বাঙ্গালী
Friday 27th of December 2024
0
نفر 0

ধর্ম ও রাজনীতি

ধর্ম ও রাজনীতি

আমাদের আলোচ্য বিষয় ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক। এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে এ সত্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন মনে করছি যে,কোনো সত্যকে চিনতে পারার বিষয়টি সত্যকে গ্রহণ ও তার নিকট আত্মসমর্পণের জন্য অন্তরের প্রস্তুতির ওপর নির্ভরশীল। কোরআন মজীদ নিম্নোক্ত আয়াতে এ সত্যই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে :

إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَ‌ىٰ لِمَن كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ

“নিঃসন্দেহে এতে (কোরআনে) তার জন্য উপদেশ রয়েছে যে ব্যক্তি (অনুধাবন করার উপযোগী) অন্তঃকরণের অধিকারী অথবা যে অভিনিবেশ সহকারে শ্রবণ করে।” (সূরা ক্বফ : ৩৭)

কারো অন্তঃকরণের যদি এ ধরনের ক্ষমতা না থাকে তা হলে সে ব্যক্তি সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়,তা সে সত্য যতই স্পষ্ট হোক এবং সে সমস্ত রকমের স্পষ্ট নিদর্শনের মোকাবিলায় একগুঁয়েভাবে রুখে দাঁড়ায়। তখন সে দ্ব্যর্থবোধক কথাবার্তা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আশ্রয় নেয় এবং সর্বাধিক সত্যপরায়ণ ব্যক্তির ওপর মিথ্যা আরোপ করে ও তাঁর কাজকে ‘জাদু’ বলে অভিহিত করে। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

لَوْ أَنَّنَا نَزَّلْنَا إِلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةَ وَكَلَّمَهُمُ الْمَوْتَىٰ وَحَشَرْ‌نَا عَلَيْهِمْ كُلَّ شَيْءٍ قُبُلًا مَّا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا

“আর আমরা যদি তাদের নিকট ফেরেশতাদেরকে পাঠাতাম ও মৃত ব্যক্তিরা তাদের সাথে কথা বলত এবং তাদের সামনে সব কিছুকেই সমবেত করতাম তথাপি তারা ঈমান আনত না...।” (সূরা আল আনআম : ১১১)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَإِن يَرَ‌وْا آيَةً يُعْرِ‌ضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ‌ مُّسْتَمِرٌّ‌

“আর তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখতে পায়,তো (তা থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে,(এ তো) ধারাবাহিক জাদু।” (সূরা আল কামার : ২)

মানুষকে বিতর্ক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং এ ক্ষমতার বদৌলতে সে তুলার সাদা হওয়া ও আলকাতরার কালো হওয়ার সত্যতা অস্বীকার করতে পারে,এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সে পরিকল্পিতভাবে কোরআনের আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা করে মদ ও জুয়া হারাম হওয়ার এবং নামায ও রোযা বাধ্যতামূলক হওয়ার সত্যতাকে উড়িয়ে দিতে পারে। এ ধরনের লোকদের নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَكَانَ الْإِنسَانُ أَكْثَرَ‌ شَيْءٍ جَدَلًا

“আর মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিতর্ককারী।” (সূরা আল কাহাফ : ৫৪)

এবার মূল আলোচ্য বিষয়ে আসা যাক। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক। এ প্রসঙ্গে আমাকে প্রথমেই ‘ধর্ম’ ও ‘রাজনীতি’ পরিভাষা দু’টির ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে,এ দু’টি পরিভাষার তাৎপর্য কী?

ধর্মের মানে যদি হয় কেবল মানুষ ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যকার এক ধরনের সম্পর্ক এবং কতগুলো সুনির্দিষ্ট ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান অথবা সে সাথে কতক সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য যুক্ত হয়,তা হলে নিঃসন্দেহে রাজনীতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অনুরূপভাবে রাজনীতি মানে যদি হয় প্রবঞ্চনা,কপটতা,ধূর্ততা ও পাশ কাটানোর শয়তানী কৌশল তা হলেও ধর্মের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

সে যা-ই হোক,প্রকৃত ব্যাপার হলো ধর্ম ও রাজনীতির এ ধরনের ব্যাখ্যা সঠিক নয় এবং ধর্ম ও রাজনীতি উভয়ের সাথেই সঠিকভাবে পরিচিত না থাকার কারণেই এরূপ ধারণা পোষণ করা হচ্ছে।

রাজনীতির সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে প্রশাসনিক শক্তির বলে একটি সমাজের ভিতরগত ও বাইরের সকল বিষয়ের শাসন,নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা। আর ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে,এতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত ঐশী ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা মানুষের সকল ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন এবং পারলৌকিক জীবনের সকল প্রয়োজনও পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করে। ধর্ম তার আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে স্বীয় অনুসারীদের নৈতিকতাকে শাণিত করা ও তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কৃত তাদের ইবাদত ও আনুগত্যকে প্রাণবন্ত করে তোলে। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّـهِ الْإِسْلَامُ

“নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট দীন একমাত্র ইসলাম...।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَ‌سُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ

“তিনিই (আল্লাহ্) যিনি উম্মী (নিরক্ষর) লোকদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রাসূলকে উত্থিত করেছেন যিনি তাদের নিকট তাঁর (আল্লাহর) আয়াত পাঠ করে শোনান এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন...।” (সূরা জুমুআ : ২)

অনুরূপভাবে ইসলাম তার পার্থিব দিকে ও সমাজ জীবনে তার অনুসারীদের জন্য সম্মান,শক্তি,ক্ষমতা,ন্যায়বিচার,শান্তি,স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই নিশ্চিত করেছে। আর তা করা হয় দুর্নীতিপরায়ণ ও চরিত্রহীন লোকদেরকে উৎখাত,দুর্নীতি ও অনৈতিকতার মূলোৎপাটন এবং এমন একটি সামাজিক পরিবেশ গঠনের মাধ্যমে যে সমাজে সকল শক্তি ও সামর্থ্য প্রবৃদ্ধি,সমন্বয় ও মানবিক পূর্ণতা অভিমুখে পথ করে নিতে সক্ষম হয় এবং দৃঢ়তার সাথে তার বাস্তব রূপায়ন ঘটায়।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

لَقَدْ أَرْ‌سَلْنَا رُ‌سُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ

“অবশ্যই আমরা আমাদের রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মানদণ্ড পাঠিয়েছি যাতে লোকেরা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর আমরা লৌহ অবতীর্ণ করেছি যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি...।” (সূরা আল হাদীদ : ২৫)

আল্লাহ্ তায়ালা অন্যত্র এরশাদ করেন :

. وَلِلَّـهِ الْعِزَّةُ وَلِرَ‌سُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ

“...আর শক্তি তো আল্লাহর এবং তাঁর রাসূলের ও মুমিনদের...।” (সূরা আল মুনাফিকুন : ৮)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

إِذْ جَعَلَ فِيكُمْ أَنبِيَاءَ وَجَعَلَكُم مُّلُوكًا

“...(মূসা বনি ইসরাঈলকে বলল :) স্মরণ করো,তিনি তোমাদের মধ্যে নবী বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন...।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ২০)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ‌ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ‌ أَنَّ الْأَرْ‌ضَ يَرِ‌ثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

“আর আমরা যিক্রের (তাওরাতের) পরে যাবূরে লিখে দিয়েছিলাম যে,আমার উপযুক্ত বান্দারা এ ধরণির উত্তরাধিকারী হবে।” (সূরা আল আম্বিয়া : ১০৫)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْ‌ضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْ‌تَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যথোপযুক্ত কর্ম সম্পাদন করেছে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন যে,অবশ্যই তিনি তাদেরকে ধরণির বুকে খেলাফত প্রদান করবেন ঠিক যেভাবে তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খেলাফত প্রদান করেছিলেন;আর অবশ্যই তিনি তাদের জন্য তাদের সেই দীনকে সম্ভাবনাময় করে দেবেন যে দীনকে তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির অবস্থার পরে তিনি তাদের অবস্থাকে নিরাপদ অবস্থায় পরিবর্তিত করে দেবেন...।” (সূরা আন নূর : ৫৫)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

يُرْ‌سِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُم مِّدْرَ‌ارً‌ا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَىٰ قُوَّتِكُمْ.

