ইমামীয়া জাফরী মাজহাবের আকিদা বিশ্বাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(১১) তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হলে মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে (আ.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি ও মুসলমানদের উপর ইমাম বা নেতা মনোনীত করে গিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের নেতৃত্ব দান ছাড়াও তাদেরকে চিন্তাগত দিকনির্দেশনা এবং নৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত ও পরিশুদ্ধ করবেন। এ মনোনয়নের ঘোষণা তিনি গাদীরে খুম নামক স্থানে তার জীবনের শেষ বছরে বিদায়হজ্জের ঠিক পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে হজ গমনকারী মুসলমানদের এক বিশাল সমাবেশে -যাদের সংখ্যা কোন কোন রেওয়ায়েত অনুযায়ী এক লক্ষের বেশী ছিল-দান করেন। এ ঘটনার প্রাক ও পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।১
তখন মহানবী (সা.) উপস্থিত জনতার প্রতি আলীর (আ.) হাতে হাত দিয়ে বাইয়াত করার আহবান জানান। ফলে মুহাজির ও আনসারদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও প্রসিদ্ধ সাহাবাদের সকলে তার হাতে বাইয়াত করেন। (বিস্তারিত জানতে দেখুন আল্লামা আমিনীর আল-গাদীর গ্রন্থ যেখানে তিনি বিভিন্ন তাফসীর,ইতিহাস ও হাদিস গ্রন্থসমূহ হতে বিষয়টি বর্ণনা ও প্রমাণ করেছেন)।
(১২) তারা বিশ্বাস করে মহানবীর (সা.) মৃত্যুর পর মনোনীত ইমামের দায়িত্ব হল যেমনভাবে রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মুসলমানদের পরিচালনা করেছেন,দিক নির্দেশনা দিয়েছেন,শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন,তাদের জন্য দ্বীনি বিধিবিধান বর্ণনা করেছেন,চিন্তাগত জটিল সমস্যাসমূহের সমাধান দিয়েছেন,সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের নিষ্পত্তি করেছেন সর্বোপরি তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তেমনিভাবেই তা পালন করা অর্থাৎ তিনি ঠিক রাসুলের মতই (নেতৃত্ব,পথ নির্দেশনা,শিক্ষা-প্রশিক্ষণ,বিধিবিধান বর্ণনা,চিন্তাগত সমস্যা সমূহের সমাধান দান সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নিষ্পত্তি প্রভৃতি) এ সকল ক্ষেত্রগুলিতে ভূমিকা পালন করবেন। অবশ্যই ইমাম বা রাসুলের উত্তরাধিকারী ব্যক্তিত্বকে এমন হতে হবে যার উপর সকল ক্ষেত্রে মানুষ নির্ভর করতে পারে যাতে করে তিনি উম্মতকে পরিচালিত করে নিরাপদ স্থানে ও তীরে পৌছতে পারেন। তিনি নবীর মতই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত হবেন যেমন ঐশী জ্ঞান,পবিত্রতা,নিষ্পাপত্ব ও অনুরূপ যা কিছু তাকে নেতৃত্ব ও দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করবে শুধু নবুওয়াত ও ওহী প্রাপ্তি ব্যতিত। কারণ মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে নবুয়তের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তিনি সর্বশেষ নবী ও রাসুল এবং তার আনীত ধর্ম সর্বশেষ ধর্ম,তাঁর শরীয়ত সর্বশেষ শরীয়ত,তাঁর উপর অবতীর্ণ গ্রন্থ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ। তাই তাঁর পর কোন নবী নেই,তাঁর ধর্মের পর কোন ধর্ম নেই,তাঁর শরীয়তের পর কোন শরীয়ত নেই। এ বিশ্বাসের বিষয়ে শিয়াদের রচিত অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে যাতে বিষয়টি বিভিন্ন কলবরে ও পদ্ধতিতে প্রমাণ করা হয়েছে।
