বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

ইসলাম অস্ত্রের জোরে প্রসার লাভ করেনি

ইসলাম অস্ত্রের জোরে প্রসার লাভ করেনি

ইসলাম জীবন্ত ও বিশ্বজনীন দীন, যা পৃথিবীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ করেছে।

ইসলাম সাবেক রোমীয় ধর্ম, ইহুদী এবং নাজীদের মত সমাজ এবং গোত্রের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যে। মুসলমানরা ইসলামের শিক্ষার অনুসারী হিসাবে তাদের দায়িত্ব হলো, বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তি দানে এবং শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের জনগণকে জীবনের কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত করতে সচেষ্ট হওয়া।

ইসলামের মুজাহিদরা চিলতে পরিমাণ জমি হস্তগত করার জন্যে জিহাদ করেনি। আর এ জন্যেও জিহাদ করেনি যে এক সরকারকে বদলে ঐ স্থানে ঐ রূপ এক সরকার অথবা তার চেয়ে আরো বেশী অত্যাচারী সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। বরং জিহাদ হলো একটি মানবপ্রেম মুখী প্রচেষ্টা যা আল্লাহর রাহে এবং মানুষের কল্যাণের জন্যে ও অসংখ্য দুর্বল মানুষকে মুক্তি দিতে সংঘটিত হয়ে থাকে যেন ফেৎনা দূরীভূত হয় এবং সর্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই মহৎ উদ্দেশ্য এবং এ জীবন্ত শিক্ষা ব্যাপক সংখ্যক জনগণের অসচেতনতার ইতি টানবে। তাছাড়া কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী যারা অনাথদের কলিজার রক্ত চুষে স্বপ্নের জীবন গড়ে তাদের পথ বন্ধ করে দেয়।

মানুষের ফিতরাতের (সহজাত প্রবণতা ও বিবেকের) দাবী হলো আগাছা এবং সমাজের নষ্ট অংশ সমূহ কেটে ফেলতে হবে। তাহলে জনগণের মুক্তির ও কল্যাণের পথ সুগম হবে। মানব প্রেমিক, ন্যায় পরায়ণ এবং স্বাধীনচেতা মানুষেরা এরূপ সংগ্রামের প্রতি উদ্যোগী ও তার প্রশংসা করেন।

মহান আল্লাহ্ কতইনা অপূর্ব ভাষায় বলেছেন :

“এবং আল্লাহ্ যদি মানব জাতিকে, তাদের একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে অবশ্যই পৃথিবী ফ্যাসাদপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ্ সকল জগদ্বাসীর উপর অতীব অনুগ্রহশীল।” (সূরা বাকারা : ২৫১)

ইসলামী আইনে জিহাদ প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে গৃহীত হয়নি। বরং তা সীমালংঘন ও নির্যাতন রোধের জন্যে। তাছাড়া যোগ্য মানুষদের কল্যাণের পথ সুগম করতে জিহাদকে সর্বশেষ উপায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরব মুসলমানদের প্রতিনিধি ইরানের সেনাপতি রুস্তম ফারাখযাদকে বলেছিলেন :

“আল্লাহ্ আমাদেরকে নির্বাচন করেছেন এই জন্যে যে, জনগণকে বান্দা পূজারী থেকে খোদা পূজারীতে, বিশ্বের বন্দিত্ব থেকে স্বাধীন ও সৌভাগ্যবান করতে এবং ভ্রান্ত দীন সমূহের অত্যাচার থেকে ন্যায় ভিত্তিক ইসলামের পথে দাওয়াত করার জন্যে। যারা আমাদের দাওয়াত গ্রহণ করবে তার দেশকে তার কাছে সপে দিয়ে চলে যাব...।”(তারিখে তাবারী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২২৭১।)

 

 

মুসলমানদের জিহাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এটা যে, নিজেদের ও আপামর বঞ্চিতদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে তারা ইসলামের কানুন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ইসলামের মহত্ত্ব ও সত্যতাকে নিকট থেকে দেখবে।

মুসলমানরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধের সময় কখনোই কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করত না। তারা সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের দীনে অটল থাকতে পারত। এর পরিবর্তে ইসলামী রাষ্ট্র তাদেরকে সাহায্য করত।

রাসূল (সা.) হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অঙ্গিকার করেন যে, যদি মক্কার কোন ব্যক্তি মুসলমান হয় এবং মদীনায় মুসলমানদের নিকট চলে আসে, মুসলমানরা তাকে গ্রহণ না করে মক্কায় পাঠিয়ে দিবে। এবং তিনি সে ওয়াদা অনুযায়ী আমল করেন। যদিও পারতেন কাফেরদের কাছ থেকে অঙ্গিকার নিতে যে, যদি কোন মুসলমান ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে মক্কায় কাফেরদের নিকট যায় তাহলে তাকে মদীনায় ফিরিয়ে দিতে।

রাসূল (সা.) মক্কা বিজয়ের দিনে কুরাইশদেরকে স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দেন এবং কাউকেই ইসলাম গ্রহণের জন্যে বাধ্য করেন নি। বরং ছেড়ে দিয়েছিলেন যেন তারা নিজেরাই সঠিক দীনকে চিনে নেয়। তাছাড়া রাসূল (সা.) মুসলমানদেরকে বলে রেখে ছিলেন যে, মক্কার দু এক জন অপরাধী ব্যতীত কাউকেই যেন হত্যা না করা হয়।(আলামূল ওয়ারা, পৃ. ১১০।) অনুরূপ যখনই কোন কাফের নিরাপত্তা চাইত, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হতো। যেন সে গবেষণার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। যেমন : সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যা মক্কা বিজয়ের পর জেদ্দায় পালিয়ে যায়। যখন রাসূল (সা.)-এর কাছে তার জন্যে নিরাপত্তা চাইল, রাসূল (সা.) নিজের আমামা তার জন্যে পাঠিয়ে দেন, যেন এটার মাধ্যমে সে নিরাপদে থাকতে পারে এবং মক্কায় প্রবেশ করতে পারে। সাফওয়ান জেদ্দা থেকে ফিরে এসে রাসূল (সা.)-এর কাছে দুই মাস সময় চায়। রাসূল (সা.) গ্রহণ করেন এবং তাকে চার মাস সময় দেন। সে কাফের থাকা অবস্থায় রাসূল (সা.)-এর সাথে হুনাইন এবং তায়েফ যায় ও অবশেষে স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়।(কামিল, ইবনে আসির, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৮- ২৪৯।) এভাবে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তলোয়ারের ব্যবহার শুধুমাত্র তাদের জন্যেই, যারা সত্যকে চেনা সত্বেও তার বিরোধিতা করে এবং অন্যদের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে বাধা দান করে।

তরবারি ফেৎনাসমূহ দূরীভূত করার জন্যে বঞ্চিতদের মুক্তির জন্যে এবং মানুষের উন্নতি ও পরিপূর্ণতার জন্যে উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের ঈমান ও দৃঢ়তাই উত্তম দলিল যে, তরবাবির মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতি সাধিত হয়নি। প্রথম যুগের মুসলমানরা দীনকে এত বেশি ভালবাসত যে, সকল সমস্যার বিপরীতে অবিচল থাকতেন; এমনকি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতেন।

বেলাল হাবাশী ইসলামের প্রথম দিকের মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিলেন। আবু জেহেল তাকে হেজাজের গরম বালিতে ফেলে রেখে বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখত এবং রৌদ্রের তাপে গরম হলে যখন সে যন্ত্রণায় চিৎকার করত তাকে বলা হতো : মুহাম্মদের খোদাকে অস্বীকার কর, কিন্তু বেলাল অনবরত বলত : আহাদ, আহাদ। এত সকল অত্যাচার সহ্য করেও সে ইসলাম থেকে হাত গুটিয়ে নেয়নি বরং দীন ইসলামের প্রতি অটল থেকেছে।

এ অবস্থার পরও কি বলা যায় যে, ইসলামের অগ্রগতি তরবারির জোরে হয়েছে?!