“...তিনি আসমানকে তোমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণকারীরূপে পাঠিয়েছেন এবং তোমাদের শক্তির সাথে আরো শক্তি যোগ করে দিয়েছেন...।” (সূরা হূদ : ৫২)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে :

وَلَن يَجْعَلَ اللَّـهُ لِلْكَافِرِ‌ينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا

“...আর আল্লাহ্ কখনোই কাফেরদের জন্য ঈমানদারদের বিরূদ্ধে কোনো পথ তৈরি করে দেবেন না।” (সূরা আন নিসা : ১৪১)

এ সব আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে খুব সহজেই বোঝা যায় যে,ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই ধর্ম ও ইবাদতের মধ্যকার সম্পর্কের তুলনায় কম নয়;বরং অনেক বেশি। এর কারণ হচ্ছে কোরআন মজীদে সরকার,শাসন,যুদ্ধ,বিচারকাজ,ফৌজদারী দণ্ডবিধি,বিয়ে,তালাক,ব্যবসায়িক লেনদেন,দেউলিয়াত্ব,বন্ধক,ঋণ,সাক্ষ্য,শাস্তি,রক্তমূল্য, উত্তরাধিকার এবং এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ে যে সব আয়াত রয়েছে-যার আয়তন সম্ভবত কোরআন মজীদের এক চতুর্থাংশ-এ সকল আয়াতে ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে অর্থাৎ একটি ঐশী সরকারের সার্বভৌমত্বের অধীনে একটি ইসলামী সমাজের প্রশাসনিক বিষয়াদি নিয়ে চর্চা করা হয়েছে। এর বিপরীতে কোরআন মজীদে নামায সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যা একশ’র বেশি নয় এবং রোযা সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যা চৌদ্দটির বেশি নয়।

ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। সে সম্পর্ক এতখানি যে,ইসলামে রাজনীতিকে ধর্মের সাথে অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে গণ্য করা হয়েছে। অতএব,এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনো প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। তবে যেহেতু শয়তানের প্ররোচনায় অনেকে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ককে অস্বীকার করে থাকে সেহেতু বাধ্য হয়েই এ বিষয়ে প্রমাণ পেশ করতে হয়। এখানে আমরা এতৎসংক্রান্ত কতক প্রমাণের দিকে দৃষ্টি দেব।

এক : সরকার (ভিলাইয়্যাহ্)

‘ভিলাইয়্যাহ্’ ক্রিয়ামূল থেকে নিষ্পন্ন বিভিন্ন শব্দ কোরআন মজীদে শতাধিক আয়াতে এবং বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রধানত হিজরত ও মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পরে নাযিলকৃত বিভিন্ন সূরায় এ সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের কাছ থেকে অপরিহার্যভাবে আনুগত্য লাভের অধিকারী রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ,বিশেষত নেতার সাথে ও প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে তাদের সম্পর্ক নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই এ সব আয়াত নাযিল হয়।

এটি অনস্বীকার্য যে,কোনো সচল,সক্রিয়,গঠনমূলক ও প্রাণশীল সমাজের জন্য অবশ্যই এমন একটি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন রয়েছে যা তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা বা সংগঠনের প্রাকৃতিক ভিত্তি তিনটি :

১. ব্যক্তিদের মধ্যকার সুদৃঢ় পারস্পরিক সম্পর্ক-যার বদৌলতে তারা একটি দেহের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন অঙ্গের ন্যায় হয়ে যায় যারা পরস্পরের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনায় অংশীদার হয় এবং তাদের বন্ধু যেমন হয় অভিন্ন,তেমনি তাদের শত্রুও হয় অভিন্ন।

২. এমন একটি অক্ষ ও কেন্দ্র যার আদেশ ও পতাকার অধীনে তারা সবাই একত্রিত হয়,যা তাদের ঐক্যের প্রতীকরূপে ভূমিকা পালন করে,যা তাদের সমস্যাবলী সমাধানের কেন্দ্র হবে এবং যা তাদের সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। এ ধরনের একটি কেন্দ্র না থাকলে কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে না এবং তাদের মধ্যে দৃঢ় সংবদ্ধতাও তৈরি হতে পারে না। বিভিন্ন বিষয়ে অপরিহার্য মতবিরোধ ও বিভেদ মূলত বিভিন্ন ধরনের বিভক্তির উৎসকে এবং অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত ও শত্রুতাকে পুনঃসক্রিয় করে তোলে।

৩. বৈদেশিক সম্পর্ক ও বিদেশীদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নীতিগত অবস্থান।

কোরআন মজীদে ভিলাইয়্যাহ্ সংক্রান্ত আয়াতসমূহে এ তিনটি বিষয় স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে। প্রথমোক্ত বিষয়ে এরশাদ হয়েছে :

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُ‌وا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَالَّذِينَ آوَوا وَّنَصَرُ‌وا أُولَـٰئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ

“অবশ্যই যারা ঈমান এনেছে,হিজরত করেছে এবং তাদের ধনসম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর  রাস্তায় জিহাদ করেছে এবং যারা (তাদেরকে) আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারা পরস্পর বন্ধু...।” (সূরা আল আনফাল : ৭২)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُ‌ونَ بِالْمَعْرُ‌وفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ‌ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّـهَ وَرَ‌سُولَهُ.

“আর ঈমানদার পুরুষ ও নারীরা পরস্পর বন্ধু;তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ প্রতিহত করে,নামায আদায় করে,যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে...।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ৭১)

সুতরাং ঈমানদারদের জন্য এক কাতারভুক্ত থাকা,রণাঙ্গনে অভিন্ন ব্যূহ রচনা ও পরস্পরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা এবং ভালবাসা ও সাহায্য করা অপরিহার্য। বাস্তবে এ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যে কোনো মুসলমানকেই তার মুসলিম ভাই-বোনের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের দুঃখ-কষ্ট ও দুরবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তা হলে বিশ্বের যে দেশে যখনই কোনো মুসলমান শত্রুর হামলার সম্মুখীন হবে তখন তাকে একা হয়ে পড়তে হবে না। কারণ,তাদের এক ব্যক্তির দুঃখ-কষ্ট তাদের সবারই দুঃখ-কষ্ট।

মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি সম্বন্ধে অনেক হাদীস রয়েছে যাতে উপরিউক্ত আয়াতসমূহেরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিধৃত হয়েছে। এ ধরনের একটি হাদীসে বলা হয়েছে :

إنّما المؤمنون في تراحمهم و تعاطفهم بِمنْزلة الجسد الواحد إذا اشتکی منه عُضو واحد تداعی له سائر الجسد بالحمّی و السّهر.

“অবশ্যই ঈমানদাররা পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও ভালবাসার ক্ষেত্রে একটি দেহের অনুরূপ;যখন তার একটি অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন জ্বর ও অনিদ্রার মাধ্যমে তার সব অঙ্গ তাতে সাড়া দেয়।”

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে :

من أصبح لا يهتمّ بأمور المسلمين فليس بِمسلم.

“যে ব্যক্তির এমন অবস্থায় সকাল হলো যে,সে মুসলমানদের কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামায় নি সে মুসলমান নয়।”

আরেক হাদীসে এরশাদ হয়েছে :

من سمع رجلا يُنادی يا للمسلمين و لم يُجبه فليس بِمسلم.

