বাঙ্গালী
Saturday 27th of July 2024
0
نفر 0

ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-শেষ পর্ব

ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-শেষ পর্ব

ইমামীয়া জাফরী মাজহাবের আকিদা বিশ্বাস :

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

(৩১) জাফরী শিয়ারা আল্লাহর রাসুল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণের শাফায়াত প্রার্থনা করে ও তাঁদের উসিলা দিয়ে মহান আল্লাহর নিকট তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা,রোগমুক্তি এবং মনের ইচ্ছা পূরণের জন্য দোয়া চায়। কারণ কোরআন শুধু এ জন্য অনুমতিই দেয়নি বরং সকলকে এরূপ করার জন্য আহবান জানিয়ে বলেছে :

وَلَو أنَهُم إذ ظَلَمُوا أنفُسَهُم جآءُوك فاستَغفِرُوا اللهَ واستغفرَ لهم الرَسُولُ لوَجَدُوا اللهَ توَّاباً رّحيماً

“এবং যখন তারা নিজেদের উপর জুলুম করেছিল তখন যদি রাসুলের কাছে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন,তবে আল্লাহকে তারা তওবা গ্রহণকারী ও দয়ালু হিসেবে পেত।”

অন্যত্র বলেছে :

وَلَسَوفَ يُعطِيك رَبُّك فَتَرضی

“তোমার প্রভু অতি নিকটেই তোমাকে এতটা দিবেন যে তুমি তাতে সন্তুষ্ট হবে।”

শাফায়াত করার মহান মর্যাদার কথাই এ আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে। কিরূপে সম্ভব মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে গোনাহগারদের জন্য শাফায়াতের অধিকার ও মর্যাদা দিয়ে এবং তাকে বান্দাদের মনের ইচ্ছা পূরণের উসিলা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে তার হতে শাফায়াত চাইতে বারণ করবেন অথবা তাঁর নবীকে এ মর্যাদাকর পদের ব্যবহারে বাধা দিবেন?

মহামহিম আল্লাহ কি হযরত ইয়াকুবের (আ.) সন্তানদের বিষয়ে বর্ণনা করেননি যে তারা তাদের পিতার নিকট শাফায়াত চেয়েছিল এ বলে যে,

يَا اَبانا استَغفِرلَنَا ذُنُوبَنَا إنَّا کُنَّا خاطِئِينَ

“হে আমাদের পিতা,আমাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আমরা অন্যায়কারী”

কিন্তু আল্লাহর সম্মানিত ও নিষ্পাপ নবী ইয়াকুব (আ.) তাদের একথায় কোন আপত্তি তো জানানই নি বরং বলেছেন :

سَوفَ اَستَغفِرُ لَکُم

“তোমাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) ক্ষমা চাইব”

কোন ব্যক্তির পক্ষেই এ দাবী করা সম্ভব নয় যে নবী ও ইমামগণ (আ.) মৃত,তাই তাদের নিকট দোয়া চাওয়া অর্থহীন। কারণ নবীগণ বিশেষতঃ মহানবী (সা.) জীবিত। পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াত এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে :

وَ کَذَلِك جَعَلناکُم اُمّةً وَسَطاً لِتَکُونُوا شُهداء عَلی النَّاسِ وَ يَکُونَ الرَّسُولُ عَلَيکُم شَهِيداً

“এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতি করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্যে এবং যাতে রাসুল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।”

অন্যত্র বলেছেন :

وَ قُلِ اعمَلُوا فَسَيَرَی اللهُ عَمَلَکُم وَ رَسُولُهُ وَالمُؤمِنون

“তোমরা তোমাদের কাজ কর নিশ্চয়ই আল্লাহ,তাঁর রাসুল,ও মুমিনগণ তোমাদের কর্মসমূহ দেখবেন।”

এ আয়াতসমূহ কিয়ামত পর্যন্ত অর্থাৎ যতদিন সূর্য,চন্দ্র এবং দিবা-রাত্রির আবর্তন থাকবে ততদিন অব্যাহত ও কার্যকরী থাকবে।

