আধ্যাত্মিক আনন্দের অপার উতস ঈদুল ফিতর। এক মাসের সংযম সাধনায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দ হল এই উতসব। নফসের কুমন্ত্রণা ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এক মাসের এই জিহাদ মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় জিহাদ। এই জিহাদে যে বিজয়ী হয়, সে অভিজ্ঞতার আলোকে সারা বছরই শয়তানকে পরাজিত করার শক্তি অর্জন করে সেই বিজয়ী মুসলমান।
এক মাসের সংযম সাধনায় মু'মিন অর্জন করে খোদাভীতি এবং রোজার সুবাদে সব ধরনের মন্দ ও অসত স্বভাব দূর হয়ে যায় বলে এই ঈদকে বলা হয় প্রকৃত মানবীয় স্বভাবগুলো বা মানবীয় ফিতরাতের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার উতসব।
অন্য কথায় ঈদুল ফিতর হচ্ছে পাক-পবিত্র হওয়ার উতসব ও মানবীয় প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার উতসব। তাই এই ঈদের আনন্দ কেবল তার জন্যই প্রযোজ্য যে নিজেকে সংশোধন করতে পেরেছে ঠিক যেমন ইফতার করা কেবল রোজাদারের জন্যই শোভনীয়।
কেউ নামাজ পড়লে তা দেখা যায়। যাকাত, হজ্ব, বাহ্যিক জিহাদ এসবও দেখা যায়। কিন্তু রোজা এমন ইবাদত যা বাহ্যিকভাবে দেখা যায় না। একজন রোজাদার যখন রোজা রাখেন তখন তার সঙ্গে সেই ব্যক্তির কোনো পার্থক্য দেখা যায় না যে রোজা রাখেনি ও প্রকাশ্যে পানাহার করছে না।
রোজাদার জানেন যে গোপনে পানাহার করলে কোনো মানুষ তা দেখবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেবল আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে এবং আল্লাহ বান্দাহদের সব কিছু দেখছেন তা জেনেই আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে রোজা রাখেন বিশ্বাসী মুসলমান। আর এভাবেই অর্জিত হয় খোদাভীতি। খোদাভীতি গোনাহ থেকে মানুষের মুক্তির মাধ্যম। রমজান শব্দটি এসেছে রমজ থেকে। এর অর্থ হল, ' যা জ্বালিয়ে দেয়'। রোজা সব পাপ ও মন্দ স্বভাবকে জ্বালিয়ে দেয়। তাই পাপমুক্ত মানুষ পরিণত হয় প্রকৃত মানুষে। আবারও মানুষ হওয়ার আনন্দ নবজন্ম লাভের আনন্দের সমতুল্য।
রোজাদার ফজর থেকে মাগরিবের সময় পর্যন্ত সব ধরনের বৈধ হালাল খাদ্য-পানীয় ও যৌন সম্ভোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। ফলে সারা বছরে হারাম ততপরতাগুলো থেকে দূরে থাকা আরো সহজ হয় তার জন্য।
মানুষের আত্মা মূলত এক পবিত্র সত্ত্বা। আল্লাহই ফুঁকে দিয়েছিলেন এই পবিত্র সত্ত্বা প্রত্যেক মানব দেহে। এক মাসের সিয়াম সাধনা মানুষের আত্মাকে দূষণ-মুক্ত করে তাকে আবারও সেই পবিত্র ও খোদা-দত্ত আত্মায় পরিণত করে।
আমরা পুরো বছর ধরেই মহান আল্লাহর মেহমান। সারা বছর ধরেই আল্লাহ আমাদের ভালো ভালো খাবার দিচ্ছেন ও পানীয় দিচ্ছেন। এসব নেয়ামতের জন্যে আমাদের উচিত আল্লাহর শোকর করা। কিন্তু পবিত্র ও বরকতময় রমজান মাসে আল্লাহ আমাদের জন্যে স্পেশাল আধ্যাত্মিক খাবার দিয়েছেন। পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহর বিশেষ মাহফিলে বা বিশেষ ভোজসভায় শরীক হবার যোগ্যতা অর্জনের জন্যে বিশেষ আধ্যাত্মিক খাবারের বিনিময়ে আমাদেরকে জৈবিক ও দুনিয়াবি খাবার বর্জন করতে হয়। অন্যদিকে আধ্যাত্মিক খাবার দানের জন্য ঈদুল ফিতরের দিনে আল্লাহর প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানান মু'মিন মুসলমানরা। উল্লেখ্য, এইসব আধ্যাত্মিক খাবার হচ্ছে কুরআন অধ্যয়ন, ইসলামী জ্ঞান চর্চা, দোয়া, জিকর, নফল ইবাদত, আত্ম-সংশোধন ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং পাপমুক্ত থাকার উপায় আবিষ্কারের মত জরুরি নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ইত্যাদি।
