হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম তৃতীয়াংশের শেষদিকে উমাইয়া খলিফাদের চরম নির্যাতন ও অসদাচরণের পরিণতিতে সকল ইসলামী দেশ গুলোতে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিদ্রোহ, বিপ্লব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। এর পাশাপাশি ইরানের খোরাসান প্রদেশে একদল লোক জনগণকে ‘আহলে-বাইতের’ অধিকার আদায়ের আন্দোলনের আহবান জানাতে থাকে। জনাব ‘আবু মুসলিম মারওয়াযি’ নামক জনৈক ইরানী সর্দার ছিলেন ঐ আন্দোলনের নেতা। তারা উমাইয়া খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং ক্রমেই তাদের আন্দোলন অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। অবশেষে তারা উমাইয়াদেরক ক্ষমতাচ্যুত করতে সমর্থ হয়।১ ঐ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে পক্ষে শীয়াদের সুগভীর প্রচার অভিযান থেকেই উৎসরিত হয়েছিল। আহলে-বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের নামেই ঐ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। এমন কি জনগণ নবীবংশের জনৈক জনপ্রিয় ব্যক্তির হাতে গোপনে ‘বাইয়াত’ (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে শীয়া ইমামগণের (আ.) সরাসরি কোন নির্দেশ বা ইংগিত ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন জনাব আবু মুসলিম মদিনায় ইমামিয়াপন্থী শীয়াদের ৬ষ্ঠ ইমামের (হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)) কাছে খেলাফতের জন্যে গৃহীত ‘বাইয়াত’ সম্পূর্ণ করতে চান।
হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তৎক্ষনাৎ ঐ প্রস্তাব পত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেনঃ ‘‘তুমি আমার লোকদের অন্তর্ভুক্ত নও। আর সময়ও এখনও আসেনি’’।২ অবশেষে আব্বাসীয় বংশের লোকেরা আহলে-বাইতের নাম ভাংগিয়ে খেলাফতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়।৩ তারা শাসন ক্ষমতা লাভের পর প্রথম দিকে জনগণ ও হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী শীয়াদের সাথে সদাচরণ করতে থাকে। এমন কি ‘আলাভীদের’ (শীয়াদের) শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের নামে তারা উমাইয়া বংশীয় লোকদের গণহত্যা চালায়। তারা উমাইয়া খলিফাদের কবর খুড়ে তাদের দেহাবশেষে যা কিছু পেত অগ্নিদগ্ধ করত।৪ কিছুদিন কাটতে না কাটতেই তারা উমাইয়া খলিফাদের মতই নিপীড়নমূলক নীতি গ্রহণ করে। অন্যায় অত্যাচার মূলক ও নীতিহীন কার্যকলাপ ঘটাতে তাদের এতটকু কন্ঠাবোধও হল না। আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের দ্বারাই আহলে সুন্নাতের ইমাম আবু হানিফা জেল বন্দী হন।৫ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালও জনৈক আব্বাসীয় খলিফার দ্বারা চাবুকে প্রহৃত হন।৬ শীয়াদের ৬ষ্ঠ ইমাম হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ও আব্বাসীয় খলিফার দ্বারা নির্যাতিত হন এবং বিষ প্রয়োগে নিহত হন।৭ আব্বাসীয় খলিফারা শীয়াদের দলে দলে হত্যা করে। অনেক শীয়াকেই জীবন্ত কবর দিয়ে তারা হত্যা করেছে। অসংখ্য শীয়াকে হত্যা করে তাদের উপর দেয়াল এবং বিভিন্ন সরকারী ভবন তৈরী করা হয়। আব্বাসীয় খলিফা হারুনের শাসন আমলে ইসলামী সমাজ, ক্ষমতা ও পরিধি ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করে। খলিফা মাঝে মাঝে সূযের দিকে লক্ষ্য করে বলতেন : ‘হে সূর্য ! যেথায় খুশি জাতি ছড়িয়ে যা কিন্তু তা যেন আমার সাম্রাজ্যের বাইরে না হয়!’ খলিফার সেনা বাহিনী মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে বিশ্বে সর্বত্র বিজয়ী বেশে এগিয়ে যাচ্ছিলো। অথচ খলিফার রাজ প্রাসাদের মাত্র কয়েক কদম দূরে বাগদাদ সেতুর উপর খলিফার অজান্তে এবং বিনা অনুমতিতে কিছু লোক পথচারীদের কাছ থেকে টোল আদায় করতে থাকে। এমনকি একদিন স্বয়ং খলিফা ঐ সেতু অতিক্রম করার সময় টোল আদায়ের জন্য তার পথরোধ করা হয়েছিল।