“যে ব্যক্তি কোনো লোককে ‘হে মুসলমানরা!’ বলে ফরিয়াদ করতে শুনল,অথচ তাতে সাড়া দিল না,সে মুসলমান নয়।”

উল্লিখিত দ্বিতীয় বিষয়ে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

نَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّـهُ وَرَ‌سُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَ‌اكِعُونَ ﴿٥٥﴾ وَمَن يَتَوَلَّ اللَّـهَ وَرَ‌سُولَهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا فَإِنَّ حِزْبَ اللَّـهِ هُمُ الْغَالِبُونَ.

“নিঃসন্দেহে তোমাদের ওয়ালী (অভিভাবক,বন্ধু) হচ্ছেন আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদাররা যারা নামায কায়েম রাখে এবং রুকূরত অবস্থায়ও যাকাত প্রদান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্,তাঁর রাসূল ও ঈমানদারদের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে সে ক্ষেত্রে (সে জেনে রাখুক যে,) অবশ্যই আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৫৫-৫৬)

এ আয়াতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে,ইসলামী সমাজের সংযোজক উপাদান হচ্ছে ভিলাইয়্যাহ্ ও এর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য যা বাধ্যতামূলক কর্তব্য। কারণ,তিনি হচ্ছেন কর্তৃত্বশালী ব্যক্তি (ولی الامر) যিনি সমাজের পরিচালক। এভাবে একটি সমাজ কার্যত একটি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসমন্বিত ঐশী সমাজে পরিণত হয়। অন্যদিকে এ ধরনের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের ফলে একটি সমাজ সব সময়ই তার শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ের অধিকারী হয়ে থাকে।

অনুরূপভাবে অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

طِيعُوا اللَّـهَ وَأَطِيعُوا الرَّ‌سُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ‌ مِنكُمْ ۖ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُ‌دُّوهُ إِلَى اللَّـهِ وَالرَّ‌سُولِ.

“...তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয় তা হলে তা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর সোপর্দ করো...।” (সূরা আন নিসা : ৫৯)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وَلَوْ رَ‌دُّوهُ إِلَى الرَّ‌سُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ‌ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ.

“...আর তারা যদি বিষয়টি রাসূল ও তাদের মধ্যকার কর্ম দায়িত্বশীলদের নিকট পেশ করত তা হলে তাদের মধ্যে যাদের দায়িত্ব অনুসন্ধান করা,তারা তা জানতে পারত...।” (সূরা আন নিসা : ৮৩)

এ ধরনের আরো অনেক আয়াতে বিরোধ নিষ্পত্তি ও ঐক্য বজায় রাখার দায়িত্ব নেতা ও কর্তৃত্বশালীদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

উল্লিখিত তৃতীয় বিষয় সম্পর্কে উল্লেখ করতে হয় যে,কোরআন মজীদের ভিলাইয়্যাহ্ সংক্রান্ত বেশির ভাগ আয়াতেই এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অনেক সূরায় এ বিষয়ের ওপর বিরাট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ইসলামের দুশমনদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্নকরণ এবং তারা র্শিক ও নিফাকের ওপর স্থির থাকলে ও মুসলমানদের প্রতি প্রকাশ্যে শত্রুতা পোষণ করলে,যেমন যুদ্ধ শুরু করলে বা গোপনে শত্রুতা পোষণ করলে,যেমন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে,মুসলমানদেরকে বাধা প্রদান করলে,দুশমনদেরকে সাহায্য করলে অথবা বিভিন্ন পন্থায় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে দুর্বল করার চেষ্টা চালালে তাদের সাথে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা প্রদান।

এ ধরনের ভিলাইয়্যাহ্কে নেতিবাচক ভিলাইয়্যাহ্ বলা যেতে পারে এবং এতে মুসলমানদের বৈদেশিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَ‌ىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ

“হে ঈমানদারগণ! ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না;তারা পরস্পরের বন্ধু। আর যে-ই এ (নির্দেশ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে,সে অবশ্যই তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে...।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৫১)

এ আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সাথে কোনো মুসলমানের ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন বা তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অন্য এক আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে :

لَّا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ‌ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّـهَ وَرَ‌سُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَ‌تَهُمْ ۚ أُولَـٰئِكَ كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُم بِرُ‌وحٍ مِّنْهُ ۖ وَيُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِ‌ي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ‌ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ رَ‌ضِيَ اللَّـهُ عَنْهُمْ وَرَ‌ضُوا عَنْهُ ۚ أُولَـٰئِكَ حِزْبُ اللَّـهِ ۚ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّـهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.

“(হে রাসূল!) আপনি এমন কোনো জনগোষ্ঠীকে পাবেন না যারা আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান পোষণ করে অথচ আল্লাহ্ ও রাসূলের বিরোধিতাকারীদেরকে ভালবাসে যদিও তারা (বিরোধিতাকারীরা) তাদের পিতা বা পুত্র বা ভাই বা আত্মীয়-স্বজন হয়ে থাকে। এরা (ঈমান পোষণকারীরা) হচ্ছে এমন লোক তিনি (আল্লাহ্) যাদের অন্তরে ঈমান লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন ও নিজের পক্ষ থেকে চেতনা (রূহ্) দ্বারা তাদেরকে সহায়তা করেছেন এবং তিনি তাদেরকে সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে;সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ্ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। এরাই হচ্ছে আল্লাহর দল;মনে রেখো,অবশ্যই আল্লাহর দল সফল হবে।” (সূরা আল মুজাদালাহ্ : ২২)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

مُّحَمَّدٌ رَّ‌سُولُ اللَّـهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ‌ رُ‌حَمَاءُ بَيْنَهُمْ

“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ এবং তাঁর সাথে যারা আছে তারা কাফেরদের ওপর খুবই কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে দয়াপ্রবণ...।” (সূরা আল ফাত্হ : ২৯)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ... قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَ‌اهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَ‌آءُ مِنكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّـهِ كَفَرْ‌نَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّىٰ تُؤْمِنُوا بِاللَّـهِ وَحْدَهُ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রুকে ও তোমাদের নিজেদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না;তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করো না। ... ইবরাহীম ও তার সঙ্গীদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে;স্মরণ করো,তারা যখন তাদের কওমকে বলল : অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের উপাসনা করছ তাদের সাথে সম্পর্কহীন;আমরা তোমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করছি,আর আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও ঘৃণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যদি না তোমরা একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আন...।” (সূরা আল মুমতাহিনাহ্ : ১ ও ৪)

এ সব আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর বান্দাদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী ব্যক্তি ও সরকারসমূহের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণ ও তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণের প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এতে প্রকাশ্যেই তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকরণের ঘোষণা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়েছে যেভাবে হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর দুশমনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তবে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে,এ সব আয়াতে কেবল রাজনৈতিক সম্পর্কের কথাই বলা হয়েছে। মানুষ হিসাবে তাদের সাথে সাধারণ সম্পর্ক রাখার জন্য এবং যে সব অমুসলিম ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর শত্রুতা পোষণ করে না তাদের কল্যাণ সাধনের জন্য ইসলামে শুধু অনুমতিই দেয়া হয় নি;বরং এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

لَّا يَنْهَاكُمُ اللَّـهُ عَنِ الَّذِينَ لَمْ يُقَاتِلُوكُمْ فِي الدِّينِ وَلَمْ يُخْرِ‌جُوكُم مِّن دِيَارِ‌كُمْ أَن تَبَرُّ‌وهُمْ وَتُقْسِطُوا إِلَيْهِمْ ۚ إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ

“যে সব লোক দীনের কারণে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি বা তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করে নি তোমরা তাদের কল্যাণ করবে ও তাদের প্রতি সুবিচার করবে-এতে আল্লাহ্ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন।” (সূরা আল মুমতাহিনাহ্ : ৮)

এটি ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়সমূহের অন্যতম যা এ সত্যকেই তুলে ধরে যে,ইসলামী সমাজ হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট ও একটি ঐক্যবদ্ধ গ্র“প যা একক নেতার অনুগত,যা ইসলামের শত্রুদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রতি কোনো ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করে না। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এ ছাড়া অন্য কিছু হওয়া কি সম্ভব?

