বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে ‘উলুল আমর’

পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে ‘উলুল আমর’

‘হে যারা ঈমান এনেছ,তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর (এই) রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যকার ‘উলুল আমর’ এর। এবং যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে কোন মতভেদ দেখা দেয় তবে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের বিশ্বাস কর। এটাই উত্তম ও পরিণামে প্রকৃষ্টতর।’ (সূরা নিসা : ৫৯)

পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটিকে ‘উলুল আমর’ এর আয়াত নামে অভিহিত করা হয়।

উলুল আমর শব্দের অর্থ

‘উলু’ (اولو) শব্দের অর্থ অধিকারীরা যার একবচন অর্থটি বুঝতে ذو (যু) শব্দটি ব্যবহৃত হয়। খালিল ইবনে আহমাদ ফারাহিদী বলেন : اولو (উলু) ও اولات (উলাত) শব্দ দু’টির অর্থ ذوذوات (যাওয়াত) এর অর্থের (অধিকারিগণ) ন্যায়। এটা বহুবচন অর্থ ব্যতীত ব্যবহৃত হয় না। اولو শব্দটি সব সময় অন্য শব্দের সাথে সংযুক্ত হয়। যেমন أُولِى ٱلأَلْبَابِ অর্থ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারীরা (বাকারা : ১৭৯), اُولِي الْاِرْبَةِ অর্থ যৌন কামনার অধিকারীরা (সূরা নূর : ৩১), اولی النُّهی অর্থ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্নরা (সূরা হূদ : ১১৬), اولی القوة অর্থ শক্তিশালী ব্যক্তিরা বা বাহুবলের অধিকারিগণ (কাছাছ : ৭৬) ইত্যাদি।

(امر) ‘আমর’ শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কখনও আদেশ ও নির্দেশ অর্থে (যার বহুবচন হলো ‘اوامر’) আবার কখনও ‘বিষয়, পদ ও দায়িত্ব’ অর্থেও (যার বহুবচন হলো ‘امور’) আসে। মুফাস্সিরদের মধ্যে আলোচ্য আয়াতে ব্যবহৃত ‘امر’ শব্দটি উল্লিখিত কোন্ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাঁদের এক দল اولو الامر (উলুল আমর) শব্দটি শাসক, নেতা ও সেনাপতি অর্থে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এ আয়াতে ‘امر’ শব্দটি নির্দেশ অর্থ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে। অপর এক দলের বিশ্বাস, আলোচ্য আয়াতে ‘اولو الامر’ শব্দের অর্থ হলো ‘পদাধিকারী’ ও ‘বিষয়ের দায়িত্বশীল’ এ অর্থে যে, যে ব্যক্তি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, বিচারবিষয়ক, সামরিক বা সামাজিক কোন দায়িত্ব ও পদের অধিকারী হবেন তিনি হলেন ‘اولو الامر’। তবে পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে এর দৃষ্টান্ত কারা তা আমরা পরবর্তীকালে আয়াতটির শব্দমালার বিন্যাস, পূর্বাপর আয়াতের সাপেক্ষে অর্থ (سياق) ও আবশ্যিক অর্থ(دلالت التزامی) এবং রাসূল (সা.) ও আহলে বাইতের ইমামদের হাদীসের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করব।

আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের পরিভাষায় ‘منکم’ বাক্যাংশটি ‘ظرف مستقر’ (অধিকরণ কারক) যার ‘عامل’ বা কার্যকরী ক্রিয়া হলো ‘افعال عموم’ মন ‘يکون، کائنٌ، مستقرٌ’ অর্থাৎ বিদ্যমান, আছে, রয়েছে; তাহলে ‘اولی الامر منکم’ এর অর্থ হবে উলিল আমর যে তোমাদের মধ্যে বিদ্যমান। যেমন :‘هو الذی بَعَثَ فی الامّيين رسولا منهم’ সেই সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যে তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ আয়াতটিতে অনুরূপ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে ‘منکم’ তোমাদের মধ্য থেকে’ অংশটি ‘اولو الامر’ এর আনুগত্যের অপরিহার্যতার দলিল হিসেবে এসেছে যা অন্যদের ওপর তাদের শ্রেষ্টত্বের নির্দেশক অর্থাৎ ‘اولو الامر’ এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে অন্যদের মধ্যে যা নেই।تَأْويل’ শব্দের অর্থ: এ শব্দটি ‘ا ول’ শব্দমূল থেকে উদ্ভূত হয়েছে যার অর্থ ‘ফিরিয়ে দেয়া’ ও ‘প্রত্যাবর্তন করানো’। ‘تَأْويل شَيْ ءٍ’ অর্থ কোন বস্তুকে তার কাংক্ষিত উদ্দেশ্যের দিকে ফিরিয়ে দেয়া। ‘تَأْويل الحکم’ অর্থ যে প্রকৃত কল্যাণ চিন্তার ভিত্তিতে কোন বিধান প্রণীত হয়েছে বিধানকে ঐ কল্যাণ চিন্তার দিকে প্রত্যাবর্তন করানো (অর্থাৎ তার আলোকে ব্যাখ্যা করা)। ‘أَحْسَنُ تَأْويلا’ অর্থ ‘সবচেয়ে কল্যাণকর পরিণতি’ ও ‘প্রকৃষ্টতর পরিণাম’। কারণ, এই বিষয়ের দিকেই তার প্রত্যাবর্তন। রাগিব ইসফাহানী বলেছেন : ‘أَحْسَنُ تَأْويلا’ অর্থ সর্বোত্তম অর্থ ও ব্যাখ্যা। শেখ তূসি ও আল্লামা তাবারসীর মতে কোন বিষয়কে আল্লাহ, রাসূল ও নিষ্পাপ উলিল আমরের নিকট উপস্থাপন করলে তাঁরা সর্বোত্তম সমাধান দান করবেন। কেননা, তা অন্যদের দেয়া সমাধান যার পেছনে কোন দলিল নেই থেকে উত্তম। কেউ কেউ বলেছেন : ‘أَحْسَنُ تَأْويلا’ এর অর্থ হলো এটা পরিণতিতে তোমাদের আখেরাতের জন্য উত্তম। তবে এ ধারণা সঠিক নয় যে, এ বাক্যে ‘أَحْسَن’ তুলনামূলক উত্তম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; বরং আয়াতের সার্বিক ও পূর্বাপর অর্থ বিবেচনা করলে বোঝা যায় এখানে ‘উত্তম’ বলতে বাঞ্ছনীয় ও আবশ্যক কর্মের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এরূপ না করা ভুল, অন্যায় ও অবৈধ। কেননা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাড়া অন্য কারো নিকট মতভেদের সমাধান চাওয়ার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।

উলুল আমর ওয়ালীয়ে আমর

এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি যে, আরবি ولی ‘ওয়ালী’ শব্দের (যার অর্থ বন্ধু, অভিভাবক, নেতা বা কর্তৃত্বশীল) সঙ্গে أُولِى শব্দের (যার অর্থ অধিকারী) শব্দমূল ও অর্থগত কোন সংযোগ নেই। এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহনকারী। পবিত্র কোরআনে ওয়ালী শব্দটি বন্ধু, অভিভাবক, কর্তৃত্বশীল, উত্তরাধিকারী, স্বজন প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্যই একক ও নির্দিষ্ট কোন অর্থে তা গ্রহণের জন্য দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন আবশ্যক। যখন তা امرএর সঙ্গে সংযুক্ত হবে তার অর্থ দাঁড়াবে নির্দেশ দানের দায়িত্বপ্রাপ্ত বা কর্তৃত্বশীল নেতা। তাই পারিভষিক অর্থে ‘উলিল আমর’ শব্দের সঙ্গে ‘ওয়ালীয়ে আমর’ এর পার্থক্য রয়েছে। এ দুই পরিভাষাকে এক করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

উলুল আমর এর আয়াতের তাফসীর

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে অপরিহার্য ঘোষণা করার পাশাপাশি ‘উলুল আমর’ এর আনুগত্যের বিষয়টি উল্লেখের মাধ্যমে এটিকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের সমপর্যায়ে গণ্য করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ সকল বিষয় ও নির্দেশের অধিকর্তা হিসেবে তাঁর আনুগত্য আবশ্যক। আর তাঁর আনুগত্যের অর্থ হলো পবিত্র কোরআনের বর্ণিত নির্দেশ পালন এবং এর শিক্ষাকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। যে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল কোরআনের আয়াতের তাফসীর করেছেন এবং বিধানসমূহের খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের শামিল। সুতরাং রাসূলের আনুগত্য বলতে কোরআনের আয়াতের তাফসীর এবং বিধানসমূহের খুঁটিনাটি বর্ণনার বাইরের বিষয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসক ও নেতা, জনগণের প্রশিক্ষক ও তাদের মধ্যে বিচার মীমাংসাকারী হিসেবে যে ফয়সালা দেন এবং যে বিষয়গুলোতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বিধান প্রণয়নের অনুমতি দিয়েছেন তাতে রাসূল (সা.)-এর আনুগত্য বুঝানো হয়েছে।

এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যখন রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে নেই তখন তাঁর আনুগত্যের অর্থ তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ। তবে যে সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে তা তাঁর সুন্নাত বলে প্রমাণিত হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে তাঁর আনুগত্যের বিষয়টি বুঝাতে স্বতন্ত্রভাবে ‘أَطيعُوا’ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। অতঃপর রাসূল ও উলিল আমর এর আনুগত্য নির্দেশ করতে একবার শুধু ‘أَطيعُوا’ ব্যবহার করেছেন (اولو الامر এর ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি করেন নি) এবং সম্বন্ধবাচক অব্যয় ‘و’ (এবং) ব্যবহার করেছেন। সুতরাং এ থেকে রাসূল (সা.) ও ‘উলিল আমর’ এর আনুগত্যের ধরনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বুঝা যায়। পবিত্র কোরআনে ১২টি স্থানে মহান আল্লাহর পাশাপাশি মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যের নির্দেশ এসেছে। তন্মধ্যে ১১ বার সার্বিকভাবে সকল মুমিনের উদ্দেশে এবং একবার তাঁর স্ত্রীদের উদ্দেশে। সবগুলো ক্ষেত্রেই আল্লাহর আনুগত্যের ন্যায় তা নিঃশর্তভাবে এসেছে। এছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে অনেক স্থানে তাঁর আনুগত্যের আবশ্যকতা, তার সুফল ও অবাধ্যতার কুফল বর্ণিত হয়েছে। কোরআনে মহানবী (সা.)-এর আনুগত্যের প্রকৃতি নিয়ে আমরা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করি :

১. আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্যের শামিল। যেমন বর্ণিত হয়েছে :

من يطع الرسول فقد اطاع الله’ অর্থাৎ যে (এই) রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। (সূরা নিসা : ৮০)

২. নবীদের প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো তাঁদের আনুগত্য করা হবে। কোরআন এ বিষয়ে বলেছে :

 ‘وَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا لِيُطاعَ بِإِذْنِ اللهِ’ আমরা প্রত্যেক রাসূলকে কেবল এই জন্যই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হবে। (সূরা নিসা : ৬৪)

৩. আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য সব সময় শর্তহীন। কখনই তা অন্যদের আনুগত্যের মতো বিশেষ অবস্থা ও শর্তের অধীন নয়। কোরআনে যেখানেই আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের কথা এসেছে সেখানেই নিঃশর্তভাবে তাঁর আনুগত্য করতে বলা হয়েছে। এমনকি আল্লাহ শুধু বাহ্যিকভাবে তাঁর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করাকে যথেষ্ট গণ্য করেন নি; বরং আন্তরিকভাবেও তাঁর নির্দেশের প্রতি অকুন্ঠ হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং কেউ তাঁর আনুগত্যের ক্ষেত্রে এরূপ না হলে তার ঈমানের বিষয়কে অস্বীকার করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন :

‘... তোমার প্রভুর শপথ, তারা ঈমান আনেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাকে তাদের দ্বন্দ্ব ও বিবাদের জন্য বিচারক সাব্যস্ত করবে; অতঃপর তুমি যা বিচার ফয়সালা করবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন দ্বিধা-সংশয় থাকবে না এবং তারা পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করবে।’ (সূরা নিসা : ৬৫)

অন্যত্র আল্লাহর বিচারের ন্যায় তাঁর বিচারকে চূড়ান্ত ও তাঁর অবাধ্যতাকে স্পষ্ট পথভ্রষ্টতা ঘোষণা করে বলা হয়েছে : ‘কোন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীর এ অধিকার নেই যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা দান করেন তখন তারা তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; এবং যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে নিঃসন্দেহে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় রয়েছে।’ (আহযাব : ৩৬)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ব্যতীত অন্যদের আনুগত্যকে শর্তাধীন করেছেন। যেমন পিতা-মাতার আনুগত্যের বিষয়ে শিরকের দিকে আহ্বান না করার শর্ত যুক্ত করেছেন।১০

সুতরাং আল্লাহ মুমিনদেরকে তাঁর ও তাঁর রাসূলের নিঃশর্ত আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এরূপ আনুগত্যকে ঈমানের নিদর্শন বলেছেন এবং কেবল তাঁদের যথার্থ আনুগত্যকারীকেই সফল ও বিজয়ী গণ্য করা হয়েছে।১১ তাঁদের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।১২ তাঁদের আনুগত্যের উত্তম পুরস্কারের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।১৩ একে ‘বেহেশতে প্রবেশ’,১৪ ‘মহাসাফল্য লাভ’,১৫ ‘আল্লাহর রহমত’১৬ প্রাপ্তি ও ‘আনুগত্যভাজন হওয়ার উপায়’ বলা হয়েছে।

আলোচ্য আয়াতে ‘উলিল আমর’ এর আনুগত্যের বিষয়টি আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের সমপর্যায়ে স্থান পেয়েছে এবং তাঁর আনুগত্যের ন্যায় শর্তহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব, রাসূলের আনুগত্যের সুফল ও তাঁর আনুগত্যের বিরোধিতার কুফল ‘উলিল আমর’ এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ উলিল আমরের আনুগত্যও আল্লাহর আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত, উলিল আমরের আনুগত্য করা হলে নবুওয়াতের মিশন বাস্তবায়িত হবে। মুমিনদের কর্তব্য হলো এ আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়া যাতে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের কল্যাণ ও প্রভাব তারা লাভ করতে পারে। নিঃসন্দেহে এ ধরনের আনুগত্যের সঙ্গে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের কোন পার্থক্য নেই। যেহেতু আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য নির্ভুল ও নিষ্পাপ সত্তার আনুগত্য সেহেতু ‘উলিল আমর’ এর আনুগত্য সেই পর্যায়ে হতে হলে তাঁদেরকে নির্ভুল ও নিষ্পাপ হতে হবে। যদি ‘উলিল আমর’ মাসুম (নিষ্পাপ) না হন তবে তাঁদের আনুগত্য নিঃশর্ত হতে পারে না এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের অনুরূপ কল্যাণ তাঁর থেকে অর্জন করা যাবে না। আর বিশেষ ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ এর শামিল হবে না। এ কারণেই উলিল আমর এর আনুগত্য আল্লাহর রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁর আনুগত্যের ন্যায়। আর যখন রাসূল থাকবেন না তখন যেমন তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ অপরিহার্য তেমনি যখন মাসুম উলিল আমর আমাদের মধ্যে শারীরিকভাবে থাকবেন না (মৃত্যুবরণ করবেন অথবা অন্তর্ধানে থাকবেন) তখন তাঁদের হাদীস ও সুন্নাতের অনুসরণ আবশ্যক একই বিষয়। কিন্তু যখন রাসূল অথবা মাসুম উলিল আমর কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেবেন বা কোন পদে অধিষ্টিত করবেন তখন সেই ব্যক্তির অনুসরণ বড় ভুল না করা ও বিচ্যুত না হওয়ার শর্তাধীন। মাসুম উলিল আমর সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে কাউকে নিয়োগ দিলে [যেমনটি হযরত আলী (আ.) হযরত মালিক আশতারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন] অথবা সার্বিকভাবে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তির (যথার্থ যোগ্যতার অধিকারী ফকিহগণ) আনুগত্যের নির্দেশ দিলে তাঁদের আনুগত্য করাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কেননা, তাকওয়ার অধিকারী হওয়ার শর্তে তাঁদের আনুগত্য মাসুম উলিল আমর এর আনুগত্যের শামিল। তবে তাঁরা ভুল-ত্রুটির সম্মুখীন হওয়ার কারণে অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে যখনই তাঁরা ইসলামের বিধানের পরিপন্থি কোন আচরণ করবেন অথবা নির্দেশ দেবেন তখনই পদচ্যুত হবেন। তাই কখনই তাঁরা উক্ত আয়াতের নিঃশর্ত আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত নন।

আহলে বাইতের চিন্তাধারায় উলিল আমর এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বিষয়টি তাঁদের ধর্মীয় নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাঁরা ধর্ম শিক্ষা এবং কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যেমন নির্ভুল তেমনি রাজনৈতিক ও বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও নির্ভুল। কেননা, তাঁরা ঐশী দিকনির্দেশনার (কোরআন ও প্রকৃত সুন্নাহর) শতভাগ অনুসারী। তাই তাঁদের আনুগত্য শর্তহীন। যদি আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত উলিল আমর ভুলবশত এমন কথা বলতেন যা আল্লাহর হালাল করা বস্তুকে হারাম অথবা তাঁর কোন হারামকে হালাল করে তবে সেক্ষেত্রে মুমিনরা (মুসলমান সমাজ) আল্লাহর আনুগত্যের বিষয়ে শিরক ও অংশীবাদে পতিত হলো। তাঁরা যেহেতু কখনও এরূপ ভুল করতে পারেন না সে কারণেই পবিত্র কোরআনে তাঁদের আনুগত্যকে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মতো নিঃশর্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

আয়াতের বহির্ভূত দলিল

আহলে বাইতের অনুসারীদের দৃষ্টিতে ‘উলিল আমর’ কারা তা চিহ্নিত করার দ্বিতীয় পথ হলো মাসুম ইমামদের বর্ণিত হাদীস। তারা বিশ্বাস করে, আল্লাহর রাসূল (সা.) ওহির ব্যাখ্যাদানকারী ও শিক্ষক হিসেবে আলোচ্য আয়াতে যাঁদের আনুগত্যকে অপরিহার্য করা হয়েছে তাঁদেরকে উম্মতের নিকট পরিচিত করিয়েছেন। কারণ, আয়াতে ‘উলিল আমর’ কারা তা উল্লেখ করা হয়নি, কেবল তাঁদের কথাই বলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, আল্লাহ ও তাঁর নবী (সা.) কি উলিল আমর কারা তা চিহ্নিত না করেই ও তাঁদের দায়িত্বের পরিধি ও বাস্তবায়নের সীমা উম্মতকে বলে না দিয়েই তাঁদেরকে আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন? মহানবী (সা.) কি স্পষ্ট করেন নি যে, এই উলিল আমর এর কর্তৃত্ব বিশেষ এক ভূখণ্ড, জনগোষ্টী ও জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নাকি আয়াতে যে মুমিনদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে তা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনকে অন্তর্ভুক্ত করে? রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী অনুযায়ী কি প্রত্যেক ভূখণ্ডের জন্য স্বতন্ত্র আনুগত্যের অধিকারী ব্যক্তি রয়েছে যাদের সমষ্টিকে ‘উলিল আমর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে?

