বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

গীবত একটি মারাত্মক ব্যাধি

জিহ্বার দ্বারা যে সব কঠিন পাপ কাজ সংঘটিত হয় তার অন্যতম হল গীবত। গীবত একটি মারাত্মক ব্যাধি। গীবত করার ফলে মানুষের অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা আল্লাহর ক্ষমা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যের ছিদ্রান্বেষণ ও গীবত বর্তমানে আমাদের অনেকেরই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমরা এর কুফল বেমালুম ভুলে গেছি। বড় ও ছোট কেউই এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। মিম্বারের উচ্চ মর্যাদা বা মসজিদের পবিত্রতা কোন কিছুই এ দোষ নিবৃত্ত করতে পারছে না। কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব একত্রে বসলেই তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় অতিরঞ্জিত করে অন্যের দোষ বের করে কুৎসা রটানো। ছিদ্রান্বেষী লোকের শত দোষ থাকলেও সে নিজের দোষ প্রকাশ হোক এটা কখনো চায় না,কিন্তু সে অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায় এবং রসিয়ে রসিয়ে তা প্রকাশ করে। নিজের জন্য যেমন অন্যের জন্যও ঠিক তেমন অনুভূতি থাকা উচিত। অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করে কিছু করা উচিত নয়। এ প্রবাদ সকলেরই মেনে চলা উচিত যে,“তুমি অন্যের কাছ থেকে যা আশা কর না,অন্যের প্রতিও তুমি তা করো না।”

গিবতের সংজ্ঞা হলো,কথায় হোক আর কর্মেই হোক মানহানি করার উদ্দেশ্যে কারো দোষ প্রকাশ করা যা তার দুঃখের কারণ হয়ে দাড়ায়। কেউ কেউ বলেন,গীবত হবে তা যা মিথ্যামিথ্যি ও সত্যের বিপরীতভাবে প্রকাশ করা হয়। তাদের মতে যা দেখেছে বা শুনেছে তা অবিকল প্রকাশ করা গীবত নয়। তারা বলে তারা তো যা দেখেছে বা শুনেছে তাই প্রকাশ করেছে-এতে গীবত হবে কেন? বস্তুত এহেন বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করার নামই হলো গীবত কারণ ঘটনাটি যদি তথ্যগতভাবে মিথ্যা হতো। তবে তা হতো কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা-গীবত নয়। একদিন রাসূল (সা.) সাহাবীদের জিজ্ঞেস করলেনঃ

‘তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে?’ সাহাবীরা বললেন : ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশি জানেন।’ তিনি বললেন : ‘তোমার ভাইয়ের এমন আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে।’ সাহাবীরা বললেন : ‘যে বিষয়ে আলোচনা করা হয় তা যদি তার মধ্যে থাকে? তিনি বললেন :‘সে বিষয় তার মধ্যে থাকলেই তো গীবত। না থাকলে তা আরও বড় অন্যায়;অর্থাৎ অপবাদ হবে।’

গীবত কেবল মৌখিকভাবে সংঘটিত হয় তা নয়;বরং ইশারা-ইঙ্গিত বা অনুকরণের মাধ্যমেও গীবত হতে পারে। হযরত আয়েশা বলেন : ‘একবার এক মহিলা আগমন করল। সে যখন চলে গেল,তখন আমি হাতে ইশারা করে প্রকাশ করলাম,সে বেঁটে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : তুমি তার গীবত করেছ।’

পবিত্র কুরআনে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার সাথে তুলনা করা হয়েছে :

وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ

‘এবং তোমাদের কেউ যেন কারও গীবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা অপছন্দ কর।’(সূরা হুজুরাত : ১২)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

‘তোমরা গীবত থেকে বেঁচে থাক। কেননা,গীবত যিনার চেয়েও কঠিন।’

এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে,যিনা করে মানুষ তওবা করলে আল্লাহ তা‘আলাতওবা কবুল করে নেন,কিন্তু গীবতকারীকে ক্ষমা করা হয় না,যতক্ষণ যার গীবত করা হয় সে ক্ষমা না করে।

অন্যদিকে গীবতের সামাজিক ক্ষতির দিকটিও ব্যাপক। কারণ,গীবতের মাধ্যমে এক মানুষ অপর মানুষের প্রকাশ্য নিন্দা করে এবং এতে সমাজে ফিতনার সৃষ্টি হয়।

গীবত নানা কারণে হয়ে থাকে;সে জন্য মানুষ কখনো জ্ঞাতসারে আবার কখনো অজ্ঞাতসারে গিবতে জড়িয়ে পড়ে। আবু হামিদ আল-গাজ্জালী তার গ্রন্থ “এহইয়া-এ উলুমেদীন"-এ গিবতের বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করেছেন;যার প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ :

গীবতের কারণঃ

১. কারো সম্বন্ধে কৌতুক করা বা কারো মানহানি করা।

২. মানুষকে হাসাবার জন্য এবং নিজের হাস্য-রসিকতা ও প্রাণ-চাঞ্চল্য প্রকাশ করা।

৩.ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা ।

৪.অন্যের বদনাম করে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করা।

৫.কোন বিষয়ে নিজের ত্রুটি ঢেকে রাখার জন্য অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়া।