নিজেদের মধ্যে ঐক্য,পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা এবং বৈদেশিক শত্রুদের মোকাবিলায় অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ ও কঠোর ঘোষণা প্রদান সম্পর্কে এতগুলো আয়াত থাকার পরেও কি এটি বলা চলে যে,ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে হবে? এ থেকেই স্পষ্ট যে,ইসলামে এ বিষয়টির ওপর কতখানি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে!

দুই : নবীদের সরকার

নবী-রাসূলরা তাঁদের নিজেদের ঐশী সরকার ব্যতীত অন্য সব সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁদের মিশন শুরু করেন। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّ‌سُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّـهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

“আমি প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই একজন রাসূল উত্থিত করেছি (এ বাণীসহ) যে,আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাগূতকে বর্জন করো...।” (সূরা আন নাহল : ৩৬)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

يُرِ‌يدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُ‌وا أَن يَكْفُرُ‌وا بِهِ

“তারা তাদের বিচার্য বিষয় তাগূতের কাছে নিয়ে যেতে চায় অথচ তারা তাকে প্রত্যাখ্যানের জন্য আদিষ্ট হয়েছে...।” (সূরাহ্ আন নিসা : ৬০)

এটি সুস্পষ্ট যে,তাগূতের নিকট থেকে বিচার চাওয়াকে নিষিদ্ধ করার পর সমাজ ব্যবস্থাকে তাগূতের তৈরি জংলী আইনের অধীনে ন্যস্ত করে বিভ্রান্তির কবলে নিক্ষেপ করা উদ্দেশ্য হতে পারে না;বরং এর বিপরীতে,আল্লাহর প্রতি বিরোধিতা ও শত্রুতা পোষণকারীদের শাসনের পরিবর্তে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠাই উদ্দেশ্য। তাই বিভিন্ন সময় নবী-রাসূলদের নেতৃত্বে ও তাঁদের পথনির্দেশনায় ঐশী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সব সরকার লোকদেরকে নবীদের আনুগত্য করার জন্য আহ্বান জানাতো। কারণ,তাঁরা ছিলেন আল্লাহ্ তায়ালার মনোনীত বান্দা এবং ঐশী ন্যায়বিচার বাস্তবায়নকারী।

সূরা আশ শুয়ারায় হযরত নূহ্,হযরত হূদ,হযরত সালেহ্ ও হযরত শুআইব (আ.)-এর যবানীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,তাঁদের সবাই একটি অভিন্ন বিষয়ের প্রতি আহ্বান করেছিলেন। আর তা হচ্ছে : “অতএব,তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।” এভাবেই তাঁরা নিজেদের আনুগত্যের প্রতি এবং সমকালীন শাসকদের আদেশ-নিষেধ প্রত্যাখ্যানের জন্য লোকদেরকে আহ্বান জানাতেন। আসলে তাঁদের সময় তাঁদের সাথে প্রতিপক্ষের যত বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল ও যত সংঘর্ষ ঘটেছিল এটিই ছিল তার কারণ। নবী-রাসূলদের মধ্যে যখন যাঁর পক্ষেই সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিল তখনই তিনি সরকার গঠন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন হযরত দাউদ,হযরত সুলাইমান,হযরত মূসা ও বনি ইসরাঈলের অন্য কয়েক জন নবী। এ প্রসঙ্গে বনি ইসরাঈলকে সম্বোধন করে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

وَجَعَلَكُم مُّلُوكًا وَآتَاكُم مَّا لَمْ يُؤْتِ أَحَدًا مِّنَ الْعَالَمِينَ

“আর তিনি (আল্লাহ্) তোমাদেরকে রাজা বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে এতই প্রদান করেছেন যে,বিশ্ববাসীর মধ্যে আর কাউকে তেমন প্রদান করেন নি।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ২০)

ইসলামের ইতিহাস থেকে এ বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। তা হচ্ছে,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সমসাময়িক সব রাষ্ট্রশক্তিকে ইসলামের ছায়াতলে আসা ও তাঁর আনুগত্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর তিনি এমন এক সময় এ আহ্বান জানান যে,তখন তিনি ছিলেন এমন এক নেতা যাঁর অনুসারীদের জন্য তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য ছিল অপরিহার্য। ঐ সময় তিনি ছিলেন ইসলামী সমাজের সব কাজের নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসক। (এ বিষয়ে পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।)

এভাবেই নবী-রাসূলরা একই সাথে আল্লাহ্ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করতেন।

তিন : জিহাদ

কোরআন মজীদের আয়াতসমূহের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে কোরআন মজীদের সূরা আল বাকারাহ্,আলে ইমরান,আন নিসা,আল মায়েদাহ্,আল আনফাল,আত তাওবাহ্,আল হাজ্ব,আল আহযাব,মুহাম্মদ,আল ফাত্হ,আল হুজুরাত,আল হাদীদ,আল হাশ্র,আস সফ ও আল মুয্যাম্মিলে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই নবী-রাসূলদের মিশন শত্রুদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন ঃ

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِّنَ الْمُجْرِ‌مِينَ.

“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের (পাপাচারীদের) মধ্য থেকে শত্রু বানিয়ে দিয়েছি।” (সূরা আল ফুরকান : ৩১)

নবী-রাসূলদের শত্রুদের অধিকাংশই ছিল শক্তি,ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী। তাঁদের এ বিরোধী পক্ষ শুধু কথায়ই তাঁদের বিরোধিতা করে নি;বরং তাঁদেরকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ বিরোধিতা সশস্ত্র সংঘাত ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পর্যবসিত হয় এবং নবী-রাসূলদেরক সব সময়ই তাঁদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِ‌بِّيُّونَ كَثِيرٌ‌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا ۗ وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِ‌ينَ

“এমন অনেক নবী ছিল যাদের সাথে থেকে বহু খোদাপন্থী লোক যুদ্ধ করেছে;আর আল্লাহর পথে তাদের ওপর যে বিপদাপদ নিপতিত হয়েছে সে কারণে তারা ভীত হয় নি ও দুর্বল হয় নি এবং দমেও যায় নি। আর আল্লাহ্ ধৈর্যধারণকারীদেরকে ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৬)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِ‌بِّيُّونَ كَثِيرٌ‌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا ۗ وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِ‌ينَ

“আল্লাহ্ মুমিনদের নিকট থেকে এ শর্তে তাদের প্রাণ ও ধনসম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন যে,তারা জান্নাতের অধিকারী হবে। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে;তারা হত্যা করে ও নিহত হয়। এ হচ্ছে তাওরাত,ইঞ্জিল ও কোরআনে বিধৃত এমন এক অঙ্গীকার যা তাঁর (আল্লাহর) ওপর (তাদের জন্য নির্ধারিত) অধিকার।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ১১১)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم ۖ مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّ‌اءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّ‌سُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ‌ اللَّـهِ

“তোমরা কি মনে করেছ যে,তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে,অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যে অবস্থা এসেছিল তেমন অবস্থা তোমাদের ওপর এখনো আসে নি? তাদেরকে এমন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করেছিল এবং তারা এমনই অস্থির হয়ে পড়েছিল যে,এমনকি রাসূল এবং তাঁর সঙ্গী-সাথী ঈমানদাররা পর্যন্ত বলে উঠেছিল : আল্লাহর সাহায্য কোথায়?..” (সূরা আল বাকারাহ্ : ২১৪)

এটি স্পষ্ট যে,যুদ্ধ হচ্ছে একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত স্বাধীন সরকারের বৈশিষ্ট্য যে সরকার তার দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

চার : বিচার বিভাগ

বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ,আইনগত শাস্তি (হুদূদ ও তাযিরাত) কার্যকরকরণ এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করা ছিল নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহ্ প্রদত্ত ইখতিয়ারসমূহের অন্যতম।

আল্লাহ্ তায়ালা হযরত দাউদ (আ.)-কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন :

يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْ‌ضِ فَاحْكُم بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ

“হে দাউদ! অবশ্যই আমি তোমাকে ধরণির বুকে খলীফা বানিয়েছি,অতএব,তুমি সত্যতা সহকারে লোকদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করো...।” (সূরা সোয়াদ : ২৬)

আল্লাহ্ তায়ালা অন্যত্র এরশাদ করেন :

وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْ‌ثِ

“আর দাউদ ও সুলাইমান;তারা উভয় যখন ফসল সংক্রান্ত বিষয়ে বিচার-ফয়সালা করল...।” (সূরা আল আম্বিয়া : ৭৮)

এ সব আয়াতের সবগুলোতেই সরকারী ও রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। ধর্ম যদি রাজনৈতিক বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করতে না চাইত তা হলে কোরআন মজীদে এ সব আয়াত থাকত না এবং ধর্মসম্পর্কহীন (ঝবপঁষধৎ) শাসকদেরকে তাদের খেয়াল-খুশী মোতাবেক কাজ করার জন্য এ সব বিষয় তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হতো। আর বর্তমানে বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত যে সব দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত নেই সে সব দেশে আমরা এটিই দেখতে পাই। এ সব দেশে যে কোনো বিষয়ে বিচার-ফয়সালার তথা সেজন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অনৈসলামী শাসক ও আইন প্রণেতাদের খেয়াল-খুশীর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে,আর তারা তাদের অসম্পূর্ণ বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের দ্বারা এমন কিছুকে উত্তম ও কাম্য বলে গণ্য করে যা আল্লাহ্ তায়ালার নাযিলকৃত হুকুমের সম্পূর্ণ বিপরীত।

পাঁচ : শরীয়ত ও নবী-রাসূলদের বাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

আল্লাহর দীন উপস্থাপনকারী নবী-রাসূলরা তাঁদের মিশনের শুরু থেকে আজীবন বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ বিরোধিতা যেমন তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে,তেমনি আইন-বিধানের ক্ষেত্রে এবং যেমন অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের কাছ থেকে,তেমনি বৈদেশিক বিরোধীদের কাছ থেকে এসেছিল। কোনো নবীই এ সব বিরোধিতার সাথে আপোস করেন নি;কারণ,তা করলে তাঁর প্রচারিত দীন  নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বলা বাহুল্য যে,নবীর জন্য স্বীয় দীনের হেফাজতের লক্ষ্যে শক্তি,ক্ষমতা,সংগঠন ও নেতৃত্বের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য ছিল। আর এরই মানে হচ্ছে রাজনীতি ও সরকার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে,সকল নবী-রাসূলেরই যখন লক্ষ্য ছিল সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা তখন এজন্য সহায়ক শক্তি তথা রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া তাঁদের পক্ষে সে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া কি সম্ভবপর ছিল? আল্লাহ্ ও মানবতার দুশমন অর্থ,সম্মান ও প্রবৃত্তির পূজারীদের সামনে অনপসরণীয় বাধা সৃষ্টি করা না হলে তারা কি তাদের অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকবে? তারা কি ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত হতে দেবে যার ফলে দুর্বল ও সবল,গরীব ও ধনী,সাধারণ মানুষ ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা,শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে সকল মানুষ আইনের সামনে একই কাতারে দাঁড়াবে এবং তাদের প্রত্যেকেই তাদের যথাযথ অধিকার লাভ করবে? ঐ সব স্বৈরাচারী লোকের পক্ষে এটি কি করে সম্ভব যে,তারা তাদের সমাজের সম্পদ ও ক্ষমতাকে এবং জনগণের মালিকানাধীন প্রাকৃতিক সম্পদকে ন্যায়সঙ্গতভাবে সকলের মাঝে বণ্টন করে দেবে? কেউ যদি তা সম্ভব মনে করে তা হলে সে কল্পনার জগতে বিচরণ করছে। তার অবশ্যই চোখ খুলে তাকানো উচিত এবং বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান বাস্তবতাকে অবলোকন করা ও ইতিহাসের পাতা উল্টানো উচিত। তা হলে সে দেখতে পাবে শক্তিশালীরা দুর্বলদের সাথে কেমন আচরণ করেছে এবং বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতি ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের যুগেও কেমন আচরণ করছে,আর মজলুম দেশগুলো পরাশক্তিদের কাছ থেকে কী ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ পাচ্ছে ও কঠিন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করছে! শক্তিশালীদের পক্ষ থেকে যেখানে অন্যায়ভাবে রক্তপাত ঘটানো হচ্ছে এবং দুর্বলদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করা হচ্ছে সেখানে তাদেরকে মোকাবিলা করা ও একটি সীমারেখার মধ্যে সংযত থাকতে বাধ্য করার জন্য একটি শক্তির রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কিছু কি তাদেরকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে?

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّـهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الْأَرْ‌ضُ

“...আর আল্লাহর পক্ষ থেকে যদি লোকদের কতকের দ্বারা অপর কতককে দমন করা না হতো তা হলে এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত...।” (সূরা আল বাকারাহ্ : ২৫১)

এ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে,দীনের জন্য স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে রাজনীতিতে প্রবেশ করা অপরিহার্য এবং রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ধর্মের পতন ও বিলুপ্তি।

এ থেকেই আমরা কোরআন মজীদের ঐ সব আয়াতের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি যাতে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে নবী-রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ

“...আর আমি লৌহ নাযিল করেছি;তাতে রয়েছে বিরাট শক্তি...।” (সূরা আল হাদীদ : ২৫)

কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া এ কথা উল্লেখ করা হয় নি;বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরা যে,শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করা ব্যতীত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণ হতে পারে না।

ছয় : রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জীবন ও সুন্নাহ্

আমরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনেতিহাসে দেখতে পাই যে,তিনি মক্কা থেকে ইয়াসরীবে (মদীনায়) হিজরত করার পর প্রথম সুযোগেই শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। আমরা আরো দেখতে পাই যে,হিজরত-পরবর্তী দশ বছরে যে ভূ-খণ্ডেই ইসলাম প্রবেশ করেছে তিনি সেখানেই প্রশাসক নিয়োগ করেছেন। তিনি সকল রাজনৈতিক বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন;তিনি বিচারক নিয়োগ করেন,যুদ্ধ ঘোষণা করেন,সন্ধি স্থাপন করেন এবং চুক্তি সম্পাদন করেন। এর সবকিছুই তাঁর একার হাতে ছিল;এ সবের কোনোটিই তিনি অন্য কোন শাসকের হাতে ছেড়ে দেন নি। তিনি কেবল তাঁর নিয়োজিত প্রশাসকদের সহায়তায় এ সব কাজ সম্পাদন করতেন। কেবল তিনিই সকল সামাজিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেন;অন্য কারোই এ অধিকার ছিল না।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّـهُ وَرَ‌سُولُهُ أَمْرً‌ا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَ‌ةُ مِنْ أَمْرِ‌هِمْ

“এটি কোনো ঈমানদার পুরুষ ও কোনো ঈমানদার নারীর কাজ নয় যে,আল্লাহ্ ও রাসূল যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা করে দেন তার পরেও তারা তাদের বিষয়াদিতে নিজস্ব পছন্দ প্রয়োগ করবে...।” (সূরা আল আহযাব : ৩৬)

আল্লাহ্ তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ

“ঈমানদারদের ব্যাপারে নবী তাদের নিজেদের তুলনায় অগ্রাধিকার রাখেন...।” (সূরা আল আহযাব : ৬)