এখানে কি এ প্রশ্ন থেকে যায় না যে, সাহাবীরা কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব ছিলেন, নাকি তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী চক্র এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর উত্তরকে গোপন করেছে। এটা কি করে সম্ভব, যে ব্যক্তিরা নতুন চাঁদ,১৭ গণিমতের মাল,১৮ দানের বস্তু১৯, এমনকি নারীদের ঋতু স্রাবের২০ মতো বিষয়ে নবীর কাছে প্রশ্ন করেছেন, অথচ এরূপ (উম্মতের) ভাগ্যনির্ধারক বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেন নি? তবে আজ মুসলিম উম্মাহর শতধাবিভক্ত হওয়া এবং ধর্মের বিষয়ে পরস্পর বিরোধী লক্ষ মতের উৎপত্তির পেছনে একক নির্ভুল ব্যাখ্যাকারী কর্তৃপক্ষ ও সঠিক দিকনির্দেশক নেতার অনুপস্থিতিই কি প্রধান কারণ নয়?

নিঃসন্দেহে বলা যায়, আল্লাহ তাঁর বিধানকে পূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর রাসূল পবিত্র কোরআনের কোন আয়াতকেই ব্যাখ্যাহীন অবস্থায় ছেড়ে যান নি। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে যে সঠিক বিধান বর্ণনা করেছেন তার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা প্রদানের দায়িত্ব তাঁর নবীর ওপর অর্পণ করেছেন। উলিল আমর এর বিষয়টি এমনই একটি বিষয় যা মহানবী (সা.) তাঁর বাণীতে ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন :

মহামহিম আল্লাহ তাঁর রাসূলকে আলী (আ.)-এর বেলায়াত (নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্ব) এর ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে অবতীর্ণ করেন : ‘নিশ্চয় তোমাদের অভিভাবক হলেন আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে, নামায কায়েম করে ও রুকু অবস্থায় যাকাত দেয়।’ তিনি উলিল আমর এর বেলায়াতকে ফরজ করেছেন, কিন্তু তা কী (তাঁরা কারা) কোরআনে বলেন নি; বরং আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের (মুমিন) জন্য বেলায়াতকে ব্যাখ্যা করার যেমনভাবে তিনি তাদের কাছে নামায, যাকাত, রোযা, হজ ইত্যাদির খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেছেন।২১

উলিল আমর কারা তাঁদের বিবরণ আহলে বাইতের নিকট থেকে বহুল সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ বর্ণনাগুলোর কয়েকটি সহীহ সনদযুক্ত। এ বর্ণনাগুলোর টেক্সট (মূল ভাষ্য) ও ভাবার্থ বুদ্ধিবৃত্তির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। কারণ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তা যার নির্ভুলতার কোন নিশ্চয়তা ও প্রমাণ নেই, তিনি তাদেরকে নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দিতে পারেন না। এ বিষয়টি আলোচ্য আয়াতের বাহ্য অর্থ দ্বারাও প্রমাণিত হয়। (এ থেকে উলিল আমর এর নির্ভুলতা ও তাঁদের আনুগত্যের বৈধতাও প্রমাণিত হয়।) পবিত্র কোরআনের অন্যান্য আয়াতের অর্থ দ্বারাও এ বিষয়টি সমর্থিত হয় যে, আল্লাহ নিষ্পাপ ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দিতে পারেন না। আমরা এখানে এ সম্পর্কিত কিছু আয়াতের উল্লেখ করছি :

 

ক .‘وَ لا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنا وَ اتَّبَعَ هواه وَ كانَ أَمْرُهُ فُرُطا

 ‘এমন ব্যক্তির আনুগত্য কর না যার মনকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কাজ হলো বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন করা।’ (সূরা কাহ্ফ : ২৮)

এ আয়াতটিতে আল্লাহ যে বিষয়গুলো একজন মানুষকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করে তা উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, মুমিনরা যেন এমন বৈশিষ্ট্যের কোন ব্যক্তির আনুগত্য না করে। কোন মানুষের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটিও যদি থাকে তবে তার অনুসরণ অবৈধ বলে গণ্য হবে।

খ . ‘إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ تَنْزيلاً فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَ لا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِماً أَوْ كَفُورا

‘আমরাই তোমার ওপর কোরআন অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের ব্যাপারে ধৈর্যশীল হও (তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক) এবং তাদের মধ্য থেকে কোন পাপী অথবা অতিশয় অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির (কাফের) আনুগত্য কর না।’ (সূরা দাহর : ২৩ ও ২৪)

এ আয়াতটিতেও আল্লাহ আনুগত্যের বিষয়টিকে পবিত্র কোরআনের বিধানের ওপর অটল থাকা এবং অকৃতজ্ঞ ও পাপী না হওয়ার শর্তাধীন করেছেন। কোরআনের বিধানের ওপর অটল থাকার পূর্বশর্ত হলো এর সকল ও খুঁটিনাটি বিধানের ওপর পূর্ণ জ্ঞান থাকা ও এ বিষয়ে নির্ভুল হওয়া এবং পাপী না হওয়ার জন্য আবশ্যক শর্ত হলো শয়তান ও প্রবৃত্তির তাড়নায় প্ররোচিত না হওয়া। সুতরাং যে ব্যক্তি পাপী অথবা কাফের ছিল আল্লাহ তার আনুগত্যকে স্বীয় আনুগত্যের সমপর্যায়ে স্থান দিতে পারেন না।

 

উলিল আমর কেবল বিশেষ ব্যক্তিগণ

আহলে বাইতের রেওয়ায়াতে ‘উলিল আমর’ বলতে কেবল মাসুম ইমামদের বোঝানো হয়েছে। ‘আল-কাফি’ এবং ‘তাফসীরে আয়াশী’তে উলিল আমরের ব্যাখ্যায় হযরত বাকির (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : ‘এর দ্বারা নির্দিষ্টভাবে আমাদের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মুমিনের জন্য আমাদের আনুগত্যকে অপরিহার্য করা হয়েছে।’২২ উলিল আমর এর এ অর্থটি ছাড়া অন্য কোন অর্থ আহলে বাইতের নিকট থেকে বর্ণিত হয়নি।

আল্লাহর রাসূল (সা.) ও পবিত্র ইমামদের অসংখ্য রেওয়ায়াতে কখনো উলিল আমর এর নাম, আবার কখনো তাঁদের বৈশিষ্ট্য সার্বিকভাবে উল্লিখিত হয়েছে যার সবগুলোই বিশেষভাবে আহলে বাইতের মাসুম ইমামদের ওপর আরোপিত হয়েছে। শেখ সাদুক স্বীয় সনদে সাহাবী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী থেকে বর্ণনা করেছেন : “যখন

يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا أَطيعُوا اللَّهَ وَ أَطيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ...’- আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন আমি রাসূল (সা.)-কে বললাম : ‘ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে চিনি। কিন্তু উলিল আমর কারা যাঁদের আনুগত্যকে আল্লাহ তাঁর আনুগত্যের সাথে সংযুক্ত করেছেন।’

রাসূল (সা.) বললেন : ‘হে জাবির! তারা আমার খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত যারা আমার পর মুসলমানদের ইমাম ও নেতা হবে। যাদের প্রথম হলো আলী ইবনে আবি তালিব, অতঃপর হাসান, অতঃপর হুসাইন, অতঃপর আলী ইবনে হুসাইন, অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে আলী যে তওরাতে ‘বাকির’ নামে প্রসিদ্ধ, যার সাথে তোমার সাক্ষাৎ হবে এবং তুমি তাকে আমার সালাম পৌছে দেবে। অতঃপর জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আস সাদিক, অতঃপর মূসা ইবনে জাফর, অতঃপর আলী ইবনে মূসা, অতঃপর মুহাম্মাদ ইবনে আলী, অতঃপর আলী ইবনে মুহাম্মাদ, অতঃপর হাসান ইবনে আলী, অতঃপর মুহাম্মাদ যার কুনিয়া আমার নামে (আবুল কাসেম), যে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রামাণ্য দলিল হবে। সে হলো আল্লাহর বান্দা হাসান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদের সন্তান, ‘মাহদী’ বা ‘বাকিয়াতুল্লাহ’ নামে প্রসিদ্ধ, যার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমে ইসলাম প্রতিষ্টিত হবে।”২৩

অপর এক হাদীসে ইমাম বাকির (আ.) ‘উলির আমর’ এর আয়াতটির তাফসীরে উলিল আমর যে কেবল আহলে বাইতের ইমামগণ তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : ‘তাঁরা হলেন ঐ নিষ্পাপ ও পবিত্র ব্যক্তিগণ যাঁরা গুনাহ করেন না ও পাপ থেকে মুক্ত... যাঁরা কখনও কোরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হন নি ও কোরআনও তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় নি।’২৪

আহলে বাইতের ইমামগণ থেকে বর্ণিত বিভিন্ন দোয়ায়ও ‘উলির আমর’ কারা তা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন প্রসিদ্ধ দোয়ায়ে ফারাজে বলা হয়েছে :

اللهمّ صلّ علی محمّد و آل محمّد، اولی الامر الذينَ فرَضتَ علينا طاعتَهُم و عرَّفتَنا بذلك منزلتهم

