফের ও পাপিষ্ঠদের মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকার কোন আশা থাকে না তখন পূর্বে সম্পাদিত স্বীয় কর্ম সম্পর্কে অনুতপ্ত হয় এবং বিশ্বাস স্থাপন করে ও নিজের পাপের জন্যে তওবাহ করে। কিন্তু মহান আল্লাহর নিকট এ ধরনের বিশ্বাস ও তওবার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। পবিত্র কোরান এ সম্পর্কে বলে :
يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِن قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا
যে দিন তোমার প্রতিপালকের কোন নিদর্শন আসবে সে দিন তার ঈমান কাজে আসবে না,যে ব্যক্তি পূর্বে ঈমান আনেনি কিংবা যে ব্যক্তি ঈমানের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করেনি। (আনআম -১৫৮)
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّىٰ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ
তওবাহ তাদের জন্যে নয় যারা আজীবন মন্দ কাজ করে এবং তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে,‘আমি এখন তওবাহ্ করছি,......। ( নিসা -১৮)
ফেরাউনের বক্তব্যে উল্লেখিত হয়েছে যে,যখন (নীল নদের পানিতে) নিমজ্জিত হচ্ছিল,তখন বলছিল :
آمَنتُ أَنَّهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ
আমি বিশ্বাস করলাম যে,বনী ইসরাঈল যাতে বিশ্বাস করে -তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ( ইউনূস-৯০)
এবং তার উত্তরে বলা হয় :
آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ
এখন! ইতিপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছি এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা ইউনুস-৯১)
পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছা :
অনুরূপ পবিত্র কোরান কাফের ও দুস্কৃতিকারীদের সম্পর্কে বর্ণনা করে যে,যখন তাদের মৃত্যু উপস্থিত হয় অথবা বিধ্বংসী আযাব তাদের উপর অবর্তীণ হয়,এই ইচ্ছা পোষণ করে : ‘হায়! যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারতাম এবং বিশ্বাসী ও সৎকর্মকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতাম!’ অথবা মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যে,আমাদেরকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিন,যাতে আমাদের পূর্ববর্তী কর্মসমূহের ক্ষতিপূরণ করতে পারি। কিন্তু এ ধরনের আকাংখা ও প্রার্থনার কোন কার্যকারিতা নেই ।৩৫ কোন কোন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে,যদি তাদেরকে (পৃথিবীতে)ফিরিয়েও দেয়া হত তবে তারা পূর্বের প্রক্রিয়াই চালিয়ে যেত।৩৬ অনুরূপ ক্বিয়ামতের দিনেও এ ধরনের ইচ্ছা ও প্রার্থনা করবে,যার জবাব প্রাথমিকভাবেই নেতিবাচক হবে।
حَتَّىٰ إِذَا جَاءَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ رَبِّ ارْجِعُونِ لَعَلِّي أَعْمَلُ صَالِحًا فِيمَا تَرَكْتُ كَلَّا إِنَّهَا كَلِمَةٌ هُوَ قَائِلُهَا
যখন তাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়,তখন সে বলে,হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় প্রেরণ কর,যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি,যা আমি পূর্বে করিনি। না,তা হওয়ার নয়। এটা তো তার একটি উক্তি মাত্র। (এবং এটা এমন এক আকাংখা,যা কখনোই কার্যকরী হবে না)। (মু’মিনুন ৯৯-১০০)
أَوْ تَقُولَ حِينَ تَرَى الْعَذَابَ لَوْ أَنَّ لِي كَرَّةً فَأَكُونَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
অথবা শাস্তি প্রত্যক্ষ করলে যেন কাকেও বলতে না হয়,‘আহা,যদি একবার পৃথিবীতে আমার প্রত্যাবর্তন ঘটত,তবে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম। ( যুমার-৫৮)
وَلَوْ تَرَىٰ إِذْ وُقِفُوا عَلَى النَّارِ فَقَالُوا يَا لَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
যখন তাদেরকে অগ্নির পার্শ্বে দাঁড় করান হবে এবং তারা বলবে হায়! যদি আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটত তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (আনআম -২৭
إِذِ الْمُجْرِمُونَ نَاكِسُو رُءُوسِهِمْ عِندَ رَبِّهِمْ رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ
যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবে,হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম;এখন তুমি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ কর,আমরা সৎকর্ম করব,আমরা তো দৃঢ়বিশ্বাসী। (সেজদা-১২)
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,পরকাল নির্বাচন ও কার্য সম্পন্ন করার স্থান নয়। এমনকি যে দৃঢ়বিশ্বাস মৃত্যুর সময় অথবা পরজগতে অর্জিত হয়,মানুষের উৎকর্ষের পথে তারও কোন গুরুত্ব নেই এবং তা তাকে পুরস্কারের যোগ্যও করে তুলে না।
এভাবেই কাফের ও পাপিষ্ঠরা পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছা পোষণ করে,যাতে স্বেচ্ছায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে ও যথোপযুক্ত কার্য সম্পন্ন করতে পারে।
বারযাখ
পবিত্র কোরানের আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাই যে,মানুষ মৃত্যুর পর কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময় কবর ও বারযাখে অতিবাহিত করবে এবং কিছুটা হলেও ভোগ ও বিলাস অথবা কষ্ট ও ক্লেশের অধিকারী হবে। অনেক রেওয়াতে এসেছে যে,বিশ্বাসী পাপীরা এ সময় তাদের পাপানুপাতে কিছু কষ্ট ও ক্লেশ ভোগের মাধ্যমে পবিত্র হয়,যাতে পরজগতে দায়ভার মুক্ত হতে পারে।
যেহেতু বারযাখ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবী রাখে,সেহেতু ঐগুলো সম্পর্কে আলোচনা না করে কেবলমাত্র একটি আয়াতের উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে :
وَمِن وَرَائِهِم بَرْزَخٌ إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ
তাদের সম্মুখে (তাদের মৃত্যুর পর) বারযাখ থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত। (মু’মিনুন-১০০)