আমরা দেখতে পাই যে,রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর যারা ইসলামী জাহানের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ ও পরিচালনা করেন তাঁরা তা করেন রাসূলের প্রতিনিধি (খলীফা) ও ইসলামের অভিভাবক হিসাবে এবং তাঁরা ইসলামের বিধি-বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এমনকি বিভিন্ন সময় ইসলামী ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন অংশে যে সব স্বৈরাচারী শাসক শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন তাঁরাও ইসলামী আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন ও জনগণের মাঝে তা কার্যকর করতেন যদিও তাঁরা তা আন্তরিকতার সাথে করতেন না;বরং কেবল রাজনৈতিক স্বার্থেই এ ধরনের  ইসলাম-প্রীতির ভান করতেন। তবে আন্তরিকতার সাথে না হয়ে কেবল বাহ্যিকভাবে হলেও তাঁরা ইসলামী আইন-কানুনের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখাতেন তা-ও গুরুত্বহীন ছিল না। উদাহরণস্বরূপ,অত্যাচারের জন্য বিখ্যাত শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফী যখন এক ব্যক্তিকে তার জনৈক আত্মীয়ের অপরাধের জন্য গ্রেফতার করার উদ্যোগ নেয় তখন ঐ ব্যক্তি তাকে কোরআন মজীদের এ আয়াত শোনায় : وَلَا تَزِرُ‌ وَازِرَ‌ةٌ وِزْرَ‌ أُخْرَ‌ىٰ ‘কোন ভার বহনকারীই অন্য কারো ভার বহন করবে না’-(সূরা আল আনআম : ১৬৪)। হাজ্জাজ তার অপরাধময় অতীত সত্ত্বেও এ আয়াত শোনার পরে ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

বস্তুত মহানবী (সা.)-এর জীবন ও সুন্নাহ্ হচ্ছে এমন এক দলিল যা কিয়ামত পর্যন্ত অবশ্য অনুসরণীয়।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَ‌سُولِ اللَّـهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْ‌جُو اللَّـهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ‌

“তোমাদের মধ্যে যে সব লোক আল্লাহ্কে ও পরকালকে (আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের সুখ-শান্তি) প্রত্যাশা করে তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ রয়েছে...।” (সূরা আল আহযাব : ২১)

মুসলমানরা তাদের গোটা ইতিহাসেই এ সত্য স্বীকার করে এসেছে। তাই এটি চিন্তাও করা যেত না যে,কোনো ওয়াকেবহাল মুসলমান তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও মুসলিম জনগণের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করার ইখতিয়ার এমন কোনো শাসকের হাতে ন্যস্ত করতে প্রস্তুত হবে যে ব্যক্তি ইসলামের অনুগত নয় এবং তার পসন্দ নয় এমন ইসলামী আইন লঙ্ঘন করবে ও শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক আইন কার্যকর করবে। কোরআন মজীদ এ ধরনের কর্মনীতিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যখ্যান করেছে এবং এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّـهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْ‌هُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللَّـهُ إِلَيْكَ ۖ فَإِن تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ أَن يُصِيبَهُم بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ ۗ وَإِنَّ كَثِيرً‌ا مِّنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ ﴿٤٩﴾ أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّـهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ.

“আর (হে নবী!) আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করুন এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না,আর তাদেরকে পরিহার করে চলুন যাতে আল্লাহ্ আপনার ওপর যা নাযিল করেছেন তারা আপনাকে তার কতক থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। এ কারণে তারা যদি (আপনার প্রতি) পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে তা হলে আপনি জেনে রাখুন যে,তিনি তাদের কতকের ওপর তাদের পাপের কারণে (শাস্তি) আপতিত করবেন। আর অবশ্যই অনেক মানুষই পাপাচারী। তা হলে তারা কি জাহেলীয়াতের বিচার-ফয়সালা সন্ধান করছে? বস্তুত দৃঢ় ঈমানের অধিকারী লোকদের জন্য ফয়সালা প্রদানের ব্যাপারে আল্লাহর চেয়ে আর কে উত্তম হতে পারে?” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৪৯-৫০)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

فَلَا وَرَ‌بِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ‌ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَ‌جًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

“অতএব,কখনোই নয়,(হে রাসূল!) আপনার রবের শপথ,তারা কখনোই ঈমানের অধিকারী হবে না যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যকার বিরোধীয় বিষয়সমূহে আপনাকে বিচার-ফয়সালাকারী রূপে মেনে নেবে,অতঃপর আপনি যা ফয়সালা করে দেবেন সে ব্যাপারে তাদের অন্তরে মোটেই কুণ্ঠাবোধ না করবে;বরং পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করবে।” (সূরা আন নিসা : ৬৫)

যারা আল্লাহর আইন প্রত্যাখ্যান করে তাদের সম্পর্কে আরো এরশাদ হয়েছে :

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّـهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُ‌ونَ.

“...আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার ভিত্তিতে যারা ফয়সালা করে না তারাই কাফের।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৪৪)

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّـهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ.

“আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার ভিত্তিতে যারা ফয়সালা করে না তারাই যালেম।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৪৫)

... وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّـهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ.

“আর আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার ভিত্তিতে যারা ফয়সালা করে না তারাই ফাসেক।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৪৭)

আমরা এ সব আয়াতে দেখতে পাই যে,এমনকি তাওরাতের অনুসারী লোকদেরকে তাওরাতে বর্ণিত আইন-কানুন মেনে চলার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং যারা এর বিরোধিতা করে তাদেরকে কাফের,জালেম ও ফাসেক বলে গণ্য করা হয়েছে। এর কারণ এই যে,তারা আল্লাহ্ তায়ালার ফয়সালার পরিবর্তে অন্য ফয়সালা গ্রহণ করে নিয়েছিল।

বস্তুত আল্লাহ্ তায়ালার দেয়া ফয়সালার বিপরীতে কী করে মুসলিম সমাজে এমন একটি খোদাহীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যে সরকার মদ,জুয়া,সুদ ও ব্যাভিচারকে বৈধ করবে এবং মৃত ব্যক্তির সম্পদকে তার বৈধ উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্য কাউকে প্রদান করবে অথবা আল্লাহর আইনে বর্ণিত অংশের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে অন্যভাবে বৈধ উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন করবে এবং বিবাহ,তালাক,বন্ধক,ঋণ,অছিয়ত,শাস্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোরআনের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়ন করবে,অথচ এরপরও সে সমাজকে ‘ইসলামী সমাজ’ বলে অভিহিত করা হবে এবং সে সমাজের লোকদেরকে ‘মুসলমান’ বলে পরিচয় দেয়া হবে?

এরূপ করা হলে কার্যত তার মানে দাঁড়াবে কোরআন মজীদ ভুল করেছে বলে দোষারোপ করা,আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তাকে হালাল করা,তিনি যা হালাল করেছেন তাকে হারাম করা এবং আল্লাহ্ তায়ালার দেয়া অকাট্য আইনের মোকাবিলায় ভিন্ন মত প্রকাশ করা। ইসলাম কি চিরন্তন ঐশী ধর্ম নয়? এ সব বিষয়ে আল্লাহ্ তায়ালা যে বিধান দিয়েছেন এবং নামায ও রোযার ব্যাপারে তিনি যে সব বিধান দিয়েছেন এতদুভয়ের মধ্যে আল্লাহর হুকুম হওয়া প্রশ্নে কোনো পার্থক্য আছে কি যে,আমরা নামায ও রোযার ব্যাপারে তাঁর দেয়া বিধান মেনে চলব,কিন্তু অন্যান্য ব্যাপারে তাঁর বিধান মানব না?