তাছাড়া মহানবী (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ হলেন শহীদ এবং শহীদেরা জীবিত যেমনটি আল্লাহ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বলেছেন।

(৩২) জাফরী শিয়ারা মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের (আ.) জন্মদিনে উৎসব এবং মৃত্যুদিবসে শোক পালন করে। তারা এ দিবসগুলিতে তাদের মর্যাদা,গৌরবময় ভূমিকা ও অবদানসমূহ নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে বর্ণনা করে থাকে। এ কাজটি তারা পবিত্র কোরআনের -যাতে মহানবী (সা.) সহ অনেক নবীরই মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা করেছে ও ঐ বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে তাদের প্রশংসা করেছে এবং এর মাধ্যমে দৃষ্টিসমূহকে সেগুলোর প্রতি নিবদ্ধ করেছে যাতে করে তাদের বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ করে ও জীবনী হতে  শিক্ষা লাভ করে-অনুসরণে করে ।

অবশ্য জাফরী শিয়ারা এ সকল উৎসবে হারাম কর্ম হতে বিরত থাকে যেমন- নারী-পুরুষের মিশ্রণ,নিষিদ্ধ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ,নবী ও ইমামদের অতিরঞ্জিত প্রশংসা যা তাদেরকে স্রষ্টা,উপাস্য বা প্রতিপালকের পর্যায়ে পৌঁছানোর নামান্তর এবং এরূপ ইসলামের পবিত্র শরীয়তের বিধান পরিপন্থী ও সুস্পষ্ট সীমা বহির্ভূত যে কোন বিষয় যা কোরআনের আয়াত,নির্ভরযোগ্য ও সহীহ হাদিস এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে হস্তগত নির্ভরযোগ্য সর্বজনীন দলিলের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তা অবশ্যই পরিত্যাগ করে।

(৩৩) জাফরী শিয়ারা মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের বাণী ও হাদিসসমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ হতে উপকৃত হয়ে থাকে,যেমন : সিকাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনী রচিত ‘আল কাফী’,শেখ সাদু’ক রচিত ‘মান লা ইয়াহজারুহুল ফাকি’  আল্লামা শেখ তুসী রচিত ‘আল ইসতিবসার’ ও ‘আত তাহজীব’ গ্রন্থ চারটি শিয়া হাদিসশাস্ত্রের অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

যদিও এই গ্রন্থসমূহ সহীহ হাদিসসমূহে পূর্ণ তদুপরি তাদের রচয়িতা ও সংকলকগণ এমনকি কোন জাফরী শিয়াই এই হাদিসগ্রন্থগুলোকে সহীহ নামকরণ করেননি। একারণেই শিয়া ফকিহগণ এই গ্রন্থসমূহের সকল হাদিসকে সহীহ অভিহিত করেন না এবং সহীহ বলে মানতেও বাধ্য নন। বরং তারা দলিল ও সনদ যাচাই-বাছাইয়ের পর সহীহ বলে প্রতিপন্ন হলে তখনই তা সহীহ বলে মেনে নেন এবং যা সহীহ বা হাসান হাদিস,রিজাল ও দেরায়াশাস্ত্রের নীতির ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য অন্যান্য প্রকারগুলির অন্তর্ভুক্ত না হয় তা পরিত্যাগ করেন।

(৩৪) তারা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ,দোয়া ও নৈতিকতা বিষয়ে আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ হতে বর্ণিত বিভিন্ন বক্তব্য ও বাণীসমূহ যা হাদিসগ্রন্থ ব্যতিত অন্যান্য গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকেও মূল্য দেয় যেমন সাইয়েদ আর রাজী (র.) সংকলিত ‘নাহজুল বালাগা’ যা আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) এর বক্তৃতামালা,পত্র ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বাণীসমূহের সমাহার।