ইসলামের শত্রুরা যেহেতু ইসলামের কোন দুর্বল দিক খুঁজে পাচ্ছিল না; তাই চেয়েছিল এভাবে ইসলামকে কলঙ্কিত করতে। কিন্তু তারা জানে না যে ইসলাম তার সহজ সরল নীতি এবং বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণকে সাহায্য করার মাধ্যমে অগ্রগতি সাধন করবে।

ফরাসী ঐতিহাসিক ড. গুস্তাভলুবুন লিখেছেন : ইসলামী বিশ্বের সম্প্রসারণ যুদ্ধের মাধ্যমে যতটা না হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেশী হয়েছে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

রাসূল (সা.)-এর সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধ

ইসলামের রাসূল (সা.) বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের ন্যায় সীমানা বৃদ্ধি করতে বা জনগণের উপর শোষণ চালাতে কিংবা বিভিন্ন জাতির ধনসম্পদ হস্তগত করতে যুদ্ধ করেন নি। বরং কোরআন ও ইসলামী আইনের মশাল নিয়ে এগিয়ে যেতেন। তরবারিকে শুধুমাত্র জরুরী ক্ষেত্রে যেমন : অত্যাচার ও জুলুম ঠেকাতে এবং সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডাকে উন্নীত করতে অথবা সত্য প্রচারের পথের বাধা দূর করতে ব্যবহার করতেন।

রাসূল (সা.)-এর সময়ে যে সকল যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল তা ছিল স্বার্থপর ও জালিম লোকদেরকে উৎখাত করতে। কেননা তারা আল্লাহর পবিত্র বান্দাদের উপর জুলুম করত এবং সত্য ও ইসলামের আকিদা প্রচারের পথে বাধা সৃষ্টি করত। এছাড়া যেন মানুষ ইনসাফ ও ন্যায় সংগত হুকুমতের ছায়ায় আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সমঝোতার অন্তর্ভূক্ত হতে পারে, সে উদ্দেশ্যেই ঐসকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

এরূপ যুদ্ধকে কি অবৈধ বলা যেতে পারে?! অবশ্য প্রত্যেক নবীর জন্যেই এ সংগ্রাম একান্তভাবে জরুরী এবং প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তিই এর প্রশংসা করবে। কেননা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এটা ছাড়া আর অন্য কোন পথ খোলা থাকে না।

যেহেতু হযরত ঈসা (আ.)-এর নবুওয়াতকাল কম ছিল এবং উপযুক্ত পরিবেশ ছিলনা, তাই তিনি যুদ্ধ করেন নি। অন্যথায় তিনিও সমাজের আগাছাগুলোকে উৎখাত করতেন। ‘খ্রিস্টানদের ধর্মপ্রচারমূলক প্রতিষ্ঠান সমূহ’ ইসলামী বিশ্বের মনোবলকে দুর্বল করার জন্যে এবং উপনিবেশ ও অনাচারের সাথে সংগ্রামের মানসিকতা নিস্পাণ করতে এবং ইসলামের উত্তরোত্তর অগ্রগতিতে বাধা দেয়ার জন্যে রাসূল (সা.)-এর যুদ্ধ সমূহকে উল্টোভাবে ব্যাখ্যা করে। আর হতাহতের সংখ্যাকে লোমহর্ষক ভাবে উপস্থাপন করে। এর মাধ্যমে তারা মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মযাজকগণ কর্তৃক ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানীদের ব্যাপক হত্যাসহ মুসলমানদের সাথে সংঘটিত ক্রুসেডের যুদ্ধকে (যাতে মিলিয়ন মিলিয়ন নিরাপরাধ লোককে হত্যা করা হয়) সামান্য এবং সাধারণ বলে উপস্থাপন করতে চায়।

প্রথমে আমরা মহানবী (সা.)-এর প্রসিদ্ধ যুদ্ধ সমূহের উদ্দেশ্য এবং শেষে মৃতের সংখ্যা তুলে ধরব। যার মাধ্যমে সত্য সুস্পষ্ট হবে এবং পাঠকবৃন্দ মহানবী (সা.)-এর এর যুদ্ধ সমূহের দর্শন উপলব্ধি করতে পারবেন। তাছাড়া জানতে পারবেন যে কত নগণ্য সংখ্যক মানুষ এ সকল যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল।

