পবিত্র কোরআন, হাদীস এবং বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে কাদেরকে আহলে বাইত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে? এবং কোরআনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কি? আদি কাল থেকেই এ বিষয়টা নিয়ে মুফাসসিরগণ ও কালাম শাস্ত্রবিদগণ বিভিন্ন ধরনের আলোচনা ও পর্যালোচনা করে আসছেন। এ ব্যাপারে অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছে। এই লেখনিগুলো থেকে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় যে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পরিবারের কিছুসংখ্যক সদস্যকে আহলে বাইত বলা হয়েছে। অন্যদিকে নবী (সা.) এর বিভিন্ন বর্ণনায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তাদের এবং পবিত্র কোরআনের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী বন্ধনও রয়েছে। পবিত্র কোরআনের সাথে আহলে বাইতের এই চিরস্থায়ী বন্ধন বিশেষ মর্যাদার পরিচয় বহন করে।
পবিত্র কোরআন মজিদে ‘আহলে বাইত’ শব্দটি মাত্র দু’বার এসেছে :
সূরা হুদের ৭৩ নং আয়াতে :
قَالُواْ أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللّهِ رَحْمَتُ اللّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَّجِيدٌ
অর্থাৎ ‘তারা বলল তুমি কি আল্লাহর কোন কাজে বিস্ময়বোধ করছো, তোমাদের উপরে সর্বদা আল্লাহর (বিশেষ) রহমত ও তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে; অবশ্যই তিনি মহাপ্রশংসিত ও মহামর্যাদাবান।’
সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে :
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
অর্থাৎ ‘হে আহলে বাইত নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা চান তোমাদেরকে পাপ পঙ্কিলতা থেকে দুরে রাখতে এবং সম্পূর্ণরূপে পূত ও পবিত্র করতে।’
প্রথম আয়াতটি হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং তার পরিবার সম্পর্কে। দ্বিতীয় আয়াতটিতে -যা তাতহীরের আয়াত নামে প্রসিদ্ধ- নবী (সা.) এর পরিবারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সকল মুসলমান একমত পোষণ করেন। এই আয়াতে মহান আল্লাহ তা’আলা নবী (সা.) এর আহলে বাইতকে সকল প্রকারের কলুষতা থেকে মুক্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
আহলে বাইত কারা : আহলে বাইতের মর্যাদার ব্যাপারে সকলেই একমত তবে আহলে বাইত কারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। নবী (সা.)এর আহলে বাইতকে চেনার একমাত্র পথ হচ্ছে হাদীস ও রেওয়ায়েত। বিভিন্ন হাদীস ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ (সা.), হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.) হচ্ছেন আহলে বাইত। জালালউদ্দিন সূয়ূতি তার তাফসীরে এ সম্পর্কে অনেক রেওয়ায়েত সনদ সহকারে নবী (সা.) এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করেছেন।
তাবারসিও হযরত আবু সাঈদ খুদরী, আনাস বিন মালেক, ওয়াছেলা বিন আছকা, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা ও উম্মে সালমা (রা.), জাবের বিন আব্দুল্লাহ ও হাসান বিন আলী (আ.) সহ অন্যান্য সাহাবা সূত্রে এর উল্লেখ করে অসংখ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন।
নবী পত্মী উম্মে সালমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি নিম্নলিখিত আয়াতটির শানে নুযুল বর্ননা করতে গিয়ে বলেছেন :
إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَ يُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
যখন এ আয়াতটি আমার গৃহে অবতীর্ণ হয়েছিল তখন আমার গৃহে সাতজন লোক ছিল। তারা হলেন জীবরাঈল (আ.), মিকাইল (আ.), নবী (সা.), আলী (আ.), ফাতিমা (আ.), হাসান ও হোসাইন (আ.) এবং আমি ছিলাম দরজার মুখে। আমি রাসূল (সা.) কে প্রশ্ন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি আহলে বাইতের মধ্যে গণ্য নই?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘না তুমি তাদের মধ্যে নও, তবে নিশ্চয় তুমি সঠিক পথে আছো; নিশ্চয়ই তুমি কল্যাণের মধ্যে রয়েছো; তুমি আমার স্ত্রীদের মধ্যে গণ্য।’