অনুরূপ ইমাম আলী ইবনে হুসাইন যাইনুল আবেদীনের দোয়াসমূহের সংকলন ‘সাহীফাতুস সাজ্জাদিয়া’ ও ‘অধিকার ও কর্তব্য’ বিষয়ক দিকনির্দেশনামূলক পুস্তিকা ‘রিসালাতুল হুকুক’,ইমাম আলীর বাণী সমৃদ্ধ ‘সাহীফাতুল আলাভীয়াহ শেখ সাদু’ক (র.) সংকলিত ইমামদের হতে বর্ণিত হাদিস সমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ যেমন : উয়ুনু আখবারির রেজা,আত তাওহীদ,আল খিসাল,ইলালুশ শারায়ে,মাআনীল আখবার প্রভৃতি। (এই গ্রন্থগুলির কোনটি আকীদা বিষয়ক,কোনটি আখলাক বা নৈতিকতা বিষয়ক,কোনটি বা সামাজিক,পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনের দিক নির্দেশনামূলক।)

(৩৫) কখনও কখনও জাফরী শিয়ারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের হাদিস গ্রন্থে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত সহীহ হাদিসসমূহের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে এবং কোনরূপ গোঁড়ামী,অহংকার ও সংকীর্ণতা ছাড়াই তারা তা গ্রহণ করে। তাদের রচিত প্রাচীন ও বর্তমান গ্রন্থসমূহ এর সাক্ষ্য বহন করছে। এ হাদিসসমূহের মধ্যে মহানবীর (সা.) স্ত্রীগণ,প্রসিদ্ধ সাহাবীগণ,বহুল বর্ণনার রাবীগণ যেমন আবু হুরায়রা,আনাস ইবনে মালিক ও অন্যান্যদের বর্ণিত হাদিসসমূহ রয়েছে। শিয়ারা যে হাদিসগুলো সহীহ এবং কোরআন,সহীহ হাদিসসমূহ,সঠিক বুদ্ধিবৃত্তি ও আলেমদের সর্বসম্মত মতের বিরোধী না হয় তা গ্রহণ করতে কোন দ্বিধা করে না।

(৩৬) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে বর্তমান পর্যন্ত মুসলমানদের উপর যত কষ্ট,বিপদ ও বিপর্যয় এসেছে তার কারণ হল এ দু’টি-

প্রথমতঃ মহানবীর (সা.) আহলে বাইতের নেতৃত্বকে উপেক্ষা,তাঁদের নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণকে অগ্রাহ্য করা বিশেষতঃ কোরআনের ক্ষেত্রে তাঁদের বর্ণিত ব্যাখ্যা ও তাফসীর হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের বিভিন্ন দল ও মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য,বিভেদ ও সংঘর্ষ।

একারণেই জাফরী শিয়ারা সবসময় প্রচেষ্টা চালিয়েছে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন দলের মাঝে ঐক্য স্থাপন করার এবং সকল মাজহাব ও দলের প্রতিই তারা ভ্রাতৃসুলভ ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে,বিভিন্ন দল ও মাজহাবের আলেমদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে।

এ লক্ষ্যেই জাফরী শিয়ারা ইসলামের প্রথম যুগ হতেই তাদের তাফসীর,কালাম ও ফিকাহ শাস্ত্রের গ্রন্থগুলিতে আহলে সুন্নাতের আলেমদের মতামতকে এনেছেন। যেমন-শেখ তুসী তার ‘খেলাফ’ গ্রন্থে আহলে সুন্নাহর আলেমদের ফিকহী মত সমূহ উল্লেখ করেছেন,আল্লামা তাবারসী তার তাফসীর গ্রন্থ ‘মাজমাউল বায়ানে’ তাদের তাফসীর বিষয়ক মতসমূহ এনেছেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমগণ এ কর্মের জন্য তাঁর প্রশংসা করেছেন।

অনুরূপ দেখা গেছে শিয়া আলেমদের গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ কোন সুন্নী আলেম রচনা করেছেন যেমন শেখ নাসিরুদ্দীন তুসীর ‘তাজরীদুল ইতিকাদ’ নামক আকীদা বিষয়ক গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ সুন্নী আলেম আলাউদ্দীন আল কুশজী রচনা করেছেন যিনি আশআরী চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন।

