শীয়াদের ধর্মীয় চিন্তাধারা
ধর্মীয় চিন্তাধারা বলতে এখানে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা, আলোচনা ও অনুসন্ধিসাকে বোঝায়, যা ধর্ম সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রদান করে। যেমনি ভাবে গণিত সংক্রান্ত চিন্তাধারা বলতে সেই চিন্তা ধারাকেই বোঝায়, যা গণিত সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করে, অথবা গণিত সংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করে।
ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার মূল উৎস
অন্য যে কোন বিষয়ক চিন্তা ধারার মত ধর্মীয় চিন্তা ধারারও উৎস থাকা প্রয়োজন, যা থেকে চিন্তাধারা উৎসারিত হবে এবং যার উপর তা হবে নির্ভরশীল। যেমন : গণিত সংক্রান্ত কোন একটি সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে গণিত সংক্রান্ত কিছু সূত্র ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হয়, যা শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয়। ধর্মীয় চিন্তাধারার ব্যাপারে ঐশী ধর্ম ইসলাম একমাত্র যে জিনিসটিকে নির্ভরযোগ্য ও মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করেছে, তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন। পবিত্র কুরআনই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন নবুয়তের অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ। ইসলামের প্রতি আহবানই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু। অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কুরআনকে একমাত্র মূল উৎস বলার অর্থ এটা নয় যে, এ সংক্রান্ত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ্য উৎসগুলোকে অস্বীকার করা। এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব।
কুরআন নির্দেশিত ধর্মীয় চিন্তা ধারার নিয়ম-নীতি
ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছা এবং ইসলামী জ্ঞান উপলদ্ধির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা তার অনুসারীদেরকে তিনটি পদ্ধতি উপহার দেয়। সেগুলো হচ্ছে: নিষ্ঠা, দাসত্ব বা আনুগত্যের মাধ্যমে ধর্মের বাহ্যিকরূপ, বুদ্ধিমত্তাগত দলিল, ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি। ব্যাখ্যা : আমরা যদি পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাব যে, কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয় যেমনঃ তৌহীদ (একত্ববাদ),নবুয়ত, মা’আদ (কেয়ামত) এবং ব্যবহারিক আইন কাননু সংক্রান্ত বিষয়, যেমনঃ নামায, রোযা..... ইত্যাদি নিয়ম নীতিগুলো মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছে। একইভাবে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে মহান আল্লাহ স্বীয় বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। বরং স্বীয় প্রভুত্বের ক্ষমতা সেখানে খাটানো হয়েছে। মহান আল্লাহ যদি পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত তার শাব্দিক বক্তব্যগুলোকে নির্ভরযোগ্যতা (প্রামাণ্য) ও গুরুত্ব প্রদান না করতেন, তাহলে অবশ্যই তিনি মানুষের কাছ থেকে ঐ ব্যাপারে আনুগত্য কামনা করতেন না। তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলতেন যে, কুরআনের এ ধরণের সাধারণ বক্তব্যসমূহ ধর্মীয় লক্ষ্যসমুহ এবং ইসলামী জ্ঞান অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি মাত্র। আমরা পবিত্র কুরআনের এ ধরণের শাব্দিক বর্ণনা গুলোকে (ঈমান আনো আল্লাহর এবং তার রাসূলের প্রতি) ও (নামায প্রতিষ্ঠা কর) ইসলামের বাহ্যিক দিক বলে গণ্য করি। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে, পবিত্র কুরআনে তার প্রচুর আয়াত বুদ্ধিমত্তাগত প্রমাণের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পবিত্র কুরআন মানুষকে আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ এ বিশ্বে ও তাতে বসবাসরত জাতিসমুহ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ভাবনা করার আহবান্ জানায়। এ ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে সত্য প্রমাণের জন্য বুদ্ধিমত্তাগত দলিল প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত আলোচনার আশ্রয় নিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, বিশ্বের কোন ঐশী পুস্তকই পবিত্র কুরআনের মত যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষা দেয় না। পবিত্র কুরআন এসব বর্ণনার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তাগত দলিল ও স্বাধীন যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণের বিষয়কে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত বলে গণ্য করে। কুরআন কখনও প্রথমে ইসলামী জ্ঞানের সত্যতা গ্রহণ করে অতঃপর বুদ্ধিমত্তা প্রসূত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করার আহবান জানায় না। বরঞ্চ, বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা সহ কুরআন বলেঃ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যাচাই-বাছাইর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানমালা অর্জন ও গ্রহণ কর। যখন ইসলামের আহবান্ শুনতে পাবে, তখন তা যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেবে। অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানাবলী অর্জন ও গ্রহণ বা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে। প্রথমে তার প্রতি ঈমান এনে তারপর স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ আনার চেষ্টা করবে না। এরপর দার্শনিক