আনাস বিন মালেক থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন : ‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ছয় মাস পর্যন্ত ফজর নামাজের সময় ফাতিমার গৃহের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলতেন, হে আহলে বাইত, তোমাদের উপর সালাম ও দরুদ। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইচ্ছা পোষণ করেছেন তোমাদের থেকে সকল প্রকার অপবিত্রতা দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’
মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে এভাবে বর্ণনা করেছেন :
فَقُلْ تَعَالَوْاْ نَدْعُ أَبْنَاءنَا وَأَبْنَاءكُمْ وَنِسَاءنَا وَنِسَاءكُمْ وَأَنفُسَنَا وأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَةَ اللّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
অর্থাৎ ‘বলুন : (হে নবী) এসো আমরা আমাদের সন্তানদের আর তোমরাও তোমাদের সন্তানদের এবং আমরা আমাদের নারীদের তোমরা তোমাদের নারীদের এবং আমরা আমাদের নিজেদেরকে (নাফসকে) আর তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ডেকে নিয়ে এসো। অতঃপর আমরা (আল্লাহর দরবারে) আবেদন জানাই এবং মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণ করি।’ (আলে ইমরান : ৬১)
যখন আয়াতটি অবতীর্ণ হল তখন মহানবী (সা.) আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (আ.)-কে ডেকে আনলেন। তিনি বললেন :
اللهم هولاءِ أهْلُ بَيْتِي
‘হে আল্লাহ এরাই আমার আহলে বাইত।’
নবী (সা.) এর বর্ণনা সমূহে আহলে বাইত ও কোরআনের বন্ধন : নবী (সা.) তাঁর আহলে বাইতের অনেক ফযিলতের কথা বর্ণনা করেছেন। তাঁর ঐ সব বর্ণনা আহলে বাইতকে তাঁর উম্মতদের মধ্যে অতি উচ্চ আসনে আসীন করেছে। এই ফযিলতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোরআন ও আহলে বাইতের একাত্মতা এবং তাদের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তাদের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে তা কেয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। শিয়া সুন্নী সকলেই যে হাদীসের ব্যপারে একমত তা হাদীসে ‘সাকালাইন’ নামে পরিচিত। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন :
إنّى تارِكٌ فِيكُمْ الثَقْلَيْنِ کِتَابَ اللهِ و عِتْرَتِی أَهْلَ بَيْتِی إنْ تَمَسَّکْتُمْ بِهِمَا لَنْ تَضِلُّوا أبَداً
‘আমি তোমাদের জন্য অতি মূল্যবান দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, অপরটি হচ্ছে আমার রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়, আমার আহলে বাইত। তোমরা যদি এ দুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’
এই হাদীসটি নবী করিম (সা.) এর অনেক বিশিষ্ট সাহাবী বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি মুতাওয়াতির (অসংখ্য) সূত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। অনেকেই উল্লিখিত হাদীসটি বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসের প্রেক্ষাপট ও দলীল সমূহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নবী (সা.) এই কথাগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাহাবা ও অনুসারীদের সামনে বলেছেন এবং আহলে বাইত ও কোরআনের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
ইবনে হাজার হাইসামি (একজন প্রসিদ্ধ সুন্নী আলেম) এ ব্যাপারে বলেছেন যে, উল্লিখিত হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই হাদীসটি বিদায় হজ্জ্বের সময় অথবা আরাফার দিনে স্বয়ং নবীর মুখ থেকে শুনেছেন এবং বর্ণনা করেছেন । কেউ কেউ বলেছেন নবী (সা.) তাঁর অসুস্থতার সময় বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর সমাবেশে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অন্য দল বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) তায়েফ থেকে ফেরার পর একটা বক্তৃতা দেন এবং সেখানেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