৬.কোন দলের সাথে জড়িত থেকেও তা ধামাচাপা দেয়ার ।

৭.নিজের দোষ প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা।

৮.প্রতিযোগীকে পরাভূত করার জন্য তার দোষক্রটি বর্ণনা করা।

১০.অমুক ব্যক্তি অমুক পাপে লিপ্ত হয়েছে-এরূপ কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করা ।

১১.বিস্ময় প্রকাশ করার জন্য,যেমন-অমুক ব্যক্তি এ কাজ করেছে এরূপ বলা।

১২.কোন কাজে ক্রোধ প্রকাশ করে কাজটি যে করেছে তার নাম প্রকাশ করা।

যে সব কারণে গীবত হয়নাঃ

তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ছিদ্রান্বেষণ বা সমালোচনা গীবত হয় না,যেমন-

(১) অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য মজলুম জালেমের বিরুদ্ধে নালিশ করলে গীবত হয় না।

(২) অন্যকে উপদেশ দেয়ার জন্য কারো দোষ উদাহরণ হিসাবে প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(৩) দ্বীনের অনুশাসন বলবৎ করার জন্য কারো বিশেষ দোষ প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(৪) কোন মুসলিমকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আত্মসাৎ ও অসাধুতার কথা প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(৫) এমন কারো কাছে দোষ প্রকাশ করা যিনি বাধা দিয়ে দোষ করা থেকে রক্ষা করতে পারবেন।

(৬) হাদিসের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হাদিস বর্ণনাকারীর সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(৭) কারো শারীরিক সীমাবদ্ধতা (যেমন-বোবা,অন্ধ,কালা,হাতবিহীন) প্রকাশ করা গীবত নয়।

(৮) চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসার জন্য দোষ প্রকাশ করা গীবত নয়।

(৯) কেউ মিথ্যা বংশ পরিচয় দিলে তার সঠিক বংশ পরিচয় প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(১০) কারো জীবন,সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করার জন্য তার দোষ প্রকাশ করলে গীবত হয় না।

(১১) যদি দু’ব্যক্তি কারো দোষ আলোচনা করে যা উভয়েরই জানা আছে। তবে তা গীবত হয় না।

(১২) যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে কুকর্ম করে তার আচরণ প্রকাশ করলে গীবত হয় না;যেমন হাদিসে আছে;“যে লজ্জার ঘোমটা ছিড়ে ফেলেছে তার বেলায় গীবত নেই।”

গীবত থেকে আত্মরক্ষার উপায়

১. পরিণাম নিয়ে চিন্তা করা : গীবত থেকে আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল এর পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করা। মানুষ এটা চিন্তা করবে যে,গীবতের ফলে তার আমলনামা বরবাদ হয়ে যাবে এবং কিয়ামতে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ চিন্তার মাধ্যমে সে নিজেকে গীবত করা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে।

২. নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে মনোনিবেশ করা : যখন মানুষ অপরের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে যাবে তখনই তাকে এটা মনে করতে হবে যে,সে নিজেও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। তাহলে নিজের মধ্যে যে ত্রুটি রয়েছে সেটার জন্য অন্যকে দোষারোপ করার কোন অধিকারই তার নেই।

৩. মানুষের অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন : এ কথা চিন্তা করা যে,যদি অন্য কোন ব্যক্তি তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করে তবে তার অনুভূতি কেমন হবে;এ একই অনুভূতি অন্যেরও হবে যখন সে তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করবে। এ বিষয়টি তাকে গীবত করা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে।

৪. গীবত করার কারণ দূর করা : যে ব্যক্তি গীবত করছে তাকে চিন্তা করে বের করতে হবে যে,সে কোন কারণে গীবত করছে। তার মধ্যে যে কারণ সে খুঁজে পাবে সেই কারণ তাকে দূর করতে হবে। যদি ক্রোধের কারণে গীবত করে তবে তাকে ক্রোধ দমন করতে হবে,যদি হিংসার কারণে গীবত করে তবে হিংসা পরিহার করতে হবে,যদি অন্যের অনুসরণ ও মন রক্ষার জন্য হয় তবে তার চিন্তা করা উচিত,যে বিষয়ে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাতে যদি মানুষ সন্তুষ্ট হয় তবে এতে কি লাভ? বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিই তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামকে  গীবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক বলেছেন  কারণ কোনো ব্যক্তি জেনার পর (বিশুদ্ধ) তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গীবতকারীকে যার গীবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না।

গীবতের কাফফারা

গীবতের কাফফারা হলো, যার সম্পর্কে গীবত করা হয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে দোয়া করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গীবতের কাফফারা হলো, তুমি যার গীবত করেছো, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে করবে, হে আল্লাহ তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।

সঙ্কলক : এম এফ বারী

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

পবিত্র কোরআনের আলোকে কিয়ামত
ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা

 
user comment