৮ জনৈকা গায়িকার যৌন আবেদনময়ী গানের মাত্র দু’টা চরণ শুনেই আব্বাসীয় খলিফা আমিন উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং সাথে সাথেই ঐ গায়িকাকে ৩০ লক্ষ দিরহাম উপহার দেন। গায়িকা ঐ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আবেগ আপ্লুত হয়ে খলিফা আমিনের পায়ে লুটিয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে : এতোগুলো অর্থ সবই কি আমাকে দান করলেন? খলিফা উত্তরে বলে: “এটা তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। এ টাকা পুনরায় সাম্রাজ্যের অচেনা অন্য আরেক অঞ্চল থেকে আদায় করে নেব!৯ ‘বাইতুল মালের (রাজকোষ) নামে পাহাড় পরিমাণ অর্থ সম্পদ সমগ্র ইসলামী সাম্রাজ্য থেকে খলিফাদের কাছে নিয়মিত এসে জমত। আর খলিফারা ঐ অর্থ তাদের বিলাসিতা, লাম্পট্য ও সত্য নিধনের কাজে ব্যয় করতেন। হাজার হাজার রূপসী ক্রীতদাসী ও সুন্দর চেহারার তরুণ-তরুণীতে আব্বাসীয় খলিফাদের দরবার ছিল পরিপূর্ণ !!
উমাইয়া বংশের পতন ও আব্বাসীয় বংশের শাসনক্ষমতা লাভের মাধ্যমে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠির নাম পাল্টানো ছাড়া শীয়াদের অবস্থার এতটুকও উন্নতি ঘটেনি।
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে শীয়ারা সর্বপ্রথম কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। কারণ
প্রথমতঃ ইতিমধ্যে সুরিয়ানী ও গ্রীক ভাষার প্রচুর বিজ্ঞান ও দর্শনের বই আরবীতে অনুদিত হয়েছিল। জনগণের মাঝে বুদ্ধিবৃত্তিক (দার্শনিক) ও প্রমাণ্য জ্ঞান চর্চা ও শিক্ষার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়াও আব্বাসীয় খলিফা মামুন (১৯৫-২১৮ হিজরী) ‘মু’তাযিলা’ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। তিনি যুক্তিভিত্তিক প্রমাণ্য মাযহাবের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। এ কারণেই তিনি যুক্তিযুক্ত প্রমাণভিত্তিক বিভিন্ন ধর্ম ও মাযহাব চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ছিলেন। শীয়া আলেম ও দার্শনিকগণও এ সুযোগটি লুফে নেয়। জ্ঞান চর্চাসহ আহলে- বাইতের মাযহাব প্রচারের সার্বিক কর্মসূচী পূর্ণদ্দোমে চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে তারা এ ২ সুযোগের পূর্ণ সদ্বব্যাবহার করেন।১০
দ্বিতীয়ত : এ ছাড়াও আব্বাসীয় খলিফা মামুন তার নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে শীয়াদের অষ্টম ইমাম, হযরত ইমাম রেজা (আ.) কে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার প্রদানের অংগীকার করেছিলেন।১১ এফেলে আহলে- বাইতের অনুসারী ও ভক্তরা শাসকগোষ্ঠির অত্যাচার ও উৎপীড়ন থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছিল। সেদিন কিছুটা রাজনৈতিক স্বাধীনতাও তাদের ভাগ্যে জুটে ছিল। কিন্তু না, সে ভাগ্য আর বেশী দিন দীর্ঘায়িত হয়নি। তলোয়ারের ধারালো অগ্রভাগ আবারও তাদের দিকেই ফেরানো হল। পাক্তন শাসকগোষ্ঠির বিস্মৃত প্রায় শোষণ ও নির্যাতন নীতি আবার তাদের উপর চালানো হয়। বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফা মুতাওয়াক্কিল (২৩২ হিঃ -২৪৭ হিঃ) আলী (আ.) ও তার শীয়াদের প্রতি চরম বিদ্বেষী ছিলেন। এমন কি তার নির্দেশেই কারবালা প্রান্তরে অবস্থিত হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাযার সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে- গুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।১২