‘হে আল্লাহ, মুহাম্মাদ ও তাঁর আলের (বংশের মনোনীত ব্যক্তিদের) ওপর দরুদ প্রেরণ কর, সেই উলিল আমর যাদের আনুগত্যকে আপনি আমাদের ওপর ফরজ করেছেন এবং এর মাধ্যমে তাঁদের মহান মর্যাদার সাথে আমাদের পরিচিত করিয়েছেন।’

এ দোয়ায় ‘উলিল আমর’ যে কেবল নবীর আহলে বাইত থেকে এবং এ মর্যাদা যে বিশেষ একটি বিষয় ও সাধারণ্যের এমনকি ফকিহ আলেমদের জন্যও তা কল্পনীয় নয় তা বোঝা যায়। এ কারণেই ইমাম হাদী (আ.) থেকে বর্ণিত ‘যিয়ারতে জামেআ কাবিরা’ য় সূরা নিসার উলিল আমরের আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে:

قرن طاعتَكم بطاعته ...من اطاعكم فقد اطاع الله و من عصاكم فقد عصا الله

‘মহান আল্লাহ (পবিত্র কোরআনে) আপনাদের আনুগত্যকে তাঁর আনুগত্যের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন (ও তাঁর আনুগত্যের পাশে স্থান দিয়েছেন)।...আর তাই যারা আপনাদের অনুগত্য করল তারা আল্লাহরই আনুগত্য করল, আর যারা আপনাদের অবাধ্যতা করল তারা আল্লাহরই অবাধ্যতা করল।’

সুতরাং কোনভাবেই এ মহান ও বিশেষ পদটিকে সাধারণ গণ্য করে অন্যদের ওপর তা আরোপের অবকাশ নেই।

শাফেয়ী মাযহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস জুয়াইনী২৫ স্বীয় সনদে খলিফা উসমানের সময়ে হযরত আলী (আ.) কিছুসংখ্যক সাহাবীর সামনে নিজের অধিকার প্রমাণে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন তা একটি দীর্ঘ বর্ণনায় এনেছেন, তাতে উল্লেখ করেছেন : “আমি আপনাদের আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আপনারা কি এ বিষয়টি জানেন না : যখন ‘يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا أَطيعُوا اللَّهَ وَ أَطيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ’ (সূরা নিসা : ৫৯) ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আর আনুগত্য কর রাসূলের ও উলিল আমরের’ এবং ‘إِنَّما وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَ رَسُولُهُ وَ الَّذينَ آمَنُوا الَّذينَ يُقيمُونَ الصَّلاةَ وَ يُؤْتُونَ الزَّكاةَ وَ هُمْ راكِعُون’ ‘তোমাদের অভিভাবক কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান এনেছে, নামায কায়েম করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত দেয়।’ (সূরা মায়েদা : ৫৫) এবং ‘তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে যতক্ষণ না আল্লাহ প্রকাশ করেন তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে এবং কারা আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের ব্যতীত অন্য কাউকে বিশ্বস্তজন (ও গোপন বিষয়ে আমানতদার) হিসেবে গ্রহণ করেনি?’ (সূরা তওবা : ১৬) আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় তখন লোকেরা আল্লাহর রাসূলকে প্রশ্ন করল : হে আল্লাহর নবী! ‘উলিল আমর’, ‘রুকু অবস্থায় যাকাত দানকারী’ এবং ‘মুমিনদের মধ্যে যাকে ব্যতীত বিশ্বস্তজন গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে তারা কারা?’ তখন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিলেন উলিল আমর ও উক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিচয় করিয়ে দিতে। তাই আল্লাহর রাসূল ঠিক যেমনভাবে নামায, যাকাত ও হজকে (বিধিবিধান) ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনিভাবেই তিনি উলিল আমরের বিষয়টি বেলায়াতের (কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব) আয়াতের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর রাসূল আমাকে গাদীরে খুমে সকলের সামনে মনোনীত করেন (যাতে মানুষের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আমিই এ আয়াতগুলোর দৃষ্টান্ত) এবং বলেন : ‘তোমরা কি অবগত নও যে, আল্লাহ আমার অভিভাবক এবং আমি মুমিনদের অভিভাবক? আর النَّبِيُّ أَوْلى بِالْمُؤْمِنينَ مِنْ أَنْفُسِهِم) আমি (নবী হিসেবে) মুমিনদের নিজেদের থেকে তাদের ওপর বেশি অধিকার রাখি (তাঁরা বলেন : হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল!)। তখন তিনি (রাসূল) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘হে আলী, ওঠ।’ আমি উঠে দাঁড়ালে তিনি বললেন : ‘আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা...।’২৬

হাকিম হাসকানী বিশিষ্ট তাবেয়ী মুজাহিদ ইবনে জাফর থেকে আলোচ্য আয়াতের শানে নুযূলের আলোচনায় বলেন : ‘أَطيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِ’ আয়াতটি আমীরুল মুমিনীন আলীর শানে অবতীর্ণ হয়েছে যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) তাবুকের যুদ্ধে যাওয়ার সময় তাঁকে মদীনায় প্রতিনিধি হিসেবে রেখে যান। আলী তাঁকে বলেন : (হে আল্লাহর রাসূল!) ‘আপনি কি আমাকে নারী ও শিশুদের ওপর আমাকে প্রতিনিধি রেখে যাচ্ছেন?’ রাসূল (সা.) বললেন : ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমার নিকট তোমার অবস্থান মূসার নিকট হারুনের অবস্থানের ন্যায়...।’২৭ (মানযিলাতের হাদিস)

যদিও এ শানে নুযূলটি একজন তাবেয়ী (মুজাহিদ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু এ বর্ণনাটি সত্য হওয়ার সপক্ষে অনেকগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে :

১. এ শানে নুযূলটি আয়াতে বর্ণিত নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশের সাথে সামঞ্জস্যশীল। কেননা, হযরত মূসা (আ.) ও হারুন (আ.) উভয়েই আল্লাহর নবী হিসেবে নিষ্পাপ ও নির্ভুল ছিলেন যাঁরা কখনই সত্যের পরিপন্থী নির্দেশ দিতে পারেন না। আল্লাহর রাসূল (সা.) হযরত আলীকে হযরত হারুন (আ.)-এর সঙ্গে তুলনা করার মাধ্যমে আলীর নির্ভুলতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অর্থাৎ আলীর আনুগত্য আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের ন্যায় নিরঙ্কুশ ও নিঃশর্ত এজন্য যে, তিনিও তাঁর মতো নিষ্পাপ।

২. এ শানে নুযূলটি মুহাদ্দিস জুয়াইনী বর্ণিত হাদীসের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।

৩. মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের নিকট থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদীস এ মতটিকে সমর্থন করে।

৪. এ শানে নুযূলটি মদীনায় হযরত আলীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটের সাথে সংগতিশীল। কারণ, তাবুকের যুদ্ধের প্রাক্কালে যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁকে মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন তখন মুনাফিকরা এ অপপ্রচার চালায় যে, মহানবী (সা.) হযরত আলীর ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ায় এ যুদ্ধে তাঁকে নিজের সঙ্গে নেননি।২৮ আর এভাবে তারা চেয়েছিল তাঁকেও মদীনা থেকে রাসূলের সহগামী হতে বাধ্য করতে যাতে তারা মদীনায় অবস্থান করে ষড়যন্ত্র করতে পারে। এ প্রেক্ষাপটেই উলিল আমরের আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং এতে নিঃশর্তভাবে আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়। এর ফলে মুনাফিকদের পক্ষে হযরত আলীর অবাধ্য হওয়ার আর কোন অজুহাত থাকেনি।

৫. আলোচ্য আয়াতের শানে নুযূল হিসেবে আহলে সুন্নাতের সূত্রে বর্ণিত পরস্পর বিপরীত বর্ণনাগুলোর মধ্যে কেবল উল্লিখিত শানে নুযূলটি আয়াতের বাহ্যিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্যশীল। কেননা, স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.) আয়াতটির দৃষ্টান্ত হিসেবে আলীর নাম উল্লেখ করেছেন এবং আলীর নির্দেশাবলি শতভাগ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের অনুবর্তী হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ‘মানযিলাতের হাদীস ছাড়াও অন্যান্য হাদীসে এর সপক্ষে দলিল রয়েছে। যেমন যখন রাসূল (সা.) হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন তখন কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্তের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে মহানবী (সা.)-এর নিকট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি (সা.) ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন : ‘ما تريدون من عليّ؟ إنّ عليّا منّي و أنا منه ، و هو وليّ كلّ مؤمن بعدي ’ ‘তোমরা আলীর থেকে কি চাও? নিশ্চয় আলী আমার থেকে এবং আমি আলীর থেকে। সে আমার পর সকল মুমিনের নেতা ও অভিভাবক।’২৯

এ হাদীসে মহানবী (সা.) হযরত আলীকে নিজের সাথে তুলনা করে তাঁর পরে মুমিনদের ওপর তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন যা হযরত আলীর কর্ম ও আচরণ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ও শরীয়তের সম্পূর্ণ অনুবর্তী হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ করে।

৬. এ শানে নুযূলটি হাদীসে সাকালাইনের৩০ বিষয়বস্তুর অনুরূপ। কারণ, হাদীসে সাকালাইনেও নিঃশর্তভাবে কোরআন ও আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে এবং এই দুই ভারী ও মূল্যবান বস্তু বিচ্যুতি থেকে মুক্তির নিশ্চয়তাদানকারী হিসেবে উত্থাপিত হয়েছে।