শাওয়ালের চাঁদ বয়ে আনে ঈদের বার্তা। ঈদের দিনে এক মাসের সংযম অনুশীলনের প্রশিক্ষণ-কোর্সে উত্তীর্ণ মুসলমানরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রশংসাসূচক ও কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপক নানা বাক্য উচ্চারণ করে ছুটে যান প্রেমময় ঈদের জামাতে। রোজার মাসে মু'মিন মুসলমান ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন দরিদ্রদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার যাতনা। তাই ইসলামী ঐতিহ্য বা প্রথা অনুযায়ী ঈদের জামাতে যাওয়ার আগেই তারা পরিশোধ করেন ফিতরা নামক জাকাত যা দরিদ্র, ছিন্নমূল, ইয়াতিম ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। ঈদের জামাতের আগেই ফিতরা পরিশোধ করা উত্তম।
পবিত্র বা নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদের জামাতে যাওয়ার পথে বা ঈদুল ফিতরের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে মুসলমানরা উচ্চস্বরে বলেন, "আল্লাহ সবচেয়ে বড় বা মহান এবং এত মহান যে তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়,এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মা'বুদ বা উপাস্য নেই, আল্লাহ সবচয়ে বড়, সব প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই জন্য, আমাদের সুপথ দেখানোর জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি হে আল্লাহ! এবং আমাদের যা দান করেছেন সে জন্য তোমায় ধন্যবাদ।"
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপক বা প্রশংসাসূচক এই জাতীয় বাক্যগুলো উচ্চারণের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নিজেও তা করতেন। এমনকি খুতবা দেয়ার আগে ও পরে মহানবী (সা.) এইসব বাক্য উচ্চারণ করতেন।
এ বছর আমরা এমন সময় ঈদুল ফিতর উদযাপন করছি যখন মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো দেশ সংকট ও সহিংসতার শিকার হয়ে আছে দীর্ঘ দিন ধরে। এই দেশগুলোর জনগণ ঈদের স্বাভাবিক ততপরতা ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর, বাহরাইন, আফগানিস্তান ও তিউনিশিয়ার মত দেশগুলো নানা ধরনের অশান্তি, নৈরাজ্য ও সহিংসতার শিকার। মিয়ানমারসহ অন্য অনেক অমুসলিম দেশে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মুসলমানরা। কাশ্মিরেও মুসলমানরা নানা জুলুম এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফিলিস্তিন দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে ইসরাইলী দখলদারদের নাগপাশে বন্দী হয়ে আছে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরাকের মত কয়েকটি দেশের সাধারণ মুসলমানরা ওয়াহাবি সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হচ্ছে প্রায়ই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো।
আসলে পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো চায় না মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকুক ও মাথা তুলে দাঁড়াক। ওয়াহাবিরা কথায় কথায় সাধারণ মুসলমানদেরকে কাফির বলতে অভ্যস্ত। আর মুসলমানদের মধ্যে এভাবে অনৈক্য ও ফেতনা সৃষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্মান্ধ ওয়াহাবি গোষ্ঠী। এদের সহায়তা নিয়ে আলকায়দার মত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রক্ত ঝরাচ্ছে মুসলমানদের। সিরিয়ার কয়েকটি শহরের বিপুল এলাকা ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে এদের তাণ্ডবে। ফলে বহু নারী-পুরুষ ও শিশুকে আশ্রয় নিতে হয়েছে শরণার্থী শিবিরে।
অন্যদিকে মুসলমানদের অনৈক্যের সুযোগে নিরাপত্তা ও স্বস্তি অনুভব করছে দখলদার ইসরাইল।
ঈদ উতসব ও ঈদের জামাতে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের উপস্থিতি ইসলামের শক্তি তুলে ধরা এবং ইসলামের শত্রুদের হতাশ করে দেয়ার জন্য জরুরি। এ কারণে ঈদের জামাতে পুরুষের পাশাপাশি নারী ও এমনকি শিশুদের অংশগ্রহণের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে ইসলামী বর্ণনায়।
হাদিসে এসেছে, মানুষের জন্য সেই দিনটিই হচ্ছে প্রকৃত ঈদ যেদিন সে কোনো পাপ বা গোনাহয় লিপ্ত হয় না। অর্থাত নিজেকে পাপ থেকে রক্ষা করতে পারাটাই হচ্ছে মু'মিনের জন্য প্রকৃত সাফল্য।