চিন্তাধারারও পথ আছে, যা পবিত্র কুরআনও সমর্থন করে। অন্য দিকে পবিত্র কুরআন তার চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে, সকল সত্য ভিত্তিক জ্ঞানই তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয়গত জ্ঞান থেকেই উৎসারিত। পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি লাভ একমাত্র তাদের জন্যেই সম্ভব, যাদেরকে মহান প্রভু নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি নিজেই ঐ সকল বিশেষ বিশ্বাস নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন। আর তারা হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি, যারা সবার থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভুলে গেছেন। অতঃপর হৃদয়ের সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের সকল শক্তিকে একমাত্র সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিনিয়োগ করেছেন। মহাপ্রভু আল্লাহর পবিত্র জ্যোতিচ্ছটায় তারা তাদের দৃষ্টিকে জ্যোতির্ময় করেছেন। তারা তাদের বাস্তব দৃষ্টিতে বস্তু নির্ণয়ের নিগুঢ়তত্ব এবং আকাশ ও পৃথিবীর ঐশী রহস্য আবলোকন করেছেন। কারণঃ আত্মিক নিষ্ঠা ও উপাসনার মাধ্যমে তারা দৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছেন। আর ‘দৃঢ় বিশ্বাসের’ (ইয়াকীন) স্তরে উন্নতি হওয়ার কারণে এ আকাশ, পৃথিবী ও অনন্ত জীবনের গোপন রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। নিম্নলিখিত কুরআনের আয়াতগুলো এ বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে।
(ক) আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশ দিয়েছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।১ (-সূরা আল্ আম্বিয়া ২৫ নং আয়াত।)
(খ) তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র। তবে কেবল মাত্র ‘সত্যনিষ্ঠ’ বান্দারা ব্যতীত।২ (-সূরা আল্ সাফাত ১৫৯ নং আয়াত থেকে ১৬০ নং আয়াত পর্যন্ত।)
(গ) বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি পত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য। অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।৩ (-সূরা আল্ কাহাফ ১১০ নং আয়াত।)
(ঘ) এবং পালনকর্তার ইবাদত কর যে পর্যন্ত তোমার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান না আসে। (-সূরা আল্ হিজর ৯৯ নং আয়াত।)
(ঙ) আমি এ রূপেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে ছিলাম ,যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায়।৪ (-সূরা আল্ আনয়াম ৭৫ নং আয়াত।) (চ) কখনও না, নিশ্চয় সৎ লোকদের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যীনে আপনি জানেন ইল্লিয়্যীন কি? এটা লিপিবদ্ধ খাতা, আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একে প্রত্যক্ষ করে।৫ (-সূরা আল্ মুতাফফিফিন ১৮ নং আয়াত থেকে ২১ নং আয়াত পর্যন্ত ) (ছ) কখনও নয়; যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের অধীকারী হতে তবে অবশ্যই জাহান্নামকে (এই পৃথিবীতেই) দেখতে পেতে।৬ (-সূরা আত্ তাকাসুর ৫ ও ৬ নং আয়াত।)
অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হল যে, ঐশী জ্ঞান উপলদ্ধির একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও উপাসনায় আত্মিক নিষ্ঠা রক্ষা করা।
পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতির পারস্পরিক পার্থক্য পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুসারে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে,পবিত্র কুরআন ইসলামী শিক্ষা উপলদ্ধির জন্যে তিনটি পদ্ধতি (ইসলামের বাহ্যিকরূপ, বুদ্ধিবৃত্তি ও উপাসনা) উপস্থাপন করেছে। তবে এটাও জানা প্রয়োজন যে, বিভিন্ন দিক থেকে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।
প্রথমত : ইসলামের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ শরীয়তি বিধান, যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং যা সর্ব সাধারণের নাগালে রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি তার বোধশক্তির মাত্রা অনুযায়ী তা থেকে উপকৃত হয়।৭ এই প্রথম পদ্ধতিটি অন্য দুটি পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কারণ অন্য দুটি পদ্ধতি সব সাধারণের জন্যে নয়। বরং তা বিশেষ একটি গোষ্ঠিরজনে।
দ্বিতীয়ত : প্রথম পদ্ধতিটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গৌণ বা শাখা-প্রশাখাগত অংশের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। আর এর মাধ্যমে ইসলামের বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক (জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের মূলনীতি) জ্ঞান অর্জন করা যায়। তবে অন্য পদ্ধতি দুটি (বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মশুদ্ধি) এমন নয়। অবশ্য যদিও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচারগত এবং ব্যবহারিক বিষয় (শরীয়তের বিধান) সম্পর্কে সামষ্টিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। তবে ঐসবের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ও খুঁটি-নাটি ব্যাপারগুলো বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে। একইভাবে আত্মশুদ্ধির পথ, যার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের উম্নোচন ঘটে, তা হচ্ছে খোদাপ্রদত্ত একটি কাজ। খোদাপ্রদত্ত ঐ বিষয়ের পরিণতিতে বিশ্বের সকল গুপ্তরহস্য মানুষের কাছে উদঘাটিত ও দৃশ্যমান হয়, যার কোন সীমা বা পরিসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কেননা এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য সবকিছুকেই সে ভুলে যায়। ঐ অবস্থায় সে সরাসরি এবং স্বয়ং আল্লাহর বিশেষ ‘বিলায়াত’ (কর্তৃত্ব ) ও তত্বাবধানে থাকে। তখন আল্লাহ যা কিছু চান (ব্যক্তি ইচ্ছায় নয়), তাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