যে সব বিভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করতে চাওয়া হয়েছে তা তিনটি উপাদান থেকে উৎসারিত হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে :

১. ইউরোপের খ্রিস্টীয় জগতে ধর্মের সঠিক প্রকৃতি সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও ধর্ম বলতে কেবল হযরত ঈসা (আ.)-এর শিক্ষার বিকৃত ও পরিবর্তিত রূপকে মনে করা এবং ঈসা (আ.)-এর সঠিক শিক্ষার বা অন্যান্য ধর্মের মূল শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া (যে সব শিক্ষা ইসলামে ও তার সামগ্রিক বিধি-বিধানে বিস্তারিতভাবে বিধৃত হয়েছে)। ইউরোপে ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা হওয়ার পেছনে এটিই মূল কারণ হিসাবে কাজ করেছে।

২. ধর্মীয় অন্ধ ভাবাবেগ ও অজ্ঞতাসুলভ ধর্মান্ধতাসহ চার্চের নেতাদের,তথাকথিত ধার্মিক লোকদের ও স্বৈরাচারী শাসকদের পক্ষ থেকে লোকদের সাথে অবমাননাকর আচরণ এবং ধর্মের নামে জ্ঞানচর্চা,গবেষণা,অনুসন্ধান,আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও যে কোনো নতুন তত্ত্ব ও প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে মোকাবিলা। এর ফলে ইউরোপীয় সমাজে ধর্মের গুরুত্ব হ্রাস পায় ও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়,ফলে সমাজ ধর্মের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তা সংস্কারকদেরকে চার্চ-নেতাদের চার্চের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য করতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে তারা জ্ঞানী-মনীষী,আবিষ্কারক ও সামাজিক সুবিচারের সমর্থকদের সামনে অবস্থিত সব বাধা অপসারণ করেন।

৩. ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের দুশমনদের,বিশেষত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। এ হচ্ছে এমন একটি উপাদান যা আজকের দিনে,বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহে ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। তারা ইসলামের শক্তির ভয়ে ভীত;ক্রুসেড যুদ্ধসমূহে ইসলামের হাতে তারা যে মার খেয়েছে তা থেকেই তাদের মধ্যে এ আতংক সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের সোনালী যুগসমূহে তারা ইসলামের শক্তিশালী রূপ দেখেছে;ইসলামী যুগের সূচনায় এবং পরবর্তীকালে ক্রুসেড যুগসমূহেও ইসলাম তার শত্রুদেরকে পর্যুদস্ত করেছিল। এ ছিল তাদের জন্য এক বিপদ সংকেত-প্রকৃত বিপদের সংকেত। এ বিপদ সংকেত তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিল যে,ইসলাম যদি তার সৃজনশীল ও গতিশীল চেতনা,প্রভাবশালী প্রেরণা,সকল শক্তি ও শৌর্যবীর্যসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং এরপর ইসলামী সমাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হয় তা হলে ইসলাম শুধু সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অবৈধ সুযোগ-সুবিধার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েই ক্ষান্ত হবে না,বরং এর ফলে স্বয়ং লোভী সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলোরও পতন ঘটবে। তারা লক্ষ্য করেছে,ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আইন-কানুন মুসলমানদের মধ্যে বিজাতীয় প্রভাব,অনৈতিকতা,অশ্লীলতা,দুর্নীতি ও অনাচার বিস্তারকে শক্ত হাতে প্রতিহত করে। বলা বাহুল্য যে,যে সব লোক মদ,জুয়া,ব্যাভিচার ও হারাম বিনোদনসমূহকে বেআইনী এবং জিহাদকে অপরিহার্য কর্তব্য বলে গণ্য করে অনিবার্যভাবেই তারা অন্য সব শক্তির ওপর আধিপত্য করবে।

আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন :

وَلَن يَجْعَلَ اللَّـهُ لِلْكَافِرِ‌ينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا.

“...আর আল্লাহ্ কখনোই মুমিনদের ওপর কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন না।” (সূরা আন নিসা : ১৪১)

وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّ‌بَاطِ الْخَيْلِ تُرْ‌هِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّـهِ وَعَدُوَّكُمْ

“আর তোমরা তাদের জন্য তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনী এবং চিহ্নিত অশ্বরাজি প্রস্তুত করে রাখ যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর দুশমনদের ও তোমাদের দুশমনদেরকে আতংকিত করে তুলবে...।” (সূরা আল আনফাল : ৬০)

فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ‌ إِنَّهُمْ لَا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنتَهُونَ.

“...অতএব,তোমরা কুফরের নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো;নিঃসন্দেহে তাদের কোনো অঙ্গীকার নেই (তাদের অঙ্গীকারের কোনো মূল্য নেই)। আশা করা যায়,এর ফলে তারা বিরত হবে।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ১২)

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّـهِ

“আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা দূরীভূত হয় এবং দীনের মূলনীতি কেবল আল্লাহরই হয়...।” (সূরা আল আনফাল : ৩৯)

لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَ‌ىٰ أَوْلِيَاءَ

“...তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না...।” (সূরা আল মায়েদাহ্ : ৫১)

قاتلوا الّذين لا يُؤمنون بالله و لا باليوم الآخر.... حتّى يُعطوا الجزية عن يد و هم صاغرون صاغرون

 “তোমরা যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহ্ ও পরকালে ঈমান পোষণ করে না... যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে জিযিয়াহ্ প্রদান করে ও অনুগত হয়ে যায়।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ২৯)

এ ধরনের লোকেরা কখনোই এবং কোনো পরিস্থিতিতেই নতি স্বীকার করেন না এবং অনৈতিকতা,অনাচার,নির্লজ্জতা ও পাপাচারের বিস্তার ঘটার সুযোগ দেন না।

ধর্ম ও রাজনৈতিক ময়দানের মধ্যে যদি পৃথকীকরণ করা হয় এবং ইসলামের নিকট থেকে রাজনৈতিক বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপের তথা শাসন,প্রশাসন,আদেশ দান ও রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম পরিচালনার অধিকার কেড়ে নেয়া হয় তা হলে সাম্রাজ্যবাদীরা খুব সহজেই তাদের সকল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।

যদি তা-ই হয় তা হলে মুসলিম জনগণের শ্রদ্ধার পাত্র ইসলাম বিশেষজ্ঞরা তথা ওলামায়ে কেরাম-যাঁরা রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিনিধি (খলীফা) হিসাবে জনগণের হৃদয়ের ওপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণকে ময়দানে নামাতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম,তাঁরা প্রকাশ্য জনজীবন থেকে সরে যেতে এবং নিজেদেরকে মসজিদ ও মাদরাসার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রাখতে বাধ্য হবেন। আর তখন যে কোনো খোদাদ্রোহী লোক বা বহিঃশক্তির এজেন্টের পক্ষে দেশের শাসন ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম হাতে তুলে নেয়া সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে যে কোনো মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশের বিচার বিভাগ,বিশ্ববিদ্যালয়,সাধারণ শিক্ষা,গণস্বাস্থ্য,অর্থনীতি,আর্থিক বিষয়াদি এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও বৈদেশিক সম্পর্ক তথা সবকিছুই তার হতে চলে যাবে। এ সব ক্ষেত্রে সে যেমন খুশী কাজ করবে এবং কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা মানবে না। তখন ইসলাম বিশেষজ্ঞরা তথা ওলামায়ে কেরাম জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে আহ্বান এবং ইসলাম ও মুসলমানদের পবিত্র বিষয়াদি তথা সত্য ও ন্যায়ের আশ্রয়স্থলসমূহের প্রতিরক্ষার্থে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে খ্রিস্টান গীর্জার অভিন্ন ভূমিকা পালন করবেন অর্থাৎ এ সব ব্যাপারে নীরব,উদাসীন ও অনুগত থাকার জন্য জনগণকে উপদেশ দেবেন,তাদেরকে ভাল কাজের আদেশ দান (امر بالمعروف) ও খারাপ কাজ প্রতিহত করা (نهی عن المنکر) থেকে বিরত থাকতে বলবেন না।

