বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো সব সময়ই দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে আসছে। এ থেকে বোঝা যায়, পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলোর কাছে কেবল ইসলাম-অবমাননাই হল স্বাধীনতার অর্থ।
সম্প্রতি পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (স.)কে নিয়ে অবমাননাকর চলচ্চিত্র তৈরির জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছে এই ছায়াছবির ইহুদিবাদী নির্মাতা নাকুলা বাসিলে (Nakoula Basseley Nakoula)। ইননোসেন্স অব মুসলিমস বা " মুসলমানদের নিষ্পাপত্ব" শীর্ষক এই ছায়াছবি নির্মাণে তাকে সহায়তা করেছে পবিত্র কুরআন পোড়ানোর জন্য কুখ্যাত মার্কিন পাদ্রি টেরি জোন্স। একজন ভাঁড়কে রাসূল (সা.) হিসেবে তুলে ধরে বিশ্বনবী (সা.)'র চরিত্রকে-কে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে এই জঘণ্য ছায়াছবিতে। এর মাধ্যমে তারা এই বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে যে মহানবী (সা.)'র কাছে কোনো ওহি নাজেল হয়নি বা তাঁর কাছে ওহি নাজেল হওয়ার দাবি মিথ্যা। এ ছাড়াও এই ছায়াছবিতে ইসলাম ধর্মকে বিশ্ব সমাজের জন্য ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক ও মুসলমানদেরকে সেকেলে, উগ্র ও সহিংসতাকামী বলে তুলে ধরা হয়েছে।
ইননোসেন্স অব মুসলিমস বা "মুসলমানদের নিষ্পাপত্ব" শীর্ষক ওই অশালীন ছায়াছবির সারাংশ প্রকাশ করার অল্প কয়েকদিন পরই "শার্লি হেবদো" নামের একটি ফরাসি ম্যাগাজিন বিশ্বনবী (সা.)'র প্রতি অবমাননাকর কিছু কার্টুন প্রকাশ করে একই ধরনের অশালীন বার্তা প্রচারের অশুভ উদ্দেশ্যে। ওই নোংরা ভিডিওটি প্রচার করা হয় ইন্টারনেটে এবং ইউরোপের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় সেইসব অশ্লীল কার্টুন। ফলে বিশ্বব্যাপী বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা প্রতিবাদ জানাতে নেমে আসে রাস্তায় ও শহরের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে। তারা বিশ্বের দেড়শ কোটি মুসলমানের পবিত্রতা ও ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অবমাননাকর এই ভয়ানক সাংস্কৃতিক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া দেখে ইউরোপ এবং আমেরিকার সরকারগুলো প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এর পরপরই তারা অতীতের মতই বাক-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে এইসব জঘন্য অবমাননার নিন্দা জানাতে কিংবা ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমরা আমাদের নাগরিকদের মতামত- তা অন্যদের জন্যই যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন- এইসব মতামত প্রকাশে বাধা দেব না।"
বাক-স্বাধীনতা বলতে কি এটা বোঝায় যে লাগামহীন বা যা-খুশি ইচ্ছা অশোভনীয় ও অশ্লীল মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া, কিংবা যে কোনো বক্তব্য তা সমাজের জন্য যতই ক্ষতিকর বা অশান্তি উতপাদক অথবা নৈতিক অধঃপতনের কারণ হোক না কেন তাও অবাধে প্রচারের লাইসেন্স দেয়া হবে? আসলে প্রত্যেক সমাজ বা দেশের আদর্শ ও নৈতিক চরিত্রের মানদণ্ড অনুযায়ী বাক-স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। এ ব্যাপারে চরম বা লাগামহীন স্বাধীনতার কোনো সুযোগ নেই।
জন স্টুয়ার্ট মিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, " কেউই এটা বলে না যে কর্ম ততপরতা ঠিক চিন্তার স্বাধীনতার মতই অবাধ। বরং ব্যাপারটি ঠিক এর বিপরীত। যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মতামত বা বিশ্বাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এ ধরনের মতামতকে অন্যদের বৈধ স্বার্থের বিরোধী কাজের জন্য উস্কানি হিসেবে কাজে লাগানো হয় তখন এ ধরনের মতামতও প্রকাশের বৈধতা হারিয়ে ফেলে।"
জার্মান লেখক ফ্রাঞ্জ নিউম্যানও লিখেছেন: "এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই ও থাকতে পারে না যেখানে ব্যক্তি-স্বাধীনতা হবে পুরোপুরি শর্তহীন ও বাধাহীন।"
মানবাধিকার ঘোষণার চতুর্থ অনুচ্ছেদে স্বাধীনতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: "স্বাধীনতার অর্থ হল এমন সব কিছু করার ক্ষমতা যা অন্য কারো ওপর আঘাত হানে না বা অন্য কারো ক্ষতি করে না।"
ফ্রান্সের মানবাধিকার ঘোষণায়ও স্বাধীনতার আইনগত সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে গৃহীত মানবাধিকার কনভেনশনের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি এও বলা হয়েছে যে, বাকী-স্বাধীনতা নিঃশর্ত বা চূড়ান্ত নয়। বাক-স্বাধীনতা ব্যক্তির মর্যাদা, জনগণের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার প্রতি আক্রমণাত্মক হতে পারবে না বলে ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এটা স্পষ্ট আন্তর্জাতিক আইনেও বলা হয়েছে যে বাক স্বাধীনতা সীমিত এবং এর নামে যে কোনো সীমারেখা লঙ্ঘন করা যাবে না।
