যে কোনো মানুষের জন্যই আত্মশুদ্ধি, নৈতিক পরিশুদ্ধি এবং সদাচার অত্যন্ত জরুরি। এসব গুণ ছাড়া প্রকৃত কল্যাণ অর্জন সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি যদি পৃথিবীর সব জ্ঞান অর্জনের পরও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়,তাহলে সে ব্যক্তিকে পরিপূর্ণ স্বার্থক বলা যাবে না। মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। বৈজ্ঞানিক ও শিল্প ক্ষেত্রেও চোখ ধাঁধানো সাফল্য পাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আত্মিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের সাফল্য কতটুকু? মানুষ কি ক্রমেই নীতিবান হচ্ছেন নাকি আরো নীতিহীন হয়ে পড়ছেন? বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দিলে সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই এখন ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে পরিহার করছে। তারা ধর্মীয় শিক্ষাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলছে। এর ফলে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। আত্মিক ও নৈতিক পরিশুদ্ধির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থতা ও নৈতিকতা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি না থাকার কারণে পাশ্চাত্যে সমকামিতার মতো নানা ঘৃণ্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে।
এ পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ও গবেষকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। যারা মানব জাতির ভবিষ্যৎ ও পরিণতি নিয়ে ভাবেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা নৈতিক অবক্ষয়ের বিপদের বিষয়ে শঙ্কিত না হয়ে পারেন না। মার্কিন অধ্যাপক থমাস লিকোনা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি ? এখন সদ্যজাত শিশুদেরকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রতি বছর আমেরিকায় ১৫ লাখ ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে। শিশুদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনও ক্রমেই বাড়ছে। কে জানে ৫০ অথবা ১০০ বছর পরের প্রজন্ম এ পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে? জনমত জরিপগুলোর ফলাফলেও দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার জনগণের একটা বড় অংশ এটা বুঝতে পাচ্ছেন যে, দেশটি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কবলে পড়েছে। তারা এটাও বুঝতে পাচ্ছেন যে, মার্কিন শিশুদেরকে স্কুল ও পরিবারে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া উচিত।’ অধ্যাপক থমাস লিকোনা এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যে নৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পাশাপাশি অনেক মুসলিম দেশেও ধর্মীয় শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এর একটি কারণ হলো, ধর্ম ভিত্তিক নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষার গুরুত্ব এখনো অনেক মুসলমানই বুঝতে সক্ষম হননি। ইসলাম ধর্মকে পুরোপুরি বুঝতে না পারার কারণেই এ ধরনের সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ সৃষ্টি করতেই পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ হচ্ছে আল্লাহর এক মহান সৃষ্টি। মানবদেহ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা সত্ত্বেও এখনো অনেকেই বলছেন, মানবদেহ সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি। মানুষ হচ্ছে দ্বিমাত্রিক জীব। মানুষের রয়েছে শরীর ও আত্মা। অন্য সব প্রাণীর সঙ্গে অনেক মিল থাকলেও মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের এমন কিছু গুণাবলী রয়েছে,যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই।
পরম সত্ত্বা আল্লাহর সর্বোত্তম ও সৌন্দর্যতম প্রকাশ হচ্ছে মানুষ। প্রতিটি মানুষের মাঝে আল্লাহতায়ালা এমন সব যোগ্যতা দিয়েছেন যে, মানুষ ইচ্ছে করলে নিজেকে সর্বোত্তম সৃষ্টি হিসেবে প্রকাশ করতে পারে। আবার এই মানুষই নিকৃষ্টতম সৃষ্টিতে পরিণত হতে পারে। মানুষকে আধ্যাত্মিক এবং বৈষয়িক উন্নতি সাধন ও পূর্ণতা লাভের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। একদিকে প্রজ্ঞা, আর অন্যদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নির্বাচন করার যোগ্যতা হলো মানুষের দু’টি বড় প্রাপ্তি। মানুষের জন্য সততার পথ উন্মুক্ত। নবী-রাসূলেরা হচ্ছেন মানুষের পথপ্রদর্শক ও প্রেরণাদাতা। তবে মানুষ কামনা-বাসনা, অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কবলে পড়ে চরমভাবে বিভ্রান্ত হতে পারে এবং পূর্ণতা ও উৎকর্ষতা লাভের সুযোগ হাতছাড়া করতে পারে।
কাজেই মানুষের সামনে দু’টি পথই খোলা রয়েছে। মানুষ পূর্ণতার পথেও যাত্রা করতে পারে, আবার চরম পতনের দিকেও ধাবিত হতে পারে। পবিত্র কুরআনের সূরা শামসের ৭,৮,৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
মানুষের নফসের ও সেই সত্ত্বার কসম, যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন। এবং [শপথ ] তার পাপ পুণ্যের জ্ঞানের। সেই-ই সফলকাম যে তার [ আত্মাকে ] পরিশুদ্ধ করে এবং সেই-ই ব্যর্থ হয়েছে যে তা দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে।
এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মানুষ উন্নতির মাধ্যমে ফেরেশতার চেয়েও উঁচু মর্যাদায় পৌঁছতে পারে। অপরদিকে মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই ব্যক্তির ওপরই নির্ভর করে তার পরম স্বার্থকতা ও চরম ব্যর্থতার বিষয়টি।
আল্লাহতায়ালা মানুষের সামনে ভালো ও মন্দ- এ উভয় পথই খোলা রেখেছেন। মানুষ তার আক্ল বা বিবেকের মাধ্যমে এবং নবী-রাসূলগণের পথনির্দেশনায় ভালো ও মন্দকে আলাদা করতে পারে। যারা ঐশী শিক্ষার আলোকে আত্মগঠন করতে পারে, আত্মার উন্নতি সাধন করতে পারে এবং পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে থাকতে পারে, তারাই প্রকৃত সফলকাম,তারাই কেবল পরিত্রাণের আশা করতে পারে। রাসূল (সা.) কে পৃথিবীতে পাঠানোর একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। সূরা জুমার ২ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্য থেকে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শোনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল। রাসূল (সা.) রেসালাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, উন্নত নৈতিক গুণাবলীকে পূর্ণতা দিতে আমাকে পাঠানো হয়েছে।
কাজেই প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি সবাইকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, নইলে গোটা মানবজাতিই চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।(রেডিও তেহরান)