প্রথম পদ্ধতি : ইসলামের বাহ্যিক অংশ ও তার প্রকারভেদ
যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের শাব্দিক অংশকে এর অধ্যয়ন ও শ্রবণকারীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আর পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর বাণীকেও মাননীয় দলিল ও প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : ‘‘তোমার কাছে কুরআন অবতির্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে, যা তাদের প্রতি অবতির্ণ করা হয়েছিল।’’ (-সূরা আন্ নাহল, ৪৪ নং আয়াত।)
পবিত্র কুরআনে তিনি আরও বলেছেন : ‘‘তিনি তাদের মধ্য থেকেই (গোত্রীয়) একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসেবে। যে তাদের কাছে তার আয়াত আবৃতি করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়।’’ (-সূরা আল্ জুমআ, ২ নং আয়াত।)
আল্লাহ আরও বলেছেন : ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ।’’ (-সূরা আল্ আহজাব, ২১ নং আয়াত।)
এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে, মহানবী (সা.)-এর বাণী, আচরণ, অনুমোদন এবং নিরবতা যদি পবিত্র কুরআনের মতই আমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ না হত, তাহলে পবিত্র কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াত গুলোর অর্থ আদৌ সঠিক হত না। সুতরাং যে কেউ সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কোন বানী শ্রবণ করবে, অথবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে তার কাছে বর্ণিত হবে, তখন তার জন্যে অবশ্য অনুকরণীয় বলে গণ্য হবে। একইভাবে মহানবী (সা.)-এর ‘‘মুতাওয়াতের’’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.)-এর আহলে- বাইতের বাণীও রাসূল (সা.)-এর বাণীর মতই নির্ভরযোগ্য ও অবশ্য অনুকরণীয়। এভাবে বিশ্বস্থ সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর হাদীস দ্বারা আহলে-বাইতের হাদীসের আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রমাণিত। রাসূল (সা.)-এর আহলে-বাইতগণ ইসলামী জ্ঞান জগতের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন রয়েছেন। ইসলামী জ্ঞান ও বিধান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল। তাদের যে কোন মৌখিক বক্তব্যই আমাদের জন্যে নির্ভরযোগ্য দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ। উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলামের বাহ্যিক অংশ, যা একটি মৌলিক সূত্র বা উৎস হিসেবে গণ্য তা দু’ধরণের : (১) পবিত্র কুরআন ও (২) সুন্নাত।
এখানে ‘পবিত্র কুরআন’ বলতে, কুরআনের সুস্পষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ সম্পন্ন আয়াতগুলোকে বোঝান হচ্ছে। আর ‘সুন্নাত’ বলতে, মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীসকেই বোঝান হচ্ছে।
সাহাবীদের হাদীস
সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসও যদি মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কাজের অনুরূপ এবং পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীসের বিরোধী না হয়, তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু সাহাবীদের ঐসব হাদীস যদি তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে সাহাবীরাও অন্য সকল সাধারণ মুসলমানদের মতই। এমনকি স্বয়ং সাহাবীরাও তাদের নিজেদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের মতই আচরণ করেছেন।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে ‘মুজাদ্দিদ’ সংক্রান্ত আলোচনা
পবিত্র কুরআনই ইসলামী চিন্তাধারার একমাত্র মূলভিত্তি ও উৎসস্বরূপ। আর একমাত্র কুরআনই ইসলামের অন্যান্য মূল ভিত্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী। এছাড়া পবিত্র কুরআন নিজেকে জ্যোতি ও অন্যদের জ্যোতির্ময় হিসেবে বর্ণনা করেছে। কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে, তারা যদি সুগভীর ভাবে কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ঐ কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী কোন বিষয় খুজে পাবে না। কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে, যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে কুরআনের মুকাবেলায় কুরআনের মতই আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে আসুক। পবিত্র কুরআন যদি সর্ব সাধারণের জন্যে বোধগম্যই না হত, তাহলে মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের এধরণের বক্তব্য প্রদানই বৃথা বলে গণ্য হত। অবশ্য এটা কারও ভাবাও উচিত নয় যে, কুরআনের এ বিষয়টি (কুরআন নিজেই সকলের জন্যে বোধগম্য) এর পূর্ববর্তী বিষয়ের [মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞান ও তার নিগূঢ়তত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরোহনের মূল উৎস] সাথে অসংগতিপূর্ণ। কারণঃ ইসলামী বিধানের শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলোই সংক্ষিপ্ত আকারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আর তার বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ব্যাখার জন্যে আমাদেরকে সুন্নাত