আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য উপস্থাপিত হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মতে আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বুদ্ধিবৃত্তি (Rationality । বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের মতেও বুদ্ধিবৃত্তি হল আধুনিক সমাজের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তবে তার দৃষ্টিতে এ বুদ্ধিবৃত্তি হচ্ছে ব্যবহারিক জীবনের হাতিয়ার স্বরূপ। তাই একে Instrumental Rationality বলা যেতে পারে। এ বুদ্ধিবৃত্তি প্রচলিত (Traditional) সকল চিন্তার বিরোধী; সমাজ গঠনে ঐশী বিধানের প্রতি অমুখাপেক্ষিতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মানুষের স্বনির্ভরতায় বিশ্বাসী। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক কাঠামো,সংস্কৃতি ও চিন্তাজগতে বুদ্ধিবৃত্তির স্বয়ংসম্পূর্ণতার এ ধারণা সামাজিক জীবনে ধর্মের ন্যূনতম প্রয়োজনকেও স্বীকার করে না। তাই এ মতের ভিত্তিতে আধুনিক সমাজজীবনে ধর্ম সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়া ও এর প্রতি মানুষের আগ্রহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক বলে পরিগণিত। কিন্তু তাঁদের এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বর্তমান বিশ্বে মানুষ দিন দিন ধর্মের প্রতি অধিকতর ধাবিত হচ্ছে। এ কারণে বারগারের দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্বের যে কোন সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় পর্যালোচনায় ধর্মকে উপেক্ষা করা বড় এক ভুল বলে পরিগণিত। মরিস বারবিয়ার মতে বর্তমানে ইউরোপের বাইরে যুবকদের মধ্যে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ এবং ধর্মীয় অনুভূতি বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ধর্মের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের গভীর সংযোগ এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়ের অনুপ্রবেশ থেকে উৎসারিত। এ বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের সফল আত্মপ্রকাশের স্বাক্ষর বহন করছে। এর ওপর ভিত্তি করেই মালরো মন্তব্য করেছেন,তৃতীয় সহস্রাব্দ হয় ধর্মের সহস্রাব্দ নতুবা তার অস্তিত্ব থাকবে না। জুলি স্কট বলেছেন,বর্তমান সময়ে ধর্মবিষয়ক সমাজবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সাম্প্রতিক বিশ্বে ধর্মের উন্নয়নের গতিকে বোঝার চেষ্টা করা। কেননা,আমরা তৃতীয় সহস্রাব্দে প্রবেশের সাথে সাথে ধর্মের লক্ষণীয় অগ্রগতির মুখোমুখি হয়েছি। মানবেতিহাসে এ ব্যাপক পরিবর্তন আমাদের সামনে এ প্রশ্ন উত্থাপন করছে যে,আধুনিক সমাজে ধর্মের এ নবজাগরণের কারণ কি আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তির অক্ষমতা ও দুর্বলতার মধ্যে নিহিত নাকি এ বিষয়টি ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার কার্যকরী প্রভাব এবং ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি মানুষের সর্বকালীন মুখাপেক্ষিতার ফল? আমাদের দৃষ্টিতে এ দু’টি কারণ বর্তমান সময়ে সমন্বিত হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
আধুনিক জীবনে বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের প্রবৃত্তিগত চাহিদা পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে যা কেবল মানুষের বস্তুগত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ দাবি প্রমাণের জন্য সাম্প্রতিক সমাজে প্রচলিত ঘটনাসমূহ পর্যালোচনাই যথেষ্ট। বিশ্বসমাজ নৈতিক অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে,অন্যায়-অবিচার ব্যক্তিগত পর্যায়ের সীমা ছাড়িয়ে সামাজিক,রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তি অন্যায়কে ন্যায়,মিথ্যাকে সত্য,মন্দকে ভাল,অকল্যাণকে কল্যাণ রূপে উপস্থাপন করে বিবেকসমূহকে লোহার খাঁচায় বন্দি করেছে। সুতরাং প্রকৃত দৃষ্টিতে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিকে বুদ্ধিবৃত্তির অনুপস্থিতি বলা যেতে পারে।