১.বদরের যুদ্ধ : মহানবী (সা.) ও তাঁর সাথীরা তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর হতে ১৩ বৎসর যাবৎ মক্কায় কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত হন। অবশেষে রাসূল (সা.) ও তাঁর সাথীরা জন্মভূমি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। কিন্তু মক্কার কাফেররা তাদের অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিল এবং অসহায় মুসলমানদেরকে নির্যাতন করত। তারা তাদেরকে মক্কা থেকে হিজরত করার ও অনুমতি দিত না।

অন্যদিকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, মদীনায় এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করবে। নির্দেশ দেয় যে, কোন কাফেলাই যেন মদীনায় কোন খাদ্য-সামগ্রী না নিয়ে যায়। বেশ কিছু দিন এ অবরোধ চলার পর মদীনার লোকজন বেশ কষ্টে ও বিপদে পড়ে। খাদ্য সামগ্রী আনার জন্যে তাদেরকে বাধ্যতামূলক ভাবে লোহিত সাগর উপকূলে যেতে হত।

আবু জেহেল ও রাসূল (সা.)-এর হিজরতের পর রূঢ় ভাষায় এক পত্র লেখে এবং রাসূল (সা.)-কে সাবধান করে দেয় যে কুরাইশদের হামলার প্রতীক্ষায় থাকতে।

এ পর্যায়ে আল্লাহ্ বললেন : ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদেরকে (আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করার) অনুমতি দেওয়া হইল। কারণ তাদের উপর জুলুম করা হচ্ছে এবং নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। (সূরা হজ : ৩৯)

যাদেরকে তাদের ঘর বাড়ী হতে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বহিষ্কার করা হয়েছে যে, তারা বলে : আল্লাহ্ আমাদের প্রতিপালক। আল্লাহ্ যদি এই সকল মানুষের এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করিতেন তা হইলে সাধু-সন্ন্যাসীগণের মঠ, গীর্জা, ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ যাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয় সেগুলো অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত এবং নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা তাঁর সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ্ অতিশয় শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী। (সূরা হজ : ৪০)

রাসূল (সা.) দ্বিতীয় হিজরীতে ইসলাম রক্ষার্থে ও মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে এবং কুরাইশদের মারাত্মক নীল নকশা পণ্ড করতে উঠে দাঁড়ান। অবশেষে বদরে কুরাইশদের মুখোমুখী হন। মুসলমান মুজাহিদদের সংখ্যা কুরাইশদের এক-তৃতীয়াংশ ভাগ হলেও ঈমানের শক্তিতে এবং আল্লাহর সাহায্যে তারা কুরাইশদেরকে পরাজিত করেন।

২.ওহুদের যুদ্ধ : যেহেতু বদরের যুদ্ধে কিছু সংখ্যক কাফের নিহত হয়েছিল, তাই কুরাইশ বিশেষ ভাবে রণ সাজে সজ্জিত হয়ে প্রতিশোধ নিতে তৃতীয় হিজরীতের মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং ওহুদে মুসলমানদের মুখোমুখী হয়। এ যুদ্ধে কিছু সংখ্যক মুসলমান কর্তৃক রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করা হলে, মুসলমানরা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়।

৩.খন্দকের যুদ্ধ : পঞ্চম হিজরীতে বনী নাযির গোত্রের কিছু সংখ্যক ইহুদী মক্কায় যেয়ে কুরাইশদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। কুরাইশ এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে লোক নিয়ে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করে।

মুসলমানরা মদীনা শহরের চারপাশে পরিখা খনন করলেন এবং ১০ হাজার শত্রু সৈন্যের বিপক্ষে সারিবদ্ধ হলেন।

হযরত আলী (আ.) বীরদর্পে শত্রুদলের সেনাপতিকে ধরাশায়ী করেন এবং মুসলমানরা বিজয়ী হয়।