উল্লিখিত আয়াতে ‘আনুগত্যের অধিকারী’ ও আনুগত্যকারী’ এই দুই দল ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। প্রথম দল হলো যারা আনুগত্য করার নির্দেশপ্রাপ্ত এবং দ্বিতীয় দল যারা আনুগত্য লাভ করবে বা যাদের আনুগত্য অপরিহার্য করা হয়েছে। শরীয়তের পরিভাষায় ‘আনুগত্যের অধিকারী’ ‘مطاع’ ও ‘আনুগত্যকারী’ ‘مطيع’। আয়াতে আল্লাহ, রাসূল ও উলিল আমর হলেন আনুগত্যের অধিকারী আর ‘يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا’ সম্বোধনে যাদেরকে আল্লাহ, রাসূল ও উলিল আমরের আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা হলো আনুগত্যের নির্দেশপ্রাপ্ত। এ দৃষ্টিতে এ দু’দল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্বোধিতরা হলো রাসূলের আবির্ভাব থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিন। তাই কখনই উলিল আমরকে মুমিনদের সাথে মিশ্রিত করা যায় না।

আয়াতে যে বলা হয়েছে : ‘তোমাদের মধ্য থেকে উলিল আমর’, অংশটির অর্থ সূরা জুমুআর ‘তোমাদের মধ্য থেকে একজন উম্মী রাসূল’ এর ন্যায় অর্থাৎ উলিল আমর এ উম্মতের মধ্য থেকেই যেমনভাবে রাসূল (সা.) এ উম্মতের মধ্য থেকে মনোনীত হয়েছেন। সুতরাং উলিল আমরকে রাসূলের মতোই আনুগত্য করতে হবে। কখনই রাসূল ও উলিল আমর, এ আয়াতের (يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا) সম্বোধনের অন্তর্ভুক্ত নন; বরং মহান আল্লাহর পাশাপাশি তাঁরা ‘আনুগত্যের অধিকারী’দের স্থান লাভ করেছেন। পবিত্র কোরআনের কোথাও ভুল-ত্রুটির শিকার হতে পারে এমন কোন ব্যক্তিকে নিঃশর্ত ‘আনুগত্যের অধিকারী’দের কাতারে স্থান দেয়া হয়নি।

 

উলিল আমর নির্ভুল ও নিষ্পাপ এবং আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যক্ষ মনোনীত

আলোচ্য আয়াতে উলিল আমরের নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ থেকে প্রমাণিত হয় তাঁরা কখনই ভুল ও পাপ করতে পারেন না। যদি তাঁদের মধ্যে বিচ্যুতির সম্ভাবনা থাকত তবে আল্লাহ অবশ্যই তাঁদের আনুগত্যকে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের অথবা শিরক বা অন্য কোন পাপে লিপ্ত না হওয়ার শর্তাধীন করে দিতেন যেমনটি পিতা-মাতার আনুগত্যের ক্ষেত্রে করা হয়েছে।৩১ এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, উলিল আমরের পক্ষ থেকে আল্লাহ নির্দেশের পরিপন্থি কোন নির্দেশ আসতে পারে না। আর এরূপ হওয়া তখনই সম্ভব যখন তাঁরা নিষ্পাপ ও নির্ভুল হবেন।

যখন উলিল আমরকে নির্ভুল ও নিষ্পাপ হওয়ার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে হবে তখন এমন বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিকে মানুষ চিহ্নিত করতে পারে না। কারণ, তারা জানে না কোন ব্যক্তি কখনই ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না এবং কখনই আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে কাজ করে না। তাই এমন ব্যক্তিদের স্বয়ং আল্লাহর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যাতে মানুষ দ্বিধায় পতিত না হয় যে, তারা কোন উলিল আমরের আনুগত্য করতে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছে। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল (সা.) বারো জন ইমাম, আমীর, খলিফা, ওয়ালী ও নাকিবের কথা পুনঃপুন উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের পরিচয় ও আনুগত্য ব্যতীত মৃত্যুকে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বলে অভিহিত করেছেন।৩২

فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِى شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَ ٱلرَّسُولِ -আয়াতাংশের তাফসীর

‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ কর তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত কর।’ এ অংশে মহান আল্লাহ সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ সকল মুমিনকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তারা যে কোন বিষয়ে মতভেদ করলে যেন তার সমাধানের জন্য কোরআন ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।

সুতরাং আয়াতের ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ কর’ অংশে সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ এবং ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর...’ অংশে সম্বোধিতরা একই অর্থাৎ আল্লাহ মুমিনদেরকেই সম্বোধন করে বলেছেন, তোমরা উলিল আমর-এর আনুগত্য কর এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলকে ফয়সালাকারী হিসেবে মেনে নাও।

অন্যভাবে বলা যায়, تَنَازَعْتُمْ (তোমরা মতভেদ কর) আয়াতাংশে ‘تُم’ (তোমরা) সর্বনামটি ‘يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا’ (হে যারা ঈমান এনেছ) এর অর্থাৎ মুমিনদের দিকেই ইঙ্গিত করছে। তাই কখনই উলিল আমরের সাথে মুমিনদের দ্বন্দ্ব অনুমোদিত নয়। আর তা উলিল আমরের নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশের সুস্পষ্ট পরিপন্থি।

উলিল আমর যদি নির্ভুল না হন তবে সেক্ষেত্রেই কেবল উলিল আমরের সাথে মুমিনদের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। তখন প্রশ্ন দেখা দেবে, সকল মুমিনের পক্ষে কি উলিল আমরের কাজ কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হচ্ছে কি না তা নির্ধারণ করা সম্ভব? যদি তা সম্ভব না হয় তবে সেক্ষেত্রে বলতে হবে, আয়াতের উদ্দেশ্য সকল মুমিন নয়; বরং একদল মুমিন। কিন্তু এ ব্যাখ্যা আয়াতের অর্থের সুস্পষ্ট পরিপন্থি। কারণ, বলতে হবে একই আয়াতে পার্থক্যকারী কোন ইঙ্গিত ও নির্দেশক ছাড়াই ভিন্ন দুই দলকে ‘يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا’ (হে যারা ঈমান এনেছ) এবং اِن تَنَازَعْتُمْ (যদি তোমরা মতভেদ কর) সম্বোধন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট নিরূপণ করা সম্ভব নয় বিধায় যে কোন ভাষায়ই হোক এমন সম্বোধন সঠিক নয়। তাই বলতে হবে উভয় সম্বোধনের ব্যক্তিরা এক আর তারা হল সার্বিকভাবে সকল মুমিন। উলিল আমর তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

উলিল আমরের দায়িত্বের পরিধি

‘উলিল আমর’ দু’টি সার্বিক দায়িত্বের অধিকারী যার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তাদের প্রথম দায়িত্ব হলো মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় নেতৃত্বদান। এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে তাঁরা ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়সমূহকে ব্যাখ্যা এবং বিধিবিধানকে বর্ণনা করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা আল্লাহর দ্বীনের মুখপাত্র হিসেবে মানবগোষ্টীর দ্বীন শিক্ষা দান করেন। এ পরিমণ্ডলে তাঁরা যা-ই বলেন তা কোরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ অনুবর্তী। তাই এ ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের বাইরে অন্য কিছুই নয়। উলিল আমর এর দ্বিতীয় যে দায়িত্ব ও পদ রয়েছে তা হলো সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দান। যদিও এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁরা স্থান, কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন রূপ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু কখনই তা ধর্মের সার্বিক যে নীতিমালা কোরআন ও রাসূলের সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে তার বাইরে যাননি। এ জন্যই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়েও তাঁদের আনুগত্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের শামিল।

অতএব, উলিল আমর আল্লাহর দ্বীনে নতুন করে কোন বিধান প্রণয়ন করেন না এবং কখনই কিয়াস, ইসতিহসান (কোরআন-সুন্নাহর দলিল ব্যতীত ফকিহের নিজের কাছে সঠিক বলে মনে হয় এমন মত দেয়া), সংকীর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক পার্থিব কল্যাণ চিন্তার ভিত্তিতে কিছু বলেন না; বরং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহর সার্বিক নির্দেশনার ভিত্তিতেই তাঁরা সিদ্ধান্ত দান করেছেন।

সূরা নিসার ৫৯ এবং ৮৩ নং আয়াতের মধ্যে সম্পর্ক

সূরা নিসার ৮৩ নং আয়াতেও মহান আল্লাহ এ সূরার ৫৯ নং আয়াতের ন্যায় উলিল আমরের উল্লেখ করেছেন, তবে এ আয়াতে উলিল আমরের আনুগত্যের বিষয় আসেনি; বরং বলা হয়েছে :

‘যখন তাদের (মুনাফিক) নিকট নিরাপত্তা অথবা ভয়ের কোন খবর আসে, তারা তা প্রচার করে দেয়। (কিন্তু) যদি তারা বিষয়টিকে রাসূল ও উলিল আমরের নিকট উত্থাপন করত তবে তাদের মধ্যে যারা সত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারে তারা অবশ্যই তা জানত (ও প্রকাশ করত)। যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকত তবে স্বল্প সংখ্যক ব্যতীত তোমরা (সকলেই) অবশ্যই শয়তানের অনুসরণ করতে।’

যেহেতু আয়াতটি বাস্তবে সংঘটিত একটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে সেহেতু অনেক মুফাস্সিরই আয়াতকে যুদ্ধের সময় উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর আরোপ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে রাসূলের জীবদ্দশায় যে সকল সেনাপতি বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের কেউই নিজেকে পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াতের দৃষ্টান্ত বলে দাবি করেননি, যদিও কোন কোন বর্ণনায় অন্যরা এরূপ দু’এক ব্যক্তিকে উক্ত আয়াতের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর বিপরীতে হযরত আলী বিভিন্ন সময় নিজেকে এ আয়াতের এবং ৫৯ নং আয়াতের দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচয় দান করেছেন। যেমন তিনি হযরত মালিক আশতারের প্রতি লিখিত পত্রে বলেছেন :