(১৩) তারা বিশ্বাস করে উম্মতের জন্য নিষ্পাপ ও পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত নেতার প্রয়োজনীয়তার দাবী রাসুলের (সা.) পর শুধু হযরত আলীর মনোনয়নের মাধ্যমে পূরণ হয়না। বরং এই নেতৃত্বের ধারা দীর্ঘ সময় অব্যাহত থাকা অপরিহার্য। যাতে করে ইসলামের মূল সুপ্রতিষ্ঠিত হয় (সমাজের গভীরে প্রবেশ করে ও স্থায়িত্ব লাভ করে),তার শরীয়তের ভিত্তি সংরক্ষিত হয়,তার আনীত বিধিবিধান সে সকল বিপদ ও আশঙ্কা মুক্ত হয় যে আশংকাগুলি সকল ঐশী ধর্মব্যবস্থা ও বিশ্বাসকে শংকিত করত ও করেছে। এ লক্ষ্যেই একদল মনোনীত ব্যক্তিবর্গকে ইমাম হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে -যারা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপ ভূমিকা রেখেছেন ও প্রচেষ্টা চালিয়েছেন- যাতে করে ইসলামী উম্মতের জন্য সকল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে গ্রহণীয় উপযোগী পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর ব্যবহারিক উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতা দান করা য়ায় ।
(১৪) তারা বিশ্বাস করে মহানবী (সা.) উপরোক্ত কারণে এবং বিশেষ প্রজ্ঞার ভিত্তিতে মহান আল্লাহর নির্দেশে আলীর (আ.) পর আরো এগারজন ইমামকেও নির্দিষ্ট করে গিয়েছেন অর্থাৎ আলীসহ (আ.) বারোজন ইমামের কথা ঘোষণা করেছেন। তাদের সংখ্যা ও তাদের গোত্রের নাম (কোরাইশ) উল্লেখ করে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বিভিন্ন শব্দের পার্থক্যে কাছাকাছি অর্থে হাদিসসমূহ বর্ণিত হয়েছে যদিও তাতে তাঁদের নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়নি। যেমন মহানবীর (সা.) হতে বর্ণিত হয়েছে : নিশ্চয়ই ততক্ষণ দ্বীন (ইসলাম) সুপ্রতিষ্ঠিত,সমুন্নত ও অব্যাহত থাকবে যতক্ষণ মুসলমানদের মাঝে বারোজন নেতার অথবা খলিফার আগমন ঘটবে যারা সকলেই কোরাইশ বংশের হবে অথবা বনি হাশেমের হবে (যেমন কোন কোন গ্রন্থে এসেছে),আবার সিহাহ সিত্তাহর বাইরের কোন কোন গ্রন্থে যেমন ফাজায়েল,মানাকিব,সাহিত্য ও কবিতা গ্রন্থেও তাদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। যদিও উল্লিখিত হাদিসগুলিতে সুস্পষ্টরূপে বারো ইমাম অর্থাৎ হযরত আলীসহ তার এগার জন সন্তানের নাম আসেনি কিন্তু জাফরী শিয়াদের বিশ্বাসের সঙ্গেই কেবলমাত্র তা মিলানো সম্ভব নতুবা অন্য কোন ব্যাখ্যাই তার সঙ্গে সাজুয্য রাখেনা। জাফরী শিয়াদের ব্যাখ্যা ব্যতীত অন্য কোন ব্যাখ্যাই এক্ষেত্রে সঠিকত্ব প্রমাণ করতে পারেনি। এজন্য দেখুন আল হায়েরী বাহরানী রচিত খুলাফাউন্নাবী গ্রন্থটি।
(১৫) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে বার ইমাম হলেন পর্যায়ক্রমিকভাবে
- ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (রাসুলের (সা.) চাচাতো ভাই ও তাঁর কন্যা ফাতিমা যাহরার (আ.) স্বামী)
- ইমাম হাসান ও হুসাইন (রাসুলের নাতি এবং আলী ও ফাতিমার সন্তানদ্বয়)
- ইমাম যাইনুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন (আস সাজ্জাদ)
- ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আল বাকির)
- ইমাম জাফর ইবনে মুহাম্মাদ (আস সাদিক)
- ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আল কাজিম)
- ইমাম আলী ইবনে মুসা (আর রিজা)
- ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আল জাওয়াদ আততাকী)
- ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ (আল হাদী আননাকী)
- ইমাম হাসান ইবনে আলী (আল আসকারী)
- ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (আল মাহদী,আল মওউদ (প্রতিশ্রুত),আল মুনতাজার (প্রতীক্ষিত)২
এরাই হলেন আহলে বাইত যাদেরকে রাসুল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ইসলামী উম্মাহর নেতা বলে ঘোষণা করেছিলেন কারণ তারা হলেন নিষ্পাপ,গুনাহ ও ভুলত্রুটি হতে মুক্ত এবং তারা তাদের পিতৃপুরুষ হতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং এ জন্যই মহান আল্লাহ তাঁদের প্রতি ভালবাসা পোষণের ও তাঁদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র কোরআনের এই আয়াতগুলিতে :
قل لا أسئلکم عليه اجرا الا المودة فی القربی
“বলুন,আমি তোমাদের নিকট আমার রেসালাতের দায়িত্বের পুরস্কার স্বরূপ কিছুই চাইনা আমার নিকটাত্মীয়দের সৌহার্দ ও ভালবাসা ছাড়া”৩ এবং
ياايها الذين آمنوا اتقوا الله و کونوا مع الصادقين
“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর ও সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।” ৪
বিস্তারিত জানতে এ সম্পর্কিত তাফসীর,হাদিসগ্রন্থসমূহ এবং সিহাহ সিত্তাহর ফাজায়েল অংশ যাতে আহলে বাইতের মর্যাদা শীর্ষক আলোচনা রয়েছে এবং এ বিষয়ক শিয়া সুন্নী উভয় মাজহাবের স্বতন্ত্র গ্রন্থসমূহও দেখুন।
(১৬) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে তাদের পবিত্র ইমামগণ যাদের কর্ম ও বাক্যের ক্ষেত্রে কোন ভুল-ত্রুটি বা গুনাহর কথাই ইতিহাসে উল্লেখিত হয়নি (যেমনটি অন্য সকলের ক্ষেত্রেই কমবেশী হয়েছে)। তাঁরা তাঁদের বিস্তৃত জ্ঞানের দ্বারা ইসলামী উম্মাহর ব্যাপক কল্যাণ সাধন করেছেন। তাঁরা তাঁদের গভীর জ্ঞানের দ্বারা এ উম্মাহর সংস্কৃতিকে করেছেন সমৃদ্ধ,আকিদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দিয়েছেন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি,ইসলামী শরীয়ত,তাফসীর,হাদিস,ইতিহাস,নৈতিকতা,আদব প্রভৃতি ক্ষেত্রে দিয়েছেন সঠিক দিক নির্দেশনা ও দিব্যদৃষ্টি। তেমনি তাঁরা তাঁদের বাণী ও কর্মের দ্বারা একদল জ্ঞানী,সৎকর্মশীল,কল্যাণকর অসামান্য নারী-পুরুষকে প্রশিক্ষিত করতে পেরেছিলেন যাদের জ্ঞান,মর্যাদা,শ্রেষ্ঠত্ব ও সদাচরণের বৈশিষ্ট্যকে সকলেই স্বীকার করেছেন।
যদিও দুঃখজনকভাবে আহলে বাইতের এই সম্মানিত ইমামদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব হতে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল তদুপরি তাঁরা তাদের সামাজিক ও চিন্তাগত দায়িত্বটি সর্বোত্তমভাবে পালন করেছেন যাতে করে ইসলামের মৌল বিষয়সমূহ,শরীয়তের বিধিবিধান বিকৃতি হতে রক্ষা পায়। যদি মুসলিম উম্মাহ তাঁদেরকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সেই দায়িত্বটি যা রাসুল (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে তাদের উপর অর্পণ করেছিলেন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিত তবে এই উম্মাহ তার কাঙ্ক্ষিত সম্মান,মর্যাদা ও সৌভাগ্যকে পূর্ণরূপে লাভ করত এবং তাদের মধ্যে এমন এক ঐক্য,সংঘবদ্ধতা ও পারস্পরিক সমন্বয়ের সৃষ্টি হত যাতে কোন ফাটল থাকত না,কোন বিভেদ ও দ্বন্দ থাকত না,কোন অপমান ও হীনতা থাকত না,থাকত না কোন যুদ্ধ বিগ্রহ।
এ বিয়য়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন আসাদ হায়দার রচিত তিন খণ্ডের গ্রন্থ আল ইমাম আস সাদিক ওয়াল মাজাহেব আল আরবায়া।