অতি হিসেবী,সুবিধাবাদিতা,স্বার্থপরতা,আত্মাহীন ছক বাঁধা জীবন,নৈতিকতাকে উপেক্ষা,আত্মবিস্মৃতি ও উদাসীনতা,মানবিক দায়িত্বহীনতা,ধ্বংসকামী প্রবণতা প্রভৃতি সংকট আধুনিক মানুষকে লক্ষ্যহীন,গৌণ ও নিরর্থক এক সত্তায় পরিণত করেছে। বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চিন্তায় রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই মুক্তির সর্বোত্তম পথ ধর্মের দিকে প্রত্যাবর্তন বলেছেন। মার্টিন হোয়াইটগার উপরিউক্ত সমস্যার সমাধান শুধু স্রষ্টাই করতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন। কিউটিটের মতে,দুনিয়ামুখী ও বস্তুবাদী বুদ্ধিবৃত্তি একটি সময় পর্যন্ত আধুনিক সংস্কৃতির এক বড় অংশকে নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হলেও অতি দ্রুত তার অকার্যকারিতা ও অক্ষমতা ফুটে উঠেছে এবং ঐতিহ্যবাহী ধর্মগুলোর স্থান দখলে ব্যর্থ হযেছে। কারণ,মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মের অপ্রতিস্থাপনীয় কার্যকর ভূমিকা রয়েছে; ধর্মহীন ও ধর্মনিরপেক্ষ সভ্যতা তার সুদীর্ঘ একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগে তা পূরণে অক্ষম হয়েছে। গ্রিফিন বিশ্বাস করেন,আধুনিক বিশ্বদৃষ্টি যা অভিজ্ঞতা,ইন্দ্রিয়নির্ভর জ্ঞান,অবাধ স্বাধীনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের তত্ত্ব-নির্ভরতা স্রষ্টাহীনতা,নীতি ও মূল্যবোধের আপেক্ষিকতা,বস্তুবাদিতা,জীবনের অর্থহীনতা,সামরিক ও পেশীশক্তির প্রাধান্য এবং নব্য গোত্রবাদে পর্যবসিত হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীগুলোকে প্রথমটির অর্থাৎ স্রষ্টাহীনতা ও ধর্মহীনতার ফল বলা যায়। এ বিষয়গুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে অসংখ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যা নব্য আধুনিকতাবাদের ধারক নতুন এক বিশ্বের জন্ম দিয়েছে। সিডমন্ডের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষ মতের সমর্থক ও সমালোচক উভয় পক্ষের লোকেরা এ বিষয়ে একমত যে,ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি ও মতবাদ বর্তমান যুগের মানুষের ব্যক্তিগত,নৈতিক ও সামাজিক জীবনকে পরিচালনার উপযোগী কাঠামো উপস্থাপনে সক্ষম নয়। তাই ধর্মের দিকে প্রত্যাবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
আধুনিকতাবাদ অপর যে সমস্যার মুখোমুখি তা হল মানুষের প্রকৃত পরিচয় ও সামাজিক সম্পর্কসমূহের রূপ সম্পর্কে তার অজ্ঞতা। মানুষের পরিচালনামূলক ও প্রমোদমূলক আচরণের বিপরীতে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনামূলক আচরণ সকল সময় পরিকল্পনা,কর্মসূচি,কর্মপদ্ধতি ও উপকরণ নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল। দৈনন্দিন জীবনে ক্ষুদ্র ও ব্যষ্টিক পর্যায়ে (micro level) পরিকল্পনা প্রণয়নে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি উপকারী ভূমিকা পালনে সক্ষম। কিন্তু মানুষের সামগ্রিক জীবনের সকল দিকের জন্য কল্যাণকর ও ভারসাম্যপূর্ণ সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন কোন একক ব্যক্তির জন্য তো সম্ভব নয়ই,এমনকি সামষ্টিকভাবেও এ বিষয়টি তার ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। কারণ,প্রথমত মানুষের নিকট তার আত্মপরিচয়,বিশেষত তার সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক ও সম্পর্ক সবচেয়ে অজানা বিষয়। দ্বিতীয়ত মানুষের আত্মা অমর এক সত্তা এবং তার জন্য রয়েছে এক অনন্ত জীবন যার কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে জানা বুদ্ধিবৃত্তির জন্য অসম্ভব এক বিষয়। কারণ,এ সম্পর্কে তার কোন অভিজ্ঞতা নেই। এখানেই সার্বিক জীবন পদ্ধতির রূপরেখা দানকারী এক জীবনাদর্শের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরূপ সকল বিষয়কে ধারণ করে এমন জীবনাদর্শ কেবল ওহী দ্বারাই পূরণ হওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য,সাধারণত অজ্ঞতাবশত বর্তমান বিশ্বের সকল প্রকার উন্নতিকে বুদ্ধিবৃত্তিনির্ভর আধুনিকতার ফল বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ, আধুনিক সভ্যতার বস্তুগত দিকের উন্নয়নে ধর্ম,বিশেষত ইসলাম কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে,আবার কোন কোন ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেছে।