(৩৭) জাফরী শিয়াদের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ সবসময়ই ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবগুলির মধ্যে আকীদা,ফিকাহ ও ইতিহাসগত বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং মুসলমানদের সময়সাময়িক সমস্যার সমাধানে পারস্পরিক মত বিনিময়ে আগ্রহী। সেই সাথে একে অপরকে অপবাদ দান,মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা,কটূক্তি ও গালিগালাজের মাধ্যমে পরিবেশ বিষাক্ত করা হতে বিরত থাকাকে অপরিহার্য মনে করে যাতে করে ইসলামী উম্মাহর পরস্পর বিচ্ছিন্ন দল ও অংশগুলোর মধ্যে যুক্তিপূর্ণ সমঝোতা ও ঐক্যের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সেই শত্রুদের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় যারা মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য ও বিভেদের ক্ষেত্রগুলোর অনুসন্ধানে রয়েছে যা কাজে লাগিয়ে সমগ্র উম্মাহর উপর বিনাশী হামলা চালানো যায়। এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোন দলকেই তারা ছাড় দিবে না। একারণেই জাফরী শিয়ারা এক আল্লাহ ও শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি বিশ্বাসী এবং কাবাকে কিবলা হিসেবে গ্রহণকারী কোন মুসলমানকেই কাফের বলে না,এ ক্ষেত্রে সে যে কোন মাজহাবেরই অনুসারী হোক বা যে কোন আকীদা বিশ্বাসই পোষণ করুক যদি না সে সমগ্র উম্মাহর সাধারণ মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী বিশ্বাস রাখে যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এরূপ মুসলমানদের প্রতি শিয়ারা কখনও শত্রুতা পোষণ করেনা,তাদের উপর কোন রকম আক্রমণকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং ইসলামের প্রতিটি দল ও মাজহাবের ইজতিহাদী মতকে তারা সম্মান করে। যদি অন্য কোন মাজহাবের অনুসারী জাফরী ফিকাহ ও শিয়া ইমামীয়া বিশ্বাসকে গ্রহণ করে সে ক্ষেত্রে যদি তার নামাজ,রোজা,হজ,জাকাত,বিবাহ,তালাক,ক্রয়-বিক্রয় সহ সকল কর্ম পূর্ববর্তী ফিকাহ অনুযায়ী সঠিকভাবে করে থাকে তবে তাকে ঐ আমলগুলোকে পুনরায় আদায় করতে হবে না। (কোন কোন মুজতাহিদের মতে) যে ওয়াজিবসমূহ কাজা হয়েছে তাও আদায় করতে হবে না। অনুরূপ তার পূর্ব অনুসৃত মাজহাবের বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন বিবাহ ও তালাকও পুনরায় কার্যকর করার প্রয়োজন নেই।

ইমামীয়া শিয়ারা তাদের মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে সকল স্থানেই ভ্রাতা ও নিকটাত্মীয়ের ন্যায় সৌহার্দ ও সুসম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করছে।

কিন্তু তারা কোন অবস্থাতেই সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা সৃষ্ট বিকৃত সম্প্রদায়-গুলোকে (বাহায়ী,বাবী,কাদিয়ানী ও এতদসদৃশদের) প্রশ্রয় দেয় না বরং তাদের কঠোর বিরোধিতা করে ও অনুরূপ চিন্তার বিস্তিৃতির পথে শক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসী।

যদিও জাফরী শিয়ারা কোন কোন ক্ষেত্রে তাকীয়ার নীতি গ্রহণ করে। তাকীয়ার অর্থ হল যে,তাদের মাজহাবে তারা যা বিশ্বাস করে বিশেষ ক্ষেত্রে তা গোপন করা। এটি কোরআন ঘোষিত একটি বৈধ ও শরীয়ত সম্মত নীতি যা ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের মধ্যে প্রচলিত একটা পন্থা যা তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংঘর্ষ এড়াতে গৃহীত হয়ে থাকে। দু’টি লক্ষ্যে তা করা হয় :

প্রথমতঃ নিজেদের জীবন রক্ষায়,যাতে করে বৃথা রক্তপাত এড়ানো যায়।

দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের ঐক্যের স্বার্থে যাতে করে তাদের সংহতিতে কোন ফাটল সৃষ্টি না হয়।