(১৭) শিয়াগণ বিশ্বাস করে যে আহলে বাইতের অনুসরণ করা ওয়াজিব ও তাদের নির্দেশিত পথ গ্রহণ করা অপরিহার্য এবং এ কারণেই তাদের আকীদা বিষয়ক গ্রন্থসমূহে এ বিষয়টি প্রমাণ করে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রেওয়ায়েত (কোরআন ও হাদিস) নির্ভর অসংখ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে। কারণ সেটা সেই পথ যা মহানবী (সা.) তার উম্মতের জন্য অংকন করেছিলেন এবং তা অনুসরণ ও দৃঢ়ভাবে ধারণের জন্য তাদের প্রতি ওসিয়ত করেছিলেন যা মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদিসে সাকালাইনে বর্ণিত হয়েছে।
إنی تارک فيکم الثقلين کتاب الله و عترتی اهل بيتی ما ان تمسکتم بهما لن تضلوا ابدا
“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। যদি তোমরা এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর কখনই বিভ্রান্ত হবে না।”
এ হাদিসটি মুসলিম ও তিরমিযী তাদের সহীহ হাদিস গ্রন্থদ্বয়ে ও তাদের অনুরূপ শত শত মুহাদ্দিস প্রতিটি হিজরী শতাব্দীতে এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা লাশনাভী (লাক্ষ্মাভী) রচিত হাদীসুস সাকালাইন প্রবন্ধে এসেছে এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন দশক পূর্বে সেটিকে সত্যায়ন করেছে।
নবীগণ কর্তৃক প্রতিনিধি মনোনয়ন এবং তাদের বিষয়ে সুপারিশ করার বিষয়টি প্রচলিত একটি রীতি যা পূর্ববর্তী নবীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। (এ বিষয়ে আলোচনা মাসউদীর ইসবাতুল ওয়াসিয়াহ এবং বিভিন্ন তাফসীর,হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থে এসেছে যা শিয়া সুন্নী উভয় সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে।)
(১৮) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে ইসলামী উম্মাহর (আল্লাহ তাদের সম্মানিত করুন) উচিত একে অপরকে কটূক্তি ও গালি গালাজ,মিথ্যা অপবাদ আরোপ,গুজব রটানো,ভীতি প্রদর্শন,কটাক্ষ ইত্যাদি (যেমন নিজের অবস্থানকে প্রমাণ করার জন্য অযাচিত কল্পনা প্রসূত যুক্তি উপস্থাপন) হতে দূরে থেকে পরস্পর অনৈক্যের বিষয়গুলোতে গঠনমূলক আলোচনা পর্যালোচনায় বসা। মুসলিম উম্মাহর সকল ফির্কা,মাযহাব ও সম্প্রদায়ের চিন্তাবিদ ও আলেমগণের উচিত ইসলামী জ্ঞান বিষয়ক আলোচনার জন্য সমবেতভাবে জ্ঞান বিষয়ক পরামর্শ কেন্দ্রের সৃষ্টি করা। জ্ঞানভিত্তিক আলোচনা পর্যালোচনার জন্য সমবেত হওয়া এবং তাদের ধর্মীয় ভাই জাফরী ফিকাহর অনুসারীদের মতসমূহ নিরপেক্ষ,নিষ্ঠাপূর্ণ ও ভ্রাতৃসুলভ মন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠতার সাথে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা,তাদের উপস্থাপিত দলিল প্রমাণসমূহ কোরআন,রাসুল (সা.) হতে বর্ণিত সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদিসসমূহ এবং রাসুলের ও তাঁর পরবর্তী সময়ের সার্বিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাসমূহ ও বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলোকে যাচাই ও মূল্যায়ন করা।
(১৯) জাফরী শিয়ারা বিশ্বাস করে সাহাবা ও যে সকল নারী-পুরুষ রাসুলের (সা.) পাশে ছিলেন এবং ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন,ইসলামের প্রচার ও তার ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য জান ও মাল দিয়ে সাহায্য করেছেন প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তাদেরকে সম্মান করা,তাদের অবদানকে মূল্যায়ন করা এবং তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে রাসুলের (সা.) সকল সাহাবাই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন (এবং নিরংকুশভাবে সত্য