তথা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতগণের হাদীসের মুখাপেক্ষী হতে হয়। যেমন : নামায, রোযা, ক্রয়-বিক্রয়, বিচার সহ ইবাদত সংক্রান্ত সকল বিষয়েই আমাদেরকে সুন্নাত বা রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতদের হাদীসের প্রতি নির্ভর করতে হয়। আর মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ ও ব্যাখা যদিও মোটামুটিভাবে সর্ব সাধারণের বোধগম্য, তথাপি এ ব্যাপারে একমাত্র আহলে বাইতগণের (আ.) গৃহীত পদ্ধতিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখা করতে হবে। নিজেদের মনমত তাফসীর বা ব্যাখা করা যাবে না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অভ্যস্ত মনের ইচ্ছেমত ব্যাখা করা যাবে না। হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ। কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ।৮ আর মহানবী (সা.) বলেছেন : কুরআনের কিছু অংশ অন্য কিছু অংশের জন্যে ব্যাখা বা বাস্তব নমুনা স্বরূপ।৯
মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের ব্যাখা করবে, এর মধ্যে সে, নিজেই নিজের জন্যে জাহান্নামে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করবে।১০ কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের একটি সহজ উদাহরণ হল : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একস্থানে পাপিষ্ট লুত জাতির প্রতি অবতির্ণ ঐশী শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন যে, আমি তাদের উপর খারাপ বৃষ্টি বর্ষণ করেছি।১১ একই বিষয়ে কুরআনের অন্যত্র তিনি এ ব্যাপারটি শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি তাদের প্রতি পস্তর বর্ষণ করেছি।১২ এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিকে দ্বিতীয় আয়াতের সাথে মিলিয়ে নিলেই অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম আয়াতে উল্লেখিত খারাপ বৃষ্টি বলতে এখানে ঐশী প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণই বোঝানো হয়েছে। কেউ যদি সুক্ষ্ণভাবে গবেষণার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং সাহাবী ও তাবেঈন মুফাসসিরদের (তাফসীর কারক) হাদীস ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহ পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে নিঃসন্দেহে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে ব্যাখার নীতি একমাত্র পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত নীতি ছিল।
কুরআনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক
ইতিপূর্বেই আমরা জেনেছি যে, পবিত্র কুরআন তার শাব্দিক বর্ণনার মাধ্যমে স্বীয় দ্বীনি উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরে মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিষয়ে জনগণকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তবে পবিত্র কুরআনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কেবল এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত এসব বাহ্যিক শব্দাবলীর কাঠামোতে এবং ঐসব উদ্দেশ্যের অন্তরালে এক সুগভীর ও প্রশস্ততর আধ্যাত্মিক অর্থ ও উদ্দেশ্য বিরাজমান। কুরআনের ভিতর আপাতঃ লুকায়িত ঐসব গভীর আধ্যাত্মিক বিষয় শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধিকৃত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারীদের কাছেই বোধগম্য। পবিত্র কুরআনের ঐশী শিক্ষক মহানবী (সা.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনে সুন্দর ও শুভপরিণতি সম্পন্ন একটি বাহ্যিক দিক ও সুগভীর এক আভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে।১৩
মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : পবিত্র কুরআনের একটি অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে, সেই অভ্যন্তরের ও অভ্যন্তরীণ দিক রয়েছে। এভাবে কুরআন সাতটি অভ্যন্তরীণ দিকের অধিকারী।১৪ পবিত্র আহলে বাইতগণও (আ.) তাদের হাদীসে কুরআনের ঐ আভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।১৫ উপরোল্লিখিত হাদীস সমূহের মূলভিত্তি হচ্ছে কুরআনের সূরা আর রা’দের ১৭ নম্বর আয়াত ,ঐ আয়াতে মহান আল্লাহ ঐশী রহমতকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন, যা আকাশ থেকে অবতির্ণ হয়। আর ঐ বৃষ্টির উপরই নির্ভরশীল হল ভূপৃষ্ঠ ও তার অধিবাসীদের জীবন ধারণ শক্তি। ভূপৃষ্ঠের বর্ষিত ঐ বৃষ্টিধারা স্রোতাকারে প্রবাহিত হয় এবং তার প্রবাহ পথের স্থানসমূহ নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ঐ জল প্রবাহ থেকে কিছুটা গ্রহণ ও ধারণ করে এবং প্রবাহ সৃষ্টি করে। ঐ জল প্রবাহের উপরিভাগ যদিও প্রচুর ফেনা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে তথাপি তার তলদেশে রয়েছে সেই মৃতসঞ্জীবনী পানি, যা মানব জাতির জন্য অত্যন্ত উপকারী। পবিত্র কুরআনে উদ্ধৃত এই উদাহরণটি সেই ঐশী জ্ঞানধারার প্রতি ইংগিত করছে। যা থেকে মানুষ তার নিজ নিজ বোধশক্তি অনুসারে অর্জন ও ধারণ করে উপকৃত হতে পারে। আর ঐ ঐশী জ্ঞান মানুষের আধ্যাত্মিক মৃতসঞ্জীবনী স্বরূপ, যা গ্রহণ ও ধারণের মাত্রা ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য হয়। এ পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যারা, সম্পূর্ণ রূপে জড়বাদী। জড়বস্তু এবং পৃথিবীর এ নশ্বর জড়জীবন ছাড়া আর কিছুর মৌলিকত্বেই তারা বিশ্বাস করে না। এ পার্থিব ষড়রিপুর তাড়নার দাসত্ব ছাড়া জীবনে অন্য কিছুতেই তারা মন দেয় না। পার্থিব ক্ষতি ছাড়া তারা আর কিছুকেই ভয় পায় না। অবশ্য এরা ব্যক্তি বিশেষে