(৩৮) জাফরী শিয়ারা লক্ষ্য করেছে বর্তমানে মুসলমানরা পিছিয়ে থাকার কারণ তাদের চিন্তাগত,সাংস্কৃতিক,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা। এক্ষেত্রে আরোগ্য ও মুক্তির রহস্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জাগ্রত হওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং তাই তাদের জ্ঞান,চিন্তা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়,একাডেমী প্রতিষ্ঠা এবং সেখানে শিল্প,স্থাপত্য,প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান দান করার মাধ্যমে তাদেরকে কার্যক্ষেত্রের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এর ফলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও কর্মপ্রেরণা সৃষ্টি হবে এবং তারা স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে বিজাতীয়দের উপর নির্ভরতা ও অনুকরণ হতে চিরতরে মুক্তি লাভ করবে।

এ কারণেই প্রথম হতেই জাফরী শিয়ারা যেখানেই গিয়েছে ও বসতি স্থাপন করেছে সেখানেই শিক্ষা ও জ্ঞানকেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং বিভিন্ন জ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ তৈরীর নিমিত্তে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে। আবার তেমনি প্রতিটি দেশেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী হয়ে প্রবেশ করেছে এবং তাদের মধ্য হতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও কৌশলীরা বেরিয়ে এসেছে যারা উন্নত ও শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানকেন্দ্রসমূহ স্থাপন করেছে।

(৩৯) জাফরী শিয়ারা আহকামের বিষয়ে অনুসরণের (তাকলিদ) ক্ষেত্রে তাদের আলেম ও ফকিহদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তারা তাদের নিকট হতে ফিকাহগত সমস্যার সমাধান লাভ করে এবং জীবনের সকল দিক ও ক্ষেত্রে  তাদের ফকিহদের মতানুসারে আমল করে। কারণ তাদের বিশ্বাস হল ফকিহগণ পবিত্র ইমামদের ধারার সর্বশেষ ইমামের সাধারণ প্রতিনিধি।

অন্যদিকে যেহেতু শিয়া ফকিহ ও আলেমগণ তাদের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের উপর নির্ভরশীল নন সেহেতু এই মাযহাবের অন্তর্ভুক্তদের নিকট তাঁরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বিশেষ মর্যাদাশীল।

জাফরী শিয়াদের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র গুলো -যেখান হতে ফকিহগণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেন- তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন জনগণের স্বেচ্ছায় স্বতস্ফূর্তভাবে দেয়া খুমস ও জাকাতের টাকায় পূরণ করে থাকে এবং এ অর্থ দানকে (আলেমদের নিকট খুমস ও জাকাত অর্পণ) তারা নামাজ ও রোজার মতই ওয়াজিব ও শরয়ী বিধান বলে জানে।

জাফরী শিয়াগণ যে ব্যবসার লভ্যাংশ ও যেকোন উপার্জিত অর্থ হতে খরচের পর বিদ্যমান অবশিষ্টাংশের এক পঞ্চমাংশ (খোমস) দানকে ওয়াজিব মনে করে যার সপক্ষে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে। এরূপ কিছু দলিল সিহাহ সিত্তাহ ও সুনান গ্রন্থসমূহেও উদ্ধৃত হয়েছে। (এ জন্য শিয়া ফকিহদের লিখিত দলিল সমৃদ্ধ খুমস বিষয়ক গ্রন্থসমূহ দেখুন)

(৪০) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে মুসলমানদের অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকা উচিত যা মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার করবে,অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে ন্যায়ভিত্তিক সুসম্পর্ক বজায় রাখবে,ইসলামের পবিত্র সীমার রক্ষক হবে,মুসলমানদের অর্থনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করবে। এর ফলে মুসলমানরা সম্মানিত হবে ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে যেমনটি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

لِلّهِ العِزةُ وَ لِرَسُولِهِ وَ لِلمُؤمِنِين

“নিশ্চয়ই সম্মান হল আল্লাহ,তাঁর রাসুল ও মুমিনদের জন্য।”