৪.বনি কুরাইযার যুদ্ধ : বনি কুরাইযা রাসূল (সা.)-এর সাথে সন্ধি চুক্তি করেছিল কিন্তু খন্দকের যুদ্ধে সে চুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশদেরকে সাহায্য করেছিল। যেহেতু রাসূল (সা.) তাদেরকে ভয়ানক হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন তাই তাদেরকে উৎখাত করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।

খন্দকের যুদ্ধের পর রাসূল (সা.) মুসলমানদেরকে বনী কুরাইযাদের দিকে যাত্রা করতে আদেশ দিলেন। ২৫ দিন মুসলমানরা তাদেরকে অবরোধ করে রাখে অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আওস গোত্র রাসূল (সা.)-এর কাছে অনুরোধ করল তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে। রাসূল (সা.) বললেন : তোমারা কি রাজি আছ সা’দ ইবনে মায়ায যে হুকুম করে তা মেনে নিতে? সকলেই মেনে নিল, তারা মনে করেছিল যে সা’দ তাদের পক্ষপাতিত্ব করবে। কিন্তু সে পুরুষদেরকে হত্যা, সম্পদসমূহকে বন্টন এবং নারীদেরকে বন্দী করার নির্দেশ দেয়। রাসূল (সা.) বললেন : এদের ব্যাপারে সা’দ যে হুকুম করেছে তা আল্লাহরই হুকুম। এ নির্দেশ অনুসারে তাদের সকল যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হয়।

৫.বনি মুসতালিকের যুদ্ধ : বনি মুসতালিক খাযায়া গোত্রের একটি দল ছিল, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কিছু ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। রাসূল (সা.) তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত হয়ে সৈন্য নিয়ে তাদের দিকে যাত্রা করেন, যেন তাদের অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকেন। মুরাইসী নামক স্থানে তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বিজয়ী হন। এ যুদ্ধ ৬ষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।

৬.খায়বরের যুদ্ধ : খায়বরের দূর্গসমূহে ইহুদীদের অনেকগুলো দল একত্রে বসবাস করত। মুশরিকদের সাথে তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। যেহেতু তাদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল; তাই ৭ম হিজরীতে মুসলমানরা শত্রুদের প্রাণকেন্দ্র খায়বার অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। অবরোধ এবং যুদ্ধের পর অবশেষে ইহুদীরা ইসলামী হুকুমতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। (এ যুদ্ধে আলী (আ.)-এর ঢাল ভেঙ্গে গেলে তিনি খায়বার দূর্গের দরজা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধ শেষে তা ছুড়ে ফেলে দেন। ঐ দরজা এত বড় এবং ভারী ছিল যে, পরবর্তীতে ৪০ জনেরও বেশী সংখ্যক লোক তা তুলতে ব্যর্থ হয়)।

৭.মুতার যুদ্ধ : অষ্টম হিজরীতে রাসূলে আকরাম (সা.) হারেছ ইবনে উমাইরকে একটি পত্র দিয়ে বসরার বাদশার নিকট প্রেরণ করেন। কিন্তু রাসূল (সা.) দূত সেখানে পৌঁছলেই তারা তাকে হত্যা করে। মুসলমানরা মহানবীর নির্দেশে শত্রুর দিকে যাত্রা করে। অবশেষে মুতায় রোমের বাদশা হিরাকিলাসের এক লক্ষ সৈন্যের মুখোমুখী হয় এবং তাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে যাইদ ইবনে হারেছ, জাফর ইবনে আবু তালিব এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা যারা ইসলামের সেনাপতি ছিলেন শহীদ হন। শেষ পর্যন্তমুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অপারগ হয়ে পড়ে এবং মদীনায় ফিরে আসে।

৮.মক্কা বিজয় : কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তিতে মহানবী (সা.)-এর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, মুসলমান ও তাদের সাথে যারা চুক্তি বদ্ধ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তারা এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং বনি বাকর গোত্রকে খায়যা গোত্র (যারা মুসলমানদের সাথে চুক্তি বদ্ধ ছিল) তাদেরকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