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে এমন বেশ কিছু কারণের উদ্ভব ঘটে, যা শীয়াদেরকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত হবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। আব্বাসীয় খেলাফতের রাজনৈতিক ও প্রসাশনিক দূর্বলতা ও ‘বুইয়া’ বংশীয় বাদশাহের অভ্যুদয় ছিল ঐসব কারণের মধ্যে অন্যতম।
‘বুইয়া’ বংশীয় বাদশারা ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী। রাজধানী বাগদাদের খেলাফত প্রশাসনের কেন্দ্র এবং স্বয়ং খলিফার উপর তাদের প্রচন্ড প্রভাব ছিল। ঐ দৃষ্টিগ্রাহ্য রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় শীয়ারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে স্বীয় মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ পায়, যা ইতোপূর্বে ক্ষমতাসীন খলিফাদের উৎপীড়নের কারণে কখনও বাস্তবতার মুখ দেখতে পায়নি। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে ঐ (৪র্থ শতাব্দীতে) বড় শহরগুলো ছাড়া আরবের অধিকাংশ অঞ্চল শীয়া অধ্যুষিত ছিল। এ ছাড়াও হাজার, ওমান ও সা’য়াদাসহ বেশ কিছু শহরও ছিল শীয়া অধ্যুষিত। ইরাকের বসরা শহর যুগের পর যুগ সুন্নীদের এবং কুফা শহর শীয়াদের কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হত। এ দু’শহরের মাঝে সব সময়ই মাজহাবগত প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। এভাবে তারাবলুস, নাবলস, তাবারীয়া, হালাব, হেরাত, আহওয়ায, ও ইরানের পারস্য উপসাগরীয় তীরবর্তী অঞ্চল সমূহ ছিল শীয়া অধ্যুষিত।১৩ হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে জনাব নাসের আতরুশ নামক জনৈক ব্যক্তি বহু বছর যাবৎ ইরানের উত্তরাঞ্চলে (শীয়া মতাদর্শ) প্রচার অভিযান চালায়। পরবর্তীতে ‘তাবারিস্থান’ নামক অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা তিনি লাভ করেন এবং ঐ শাসন ক্ষমতা তার বংশের বেশ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অবশ্য জনাব আতরুশের পূর্বে ও হাসান বিন যায়েদ আলাভী (শীয়া) বহু বছর তাবারিস্থানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।১৪ হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতেই ফাতেমী বংশীয় ইসমাঈলীপন্থী শীয়ারা মিসরের শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং বেশ কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের রাজত্ব অব্যাহত (২৯২-৫২৭ হিজরী বর্ষ) থাকে।১৫ ইতিহাসে বহুবার বাগদাদ, বসরা, নিশাপুর ইত্যাদি বড় বড় শহরে শীয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ও সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটেছিল, যার অনেক গুলোতেই শীয়ারা বিজয়ী হয়েছিল।
হিজরী নবম শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মতই হিজরী পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্তও শীয়ারা তাদের বিস্তার লাভের গতি অব্যাহত রাখে। ঐ যুগে ক্ষমতাসীন বাদশারা ছিলেন শীয়া মতাদর্শের অনুসারী। ফলে তারাও শীয়া মতাদর্শের বিস্তৃতিতে যথেষ্ট সাহায্য করেন। হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে ‘কিলাউল মাউত’ নামক স্থানে ‘ইসমাঈলীপন্থী’ শীয়া মতাদর্শ প্রচারের অভ্যুদয় ঘটে। ইসমাঈলীরা প্রায় দেড় শতাব্দী পর্যন্ত ইরানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করে।১৬ ‘মারআ’শী’ বংশীয় সাইয়্যেদগণ (রাসূল (সা.)-এর বংশের লোক) বহু বছর যাবৎ ইরানের মাযেন্দারানে রাজত্ব করেন।১৭ শাহ্ খোদা বান্দেহ নামক জনৈক মোগল সম্রাট শীয়া মাযহাব গ্রহণ করেন এবং তারপরও বহু বছর যাবৎ তার উত্তরাধিকারীরা (শীয়া) ইরানের রাজত্ব করেন এবং শীয়া মাযহাবের উন্নতি ও সম্প্রসারণে সাহায্য করেন। একইভাবে ইরানের তাব্রিজ ‘অকে কুইউ নালু’ ও ‘কোররে কুইউ নালু’ বংশীয় শীয়া সম্রাটরাও বহু বছর ঐ অঞ্চলে শাসন করে।