আদিকাল থেকেই মানব সমাজে ‘ন্যায়বিচার’ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়ে এসেছে। সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানুষকে আল্লাহ যে স্বাধীনতা (সীমিত আকারে) দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার সাথে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ সরাসরি জড়িত। মানুষ জীবনে চলার পথে স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জুলুম-অত্যাচার কিংবা শান্তি ও ন্যায়পরায়ণতা এ দু’পথের কোন্ পথে সে অগ্রসর হবে তা সে নিজেই নির্বাচন করে। অন্যথায় দায়িত্ব-কর্তব্য,হিসাব-নিকাশ এবং পরিণতিতে শাস্তি ও পুরস্কার (দোযখ ও বেহেশত) এ সব কিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় “আমি তাকে পথ প্রদর্শন করেছি,হয় সে কৃতজ্ঞ হবে না হয় অকৃতজ্ঞ হবে।” (সূরা দাহর : ৩)
যুগে যুগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ অত্যন্ত জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ‘ন্যায়পরায়ণতা’ বা ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটি অন্য যে কোন শব্দের চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানব সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ কেন উত্থাপিত হয়েছে? আর এর মূল উৎসই বা কোথায়? তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে মানব সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মূল সূত্রের সন্ধান পেতে হলে তা ঐশী গ্রন্থসমূহেই খুঁজতে হবে। নবী-রাসূলগণের আগমন ও সে সাথে ঐশী গ্রন্থসমূহের অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে,“নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলদেরকে স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মানদণ্ড অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।” (সূরা হাদীদ্ : ২৫) অন্যত্র বলা হয়েছে,“(হে রাসূল) বল,আমার প্রতিপালক ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন।” (সূরা আ’রাফ : ২৯) এভাবে ঐশী গ্রন্থ আল কোরআন মানুষের হৃদয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেতনা উদ্দীপিত করেছে।
মহান আল্লাহ এবং তাঁর সমগ্র সৃষ্টিজগতও যে ন্যায়পরায়ণতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত সে দিকে ইঙ্গিত করে কোরআন আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ঘোষণা করেছে,“আল্লাহ সাক্ষ্য দেন,তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নেই,ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানিগণও (সাক্ষ্য দেয়);আল্লাহ ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।” (সূরা আলে ইমরান : ১৮) “তিনি আকাশকে সমুন্নত করেছেন আর (তাতে) মানদণ্ড স্থাপন করেছেন।” (সূরা আর রাহমান : ৭)
সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে ইসলাম ঐশী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে,যা ন্যায়পরায়ণতা এবং অত্যাচারবিরোধী নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। পবিত্র কোরআনে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ইমামত বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,“এবং (স্মরণ কর) যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক বিভিন্ন বিষয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করলেন এবং সে তাতে উত্তীর্ণ হলো,আল্লাহ বললেন : আমি তোমাকে জনগণের নেতা (ইমাম) হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলাম,ইবরাহীম বলল : আমার বংশধরগণের মধ্য হতেও (নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করুন),আল্লাহ বললেন : আমার প্রতিশ্রুতি অত্যাচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় (তোমার বংশধরগণের মধ্যে শুধু যারা ন্যায়পরায়ণ তারাই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হবে)।” (সূরা বাকারা : ১২৪)
এ আয়াত থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে,নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ইসলাম ন্যায়পরায়ণতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত মনে করে। আর বাস্তবেও তাই অর্থাৎ সমাজে ন্যায়বিচার ও প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আজকের এ বিশ্বে এত অবিচার-অনাচার,শোষণ-নিপীড়ন,জাতিতে জাতিতে,ভাষায় ও বর্ণে এত বিবাদ-বিসম্বাদ,চারিদিকে সন্ত্রাস আর যুদ্ধ-এ সব কিছুর মূলেই রয়েছে সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। বৃহৎ শক্তিবর্গসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজ যারা ক্ষমতাসীন তাদের মধ্যে ন্যায়নীতি ও সততার বড়ই অভাব। শক্তিমত্তার অহংকার এবং আধিপত্যের মোহই তাদের মাঝে বেশি কাজ করছে। তাই বর্তমান এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে বিশ্বশান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে ঐশী বিধান মোতাবেক বিশ্বের দেশে দেশে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তাহলেই বিশ্বশান্তি নিশ্চিত হবে।