পরায়ণ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন) ফলে তাদের কর্ম ও ভূমিকা সমালোচনা ও পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে রয়েছে। না এরূপ নয়। তারাও সেসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত যারা ভুল করেন আবার সঠিক কাজও করেন। ইতিহাস এমন অনেক ঘটনা উল্লেখ করেছে যাতে প্রমাণিত হয় তাদের অনেকেই এমনকি রাসুলের জীবদ্দশায় সৎপথ হতে বিচ্যুত হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনও তার অনেক সূরা ও আয়াতে এরূপ ব্যক্তিবর্গের কথা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছে যেমন সূরা মুনাফিকুন,আল আহযাব,আল হুজুরাত,আত তাহরীম,আল ফাতহ,মুহাম্মাদ ও তওবাহ।
সুতরাং নিখাদ সমালোচনার অর্থ তাদের একটি অংশকে কাফের প্রতিপন্ন করা নয়। কারণ ঈমান ও কুফরের মানদণ্ড সকলের নিকট স্পষ্ট,এ দু’য়ের সীমারেখা ও কেন্দ্রবিন্দুও চিহ্নিত আর তা হলো তওহীদ,রেসালাত,দীনের জরুরী ও অনস্বীকার্য বিষয়সমূহ যেমন নামাজ,রোজা,হজ,জাকাত ইত্যাদি এবং সুস্পষ্ট হারামসমূহ যেমন মদ্যপান,জুয়া,ব্যভিচার,চুরি,সুদ ইত্যাদির মত বিষয়সমূহকে স্বীকার বা অস্বীকার করা।
কিন্তু মহানবীর (সা.) আদর্শের অনুসারী প্রত্যেক পরিশুদ্ধ মুসলিমেরই উচিত তার কলম ও জিহ্বাকে সংযত রাখা অর্থাৎ নিকৃষ্ট কথা বলা,অপবাদ আরোপ ও গালিগালাজ হতে দূরে থাকা। যা হোক রাসুলের (সা.) অধিকাংশ সাহাবীই সৎকর্মশীল এবং শ্রদ্ধা ও সম্মানের উপযুক্ত ও যোগ্য ছিলেন। কিন্তু রাসুলের প্রকৃত সুন্নত অর্থাৎ তাঁর হতে বর্ণিত নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল (সহীহ) হাদিস শনাক্তকরণের জন্য সাহাবাদেরকে সততা ও ন্যায়ের মানদণ্ডে যাচাই করা অপরিহার্য। যখন আমরা জানি তাঁর উপর মিথ্যারোপের বিষয়টি তাঁর মৃত্যুর পর ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছিল যার ইঙ্গিত তিনি তাঁর জীবদ্দশায়ই দিয়েছিলেন।
এ বিষয়টিই শিয়া সুন্নী উভয় মাজহাবের আলেমদের তৎসম্পর্কিত গ্রন্থ রচনায় বাধ্য করেছিল যেমন সুয়ুতী,ইবনুল জাওযীসহ অনেক আলেমই এ (জাল হাদিস) বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থসমূহ রচনা করেছেন এবং নবী করিম (সা.) হতে প্রকৃতই যে হাদিসসমূহ বর্ণিত হয়েছে এবং যে হাদিসসমূহ তার উপর আরোপ করা হয়েছে ও জাল বলে গণ্য সেগুলোকে পরস্পর হতে পৃথক করেছেন।
(২০) জাফরী শিয়ারা প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদীতে (আ.) বিশ্বাস করে। তাদের এ বিশ্বাস রাসুলের (সা.) হতে বর্ণিত অসংখ্য হাদিসের ভিত্তিতে প্রমাণিত যেগুলোতে বলা হয়েছে তিনি ফাতিমার সন্তান এবং ইমাম হুসাইনের বংশধারার নবম সন্তান। আমরা জানি ইমাম হুসাইনের (আ.) বংশধারার অষ্টম সন্তান হলেন ইমাম আসকারী (আ.) যিনি ২৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁর একটির বেশি সন্তান ছিল না যার নাম হল মুহাম্মাদ এবং তিনিই হলেন ইমাম মাহদী। তার উপনাম হল আবুল কাসেম। ৫
মুসলমানদের মধ্যে কিছু নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি তাঁকে দেখেছেন এবং তাঁর শারীরিক ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য এবং ইমামত সম্পর্কে খবর দিয়েছেন। তাঁর ইমামত সম্পর্কিত বিষয়ে তাঁর পিতা হতে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তিনি পাঁচ বছর বয়সে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। কারণ শত্রুরা চেয়েছিল তাঁকে হত্যা করতে কিন্তু আল্লাহ তাকে শেষ যুগে পৃথিবীতে জুলুম ও ফ্যাসাদ (বিশৃংখলা ও অনাচার) নিশ্চিহ্ন করে ন্যায়ভিত্তিক ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য সংরক্ষণ করেছেন।