১৮ যাদের রাজ্যসীমা ইরানের (তাব্রিজ থেকে) ফার্স প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ঐ একই সময় মিসরে ফাতেমীয়রা বহু বছর যাবৎ শাসন করে। অবশ্য মাযহাবগত শক্তি বিভিন্ন বাদশাহদের যুগে বিভিন্ন রকম ছিল। যেমন মিসরে ফাতেমীয়দেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘আইয়ূবীয়’ বংশ যখন শাসন ক্ষমতা লাভ করে তখন, মিশরের অবস্থা সম্পূর্ণ প্রাল্টে যায়। মিশর ও সিরিয়ার শীয়ারা সম্পূর্ণ রূপে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। ফলে তলোয়ারের সম্মুখে অসংখ্য শীয়াদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।১৯ বিখ্যাত শহীদলু আওয়াল (প্রথম শহীদ) জনাব মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ মাক্কীর শাহাদতের ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি ইতিহাসের এক অসাধারণ মেধাসম্পন্ন শীয়া ফকীহ্ (ইসলামী আইন বিশারদ) ছিলেন। শুধুমাত্র শীয়া মাযহাবের অনুসারী হওয়ার অপরাধে হিজরী ৭৮৬ সনে দামেস্কে তাকে হত্যা করা হয়েছিল!২০ একইভাবে সিরিয়ার ‘হালাব’ শহরে জনাব শেইখ এশরাক শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দি নামক জনৈক বিখ্যাত দার্শনিককে শীয়া হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হয়!!২১
মোটকথা, এই পাঁচ শতাব্দী যাবৎ ক্ষমতাসীন মৈত্রী শাসকগোষ্ঠি কতৃক প্রদত্ত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ভোগ করায় শীয়া মতাদর্শের অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রায়। আবার কখনও বা তারা বৈরী শাসক গোষ্ঠির কোনপানলেও প্রতিত হয়। কিন্তু ঐ দীর্ঘ সময়ে কোন ইসলামী দেশে শীয়া মাযহাব কখনও রাষ্ট্রিয় মাযহাব হিসেবে ঘোষিত হয়নি।
হিজরী দশম ও একাদশ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
জনাব শেখ সাফী আর্দেবিলী (মৃত্যু হিজরী ৭৩৫ সনে) নামক জনৈক ব্যক্তি ছিলেন শীয়া মাযহাবের অনুসারী তরিকতপন্থী সুফী সাধাক। হিজরী ৯০৬ সনে ঐ পরিবারের জনৈক ১৩ বছর বয়সী এক তরুণ তার বাবার ভক্ত মুরীদদের মধ্য থেকে ৩০০ জন দরবেশের সহযোগীতায় একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন শীয়ারাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে‘আর্দেবীলে’ বিদ্রোহ করেন। এরপর তারা একের পর এক দেশ দখল করতে থাকে এবং ইরানের গোত্রীয় প্রশাসন পদ্ধতি ধ্বংস করে চলে। এভাবে স্থানীয় রাজা-বাদশাহ্ এবং বিশেষ করে ওসমানী সাম্রাজ্যের অধীন ওসমান বংশীয় বাদশাদেরকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে খণ্ড- বিখণ্ড ইরানকে পূর্ণাঙ্গ একটি দেশে রূপ দেয়। তিনি স্বীয় অধিকৃত অঞ্চলে শীয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা প্রদান করেন।২২ বাদশাহ্ ইসমাইল সাফাভীর মৃত্যুর পর দ্বাদশ হিজরী শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সাফাভী বংশীয় বাদশাগণ একের পর এক রাজত্ব চালিয়ে যান। তারা প্রত্যেকেই বংশানুক্রমে ইমামিয়া শীয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রিয় মর্যাদা প্রদান করেন এবং তা সমর্থন ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পান। এ অবস্থা মহাসম্রাট ‘শাহ আব্বাস কবীর’ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, যখন সাফাভী বংশীয় রাজত্ব ক্ষমতার চুড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল এবং তাদের রাজ্যসীমা বর্তমান ইরানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে (হিজরী ১৩৮৪ সন) পৌছে ছিল।
হিজরী দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে শীয়াদের অবস্থা