বিভিন্ন ধরণের অবস্থার অধিকারী। ঐশী জ্ঞানমালা থেকে এরা খবু বেশী যেটুক উপকৃত হয়, তা হল, মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়ে এরা মোটামুটি ভাবে একটা ধারণা গ্রহণ বা বিশ্বাস করে। আর ইসলামের ব্যবহারিক আইনগুলোকে অত্যন্ত শুষ্কভাবে এরা পালন করে। অবশেষে এরা এক আল্লাহকে পরকালীন পুরুস্কারের লাভে এবং পরকালীন শাস্তির ভয়ে উপাসনা করে। আবার এমন অনেক লোকও আছে, যারা তাদের হৃদয়ের স্বচ্ছতা ও খোদাপ্রদত্ত স্বভাবজাত সততার কারণে পার্থিব জীবনের ক্ষণকালীন আরাম আয়েশের প্রতি কখনও আসক্ত হয় না। জীবনের লাভ-ক্ষতি, মিত্রতা ও তিক্ততা তাদের জন্য প্রতারণামূলক কল্পনা বৈ আর কিছুই নয়। প্রাগৈতিহাসিক জাতিসমূহের “স্মরণ, যা অতীতের দুনিয়ালোভীদের ইতিহাস এবং আজকের গল্প স্বরূপ, তা তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য শিক্ষা বৈ কিছুই নয়। আর ঐতিহাসিক শিক্ষা তাদের হৃদয়ে সবসময় এক প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো সেই অবিনশ্বর জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এ নশ্বর পৃথিবীর বৈচিত্রময় সৃষ্টিনিচয়কে তারা সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিদর্শনের দৃষ্টিতেই পর্যবেক্ষণ করে মাত্র। এছাড়া এসব পার্থিব বিষয়কে তারা কখনো মৌলিক ও সার্বভৌম বলে বিশ্বাস করে না। আর তখন এ আকাশ ও পৃথিবীতে অবস্থিত সব স্রষ্টার অন্তহীন ও মহত্বের নিদর্শনবাহী নতুন এক ঐশীজগতের রহস্যের দ্বার তাদের প্রানে খুলে যায়। তখনই তারা আত্মিক উপলদ্ধির চক্ষু দিয়ে সর্বস্ব অবলোকন করে। তাদের পবিত্র হৃদয়গুলো এ সৃষ্টিজগতের মূলরহস্য উপলদ্ধির প্রতি নিবদ্ধ হয়ে যায়। তখন এ পৃথিবীর লালসা আত্মলিপ্সার সংকীর্ণতায় বন্দী না হয়ে তাদের হৃদয়গুলো অন্তহীন ও মুক্ত মহাকাশে পাখা মেলে উড়তে থাকে। যখন তারা ঐশী ওহী মারফৎ শুনতে পায় যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ করেছেন; তখন এ থেকে তারা বুঝতে পারে যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করা যাবে না। কারণঃ দাসত্ব ও মাথানত করাই আনুগত্যের নিগুঢ় অর্থ। এছাড়া তারা এটাও বুঝে যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করা যাবে না এবং আর কারো প্রতি আশাও করা যাবে না। এর পর তারা এটাও বুঝতে সক্ষম হয় যে, প্রবৃত্তির চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না। আর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য কারো প্রতি মনোনিবেশ করা যাবে না। একইভাবে যখন তারা শুনতে পায় যে, পবিত্র কুরআন নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে, যার বাহ্যিকরূপ হচ্ছে একটি বিশেষ প্রকৃতির উপাসনা; তখন তারা ঐ কুরআনের আদেশের মর্মার্থ স্বরূপ কায়মনো বাক্যে মহান আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের মাধ্যমে প্রার্থনা করাকেই বোঝায়, শুধু তাই নয়, তারা সত্যের সম্মুখে নিজেকে একেবারেরই হীন ও নগন্য মনে করে এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই নিমগ্ন থাকাকে শ্রেয় বলে বিশ্বাস করে। এটা স্পষ্ট যে, উপরোল্লিখিত আদেশ ও নিষেধের উদাহরণই্ আধ্যাত্মিকতার অর্থ বহন করে না। তবে ঐ আধ্যাত্মিক তত্ব উপলদ্ধি একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব, যারা উদার দৃষ্টি ও চিন্তার অধিকারী এবং বিশ্ব দর্শনকে আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণ দর্শনের উপর অগ্রাধিকার দেয়। পূ্র্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। আর এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরআনের নিগুঢ় আত্মিক অর্থ তার বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে না। বরং কুরআনের নিগূঢ় আধ্যাত্মিক অর্থ কুরআনের আত্মার মত। এটা দেহস্থিত আত্মার ন্যায় যা দেহের সঞ্জীবনী শক্তি স্বরূপ। ইসলাম একটি সার্বজনীন ও অনন্ত ধর্ম, ইসলাম সমাজ সংশোধনের বিষয়টিকে সবার উপরে অগধিকার দেয়। ইসলামের বাহ্যিক আইনসমূহ যা সমাজ সংস্কারক স্বরূপ। আর এর সহজ মৌলিক বিশ্বাস সমূহ যা এসব বাহ্যিক আইন সমূহের সংরক্ষকও প্রহরী স্বরূপ এগুলো সবই চির অপরিবর্তনশীল। আমরা দেখতে পাই যে, অনেক সমাজের লোকেরা বিশ্বাস করে যে, মানুষের হৃদয় পবিত্র হওয়াই বড় কথা তার কার্যক্রমের প্রকৃতির কোন গুরূত্ব নেই। তাই সে সমাজের লোকেরা এক অরাজকতাপূর্ণ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে। তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে, এ ধরনের বিচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনের মাধ্যমে তারা জীবনে সফল ও সৌভাগ্যবান হবে? কিন্তু অপবিত্র কথন ও অসদাচরণের মাধ্যমে অন্তরের পবিত্রতা রক্ষা করা কি করে সম্ভব ? অপবিত্র ও নোংরা চরিত্র ও কথন থেকে পবিত্র হৃদয়ের পস্ফুটন সম্ভব কি ? তাই মহান আল্লাহ বলেছেন : ‘‘উৎকৃষ্ট শহর, তার ফসল তারই প্রতিপালকের নির্দেশে (ভাল পরিমান) উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয়।’’ (সূরা আল্ আ’রাফ ৫৮ নং আয়াত)। অর্থাৎ পবিত্র উৎস থেকেই পবিত্রের জন্ম আর অপবিত্রদের উৎস হল অপবিত্র। পূ্র্বোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পবিত্র কুরআনের একটি বাহ্যিক ও একটি আত্মিকরূপ রয়েছে। ঐ আত্মিকরূপেরও আবার বহু স্তর রয়েছে। একইভাবে পবিত্র কুরআনের ব্যাখাকারী হাদীসেরও ঐ একই ধরণের স্তর বিন্যাস রয়েছে।
কুরআনের ‘‘তা’উইল’’