যদিও ইসলামী সভ্যতা স্বল্প কয়েক শতাব্দীর জন্য শাসন করেছে,কিন্তু সে স্বল্প সময়েই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গুরুত্বপর্ণ ভূখণ্ডসমূহের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে আমূল পরিবর্তন ঘটায় ও বিশ্বকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে টেনে আনে।
মানুষের উৎপত্তির সময় থেকেই ধর্ম উন্নত নৈতিক চরিত্র,ন্যায় ও সত্যের প্রতি ভালবাসা এবং মানুষের কল্যাণের জন্য আবশ্যকীয় কর্মকে তাদের সামনে তুলে ধরেছে ও এর দিকে উদ্দীপনা সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। কারণ,ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন কারণ ও নিয়ামক মানবেতিহাসে বিদ্যমান নেই যা মানুষকে উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য,সত্যনিষ্ঠা,ন্যায়পরায়ণতা,মানবীয় আচরণ ও উপযুক্ত কর্মের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিবাচক দিকগুলো ইসলামী সভ্যতার সাথে পরিচয়ের পর উদ্ভূত হয়েছে এবং তা এ সভ্যতার সম্প্রসারণের মাধ্যমেই ঘটেছে। ম্যাকস ওয়েবার ও পার্সোনেজ আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতি,রাজনীতি,বিজ্ঞান,শিল্পকলা,রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা,ঐক্য,শৃক্সক্ষলা,স্বাধীনতা,স্বনির্ভরতা সর্বোপরি জ্ঞানগত উন্নতি ও সার্বিক দক্ষতার মূল খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষায় নিহিত বলে দাবি করেছেন। যদিও এ কথা সর্বৈবভাবে গ্রহণযোগ্য নয়,কিন্তু ধর্মের -অবশ্য যদি তা সঠিক অর্থে ধর্ম হয়- যে এরূপ ক্ষমতা রয়েছে তা অবশ্যই সত্য।
ধর্মহীন নৈতিকতার প্রধান দু’টি ধারাই দায়িত্ববোধকেন্দ্রিক (Deontologist) ও উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক (Teleologist) নৈতিকতাকে বুদ্ধিবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক্ষেত্রে নৈতিকতার বিকাশে ধর্মের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্বীকার করলেও অধিকাংশই ধর্মের প্রতি অমুখাপেক্ষিতার দাবি করেছেন। পরিণতিতে এ দুই মত আত্মত্যাগ,অপরকে প্রাধান্য দান,নিঃস্বার্থ হওয়া,পরোপকার,ক্ষমা,স্বীয় স্বার্থ বিরোধী হলেও সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়গুলো বস্তুবাদী চিন্তায় বুদ্ধিবৃত্তির পরিপন্থী কাজ বলে বিবেচিত হওয়ায় অর্থহীন গণ্য হয়েছে। কারণ,এরূপ কর্মসমূহের বিপরীতে বস্তুগত কোন প্রতিদান তো পাওয়া যায়ই না বরং বঞ্চিত হতে হয়। উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক নৈতিকতায় বিশ্বাসীরা যাঁরা সামগ্রিক স্বার্থের কথা বলেন তাঁদের দৃষ্টিতেও যেক্ষেত্রে ব্যক্তির জন্য কোন লাভই অর্জিত হয় না সেক্ষেত্রে এ ধরনের কর্ম নিরর্থক। কিন্তু যে চিন্তাধারা নৈতিক কর্মের ভিত্তিকে ধর্ম ও অতিপ্রাকৃতিক অসীম সত্তার সাথে সম্পর্কিত বলে বিবেচনা করে তাদের দৃষ্টিতে নৈতিকতার বিষয় অর্থপর্ণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়। কারণ,এ কর্মগুলো মানুষ হয় তার স্রষ্টার সান্নিধ্য ওূ সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা পারলৌকিক পুরস্কার লাভের আশায় করে থাকে। অর্থাৎ সে তার স্রষ্টার নিকট থেকে প্রাপ্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন বা পারলৌকিক মুক্তির জন্য তা করে। তাই তা যৌক্তিক এক কর্ম বলে বিবেচিত। এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোন কোন নৈতিক মৌলনীতিকে যদি ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু বুদ্ধিবৃত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয় তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কারণ,বস্তুগত দিক দিয়ে এরূপ কর্মের কোন অর্থ হয় না। এ মতের ভিত্তিতেই রোনাল্ড এম. গ্রিন বলেছেন,‘দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের একদল এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন যে,অতিপ্রাকৃতিক সজ্ঞান সত্তা (পরাবস্তু) ও বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মতসমূহ নৈতিক জীবনের উদ্দেশ্য ও কারণ ব্যাখ্যা এবং এরূপ জীবনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। এ সকল দার্শনিক তাঁদের মতের সপক্ষে যুক্তি হিসাবে বলেন,ন্যূনতম ধর্মীয় ও অতিপ্রাকৃতিক চিন্তাগত ভিত্তি ছাড়া সকল প্রকার নৈতিক প্রচেষ্টা অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবে।’