রাসূল (সা.) তাদের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে রুখে দাঁড়ান। অতঃপর মক্কায় প্রবেশ করেন এবং মক্কা বিজয় হয়। তিনি খোদার ঘর যিয়ারত করেন। অতঃপর তার ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন : “জেনে রাখ, তোমরা রাসূল (সা.)-এর জন্যে অতি নিকৃষ্ট প্রতিবেশী ছিলে, তাকে অস্বীকার করেছিলে এবং তার প্রতি অত্যাচার করেছিলে। আমাদেরকে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিলে এমনকি তাতেও তুষ্ট থাকনি। মদীনাতে এবং অন্যান্য স্থানেও আমাদের বিরোধিতা করেছিলে। যেখানে যেতে চলে যাও তোমরা সকলেই স্বাধীন।

এই ক্ষমা এবং মহত্ত্বের কারণে মক্কার লোকেরা মুসলমান হয়ে যায়। এ বিজয়ে রাসূল (সা.) মুসলমানদেরকে যুদ্ধ করতে নিষেধ করেন। তবে আত্মরক্ষা এবং মুশরিকদের হামলা প্রতিহত করতে অনুমতি দেন। আর ৮ জন পুরুষ ও ৪ জন নারীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মধ্যে মাত্র ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের সেনাদল এবং মুশরিকদের মধ্যে কিছুটা দাঙ্গা দেখা দেয় এবং তাতেও কয়েক ব্যক্তি নিহত হয়।

৯.হুনাইন ও তায়েফের যুদ্ধ : হাওয়াযেন গোত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে সৈন্য গঠন করে। রাসূল (সা.) বিষয়টি জানতে পেরে ১২ হাজারের এক বাহিনী নিয়ে তাদের দিকে যাত্রা করেন এবং হুনাইনে যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত কাফেররা হেরে যায় এবং আত্মসমর্পন করে। এ যুদ্ধের পর রাসূল (সা.) তায়েফের দিকে দৃষ্টি দেন এবং ছাকিফ গোত্রকে (যারা হাওয়াযেন গোত্রের সাথে এক হয়েছিল) উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন তাদেরকে অবরোধ করে রাখার পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং মক্কায় ফিরে আসেন।

এ যুদ্ধসমূহ ব্যতীত রাসূল (সা.)-এর সময়ে কয়েকটি সফর এবং ছোট খাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

যে সামান্য সংখ্যক হতাহতের সংখ্যা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন তা কখনোই খ্রিস্টানদের বিভিন্ন ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ ও ক্রুসেডের যুদ্ধে মৃতের সংখ্যার তুলনায় খুবই নগণ্য।

পাঠক মহাদয় লক্ষ্য করেছেন যে, রাসূল (সা.)-এর কোন যুদ্ধই সীমানা বৃদ্ধি, প্রতিশোধ বা অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে ছিলনা। বরং অনুপ্রবেশ রোধ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতা রক্ষার্থে, মুসলমানদের সীমানা প্রতিরক্ষা ও সত্য প্রতিষ্ঠা করতে তা সংঘটিত হয়েছিল।

ড. গুস্তাভলুবুন, মিশুড থেকে বর্ণনা করেন :

“ইসলাম জিহাদকে ওয়াজিব করেছে কিন্তু জনগণকে অন্যন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ইনসাফ, ন্যায় বিচার ও সদয় আচরণের দাওয়াত দিয়েছে এবং সকল ধর্মকে স্বাধীনতা দিয়েছে।”

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

আল্লাহর প্রতি ইমান
মৃত্যুর পর মানুষকে কতদিন কবরে ...
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
নামাজ : আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ...
মিথ্যা কথা বলা
শিয়া মুসলমানরা কত ওয়াক্ত নামাজ ...
বারজাখের জীবন
সূরা ইউনুস;(১৬তম পর্ব)
দরিদ্রতার চেয়ে মৃত্যু ভাল
দোয়া কবুলের মাস

 
user comment