তিনি যে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন এটি কোন অভূতপূর্ব আশ্চর্যজনক বিষয় নয়। কারণ কোরআনের বর্ণনা মতে ঈসা (আ.) এখনও জীবিত আছেন অথচ তাঁর জন্মের পর ২০০৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং হযরত নুহ (আ.) তাঁর জাতিকে নয়শত পঞ্চাশ বছর দীনের দাওয়াত দিয়েছেন ও দ্বীর্ঘসময় তাদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছেন। হযরত খিজিরও (আ.) এখন জীবিত আছেন।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান,তাঁর ইচ্ছাই কার্যশীল যার কোন প্রতিরোধকারী নেই। আল্লাহ কি হযরত ইউনুস (আ.) এর বিষয়ে এর থেকেও আশ্চর্য কিছু বলেননি যে,
فلولا انه کان من المسبحين للبث فی بطنه الی يوم يبعثون
“যদি তিনি আল্লাহর তসবীহ (পবিত্রতা ঘোষণা) না করতেন তবে তাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটে থাকতে হত।” ৬
আহলে সুন্নাতের অনেক প্রসিদ্ধ আলেম ও ব্যক্তিত্ব ইমাম মাহদীর (আ.) জন্ম ও বিদ্যমান থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এবং তাঁর নাম,পিতার নাম ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। যেমন-
ক) আব্দুল মুমিন শাবলানজী শাফেয়ী তাঁর ‘নুরুল আবসার ফি মানাকিবি আলে বাইতিন্নাবী আলমুখতার’ গ্রন্থে।
খ) ইবনে হাজার আল হাইসামী আল মাক্কী আশ শাফেয়ী তার ‘আস সাওয়ায়েক আল মুহরেকা’ গ্রন্থে বলেছেন,(তাঁর নাম) আবুল কাসেম মুহাম্মাদ আল হুজ্জাত,তাঁর বয়স তাঁর পিতার মৃত্যুর সময় পাঁচ বছর ছিল। তিনি সে বয়সেই পূর্ণ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান লাভ করেছিলেন তাঁর উপাধি হল আল কায়েম আল মুন্তাজার।
গ) আল কুন্দূযী আল হানাফী আল বালখী তার ‘ইয়ানাবিউল মাওয়াদ্দাহ’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থটি তুরস্কে উসমানী খিলাফতের সময় সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল।
ঘ) সাইয়েদ মুহাম্মাদ সিদ্দিক হাসান আল কুন্দুযী আল বুখারী তার ‘আল ইজায়া লিমা কানা ওয়া মা ইয়াকুনু বাইনা ইয়াদাই আস সায়াত’ গ্রন্থে। এ গ্রন্থটি প্রাচীন গ্রন্থসমূহের একটি।
সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে ড. মুস্তাফা আর রাফেয়ী তার ‘ইসলামুনা’ গ্রন্থে ইমাম মাহদীর (আ.) জন্মের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষাপটে এ ক্ষেত্রে উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।
(হুজ্জাতুল ইসলাম জাফর আল হাদী লিখিত, আবুল কাসেম অনূদীত “সত্য পরিচয়” গ্রন্থ থেকে সংকলিত )
চলবে…
তথ্যসূত্র:
১। (ক) তাবলীগের আয়াত-
يَأَيهَاالرَّسولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْك مِن رَّبِّك وَ إِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْت رِسالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُك مِنَ النَّاسِ
“হে নবী! আপনার প্রভূর নিকট হতে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন, যদি আপনি তা না করেন তবে তাঁর রেসালতের কোন দায়িত্বই আপনি পালন করেননি এবং আল্লাহ আপনাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়েদা- ৬৭)।
(খ) দ্বীনের পূর্ণতা দানের আয়াত-
الْيَوْمَ أَكْمَلْت لَكُمْ دِينَكُمْ وَ أَتمَمْت عَلَيْكُمْ نِعْمَتى وَ رَضِيت لَكُمُ الاسلامَ دِيناً