“আল্লাহর রাসূলের (সা.) নিকট মুশরিকদের ব্যাপারে প্রযোজ্য কিছু বিধান ছিল (যা তিনি প্রয়োগ করেছেন) এবং আমার নিকটও তাঁর মৃত্যুর পর যালিম, আমাদের কিবলার অনুসারী ও বাহ্যিকভাবে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দানকারী ব্যক্তিদের ওপর প্রযোজ্য বিধান বিদ্যমান ছিল যা আমি তাদের ওপর প্রয়োগ করেছি। আল্লাহ যে সকল মানুষকে (এ সম্পর্কে) নির্দেশনা দিতে পছন্দ করেন তাদের উদ্দেশে বলেছেন : ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসূল ও উলিল আমরের। আর যখন কোন বিষয়ে তোমরা মতভেদ কর, যদি আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখ, তবে তা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের নিকট উপস্থাপন কর। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্ট।’ (সূরা নিসা : ৫৯) আল্লাহ আরও বলেছেন : ‘যদি তারা তা রাসূল ও উলিল আমরের নিকট উত্থাপন করত তবে অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা সত্যকে উদ্ঘাটনে সক্ষম তারা বিষয়টি জানত।’ (সূরা নিসা : ৮৩) আর আল্লাহর নিকট উত্থাপনের অর্থ হলো তাঁর কিতাবের দ্ব্যর্থহীন বিধানকে গ্রহণ এবং রাসূলের নিকট উত্থাপনের অর্থ তাঁর সর্বস্বীকৃত সুন্নাহর অনুসরণ যা মুসলমানদেরকে একত্র করে- বিচ্ছিন্ন করে না। আমরাই হলাম আল্লাহর রাসূলের সেই আহল (উত্তরাধিকারী বংশধর) যারা তাঁর গ্রন্থের দ্ব্যর্থহীন আয়াত থেকে বিধান হস্তগত করি ও মুতাশাবিহ (বিভিন্ন অর্থবাহী) আয়াতকে তা থেকে পৃথক করি এবং আমরাই মানসুখ (বিধান রহিত) আয়াত যার কঠিন বোঝাকে আল্লাহ (বান্দার থেকে) অপসারণ করেছেন এবং নাসিখ (বিধান রহিতকারী) আয়াত সম্পর্কে অবহিত।”৩৩

এ বর্ণনাটিতে হযরত আলী রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতকে এই দু’আয়াতের উদ্দিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষত তিনি দ্বিতীয় আয়াতের বিষয়কে যুদ্ধ ও নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন নি; বরং পবিত্র কোরআনের ওপর পূর্ণ জ্ঞান থাকাকে উলিল আমরের মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরেছেন যা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত ভিন্ন অন্য কারো ওপর প্রযোজ্য হতে পারে না। যেহেতু হযরত আলী এ পত্রটি তাঁর অধীন এক গভর্নর মালিক আশতারের উদ্দেশে লিখেছেন, অথচ তাঁকে এ আয়াতের দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেন নি সেহেতু বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তাদের ‘উলিল আমর’ মনে করতেন না।

‘ইহতিজাজ’ গ্রন্থেও একটি বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি হযরত আলীকে প্রশ্ন করেন : ‘আল্লাহর হুজ্জাত কারা?’ তিনি উত্তরে বলেন : “তাঁরা হলেন আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহর মনোনীত সেই সকল বান্দা যাঁদেরকে তিনি নিজের ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন এবং স্বীয় আনুগত্যের ন্যায় তাঁদের আনুগত্যকে ফরজ করেছেন। তাঁরাই হলেন ‘বিষয়সমূহের অধিকর্তা’ (أُولِي الْأَمْرِ) যাঁদের সম্পর্কে বলেছেন : ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর আর আনুগত্য কর রাসূল ও উলিল আমরের।’ (নিসা : ৫৯) তিনি আরো বলেছেন : ‘যদি তারা রাসূল ও উলিল আমরের নিকট উত্থাপন করত তবে যারা সত্য উদ্ঘাটনে সক্ষম তারা অবশ্যই তা জানত (এবং প্রকাশ করত)’(নিসা : ৮৩)।”৩৪

এ বর্ণনায় ‘উলিল আমর’ এক মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কেননা, পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পাশে তাঁদের নাম স্থান পেয়েছে। সুতরাং এটি সাধারণ কোন পদ নয় যে, যে কেউ তা দাবি করতে পারে। এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ইমাম সাদিক (আ.) বলেন : “আল্লাহর রাসূল (সা.) তাদের (মুমিনদের) জন্য ... ‘أَطيعُوا اللَّهَ وَ أَطيعُوا الرَّسُولَ وَ أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ’ আয়াতকে তাফসীর করেছেন ও বলেছেন, আয়াতটি আলী, হাসান ও হুসাইন (আ.) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে এবং বিশেষভাবে আলী (আ.)-কে এ আয়াতের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন ‘আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা (নেতা ও অভিভাবক)’ এবং (সার্বিকভাবে আহলে বাইতের ইমামদের উলিল আমর হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে) বলেছেন : ‘আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর কিতাব ও আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে বিশেষভাবে বলে যাচ্ছি।... তারা তোমাদের কখনও হেদায়াতের দ্বার থেকে বের করে দেবে না এবং বিচ্যুতির দ্বারে প্রবেশ করাবে না।’ যদি আল্লাহর রাসূল (সা.) চুপ করে থাকতেন এবং এ আয়াতের উদ্দিষ্ট আহলে বাইতকে পরিচিত না করাতেন তবে অমুক ও অমুকের বংশধররা তা দাবি করত...৩৫

এ বর্ণনায় ইমাম সাদিক (আ.) সুস্পষ্টভাবে আহলে বাইতের ইমামগণ ব্যতীত অন্য কারো উলিল আমর হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশেষত এ উদ্ধৃতি ‘আহলে বাইত (উলিল আমর) কখনও তোমাদের সত্যের দ্বার থেকে বের করে দেবে না... তাঁদের নির্ভুলতার প্রমাণ।

আলেম ও ফকীহগণ উলিল আমর নন

কেউ কেউ মনে করেন, আয়াতে বর্ণিত উলিল আমর হলেন ফকীহ আলেমগণ। যেমন হাকিম নিশাবুরী উলিল আমর সম্পর্কে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মত এভাবে বর্ণনা করেছেন :

‘দ্বীন ও ফিকাহর জ্ঞানের অধিকারীরা হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আনুগত্যের অধিকারী। তারা মানুষকে তাদের ধর্ম সম্পর্কে অবহিত করে এবং তাদের সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। এ জন্য আল্লাহ তাদের আনুগত্যকে ফরজ করেছেন।’

ফকীহ আলেমের আনুগত্যের বিষয়টি তখনই আসে যখন কোন ফকীহ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার পদক্ষেপ নেন অথবা কোন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে কোন নির্দেশ দান করেন। এ আনুগত্যের সপক্ষে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক ও নাকলী (হাদীসভিত্তিক) দলিল থাকলেও আলোচ্য আয়াতটির উলিল আমরের দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা এ আনুগত্যের অধিকারী নন। কেননা, প্রথমত আহলে বাইতের হাদীসসমূহে ‘উলিল আমর’ কেবল বারো ইমামের ওপর আরোপিত হয়েছে। অন্য কাউকে এতে শামিল করা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, আলোচ্য আয়াতে যেহেতু উলিল আমরের আনুগত্য রাসূলের আনুগত্যের ন্যায় নিঃশর্ত, সেহেতু ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনাপূর্ণ কোন ব্যক্তি এরূপ নিঃশর্ত আনুগত্যের অধিকারী হতে পারে না। এ কারণেই আহলে সুন্নাতের মুফাস্সিরগণ আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে উলিল আমরের আনুগত্যকে আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নির্দেশ অমান্য না করার শর্তাধীন করেছেন যা আয়াতের বাহ্যিক অর্থের (নিঃশর্ত আনুগত্য) পরিপন্থি। বরং আয়াতে উল্লিখিত উলিল আমর ঐশীভাবে নিষ্পাপ হওয়ার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণে এরূপ কোন শর্ত আরোপ করা হয়নি।

তৃতীয়ত, যদি ‘উলিল আমর’ এর উদ্দেশ্য ফকীহ ও আলেম হয় তবে আয়াতের এ অংশের ‘تَنَازَعْتُمْ اِن’ অর্থ হবে যদি ফকীহ ও আলেমরা পরস্পর দ্বন্দ্ব করে তবে তাদের দ্বন্দ্বকে আল্লাহ ও রাসূলের সামনে উপস্থাপন করতে হবে (যাতে তার সমাধান হয়)। তাহলে কি আল্লাহ একই মুহূর্তে ভুল-ত্রুটির সমূহ সম্ভাবনাযুক্ত কয়েক ব্যক্তিকে তাদের মতভেদ সত্ত্বেও নবীর ন্যায় আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন যদিও এতে উম্মত শতধাবিভক্ত হয়? এটা কিভাবে সম্ভব যে, এমন একদল ব্যক্তিকে যারা কখনও সঠিক সিদ্ধান্ত দান করে, আবার কখনও ভুল সিদ্ধান্ত দান করে তা জেনেও নিঃশর্তভাবে তাদের সকলের আনুগত্যের নির্দেশ দেবেন? এটা কি আল্লাহর হেদায়াতের লক্ষ্যের পরিপন্থি নয়?

আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ নিষ্পাপ ইমামদের অনুপস্থিতিতে উম্মতের নিরুপায় অবস্থায় ফকীহ আলেমের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান যা দ্বিতীয় পর্যায়ের ও বিশেষ অবস্থার এক বিধান (احكام ثانوي)হিসাবে আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করেন নি; বরং আয়াতটি প্রথম পর্যায়ের একটি বিধান। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর নবীর আনুগত্য যেমন সকল সময় ও সকল অবস্থায় নিঃশর্তভাবে পালনীয়, উলিল আমরের নির্দেশও তেমনি সর্বকালীন ও সর্বজনীন। কারণ, কোন অবস্থাতেই তা বিচ্যুতকারী নয় ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করবে না। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কখনই উলিল আমরের সদস্যদের মধ্যে মতভেদ হতে পারে না।

চতুর্থত, আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ ও রাসূল অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করলে মতভেদের সমস্যার সমাধান ঘটবে। কিন্তু এখানে কোরআন ও সুন্নাহর থেকে বিধান বের করতে গিয়েই ফকীহদের বোঝার পার্থক্যের কারণে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে এক্ষেত্রে কে ও কোন্ মানদণ্ডের ভিত্তিতে এ ফকীহদের মধ্যে কার মত সঠিক তা বিচার করবে? যদি বলি, তাঁরা নিজেরা বসে ? কি করবেন কার মত সঠিক তাহলে একক ফকীহ নয় বরং ফকীহদের দ্বারা গঠিত কমিটিকে উলিল আমর বলতে হবে। এমন উলিল আমর এর আনুগত্য অসম্ভব। কেননা, মুসলমানদের শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনার ভার, যেমন : রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সার্বিক দিকনির্দেশনা, আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো, যুদ্ধ ঘোষণা, সন্ধি স্থাপন, প্রধান বিচারপতি ও প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত দানের দায়িত্ব মতভেদের সম্মুখীন অনেক ফকীহর ওপর ন্যস্ত করলে কখনই একক ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছা যাবে না। বরং অবশেষে কোন একক বা একদল ফকীহর মতকে প্রাধান্য দিতে হবে। (বিচারকার্যের ক্ষেত্রে যেমন বিষয়টি এরূপ যে, একক বিচারক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দান করেন।) এখন প্রশ্ন হলো কোরআন কি এ আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে এ ধরনের ফকীহর সমষ্টির গৃহীত সিদ্ধান্তকে মানার নির্দেশ দিচ্ছে? যদি তাই হয়, তবে বলতে হবে কোরআন ও সুন্নাহ নয়; বরং ফকীহদের সামষ্টিক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ফয়সালা দানকারী আর তা গ্রহণ করাই হলো এ আয়াতের আনুগত্যের অর্থ। কিন্তু এ অর্থটি কখনই আয়াতের উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ, আয়াত বলছে, মতভেদকে আল্লাহ ও রাসূলের কাছে পেশ কর। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর থেকে সঠিক মতটি জেনে নাও। তাই এক্ষেত্রে মতভেদের অবসান ঘটাতে হলে কোরআন ও সুন্নাহর থেকে নির্ভুল মতটি বের করতে হবে যা কেবল নির্ভুল উলিল আমরই নির্ধারণ করতে পারেন, অন্যরা নয়। সুতরাং আয়াতের উদ্দেশ্য রাসূলের উপস্থিতিতে বিভেদের বিষয়কে রাসূলের কাছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিষ্পাপ উলিল আমরের কাছে উপস্থাপন কর, তাহলেই সঠিক মতটি জানতে পারবে।

উলিল আমর সেনাপতি ও শাসকগণ নয়

আয়াতটি নবী বা ইমামের উপস্থিতিতে তাঁদের মনোনীত বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়, যেহেতু তাঁদের আনুগত্যের বিষয়টি নবী বা ইমামের নির্দেশের কারণে অপরিহার্য হয়েছে। এ জন্য আল্লাহ স্বতন্ত্রভাবে পবিত্র কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন নি। এছাড়া নবীর বা ইমামের মনোনীত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (যতদিন কোন পদে, যেমন সেনাপতি বা শাসক হিসেবে বহাল থাকেন) দায়িত্ব পালন করেন এবং যখন দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করেন তখন তার আনুগত্যের আর কোন নির্দেশ থাকে না। তাই আয়াতের উলিল আমর এমন ব্যক্তিদের জন্য নির্দিষ্ট যাদের থেকে এ পদকে কখনই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এ কারণেই আয়াতের উলিল আমরের পদটি নবীর পদের ন্যায় স্থায়ী একটি পদ এবং তাঁদের উভয়ের আনুগত্য সর্বজনীনভাবে উম্মতের সকল সদস্য এবং প্রত্যেক মুমিনের ওপর প্রযোজ্য। কখনই যেমন এরূপ হতে পারে না যে, নবীর আনুগত্য একদল মুমিনের ওপর প্রযোজ্য হবে, অথচ অন্যদের ওপর প্রযোজ্য হবে না। তেমনি উলিল আমরের আনুগত্যও বিভাজ্য নয় অর্থাৎ তাঁদের একজনের আনুগত্য একদল মুমিনের জন্য নির্দিষ্ট হতে পারে না। বরং তাঁদের সকলের আনুগত্য কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনের ওপর অপরিহার্য। আয়াতের সর্বজনীন সম্বোধন- (يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا) ‘হে যারা ঈমান এনেছ!’ এ সত্যকেই প্রমাণ করে।

 

সিদ্ধান্ত ও ফলাফল

১. উলিল আমরের আয়াতটি নিঃসন্দেহে নিঃশর্ত আনুগত্য প্রমাণ করে। নবীর আনুগত্যের সঙ্গে উলিল আমরের আনুগত্য সংযুক্ত হওয়া উভয় আনুগত্য একই ধরনের হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে।

২. আয়াতের বাহ্যিক অর্থ উলিল আমর বিশেষ ব্যক্তিবর্গের ওপর প্রযোজ্য হওয়ার সাথেই কেবল সামঞ্জস্যশীল। আয়াতের শানে নুযূল হিসেবে বর্ণিত বিভিন্ন রেওয়ায়াত ও মহানবী (সা.)-এর হাদীস এ আয়াতের উলিল আমরের দৃষ্টান্তকে বর্ণনা করেছে।

৩. আয়াতে বর্ণিত নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ উলিল আমর মাসুম ও নিষ্পাপ হওয়াকে অপরিহার্য করে।

৪. নিষ্পাপ উলিল আমরকে চিহ্নিত করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এরূপ বৈশিষ্ট্যের উলিল আমর আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিচিত করানো আবশ্যক বিষয়।

৫. উলিল আমর নির্দিষ্ট না হলে তাঁদের আনুগত্য মুমিনদের জন্য অসম্ভব হবে। কেননা তারা জানবেনা যে কোন ব্যক্তির আনুগত্যকে আল্লাহ অপরিহার্য করেছেন। ফলে তারা বিভিন্ন ব্যক্তির শরণাপন্ন হবে। এভাবে তারা মতদ্বৈততার সম্মুখীন হবে। অথচ আল্লাহ উলিল আমর-এর আনুগত্যের মাধ্যমেই উম্মতের ঐক্যকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।

৬. যেহেতু আয়াতের সম্বোধন সর্বজনীন, সেহেতু তা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনকে শামিল করে যা কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্পাপ উলিল আমর বিদ্যমান থাকা ও তাঁদের আনুগত্যের অপরিহার্যতাকে প্রমাণ করে। তাই কেউই এ অনুগত্যের বাইরে থাকতে পারবে না।

৭. নবী (সা.)-এর আনুগত্য করা যেমন সকল মুমিনের জন্য ফরজ তেমনি উলিল আমরের আনুগত্য করা সকল মুমিনের জন্য ফরজ। এমন হওয়া অসম্ভব যে, উলিল আমরের কোন সদস্যের আনুগত্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ওপর আবশ্যক হবে ও অন্যদের ওপর অনাবশ্যক হবে। কারণ, আয়াতে বর্ণিত উলিল আমরের আনুগত্যকে আল্লাহ সকল মুমিনের ওপর ফরজ করেছেন। ভৌগলিক বা অন্য কোন কারণে উলিল আমর ভিন্ন হলে বলতে হবে আল্লাহ কোরআনেই মুসলমানদের একেক দলের জন্য একেক ব্যক্তির নিঃশর্ত অনুসরণ (যদিও সে বিচ্যুতি ও ভুলের সম্মুখীন হয় ও বিভিন্ন ব্যক্তির অনুসরণের কারণে মুসলমানদের মধ্যে আনুগত্যের ক্ষেত্রে মতভেদের সৃষ্টি হয়) আবশ্যক করেছেন, অথচ এ কর্ম তাঁর প্রজ্ঞা পরিপন্থী।

৮. উলিল আমরের আনুগত্য শুধু ধর্মের ব্যাখ্যা, খুঁটিনাটি বিধান বর্ণনা ও ইসলামের শিক্ষা দানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং রাজনৈতিক, সামাজিক, বিচার সংক্রান্ত ও সামরিক নেতৃত্বকেও শামিল করে।