পবিত্র রমজান মাসে মুসলমানরা যে খোদাভীতি ও উন্নত স্বভাব-চরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হয় তা সারা বছর এবং সারা জীবন ধরে রাখা খুবই জরুরি। মুসলমানরা যদি পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরের প্রকৃত শিক্ষাগুলোর আলোকে নিজেকে, ইসলামী সমাজকে এবং মুসলমানদের ও গোটা মানবজাতির অবস্থাকে উন্নত করতে সক্ষম হয় তাহলেই ঈদগুলো হবে সার্থক।
ইসলাম মানব-প্রকৃতির ও প্রকৃত মানবতার ধর্ম। তাই প্রকৃত মুসলমান ঈদের দিনে ভুলে যেতে পারেন না প্রতিবেশীর বা আত্মীয়-স্বজনের দুঃখ-বিপদের কথা, ভুলে যেতে পারেন না মৃত ব্যক্তিদের কল্যাণের কথা যারা ছিলেন ঘনিষ্ঠজন, পিতা-মাতা, কিংবা প্রতিবেশী। ঈদের দিনে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, অন্নহীন, দরিদ্র, ভুগা-নাঙ্গা, ঋণগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত, বন্দী, অভাবগ্রস্ত প্রবাসী বা মুসাফির ও মজলুম বা বঞ্চিত মানুষদের কথা। সাধ্য অনুযায়ী এইসব মানুষের সেবা করা উচিত সব মুসলমানের।
মুসলিম দেশগুলো থেকে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করার জন্যও সবাইকে সক্রিয় হওয়ার শপথ নিতে হবে ঈদের দিনে। মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয় ও পরস্পরের প্রতি সহমর্মী হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সব ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ হবে। বর্তমান বিশ্বে কয়েক দশক ধরে মার্কিন আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে ইরানের ইসলামী রাষ্ট্র। ইসলামের জুলুম বিরোধী নীতির আলোকে এই দেশটি মজলুম ফিলিস্তিনি জাতিসহ অন্যান্য মজলুম জাতিগুলোকে দিয়ে আসছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা। ইসলামী ইরানের সহযোগিতার ফলেই হামাস ও হিজবুল্লাহর মত বিপ্লবী দলগুলো দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলের গায়ে পদাঘাত করতে ও তাকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে। আর এসবের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদী শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে এবং ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ দিনকে দিন জোরদারের চেষ্টা করছে। একই ষড়যন্ত্রের আওতায় সাম্রাজ্যবাদীরা ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ-শক্তির ঘাঁটি সিরিয়ায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু মুসলমানদের ঐক্য ও প্রতিরোধ এইসব ষড়যন্ত্র অনেকাংশেই বানচাল করে দিয়েছে।
মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য, সংহতি ও সহমর্মিতা ইরানের ওপর পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকেও বানচাল করতে সক্ষম। মুসলিম দেশগুলো যদি আজ দখলদার ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সহযোগিতার অপরাধে জড়িত পশ্চিমা শক্তিগুলোর কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিত, কিংবা মুসলমানরা যদি পশ্চিমা পণ্য বর্জন করতো তাহলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ত এবং ইসরাইলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ত। মুসলিম দেশগুলো যদি পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদার করে তাহলে তারা পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই সবক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
ঈদুল ফিতর আমাদেরকে এই বৃহত্তর ইসলামী ঐক্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতারই ডাক দিয়ে যাচ্ছে। ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে আমাদেরকে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
বিলিয়ে দেয়ার আজকের এই ঈদ
দেহ নয় কেবল দিলও হোক শহীদ।(রেডিও তেহরান)