কোরআন এবং আহলে বাইতের মধ্যে বিদ্যমান চিরস্থায়ী ও দৃঢ় বন্ধনের পেছনে একটা সূক্ষ্ণ ঐশী পরিকল্পনা রয়েছে। কোরআনের কিছু কিছু আয়াত সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছে যে, সকল যুগের ঐশী বাণীসমূহ দুটো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবসময় আল্লাহর ঐশী বাণী সে যুগের নবীর মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ওহীর পাশাপাশি একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিলেন, যিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং যিনি আল্লাহর দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন, সেই সাথে অদৃশ্যেরও জ্ঞান রাখেন। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তি পূর্ণ পবিত্রতার অধিকারী এবং কু প্রবৃত্তি ও শয়তানের প্ররোচনায় কখনও প্রভাবিত হন না। আল্লাহর ওহী প্রচার এবং প্রসারের দায়িত্ব ছাড়াও তা বর্ণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তারা পালন করে থাকেন। সর্বোপরি তারা হচ্ছেন ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির দিশারী।
পবিত্র কোরআনে এব্যাপারে বলা হয়েছে যে :
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلاَّ بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ
‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে কেবল তাঁর স্বজাতির ভাষায়ই প্রেরণ করেছি যাতে করে সে তাদের জন্য (আমার বাণী) সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। (ইব্রাহীম:৪)
পবিত্র কোরআনেও নবী (সা.) এর এই দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
‘তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে করে যা কিছু মানুষদের জন্য পাঠানো হয়েছে, তা তুমি তাদের জন্য সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা কর; হয়তো তারা চিন্তা ভাবনা করবে।’(নাহল:৪৪)
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে :
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَ الْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘তিনিই সেই সত্তা যিনি সাধারণ জনগোষ্ঠীর (নিরক্ষর লোকদের) মাঝে তাদেরই মধ্য থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনায়, তাদেরকে পবিত্র করে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়, অথচ তারা তার পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিলো।’(জুমুআ : ২)
এসব আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহর ঐশী বাণীসমূহ ব্যাখ্যার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে মনোনীত বান্দারা সবসময় ছিলেন। সুতরাং এমন এক ব্যক্তি সর্বদা অবশ্যই থাকবেন যিনি ওহী সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবেন। নবুওয়াতের ধারা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ওহী নাযিলের ধারাও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কোরআনের বাণীর আহ্বান চিরন্তন হওয়ায় কিয়ামত পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। একদিকে এই অবিনশ্বর ও চিরন্তন হওয়ার বৈশিষ্ট্য, অন্যদিকে মুসলমানরা তাদের ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও ধর্মীয় জীবনে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য প্রতিনিয়ত এ গ্রন্থের মুখাপেক্ষী হওয়ায় সব যুগেই কোরআনের পাশাপাশি তার সমস্ত গূঢ় রহস্য সম্পর্কে জ্ঞাত একজন ব্যাখ্যাকারক প্রয়োজন।
পবিত্র কোরআন ও আহলে বাইতের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধন থেকে প্রাপ্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ হচ্ছে নবী (সা.) এর মৃত্যুর পর একমাত্র তাঁর আহলে বাইতের দ্বারাই পবিত্র কোরআনের আয়াত সমুহের নির্ভুল ও সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পাদিত হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি নিজেই এ দায়িত্ব পালন করতেন। নবী (সা.) এর মৃত্যুর সাথে সাথে যদিও ওহী নাযিলের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু আল্লাহর বাণী প্রচার, প্রসার ও বর্ণনার কাজ শেষ হয়ে যায় নি। কোরআনের আয়াত নবী (সা.) এর সময়কার মানুষদের যেভাবে সম্বোধন করেছে তার পরবর্তী যুগের মানুষদেরকেও ঠিক সেভাবেই সম্বোধন করেছে।
আহলে বাইত ও পবিত্র কোরআনের এই বন্ধন যদি অব্যাহত না থাকত নবী (সা.) এর পরবর্তী যুগে কোরআন একটি নীরব প্রতিবেদন হয়ে পড়ত। কখনোই মুসলমানদের চাহিদা মিটাতে পারতো না এবং ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়তো।
হযরত আলী (আ.) এর বাণীতে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