মুমিনদের উদ্দেশ্যে অন্যত্র বলা হয়েছে :

وَ لا تَهِنُوا وَ لا تَحزَنُوا وَ أنتُم الاعلَونَ إن کُنتُم مُؤمِنِين

“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও।”১০

শিয়ারা বিশ্বাস করে যেহেতু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন সেহেতু তা রাষ্ট্র পরিচালনার সুক্ষ্মতম পদ্ধতি ও রূপটি মানবতার জন্য উপস্থাপন করেছে। এজন্যই ইসলামী উম্মাহর আলেম ও চিন্তাবিদদের উচিত পূর্ণতম রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামোর ইসলামের উপস্থাপিত রূপটিকে উদ্ঘাটনে সমবেতভাবে গবেষণায় লিপ্ত হওয়া ও তার দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করা। এর ফলে মুসলিম উম্মাহ তাদের অপরিসীম সমস্যা ও হত-বিহবল অবস্থা হতে মুক্তি পাবে। মহান আল্লাহ একমাত্র সহায় ও সাহায্যকারী।

وَ إن تَنصُرُوا اللهَ يَنصُرکُم وَ يُثَبِّت اَقدَامَکُم

“এবং তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদক্ষেপকে দৃঢ় রাখবেন।”

ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এটিই ইমামীয়া শিয়া বা জাফরী শিয়াদের অনুসৃত পথ।

এই মাজহাবের অনুসারীরা বিশ্বের সকল মুসলিম দেশে তাদের স্বধর্মী মুসলিম ভাইদের সাথে সহাবস্থান করছে। তারা মুসলমানদের সম্মান ও মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে ও রক্ষায় আগ্রহী এবং এ পথে তাদের জীবন ও সম্পদ বিলিয়ে দিতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

 

সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য।

 

তথ্যসূত্র :

১। সূরা আন নিসা ৬৪।

২। সূরা দ্বোহা ৫।

৩। সূরা ইউসুফ ৯৭-৯৮।

৪। সূরা ইউসুফ ৯৮।

৫। সূরা বাকারা ১৪৩।

৬। সূরা তাওবাহ ১০৫।

৭। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে স্বাধীনভাবে তারা কিছু করতে পারেন এমন বিশ্বাস রাখা যেমনটি ইহুদী ও খৃষ্টানরা নবীদের বিষয়ে করে থাকে।

৮। এখানে উল্লেখ্য যে,ইমামীয়া শিয়াগণও আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তারা মহানবীর (সা.) কাওলী (قَولی) ফেলী (فِعلِی) ও তাকরীরী (تَقريری) সকল সুন্নাতের অনুসরণ করে। মহানবীর (সা.) অন্যতম নির্দেশ ও অসিয়ত ছিল এটাই যে,তাঁর আহলে বাইতের নির্দেশকে আঁকড়ে ধরা। আর তাই তারা তাঁদের নির্দেশকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যথার্থভাবে পালন করে থাকে। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হল তাদের কালামশাস্ত্র,ফিকাহ ও হাদীস গ্রন্থসমূহ। সম্প্রতি রাসুল করিম (সা.) হতে শিয়া সূত্রে বর্ণিত হাদিসসমূহের সমন্বয়ে দশাধিক খণ্ডের বৃহৎ এক গ্রন্থ ‘সুনানুন্নাবী’ (সা.) নামে প্রকাশিত হয়েছে।

৯। সূরা মুনাফিকুন ৮।

১০। সূরা আলে ইমরান ১৩৯।

 

(হুজ্জাতুল ইসলাম জাফর আল হাদী লিখিত, আবুল কাসেম অনূদীত “সত্য পরিচয়” গ্রন্থ থেকে সংকলিত )

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কুরআন ও হাদীসের আলোকে হিংসা ও লোভ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো ...
যাকাত
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সম্পদ
ইসলামী বিচার পদ্ধতি
কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও ...
ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-শেষ পর্ব
শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ...
সফলতার অন্যতম একটি কারণঃ ধৈর্য
হামলার আশঙ্কা, পাকিস্তানের ...

 
user comment