পবিত্র ইসলাম ধর্মও বাক-স্বাধীনতার বিরোধী নয়। সুরা যুমারের ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, "যারা মনোযোগ দিয়ে নানা কথা শুনে, অতঃপর যা উত্তম, তার অনুসরণ করে, তাদেরকেই আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেন এবং তারাই বুদ্ধিমান।"
এই আয়াতে নানা বিষয়ে মত-বিনিময়, সংলাপ ও গঠনমূলক বিতর্কের এবং মতামত তুলে ধরার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর অর্থ কোনো বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বি গ্রুপগুলোর বা পক্ষ ও বিপক্ষের মতামত তুলে ধরা বৈধ যাতে জনগণ উভয় পক্ষের যুক্তি ও বক্তব্য সমান মাত্রায় শুনতে পারে। কুরআন সংলাপকে ধর্মগুলোর মধ্যে মত-বিনিময়ের সবচেয়ে ভালো পন্থা বলে মনে করে। সুরা আনকাবুতের ৪৬ নম্বর আয়াতে এসেছে:
"তোমরা কিতাবধারীদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে না, উত্তম পন্থা ছাড়া; তবে তাদের সাথে নয়, যারা তাদের মধ্যে বে-ইনসাফ। আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য একই এবং আমরা তাঁরই আজ্ঞাবহ।"
অন্য কথায়- ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ তার মত প্রকাশে স্বাধীন, যদি না তা মানুষের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক এবং ইহকালীন ও পরকালীন স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয়।
বাক-স্বাধীনতা যতক্ষণ মানুষের সত প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে ও মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে কেবল তখনই তা সম্মানিত। কিন্তু এর বিপরীত ক্ষেত্রে তা সম্মানিত নয়। মানুষের স্বাধীনতা যদি মানবতা ও মানবীয় মর্যাদার পরিপন্থী হয় তবে তা প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। মানবীয় মূল্যবোধগুলোর একটি অংশ হল বাক-স্বাধীনতা। কিন্তু মানুষের সবগুলো মূল্যবোধ এর আওতাধীন নয়। তাই বাক-স্বাধীনতার নামে মানুষের মর্যাদা ও পবিত্রতার মত বিষয়গুলোকে বিসর্জন দেয়া যায় না। ইসলাম যে কোনো একত্ববাদী ধর্মের অবমাননাকে সব ঐশী ধর্মের অবমাননা বলেই মনে করে। যে কোনো ধর্মের এবাদত বা উপসানার স্থান ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মানিত। তাই সুরা আনআমের ১০৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: "তোমরা তাদের উপাস্যগুলোকে মন্দ বলো না যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য মনগড়া খোদার আরাধনা করে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকেও মন্দ বলবে। .. ..."
পশ্চিমা সরকারগুলো আজ এমন এক মহাপুরুষের অবমাননাকে উসকে দিয়েছে যিনি ইতিহাসের সবচেয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও দুর্নীতিগ্রস্ত যুগে সব ধরনের অনাচার ও দুর্নীতি নির্মূল করেছিলেন। পাশ্চাত্য ইসলাম-অবমাননার অনুমতি দিলেও হলোকাস্টের মত একটি সন্দেহজনক ঘটনার ব্যাপারে গবেষণা করাকেও নিষিদ্ধ করেছে। ফরাসি গবেষক রুজে গারুদি এবং ব্রিটিশ গবেষক আরভিং এ বিষয়ে গবেষণার জন্য জেল-জরিমানার শিকার হয়েছেন। পাশ্চাত্যের এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে খ্যাতিমান ব্রিটিশ লেখক জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, "স্বাধীনতার মূর্তি শুধু আমেরিকাতেই আছে, অন্য কোথাও নেই। কারণ, মানুষ সাধারণত মৃত ব্যক্তিদেরই মূর্তি বানিয়ে থাকে!"
বাক-স্বাধীনতার ব্যাপারে পাশ্চাত্যের এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির আরেকটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হল ব্রিটিশ রাজবধূ কেটের নগ্ন ছবি ছাপানো নিষিদ্ধ করা। ওইসব অনৈতিক ছবি ছাপানোর কারণে ব্রিটিশ রাজপরিবারের আপত্তির মুখে ফরাসি সরকার একটি ফরাসি ম্যাগাজিন বন্ধ করে দেয় এবং ওইসব ছবি ফেরত দিতে প্রতি একদিন বিলম্বের জন্য ওই ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষকে দশ হাজার ইউরো জরিমানা ধার্য করে। ব্রিটেনেও আরোপ করা হয়েছে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা।
অথচ পাশ্চাত্যের কোনো সরকারই দেড়শ কোটি মুসলমানের কাছে শ্রেষ্ঠ মহামানব হিসেবে বিবেচিত বিশ্বনবী (সা.)'র অবমাননাকর ভিডিও ও কার্টুন প্রকাশ নিষিদ্ধ করার জন্য সামান্যতাম ইচ্ছাও প্রকাশ করেনি। তাই এটা স্পষ্ট, পশ্চিমা সরকারগুলো বাক-স্বাধীনতাকে কেবল ইসলাম-অবমাননার জন্যই ব্যবহার করছে।
ইসলামের প্রতি তাদের ক্ষোভের কারণ হল, এ ধর্ম খুব দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ও সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং তারা অকাট্য কোনো যুক্তি দেখিয়ে বিশ্বের জাতিগুলোর মধ্যে , বিশেষ করে পশ্চিমা ও ইউরোপীয় জাতিগুলোর মধ্যে, খোদায়ী এ ধর্মের দ্রুত বিস্তারের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারছে না। আর এ জন্যই তারা ইসলাম-অবমাননার আশ্রয় নিচ্ছে। (সূত্র:রেডিও তেহরান)