৯. যারা দাবি করে নবী বা কোন ইমামের পক্ষ থেকে নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সেনাপতি উক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত তাদের ধারণা সঠিক নয়। কেননা, তাদের অনেকেই রাসূলের নির্দেশের পরিপন্থি কাজ করেছেন ও তাঁদের কাজ থেকে রাসূল নিজেকে সম্পর্কহীন ঘোষণা করেছেন। যেমন উসামা ইবনে যাইদ, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, ওয়ালিদ ইবনে উকবা প্রমুখ। হযরত আলীও যিয়াদ ইবনে আবি ও আশআস ইবনে কাইসের মতো লোকদেরকে নিজের শাসনকর্তা মনোনীত করেছেন যাদের পরবর্তী কর্মকাণ্ড তাঁর দ্বারা সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। তাই আল্লাহ কখনই পবিত্র কোরআনে তাঁর ও তাঁর নবীর পাশে এমনকি নবী ও হযরত আলীর সরাসরি নিয়োগকৃত ব্যক্তিদেরও নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশ দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে অন্যদের তো কথাই নেই।

১০. কেউ কেউ ফকীহ আলেমদেরকে আলোচ্য আয়াতের দৃষ্টান্ত বলতে চেয়েছেন, কিন্তু তা আয়াতের নিঃশর্ত আনুগত্যের নির্দেশের পরিপন্থি হওয়া ছাড়াও ফকীহদের মধ্যে মতের পার্থক্য থাকা ও তার মধ্যে কোন্ মতটি সঠিক তা যাচাই করা সম্ভব না হওয়ার কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, আয়াত যে কোরআন ও সুন্নাহকে মতভেদ দূর করার কারণ বলেছে সেই কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থেকেই এ মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. যাভী, তারতিবুল কামুসিল মুহিত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯৮।

২. ফারাহিদী, তারতিবুল আইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১২০।

৩. আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেছেন : যাঁরা বলেছেন ‘আয়াতটিতে ‘امر’ শব্দটি আদেশ অর্থে এসেছে যা নিষেধ অর্থের বিপরীত (এবং বহুবচন হলো اوامر )’ তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাবাতাবায়ী, আল মিজান ফি তাফসিরীল কোরআন, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৯১।

৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪।

৫. রাগেব ইসফাহানী, মুফরাদাতু আল ফাযিলুল কোরআন, পৃ. ৯৯।

৬. দ্রষ্টব্য : আততিবইয়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৩৭; মাজমাউল বায়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০০- ১০১।

৭. মাজমাউল বায়ান, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০০।

৮. বিশেষ আয়াতে মতভেদের বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের নিকট উপস্থাপনের সাথে আল্লাহ ও কিয়ামতের ওপর বিশ্বাসকে সম্পর্কিত করা হয়েছে যা এ উপস্থাপনের অপরিহার্যতার দলিল।

৯. যেমন পবিত্র কোরআনে কেবল আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত মদ (শরাব) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর অনুমতিক্রমে সকল প্রকার নেশাকর দ্রব্যকে হারাম ঘোষণা করেছেন- এখন তা যে কোন উপাদান থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকুক।

১০. সূরা আনকাবুত : ৮।

১১. সূরা নুর : ৫১।

১২. সূরা আনফাল : ২০; সূরা মুহাম্মাদ : ৩৩।

১৩. সূরা নিসা : ১৩।

১৪. সূরা ফাত্হ : ১৬।

১৫. সূরা আহযাব : ৭১।

১৬. সূরা নূর : ৫৬।

১৭. সূরা বাকারা : ১৮৯।

১৮. সূরা বাকারা : ২১৫।

১৯. সূরা আনফাল : ১।

২০. সূরা বাকারা : ২২২।

২১. হামাভী, ফারায়িদুস সিমতাইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৩, হা. ২৫০, বাব ৫৮; ইবনে উকদা, কিতাবুল বিলায়াহ, পৃ. ১৯৮, হাদীস ৩১।

২২. কুলাইনী, আল-কাফী, ১ম খণ্ড, পৃ.২৭৬, হা. ১; তাফসীরে আয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৪, হা. ১৫৪ ও ১৬৯।

২৩. কামালুদ্দীন, শেখ সাদুক, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫৩, হা. ৩; তূসি, ইলামুল ওয়ারা, পৃ. ৩৭৫।

২৪. সাদুক, ইলালুশ শারায়ে, ১ম খণ্ড, বাব ১০৩, পৃ. ১২৩-১২৪, হা. ১।

২৫. জুয়াইনী হাফিজ শামসুদ্দীন যাহাবীর হাদীস শিক্ষক। যাহাবী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন : জুয়াইনী হাদীসের জ্ঞানে অতুলনীয় ও শেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন। ইসলামের গর্ব সাদরুদ্দীন জুয়াইনী রেওয়ায়েতের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন। দ্রষ্টব্য : তাযরিকাতুল হুফ্ফাজ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৫০৫, মাবহাস ‘শুউখুস সাহিবুত তাযকিরা’, সংখ্যা (রাকাম) ২৪।

২৬. হামাভী, ফারায়িদুস সিমতাইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১৩, বাব ৫৮, হা. ২৫০; হামাভী এ হাদিসটি আবান ইবনে আবি আয়াশ সূত্রে সুলাইম ইবনে কাইস থেকে বর্ণনা করেছেন। আবান ইবনে আবি আয়াশ থেকে আবু দাউদ তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে কিছুসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁকে কেউ কেউ দুর্বল রাবি বললেও অনেকেই তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। (দ্রষ্টব্য : তাহযিবুল কামাল, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯-২৪, নং ১৪২)

২৭. হাসকানী, শাওয়াহেদুত তানযিল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৯২, হাদীস ২০৫; কাজী নুরুল্লাহ শুসতারী (তুসতারী) ও তাঁর ‘ইহকাকুল হাক’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস থেকে আয়াতটি সম্পর্কে অনুরূপ শানে নুযূল বর্ণনা করেছেন; ইহকাকুল হাক, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪২৫ (আবু বাকর ইবনে মুমিন শিরাজীর ‘রিসালাতুল ইতিকাদ’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত। ইবনে শাহরে অশুবও ‘তাফসীরে মুজাহিদ’ থেকে উল্লিখিত শানে নুযূলটি বর্ণনা করেছেন। (দ্রষ্টব্য : ইবনে শাহরে অশুব, আল-মানাকিব, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৯।)

২৮. দ্রষ্টব্য : ইবনে আবি আছিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৫৮৭, হা. ১৩৪২ ও ১৩৪৩; মুসনাদে আবু ইয়ালা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৬, হা. ৭৩৮ (মুসনাদের গবেষক গ্রন্থের পাদটীকায় হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; নাসায়ী, আল-খাসায়িস, পৃ. ৭৬, হাদীস ৪৪।

২৯. দ্রষ্টব্য : সুনানে তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬৩৩, হা. ৩৭১২; ইবনে আবি আছিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৫৫০, হা. ১১৮৭ (গবেষক মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন : এ হাদীসটির সনদ সহীহ। হাকিম নিশাবুরী ও হাফিজ যাহাবী এর সহীহ হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে একমত)। নাসয়ী, খাসায়ীস, পৃ. ৮৮-৮৯ এবং ১২৯-১৩১। এ হাদীসটি আহলে সুন্নাতের গ্রন্থসমূহে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। খাসায়িস গ্রন্থের গবেষক কয়েকটি গ্রন্থসূত্রে হাদীসটি উক্ত স্থানে উল্লেখ করেছেন।

৩০. হাদীসে সাকালাইনের টেক্সট হলো : মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী ও মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনও বিচ্যুত হবে না : আল্লাহর কিতাব এবং আমার বংশধর আহলে বাইত। এ দু’টি আমার সাথে (কিয়ামতে) হাউজে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ সুনানে তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৬২২, হা. ৩৭৮৬ এবং পৃ.৬৬৩, হা. ৩৭৮৮; মুসতাদরাকে হাকিম নিশাবুরী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৯ ও ১১০; ইবনে আবি আছিম, কিতাবুস সুন্নাহ, পৃ. ৬২৯, হা. ১৫৫৩ এবং পৃ. ৬৩০, হাদীস ১৫৫৮; মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল, ১৭তম খণ্ড, পৃ. ১৬১, হা. ১১১০৪; তাবরানী, আল †মাজামুল কাবীর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৫-৬৬, হা, ২৬৭৮, ২৬৮০, ২৬৮১ এবং ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৬৬, হা. ৪৯৭১; ইবনে হামিদ, মুসনাদ, পৃ. ১০৭-১০৮, হা. ২৪০ ও অন্যান্য সূত্র দ্রষ্টব্য।

৩১. সূরা আনকাবুত : ৮ [যদি তারা দু’জন (পিতা-মাতা) তোমাকে এমন বিষয়ে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই আমার সাথে শিরক করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায় তবে তুমি তাদের আনুগত্য কর না।)

৩২. আল-কাফি, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯, হা. ৬; তাফসীরে আয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৪, হা. ১৫৪ ও পৃ. ৪১৪, হা. ১৭৯। ‘যে কেউ ইমাম ব্যতীত মৃত্যুবরণ করবে সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’ হাদীসটি সহীহ সূত্রে মুসনাদে আহমাদ, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৮৪, হা. ৫৩৮৬ এবং ২৮তম খণ্ড, পৃ. ৮৮, হা. ১৬৮৭৬ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

৩৩. তুহাফুল উকুল, পৃ. ১২৩ (বাংলায় অনূদিত)।

৩৪. তাবারসী, আল-ইহতিজাজ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৬৮।

৩৫. উসূলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৬, হা.১; তাফসীরে আয়াশী, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪৯, হা. ১৬৯।

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আল্লাহর প্রতি ইমান
মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
বারজাখের জীবন
সূরা ইউনুস;(১৬তম পর্ব)
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
দোয়া কবুলের মাস

 
user comment