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম,তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়েদা-৩)
(গ) الْيَوْمَ يَئس الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلا تخْشوْهُمْ وَ اخْشوْنِ “আজকের এইদিনে কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো।” (সূরা আল মায়েদা-৩)
(ঘ) سأَلَ سائلُ بِعَذَابٍ وَاقِع - لِّلْكافِرِينَ لَيْس لَهُ دَافِعٌ “এক ব্যক্তি চাইল সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত। কাফেরদের জন্য যার প্রতিরোধকারী নেই।” (সূরা মাআরিজ-১,২)
২। আরব ও অনারবদের মধ্য হতে অনেক অসামান্য ও প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ও কবি যারা শিয়া নন এই বার ইমামের সকলের নামোল্লেখ করে দীর্ঘ কাসিদা ও গজল রচনা করেছেন। যেমন হাসকাফি,ইবনে তুলুন,আল ফাজল ইবনে রুযবাহন,জামী, ফরিদুদ্দীন আত্তার নিশাবুরী,মাওলানা রুমি। এদের কেউবা হানাফী,কেউবা শাফেয়ী বা অন্য কোন মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। আমরা এখানে নমুনা হিসেবে তাদের দুজন হতে দুটি কাসীদা উল্লেখ করছি।
প্রথম কাসীদাটি হাসকাফী হানাফী হতে যিনি সপ্তম হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম ও কবি :
(আলী) হায়দার,তারপর দুই হাসান (হাসান ও হুসাইন)
তারপর আলী ও তার পুত্র মুহাম্মাদ
জাফর সাদিক ও তার পুত্র মুসা
তার পুত্র আলী নেতা ও সর্দার
আর রেজা হল উপাধি তার
তার পুত্র মুহাম্মাদ,তারপর আলী
সত্যের পথে হেদায়াতকারী হলেন তিনি
তারপর হাসান ও তদীয় পুত্র মুহাম্মাদ
এরা হলেন আমার ইমাম ও নেতা।
যদি এ বিশ্বাসের কারণে কোন দল আমাকে করে মিথ্যা প্রতিপন্ন
যেহেতু তাঁরা হলেন ইমাম তাই তাদের সম্মান করে আমি ধন্য
তাঁদের নাম সম্মানের সাথে (সুন্দরভাবে) উচ্চারিত হয়,কখনই প্রত্যাখ্যাত নন।
তাঁরা আল্লাহর বান্দাদের উপর তাঁর দলিল ও প্রমাণ
এবং তাঁর দিকে তাঁরাই হলেন পথ ও গন্তব্যস্থল
তাঁরা তাদের প্রভুর জন্য দিনে রোজা পালনকারী
আর রাতের আঁধারে রুকু ও সিজদাকারী।
দ্বিতীয় কাসিদাটি দশম হিজরীর বিশিষ্ট আলেম শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে তুলুনের রচিত। তিনি তার কাসিদায় বলেছেন,
তোমরা বার ইমামকে ধারণ কর
যারা হলেন শ্রেষ্ঠমানব মুস্তাফার বংশের
আবু তুরাব (আলী),হাসান ও হুসাইন
যাইনুল আবেদীনের বিদ্বেষ ত্রুটি বলে গণ্য
মুহাম্মাদ আল বাকির হতে কতইনা জ্ঞান প্রজ্বলিত হয়েছে
আস সাদিক বলে ডাক জাফরকে সবার মাঝে
মুসা হলেন কাজিম (ক্রোধ সংবরণকারী),তাঁর পুত্র আলী
তাকে ভূষিত কর রেজা উপাধিতে কারণ তার মর্যাদা উচ্চ
মুহাম্মাদ আততাকী যার হৃদয় সজ্জিত
আলী আননাকী যার রত্ন সর্বত্র বিক্ষিপ্ত
আল আসকারী আল হাসান তিনি পবিত্র
মুহাম্মাদ আল মাহদী যিনি নিকটেই হবেন আবির্ভূত।
দ্রষ্টব্য: আল আইম্মাতু ইসনা আশার,সিরীয় ঐতিহাসিক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে তুলুন (মৃত্যু ৯৩৫ হিজরী) গবেষণা: ডক্টর সালাহউদ্দীন আল মুনাজ্জাদ,বৈরুত হতে প্রকাশিত।
৩। সূরা শুরা ২৩।
৪। সূরা তাওবাহ ১১৯।
৫। সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে শিয়া সুন্নী উভয় সূত্রে রাসুল (সা.) হতে বর্ণিত হয়েছে,শেষ জামানায় আমার বংশধর হতে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন যার নাম আমার নামে,তার উপনাম আমার উপনাম,তিনি পৃথিবীকে অন্যায় ও অত্যাচারপূর্ণ অবস্থা হতে পূর্ণ ন্যায় ও আদালত প্রতিষ্ঠা করবেন।
৬। সূরা আস সাফ্ফাত ১৪৩-১৪৪।