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীদের অধিকাংশের মধ্যে কুরআনের ব্যাপারে একটি বিশ্বাস ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ছিল। আর তা হল এই যে, কোথাও যদি উপযুক্ত দলিল পাওয়া যায়, তাহলে কুরআনের কোন আয়াতের প্রচলিত বাহ্যিক অর্থকে ত্যাগ করে তার বিরোধী অর্থকেও সেক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে। এভাবে কুরআনের কোন আয়াতের বাহ্যিক অর্থকে তার বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত করাকেই ‘তা’ উইল’ বলা হয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধর্মীয়গ্রন্থ সমূহ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিতর্কের ঘটনা সম্বলিত গ্রন্থসমূহে এ ঘটনাটি ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হয়। যেমন : ধর্মীয় কোন একটি বিষয়ে যদি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অধিকাংশ আলেমগণ একমত হন, আর তা যদি পবিত্র কুরআনের এক বা একাধিক আয়াতের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থিও হয় তাহলে কুরআনের ঐ আয়াত বা আয়াত সমূহের বাহ্যিক অর্থকে রূপান্তরিত করেন। এভাবে অন্য কোন দলিল দ্বারাও যদি কুরআনের আয়াত বা আয়াতসমূহের বাহ্যিক অর্থের পরিপন্থি কোন বিষয় প্রমাণিত হয়, তাহলে কুরআনের ঐ বাহ্যিক অর্থকে প্রয়োজনবোধে রূপান্তরিত করেন। এমনকি অনেক সময় দেখা গেছে যে, পরস্পর বিবাদমান দু’পক্ষ নিজেদের মতামত প্রমাণের স্বার্থে এক বা একাধিক কুরআনের আয়াতকে পরস্পর বিরোধী অর্থে রূপান্তরিত (তা’উইল) বা ব্যাখা করেছে। এমনকি দঃখজনক ভাবে, এধরণের আচরণে শীয়ারাও কম-বেশী কিছুটা আক্রান্ত হয়েছে। যার উদাহরণ শীয়াদের বেশ কিছু ‘কালাম’ (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রন্ত) শাস্ত্র গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যে বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সুগভীর ভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে অর্জিত হয়, তা’হল পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট, বোধগম্য ও সুমধুর বর্ণনা পদ্ধতির মধ্যে কখনও জটিল ও ধাধাঁ সদৃশ্য পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়নি। পবিত্র কুরআন তার বিষয়বস্তু শাব্দিক কাঠামোর গণ্ডি ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে বর্ণনা করেনি। কিন্তু পবিত্র কুরআনের ‘‘তা’উইল’’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তা কোন শাব্দিক অর্থের ব্যাপার নয়। বরং তা এমন কিছু নিগুঢ় রহস্য, যা সাধারণ মানুষের উপলদ্ধির উর্দ্ধে। আর ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও ব্যবহারিক বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান তা থেকেই উৎসরিত। হা, কুরআনের সর্বত্রই ‘‘তা’উইলের’’ অস্তিত্ব বিদ্যমান। তবে সাধারণ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে সরাসরি তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আর শব্দের মাধ্যমে তা বর্ণনার যোগ্যও নয়। শুধুমাত্র আল্লাহর নবীগণ ও এবং সকল মানবীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত আওলিয়াগণ কুরআনের ‘‘তা’উইল’’ করতে সক্ষম। তারা আত্মিক দর্শনের মাধ্যমে কুরআনের ‘‘তা’উইলের’’ নিগূঢ়তত্ব অর্জন করেন। কেয়ামতের দিন কুরআনের প্রকৃত ‘‘তা’উইলের’’ বিষয়টি সকল মানুষের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ব্যাখ্যাঃ এটা সবারই জানা যে, মানুষ তার সামাজিক জীবনের বিভিন্ন পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে ভাষার বিভিন্ন শব্দসমূহ ব্যাবহার করতে বাধ্য হয়েছে। সামাজিক জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ তার স্বজাতির কাছে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে বাধ্য। এ জন্যেই সে শব্দ ও তার কানের সাহায্য কামনা করতে বাধ্য হয়। কখনও বা কমবেশী চোখের ইশারার সাহায্যও তাকে নিতে হয়। আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাই যে, একজন বধির ব্যক্তি কখনও একজন অন্ধব্যক্তির সাথে যোগাযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। কারণঃ একজন অন্ধ যা কিছু বলে, বধির ব্যক্তি তা শুনতে পায় না। আবার বধির ব্যক্তি তার হাতের ইশারায় যা কিছু বুঝাতে চায়, অন্ধব্যক্তি তা দেখতে পায় না। তাই কোন জিনিসের নাম করণ ও ভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থই কার্যকর ছিল। বিভিন্ন বস্তু, অবস্থা ও পরিবেশর জন্য শব্দ রচিত হয়, যা আমাদের পঞ্চেন্দ্রীয় শক্তি দ্বারা নির্ভরযোগ্য। তাই আমাদের প্রতিপক্ষ যদি পঞ্চেন্দ্রীয়ের কোন একটিরও অভাব ঘটে এবং আমারা যদি ঐ বিশেষ ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন একটি শব্দের অর্থ তাকে বোঝাতে চাই, তাহলে তা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়। তখন ঐ নির্দিষ্ট বিষয়টি প্রতিপক্ষকে বোঝানোর জন্য আমরা বিভিন্ন ধরণের উদাহরণের আশ্রয় গ্রহণ করি। তবুও সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় বিহীন প্রতিপক্ষকে ঐ বিশেষ শব্দ বা বিষয়টি বোঝানো সহজ হয় না। যেমনঃ কোন জন্মান্ধকে যদি আমরা আলো বা রংয়ের ব্যাপারটি বোঝাতে চেষ্টা করি, বা কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে যদি যৌন সুখের বিষয়টি বোঝাতে চাই, তাহলে আমাদের বহু তুলনা মূলক উদাহরণের আশ্রয় নিতে হয়। তেমনি এ বিশ্ব জগতের এমন অনেক অজড় বিষয়ের অস্তিত্ব আছে, যা জড় জগতের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত । আর প্রতি যুগেই এই মানবজাতির মধ্যে হাতে গোনা অল্প ক’জন ছাড়া কেউই ঐ অজড় জগত অবলোকন ও উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়নি। আর ঐ অজড় জগতের বিষয়াদি শব্দাবলীর কাঠামোত বর্ণনা করা বা সাধারণ চিন্তাশক্তি দিয়ে তা অনুধাবন ও উপলদ্ধি করা আদৌ সম্ভব নয়। শুধুমাত্র তুলনামুলক ও সদৃশ্যসম কিছু উদাহরণ উত্থাপণ ছাড়া ঐসব বিষয়ের প্রতি ইংগিত করা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : আমি একে অবতির্ণ করেছি কুরআনরূপে, আরবী ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পার। নিশ্চয়ই এ কুরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লওহে -মাহফুজে। (-সূরা আল্ যুখরূফ, ৩ ও ৪ নং আয়াত।)