‘কোরআন আল্লাহর নির্বাক গ্রন্থ, আর আমি তার ব্যখ্যা বিশ্লেষণকারী, সুতরাং আল্লাহর সবাক পুস্তককে আঁকড়ে ধর।’
ইমাম বাকের (আ.) কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে নবী (সা.) এর পর মানুষের পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নিস্পাপ ইমামগণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, আল্লাহ বলেছেন :
إِنَّمَا أَنتَ مُنذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ
‘অর্থাৎ নিশ্চয় (হে নবী) তুমি সতর্ককারী এবং প্রত্যেক জাতির জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে।’(রা’দ : ৭)
এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম বাকের (আ.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন :
‘রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ভীতি প্রদর্শনকারী। আর প্রত্যেক যুগে আমাদের আহলে বাইতের মধ্যে একজন ইমাম থাকবেন যিনি নবী (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে যা নিয়ে এসেছেন তার দিকে মানুষকে আহ্বান করবেন। নবী (সা.) এর পর প্রথম ইমাম হচ্ছেন হযরত আলী (আ.)।’
ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :
‘সব সময়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদের আহলে বাইতের মধ্যে থেকে কাউকে না কাউকে নির্বাচিত করেন, যে তাঁর কিতাবের আদ্যপ্রান্ত সব জানেন।’
তাঁর থেকে অন্য আরেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে :
‘আল্লাহর কসম কোরআনের সমস্ত জ্ঞান ভান্ডার আমাদের নিকটে মজুদ রয়েছে।’
এটা মনে রাখা দরকার যে, আহলে বাইত কর্তৃক আল্লাহর বাণীসমূহকে ব্যাখ্যা দান এবং মানুষকে শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি কোন নির্দিষ্ট আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট যুগের জন্যও নয়। বরং এটা সর্ব যুগের ও সর্ব কালের জন্য। এর যথার্থতা হাদীসে সাকালাইন থেকে ষ্পষ্টভাবে বোঝা যায়। কেননা ঐ হাদীসেই কোরআন ও আহলে বাইতের চিরস্থায়ী বন্ধনের কথা বলা হয়েছে যা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ইবনে হাজার হাইসামী কোরআন এবং আহলে বাইতের অব্যাহত বন্ধনের ব্যাপারে বলেছেন : সাকালাইনের হাদীস আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দান করে এই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে, কোরআন যেমন কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে এবং সেটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে তেমনি আহলে বাইতও কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে এবং তাদেরকে কোরআনের মতই আঁকড়ে ধরতে হবে।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, আহলে বাইত (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং আল্লাহর পবিত্র বাণীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাদের সমতুল্য কেউ নেই। এর যথার্থতা পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৩৩ এবং ওয়াকেয়ার ৭৭-৭৯ নং আয়াত :
إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ * في كِتابٍ مَّكْنُونٍ * لَّا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ
অর্থাৎ নিশ্চয় এটি মহাসম্মানিত কোরআন যা গুপ্ত এক সুরক্ষিত গ্রন্থে আছে। পবিত্র লোকেরা ব্যতীত কেউ তা স্পর্শ করে না (করতে পারেনা)।
কোন কোন মুফাসসির (তাবাতাবাঈ) لا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ বাক্য কে كِتَابٍ مَّكْنُون বাক্যাংশের সিফাত (বৈশিষ্ট্য) হিসেবে বলেছেন। এই অবস্থায় আল্লাহর পবিত্র বাণীর অর্থ হবে যে, শুধুমাত্র যারা الْمُطَهَّرُونَ অর্থাৎ পবিত্র কেবল তারাই কোরআনের মূল উৎস ও এর অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। আর তাতহীরের আয়াতে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন সেই মুতাহ্হারুন বা পবিত্র ব্যক্তিবর্গ। অতএব তাঁরাই আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন।
ইমাম আলী (আ.) বলেন :
‘আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সমস্ত পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। আমরা পৃথিবীতে মানুষের জন্য পথ প্রদর্শনকারী। আমরা সব সময় কোরআনের সাথে এবং কোরআন আমাদের সাথে; তারা কখনোই একে অপরের থেকে আলাদা হবে না।’