এরপর তাঁরা ধর্মদ্রোহীদের কাছে ময়দান ছেড়ে দেবেন। এর ফলে ধর্মদ্রোহীদের পক্ষে এরূপ দাবী করা সহজ হবে যে,জনগণের জন্য ধর্ম হচ্ছে আফিমস্বরূপ,কারণ,তা বঞ্চিত ও অন্যায়-অবিচারের শিকার লোকদের অধিকারের সপক্ষে কথা বলে না এবং ধর্ম দারিদ্র,অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদতার ন্যায় সমস্যাবলীর সমাধান করতে পারে না। এর ফলে বঞ্চিত ও অন্যায়-অবিচারের শিকার লোকেরা ধর্ম ও ধর্মনেতাদের নিকট থেকে সুরক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা পাবার ব্যাপারে চিরদিনের জন্য হতাশ হয়ে পড়বে। তখন তারা কমিউনিস্ট মতাদর্শের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করবে ও তার ধারক-বাহকদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হবে-যারা জনগণকে ফাঁপা সে‌াগান ছাড়া আর কিছুই উপহার দেয় না;তখন জনগণ মনে করবে যে,বাম শিবির ছাড়া তাদের আশ্রয় গ্রহণের জন্য আর কোনো আশ্রয়স্থল নেই। এ ধরনের সমাজে আমরা তরুণ প্রজন্মকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরিবর্তে লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে,কোরআন মজীদের পরিবর্তে কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টোকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতে এবং কাবার পরিবর্তে মস্কোকে কিবলারূপে বরণ করতে দেখতে পাই। তখন ধর্ম সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে বৃদ্ধ ও অবসরপ্রাপ্ত লোকদের পেশায় পরিণত হয়।

এ হচ্ছে ধর্ম ও রাজনীতিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিণাম। এ হচ্ছে দেহ থেকে প্রাণকে এবং হৃদয় থেকে অনুভূতিকে বিচ্ছিন্ন করার সমতুল্য। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে,বিংশ শতাব্দীতে ধর্মের জন্য এর চেয়ে অধিকতর ভয়াবহ অন্য কোনো হুমকিরই উদ্ভব হয় নি।

আমাদের তরুণ মুসলিম প্রজন্ম কি কোরআন মজীদের নিম্নলিখিত আয়াতসমূহে ঈমান পোষণ করে?

قُلْ هَلْ تَرَ‌بَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ

“(হে নবী! কাফেরদেরকে) বলুন,তোমরা কি আমাদের জন্য দু’টি উত্তম অবস্থা (বিজয় বা শাহাদাত) ব্যতীত অন্য কিছুর অপেক্ষা করছ?...” (সূরা আত তাওবাহ্ : ৫২)

قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّـهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا

“(হে নবী!) বলুন,আল্লাহ্ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা ছাড়া অন্য কোনো কিছুই আমাদের ওপর আপতিত হবে না।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ৫১)

قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُم مِّنَ الْكُفَّارِ‌ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً

“কাফেরদের মধ্যে যারা (তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য) তোমাদের দিকে এগিয়ে আসে তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো এবং তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়...।” (সূরা আত তাওবাহ্ : ১২৩)

وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَ‌بِّهِمْ يُرْ‌زَقُونَ.

“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তোমরা তাদেরকে মৃত মনে করো না,বরং তারা তাদের রবের সান্নিধ্যে জীবিত;তারা রিয্কপ্রাপ্ত।” (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯)

وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ.

“...আর তোমরাই প্রাধান্যের অধিকারী হবে যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকে।” (সূরা আলে ইমরান : ১৩৯)

আমাদের তরুণ মুসলিম প্রজন্ম যদি কোরআন মজীদের এ সব আয়াতে ঈমান পোষণ করত তা হলে নরপিশাচ অর্থপূজারী ইসরাঈলী বাহিনী তাদের অন্তরে ফোরাত থেকে নীল পর্যন্ত ইসলামী ভূ-খণ্ড দখলের আকাঙ্ক্ষা পোষণের দুঃসাহস দেখাত না এবং পবিত্র ইসলামী ভূ-খণ্ড ফিলিস্তিনের ও সেখানকার মুসলিম জনগণের ওপর তাদের ঘৃণ্য শাসন চাপিয়ে দিতে সক্ষম হতো না বা তাদের সম্পদ জবর-দখল ও তাদের সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারত না। সে ক্ষেত্রে আমাদের তরূণরা সত্যকে বুলন্দ করতে গিয়ে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও মজলুমদেরকে রক্ষার জন্য মৃত্যুবরণ করতে বিন্দুমাত্র ভয় পেত না। সে ক্ষেত্রে তারা ‘গাসিলুল্ মালায়িকা’ নামে খ্যাত সাহাবী হানজালার ন্যায় বীরত্বগাথা সৃষ্টি করত যিনি নববিবাহিতা স্ত্রীর কক্ষ থেকে অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে রণাঙ্গনে ছুটে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।

অন্যদিকে তাদেরকে যদি শেখানো হয় : ধর্ম রাজনীতি থেকে আলাদা;আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের নিকট থেকে নামায,রোযা ইত্যাদি ইবাদত ছাড়া আর কিছু চান না;দেশের শাসন,প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম সেই রাজনীতিবিদদের ওপর ন্যস্ত করতে হবে যারা ধর্মের অনুগত নয় ও নিজেদের প্রণীত আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন মানে না,এমনকি তাদের প্রণীত আইন কোরআন মজীদের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও,তা হলে তারা ইসলামকে এমন একটি ইয়াতীম শিশুর ন্যায় দেখতে পাবে যার নিজেকে রক্ষা করার মতোও কোনো ক্ষমতা নেই। অতঃপর তাদের মধ্যে ধর্মের প্রতি আদৌ কোনো আকর্ষণ থাকবে না বা ধর্ম তাদের নিকট কোনো অর্থ বহন করবে না। ফলে তারা স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শত্রুর বুলেটের সামনে বুক পেতে দেবে এমনটি আশা করার কোনো কারণই থাকবে না,কারণ এজন্য তাদের সামনে কোনো প্রেরণা থাকবে না;বরং তারা রাষ্ট্রীয় ও সরকারী তথা শাসকদের কাজ-কর্মের এবং জনগণের ভাগ্যের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে গড়ে উঠবে। এর ফলে তাদের জন্য অনৈতিকতা,দুর্নীতি ও অনাচারের পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত হওয়ার এবং বিজাতীয়দের জালে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য ইসলামের নাম ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

আফসোস! আমরা নিজেদেরকে ধর্মীয় পণ্ডিত ও আলেম বলে দাবী করছি এবং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খলীফার আসনে বসে আছি অথচ আমরা তাঁর জিহাদের বাণী,কুফরের বিরুদ্ধে তাঁর অবিরত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর নিরলস কর্মব্যস্ততার কথা লোকদের নিকট পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছি। ইসলামকে ছিন্নভিন্ন ও টুকরো টুকরো করা হচ্ছে,আর আমরা তা বসে বসে দেখছি! আমি জানি না আগামীকাল আমরা আমাদের রবের দরবারে কী জবাব দেব।

إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكْرَ‌ىٰ لِمَن كَانَ لَهُ قَلْبٌ أَوْ أَلْقَى السَّمْعَ وَهُوَ شَهِيدٌ

“নিঃসন্দেহে এতে (কোরআনে) তার জন্য উপদেশ রয়েছে যে ব্যক্তি (অনুধাবন করার উপযোগী) অন্তঃকরণের অধিকারী অথবা যে অভিনিবেশসহ শ্রবণ করে।” (সূরা কাফ : ৩৭)

পাদটীকা

১. এ প্রবন্ধ রচনাকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে নি এবং মস্কো তখনো বামপন্থীদের কেন্দ্র ছিল।-অনুবাদক।

(জ্যোতি, ৫ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা)

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

মিথ্যা কথা বলা
ধর্ম ও রাজনীতি
সূরা ইউসুফ; (২৯তম পর্ব)
কাদিয়ানী মতবাদ এবং খতমে ...
আমি যা কিছু পেয়েছি কুরআন থেকেই ...
লাইলাতুল মিরাজ
বিভিন্ন ফিকাহর দৃষ্টিতে যাকাত
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
রাজনীতি কি ধর্ম থেকে আলাদা
কোরআনের محكم (মুহকাম) বা সুস্পষ্ট ও ...

 
user comment