মহান আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে গোপন কিতাবে, যারা পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না। (-সূরা আল্ ওয়াকিয়াহ, ৭৭থেকে ৭৯ নং আয়াত।)
একইভাবে মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ হে আহলে বাইত মহান আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণ রূপে পূতপবিত্র করতে। (-সূরা আল্ আহযাব, ৩৩ নং আয়াত।)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের প্রকৃত ও গূঢ়অর্থ উপলদ্ধি করতে সাধারণ মানুষ অক্ষম। শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ ছাড়া রহস্য উপলদ্ধি অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। আর আল্লাহর রাসূল ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.)-ও আল্লাহর দ্বারা পবিত্র ব্যক্তিগণ।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন : ‘‘কিন্তু কথা হল এই যে, তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আরম্ভ করেছে যা (তাদের জ্ঞান বহির্ভূত) বুঝতে তারা অক্ষম। অথচ এখনো এর (তাউইল) বিশ্লেষণ আসেনি। এমনি ভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পূর্ববতীরা অতএব লক্ষ্য করে দেখ যে কেমন হয়েছে পরিণতি।’’ (-সূরা আল্ ইউনসু ৩৯ নং আয়াত।)
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেছেনঃ তারা কি এখন এর তা’ উইলের অপেক্ষায় আছে যে, এর তা’উইল প্রকাশিত হোক? যেদিন এর তা’ উইল প্রকাশিত হবে সেদিন পূর্বে যারা ভুলে গিয়েছিল, তারা বলবে : বাস্তবিকই আমাদের প্রতিপালকের পয়গম্বরগ সত্যসহ আগমন করেছিলেন। (-সূরা আল্ আ’রাফ, ৫৩ নং আয়াত।)
হাদীস সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয়ের সমাপ্তি
পবিত্র কুরআন যে, হাদীস সংক্রান্ত বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে, এ ব্যাপারে শীয়া মাযহাবসহ অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে খলিফাদের দ্বারা যে বাড়াবাড়ীর সূত্রপাত ঘটে এবং হাদীসের প্রসারের ব্যাপারে সাহাবী ও তাবেঈনরা যে বাড়াবাড়ীর আশ্রয় নেন, ফলে হাদীস শাস্ত্র এক দঃখজনক পরিণতির স্বীকার হয়। তার একদিকে খলিফা হাদীস লিখন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তা পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতেন, কখনও বা হাদীস বর্ণনাতেই বাধা প্রদান করতেন, এ কারণেই প্রচুর সংখ্যক হাদীস বিকৃতির স্বীকার হয়েছে। আবার অন্য দিকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সাহাবীগণ যারা মহানবী (সা.) এর উপস্থিতি উপলদ্ধি ও তার বক্তব্য শ্রবণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন এবং সাধারণ মুসলমান ও খলিফাদের সম্মান লাভে সক্ষম হয়েছিলেন তারা হাদীস প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে পরবর্তীতে তাদের কাজের পরিণতি এমন এক জায়গায় গিয়ে দাড়ায় যে, কুরআনের উপর হাদীসের শাসন ও প্রভুত্ব বিস্তৃত হয়। এমন কি কখনও কখনও হাদীসের মাধ্যমে কুরআনের নির্দেশও বাতিল হয়ে যেত।১৬
অনেক সময় দেখা গেছে শুধুমাত্র একটি হাদীস শ্রবণের জন্য হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রমের মত অসংখ্য ঘটনা সে যুগে ঘটেছে। সে সময় ইসলাম বিরোধী অসংখ্য ব্যক্তি বাহ্যত ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামী চেহারার অন্তরালে ইসলামের গৃহশত্রুতে পরিণত হয়। তারা অসংখ্য হাদীসের বিকৃতি সাধান ও জাল হাদীস তৈরীর মাধ্যমে হাদীস শাস্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার বিলোপ সাধান করে।১৭ হাদীস শাস্ত্রকে ঐ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি থেকে ঊদ্ধারের উদ্দেশ্যে ইসলামী পণ্ডিতগণ, ‘ইলমে রিজাল’ ও ‘ইলমে দিরায়াহ’ নামক দুটি শাস্ত্রের গোড়া পত্তন করেন। এ দুটো শাস্ত্রের মাধ্যমে সত্য হাদীসকে বিকৃত ও জাল হাদীস থেকে পৃথক করা যেতে পারে। কিন্তু শীয়া সম্প্রদায় হাদীসের সূত্র পরীক্ষার পূর্বে তাকে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে যাচাই করাকে অবশ্য করণীয় বলে বিশ্বাস করে। শীয়া সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অসংখ্য হাদীস (যার সূত্র সমূহ অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য) আমাদের কাছে এসে পৌছেছে, যাতে বলা হয়েছে যে, কুরআন বিরোধী যে কোন হাদীসই মূল্যহীন।১৮ আর যে হাদীস কুরআনের বিষয়বস্তুর অনুকুলে একমাত্র তাই নির্ভরযোগ্য। আর এ ধরণের হাদীসের কারণে যেসব হাদীস কুরআনের পরিপন্থি, শীয়ারা তা মানা থেকে বিরত থাকে।১৯ একইভাবে যেসব হাদীস পবিত্র কুরআনের পরিপন্থি বা অনুকুলে হওয়ার বিষয় সুস্পষ্ট নয়, পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্দেশ অনুযায়ী সেসব হাদীস গ্রহণ বা বর্জনের ব্যাপারে তারা নীরবতা অবলম্বন করে। অবশ্য শীয়াদের মধ্যেও এমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা আহলে সুন্নাতের অনেকের মতই কোন যাচাই বাচাই ছাড়াই যে কোন হাদীস পাওয়া মাত্রই তার অনুসরণ করে থাকে।
হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি
মহানবী (সা.) অথবা পবিত্র আহলে বাইতের যেসব হাদীস কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি তাদের কাছ থেকে শোনা হয়ে থাকে, তা কুরআনের নির্দেশের মতই মর্যাদা সম্পন্ন। কিন্তু যেসব হাদীস বিভিন্ন মাধ্যম পেরিয়ে আমাদের হাতে এসেছে, সে সব হাদীস অনুসরণের ক্ষেত্রে শীয়াদের নীতি নিম্নরূপ:
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগত জ্ঞানের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ, ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস (যা সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দেয়) অথবা যে হাদীস অত্যন্ত বিশ্বস্থ কোন সূত্রে অর্জিত হয়েছে, তাই অনুসরণযোগ্য। উপরোক্ত দু’প্রকার হাদীস ছাড়া অন্য সব হাদীস (যেমন : খাবারে ওয়াহিদ) তেমন একটি নির্ভরযোগ্য নয়। তবে ইসলামী বিধানের কোন আইন প্রণয়ন২০ বা প্রমাণের ক্ষেত্রে দলিল হিসাবে ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস ছাড়াও বিশ্বস্থ অ-মুতাওয়াতির (খাবারে ওয়হিদ) হাদীসও গৃহীত হয়ে থাকে। সুতরাং ‘মুতাওয়াতির’ যা বিশ্বস্থ সূত্রে বর্ণিত হাদীস শীয়াদের নিকট সম্পূর্ণ রূপে প্রমাণ্য দলিল স্বরূপ । আর তা অবশ্য অনুসরণীয় । আর অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীস, যদি আস্থাযোগ্য হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র ইসলামী আইনের ক্ষেত্রেই প্রমাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য হবে।
তথ্যসূত্র :
১. ইসলামে আল্লাহর ইবাদত তার একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাসের একটি অংশ এবং তার উপর ভিত্তি করেই তা গঠিত হয়ে থাকে। এটাই উল্লেখিত কুরআনের আয়াতের মর্মার্থ ।
২. যথার্থ গুণকীর্তন সঠিক উপলদ্ধির উপরই নির্ভরশীল। উক্ত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, একমাত্র ‘মুখলাস’ (পরম নিষ্টবান ব্যক্তি) এবং আত্মশুদ্ধি সম্পন্ন পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত কেউই সর্বস্রষ্টা অল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভে সক্ষম হবে না। আর মহান অল্লাহ্ অন্যদের দ্বারা বিশেষিত হওয়া থেকে পবিত্র।
৩. উক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্যে তার একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস আনয়ন ও সৎকাজ সম্পাদন ছাড়া আর কোন পথ নেই।
৪. উক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহর প্রকৃত ইবাদত ও আনুগত্য ‘নিশ্চিত বিশ্বাসের’ স্তরে উন্নত হওয়ারই ফসল।
৫. উক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, নিশ্চিত বিশ্বাসের (ইয়াকীন) স্তরে উপনীত হওয়ার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে পৃথিবী ও আকাশের প্রকৃত রূপের রহস্য অবলোকন।
৬. উক্ত আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সৎকাজ সম্পাদনকারীদের স্থান হবে বেহেস্তের ‘ইল্লিয়্যিন’ (অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থান) নামক স্থানে, যা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই অবলোকন করবেন। এখানে ‘বই’ বলে লিখিত কোন পুস্তককে বুঝানো হয়নি। বরং তা দিয়ে উন্নত ও নৈকট্যের জগতই বুঝানো হয়েছে।
৭. এ ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীস আছে, যা শীয়া ও সুন্নী উভয় গোষ্ঠি থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ ‘‘আমরা নবীরা মানুষের সাথে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির পরিমাণ অনুযায়ী কথা বলে থাকি।’’ (বিহারূল আনোয়ার, ১ম খণ্ড, ৩৭ নং পৃষ্ঠা। উসুলে কাফী, ১ম খণ্ড, ২০৩ নং পৃষ্ঠা।)
৮. নাহজুল বালাগা, ২৩১ নং বক্তৃতা।
৯. দুররূল মানসুর, ২য় খণ্ড, ৬নং পৃষ্ঠা।
১০. তাফসীরে সাফী, ৮ নং পৃষ্ঠা ও বিহারূল আনোয়ার ১৯ তম খণ্ড, ২৮ নং পৃষ্ঠা।
১১. সূরা আশু শুয়ারা, ১২৭ নং আয়াত।
১২. সূরা আল হিজর, ৭৪ নং আয়াত।
১৩. তাফসীরে সাফী, ৪নম্বর পৃঃ ।
১৪. সাফিনাতুল বেহার তাফসীরে সাফী, ১৫ নম্বর পৃঃ এবং অন্যসব তাফসীর গ্রন্থেও মুরসাল স্বরূপ মহানবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, কাফী, তাফসীরে আইয়াশী ও মা’আনী আল আখবার গ্রন্থেও এজাতীয় রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে।
১৫. বিহারুল আনওয়ার, ১খণ্ড, ১১৭পঃ।
১৬. হাদীসের দ্বারা কুরআনের আয়াত বাতিল হওয়ার বিষয়টি ‘ইলমুল উসুলের’(ইসলামী আইন প্রণয়নে মূলনীতি শাস্ত্র) আলোচ্য বিষয়। আহলুস সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আলেমদের একাংশের মতে হাদীসের দ্বারা কুরআনী আইন রহিত হওয়া সম্ভব। প্রথম খলিফাও যে, এ মতেরই অনুসারী ছিলেন, তা ‘ফিদাকের’ ব্যাপারে তার ভূমিকা তাই প্রমাণ করে।
১৭. এ বিষয়ের সাক্ষী সরূপ, হাদীস সংক্রান্ত বিষয়ের উপর আলেমগণের লিখিত অসংখ্য গ্রন্থই যথেষ্ট। এ ছাড়া ‘ইলমে রিজাল’ (হাদীস বর্ণনাকারীদের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা শাস্ত্র) সংক্রান্ত গ্রন্থ গুলোতে হাদীসের অনেক বর্ণনাকারীকেই মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারী হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে।
১৮. বিহারূল আনোয়ার, ১ম খণ্ড, ১৩৯ নং পৃষ্ঠা।
১৯. বিহারূল আনোয়ার, ১ম খণ্ড, ১১৭ নং পৃষ্ঠা।
২০. ‘খাবারে ওয়াহিদের’ (অ-মুতাওয়াতির হাদীস) দলিল হওয়ার যোগ্যতার আলোচ্য অধ্যায় দ্রষ্টব্য। এটা ইলমে উসুলের (ইসলামী আইন প্রণয়নের মূলনীতি শাস্ত্র ) আলোচ্য বিষয়।