ইমানুয়েল কান্টের মতেও নৈতিকতার বিষয়সমূহ অর্থবহ হওয়া ও কার্যকারিতা লাভের জন্য ধর্মের মুখাপেক্ষী। যদিও কান্ট নৈতিকতার স্থান ধর্মের পূর্বে বলে মনে করেন,কিন্তু তিনি তাঁর শেষ লেখনীগুলোতে যে চিন্তাধারা উপস্থাপন ও সেটাকে শক্তিশালী করার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা হল মানুষের নৈতিক প্রচেষ্টাসমূহ অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য এমন খোদার প্রতি বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যিনি আমাদের নৈতিক ইচ্ছাসমূহের ব্যাপারে পূর্ণ অবহিত এবং তার বিচারক।
গোল্ডনারের মতে,কোন বিধান নৈতিক বা অনৈতিক হওয়ার বিষয়টি সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শর্ত হল নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তা নির্ধারিত হয়েছে অর্থাৎ তার নিরপেক্ষ একটি মনদণ্ড রয়েছে। সমাজে প্রচলিত কোন আইন বা নীতি স্রষ্টার পক্ষ থেকে প্রণীত হওয়া তা নিরপেক্ষ হওয়ার অন্যতম প্রমাণ। যদি স্রষ্টাকে নৈতিকতার উৎস বলে ধরা হয়,তবে এর মাধ্যমে নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন দলের পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি আনুষঙ্গিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে নৈতিক ন্যায়পরায়ণতা পবিত্র একটি বিষয় হিসাবে সর্বজনগ্রাহ্য হয়। নৈতিক বিষয়গুলোকে যখন পবিত্র বলে গণ্য করা হবে তখন মানুষ তা অনুসরণে উৎসাহিত হবে। তাঁর মতে,আইন-কানুন যখন স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হবে তখন তা নিরপেক্ষভাবে সকলের ওপর প্রযোজ্য হবে যা ঐ বিধানসমূহের বৈধতা লাভের কারণ হয়। এ কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে তা পালনে উদ্বুদ্ধ হয়। শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মোতাহহারীর ভাষায় : মানবতার উৎস হল আল্লাহ-পরিচিতি। মানবতা,মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা আল্লাহ-পরিচিতি ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার কোন বিষয়ই তার পরম্পরার সমাপ্তি যদি নৈতিকতার মূলে (আল্লাহতে) না ঘটে তা অর্থহীন... যদি তার মূল মানবাত্মায় প্রোথিত না হয়,তবে তাকে মানবতা বলা যায় না। তার সঙ্গে মনুষ্যত্বের কোন সম্পর্ক নেই... যদি (আল্লাহর প্রতি) ঈমান না থাকে,তবে এরূপ নৈতিকতা জাল টাকার ন্যায় যার কোন মূল্য নেই।
অন্যত্র তিনি বলেছেন : ‘ধর্ম নৈতিকতার ভিত্তি হওয়ার মাধ্যমে নৈতিকতাকে নিশ্চিত করে। যদি নৈতিকতাকে পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত করতে হয়,তবে ধর্মের ভিত্তিতে ও তার সমর্থনে তা হতে হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত যে,ধর্ম অন্ততপক্ষে নৈতিকতার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কারণ,প্রথমত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দান করে যে,যেখানেই নৈতিকতা থেকে ধর্ম বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং ধর্ম দুর্বল হয়ে পড়েছে সেখানেই স্বয়ং নৈতিকতা দুর্বল হয়েছে ও পিছিয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত ধর্ম দুর্ভেদ্য নৈতিক শৃঙ্খলা সৃষ্টি ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তৃতীয়ত যে সকল চিন্তাবিদ নৈতিকতার বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাঁরা এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন যে,ধর্ম নৈতিকতার সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষক।’
সুতরাং বর্তমান সময়েও ধর্ম নৈতিকতার নিশ্চয়তা দানকারী হিসাবে মানব জাতির রক্ষকের ভূমিকা পালন করছে এবং এর অনুপস্থিতিই নৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। এ বিষয়টি আধুনিক সমাজে নতুন করে ধর্মীয় জাগরণের কারণ। (সূত্র:প্রত্যাশা বর্ষ ২,সংখ্যা ১)