পূর্ববর্তী তিন শতাব্দী যাবৎ শীয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উন্নতি প্রাকৃতিক গতিতে অব্যাহত ছিল। অবশেষে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে শীয়া মাযহাব আনুষ্ঠানিক ভাবে গণপরিচিতি লাভ করে। ইয়ামান ও ইরাকের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসাধারণ শীয়া মাযহাবের অনুসারী। এ ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই কমবেশী শীয়াদের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে শীয়া জনসংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।২৩
তথ্যসূত্র :
১. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড ৭৯ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ১ম খণ্ড, ২০৮ নং পৃষ্ঠাও অন্যান্য ইতিহাস দ্রষ্টব্য।
২. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৮৬ নং পৃষ্ঠা। ‘মুরুযুয যাহাব’ ৩য় খণ্ড, ২৬৮ নং পৃষ্ঠা।
৩. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৮৬ নং পৃষ্ঠা। ‘মুরুযুয যাহাব’ ৩য় খণ্ড, ২৭০ নং পৃষ্ঠা।
৪. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ৯১-৯৬ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ১ম খণ্ড, ২১২ নং পৃষ্ঠা।
৫. ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ২য় খণ্ড, ৬ নং পৃষ্ঠা।
৬. ‘তারিখে ইয়াকুবী’ ৩য় খণ্ড, ১৯৮ নং পৃষ্ঠা। ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ২য় খণ্ড, ৩৩ নং পৃষ্ঠা।
৭. ‘বিহারুল আনোয়ার’ ১২ তম খণ্ড, ‘ইমাম জাফর সাদিকের (আ.) অবস্থা’ অধ্যায়।
৮. ‘বাগদাদ সেতুর কাহিনী’।
৯. ‘আগানী আবিল ফারাজ কিস’আতু আমিন’।
১০. তাওয়ারিখ
১১. রাজনৈতিক দিক থেকে আব্বাসীয় খলিফা মামুন ছিলেন অত্যন্ত চতুর। তিনি অষ্টম ইমাম হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে তার খেলাফতের পরবর্তী উত্তরাধীকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু এটা ছিল তার এক ধূর্ততাপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল। হযরত ইমাম রেজা (আ.) এটা ভাল করেই জানতেন। তাই তিনি বাহ্যতঃ খলিফা মামুনের প্রস্তাব মেনে নিলেও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেন। মামুনের ধূর্ততা সম্পর্কে ইমাম রেজা (আ.)-এর ধারণার সত্যতার প্রমাণ তখনই পাওয়া গেল, যখন খলিফা মামুন হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে শহীদ করেন।
১২. তারিখে আবিল ফিদা ও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থাবলী দ্রষ্টব্য ।
১৩.‘আল হিদারাতুল ইসলামিয়া ’ -১ম খণ্ড, ৯৭ নং পৃষ্ঠা।
১৪. ‘মরুযুয যাহাব’ ৪র্থ খণ্ড ৩৭৩ নং পৃষ্ঠা। ‘আল মিলাল ওয়ান নিহাল’ ১ম খণ্ড, ২৫৪ নং পৃষ্ঠা।
১৫. ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ২য় খণ্ড, ৬৩ নং পৃষ্ঠা, এবং ৩য় খণ্ড, ৫০ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
১৬. ‘তাওরীখে কামেল’ ‘তারিখে রাওদাতুস সাফা, ও ‘তারিখে হাবিবুস সিয়ার দ্রষ্টব্য
১৭. ‘তারিখে কামেল’ ‘তারিখে আবিল ফিদা, ৩য় খণ্ড দ্রষ্টব্য।
১৮. ‘তারিখে হাবিবুস সিয়ার’। ‘তারিখে আবিল ফিদা’ ও অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
১৯. ‘রওদাতল জান্নাত ও রিয়াদুল উলামা (রাইহানাতুল আদাব )’ ২য় খণ্ড, ৩৬৫ নং পৃষ্ঠা।
২০. ‘কিতাবুর রাওদাত কিতাবুল মাজালিশ ও ওয়াফিয়াতুল আ’ঈয়ান’।
২১. ‘রওদাতুস সাফা’ ও ‘হাবিবুস সাইর’।
২২. ‘রওদাতুস সাফা’ ও ‘হাবিবুস সাইর’।
২৩. উল্লেখ্য যে পাঠকদের হাতে উপস্থিত গ্রন্থটি প্রায় ৩৫ বছর পূর্বে রচিত। ফলে শীয়াদের যে সংখ্যাটি উদ্ধৃত হয়েছে সেটি অত্যন্ত প্রাচীন হিসাব। বর্তমান যুগে বিশ্বে শীয়াদের সংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। (-অনুবাদক)