বাঙ্গালী
Friday 22nd of November 2024
0
نفر 0

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (২য় পর্ব)

ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (২য় পর্ব)

গত পর্বে আমরা পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলাম যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্যে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা প্রস্তুত করে রেখেছেন, এখন মানুষের কাজ হলো কর্ম ও শ্রমের মাধ্যমে সেগুলোকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর সাহায্যে নিজেদের সার্বিক অভাব ও দৈন্যতা দূর করা। এ পর্বে আমরা নবীজীবনে তথা ইসলামের শিক্ষায় কাজের অবস্থান ও গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
বিশ্ব প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই মানুষের ওপর কাজের একটি গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যাতে মানুষ তাদের চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে প্রকৃতি থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদাগুলো মেটাতে পারে। হযরত আদম (আ) পৃথিবীতে আসার প্রথম দিন থেকেই জীবন যাপনের জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা শুরু করেন। অবশ্য এই চেষ্টা প্রচেষ্টার বিষয়টি কেবল মানুষের জন্যেই নয় বরং সকল প্রাণীকূলের জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য। বেঁচে থাকার তাগিদে সবাই নিজ নিজ জীবিকার প্রয়োজনে কর্মতৎপর। যেমনটি আগেই বলেছি যে, ইসলামী চিন্তাদর্শে কর্মপ্রচেষ্টার বিশেষ একটি স্থান রয়েছে। কেননা এতে রয়েছে মানুষের জন্যে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক অগণিত কল্যাণ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত এবং ধর্মীয় শিক্ষাগুলো মানুষকে কর্মচাঞ্চল্যের পক্ষে অনুপ্রাণিত করে। ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষের উচিত জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে এবং চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। জীবিকার জন্যে চেষ্টা শ্রম দিলে মানুষের মাঝ থেকে যেমন নিষ্প্রাণ আলস্য দূর হয়ে যায় তেমনি মনের ভেতরে এক ধরনের প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়।
দৈহিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্যে কাজ সবোর্ত্তম একটি উপায় বা উপকরণ। মানুষের সাফল্য বা বিজয়ের নেপথ্যে রয়েছে এই কর্মপ্রচেষ্টা। যারা ব্যাপক পরিশ্রমী তাদের সাফল্য ব্যাপক আর যারা অপেক্ষাকৃত অলস তারা সফলতা থেকেও তুলনামূলকভাবে বঞ্চিত। বিবেক তাড়িত মানুষের উচিত দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করার জন্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকা এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করার জন্যে কাজ করা যাতে অপরের কাছে হাত বাড়াতে না হয়। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি ইসলামের স্বাতন্ত্রের কথাটি তুলে ধরছে তাহলো কর্মপ্রচেষ্টার পাশাপাশি ইসলাম তাকওয়ার প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা নূরের সাইত্রিশ নম্বর আয়াতে তাকওয়াবান লোকদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তাঁরা এমন যে, অর্থনৈতিক কাজকর্ম তাঁদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে অর্থাৎ নামায কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখে না।' অন্যভাবে বলা যায় জীবনে আল্লাহ কেন্দ্রিকতা এমন একটি মৌলিক বিষয় যাকে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক সকল কাজকর্মের মাঝেও ভোলা যাবে না। তাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ জীবনের সকল কাজ হতে হবে তাকওয়া ও আল্লাহ কেন্দ্রিক।
সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিবশে যদি এরকম পরহেজগারীপূর্ণ হয় তাহলে ঐ সমাজের প্রতিটি সদস্যের মাঝে সুস্থ ও যথাযথ একটি সম্পর্ক বিরাজ করবে। কেননা মানুষ যখন তাকওয়া ও পরহেজগারীর মধ্য দিয়ে হারাম বা আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজকর্ম থেকে দূরে থাকে তাহলে ঐ সমাজের ওপর আল্লাহর রহমত ও বরকতের বৃষ্টি বর্ষিত হবে। সূরা তালাকের দুই ও তিন নম্বর আয়াতে এসেছেঃ ‘আর যে তাকওয়াবান অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করে,আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন...এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন।' আল্লাহর পূণ্যবান বান্দারা যে যে কাজই করুন না কেন তাঁর শুরুতেই আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টিকে মাথায় রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর সকল কাজই দেখছেন এই বিশ্বাস সবসময় মনে লালন করে কাজ করেন। রাসূলে খোদা (সা) থেকে ইমাম বাকের (আ) বর্ণনা করেছেনঃ ইবাদাতের সত্তুরটি অংশ রয়েছে,তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম অংশটি হলো হালাল উপায়ে রুযির জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো।
তো হালাল উপায়ে রুটি রুযির মধ্যে আল্লাহ যে বরকত রেখেছেন সেই বরকতের কল্যাণেই যে ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের জীবন জীবিকার প্রয়োজনে গঠনমূলক ও ইতিবাচক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়,সে ব্যক্তি পার্থিব জীবনের উন্নতির পাশাপাশি পরকালীন জীবনের জন্যেও ব্যাপক কল্যাণ ও সওয়াব অর্জন করে। এ কারণেই ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে ‘এই পার্থিব জগত হচ্ছে পরকালীন জীবনের কৃষিক্ষেত্র'। আর এই কৃষিক্ষেত কেবলমাত্র সঠিক বা ন্যায় পন্থা অর্থাৎ তাকওয়াময় কাজ কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমেই চাষাবাদ করা যায়।
আল্লাহর নবী রাসূলগণের জীবন কিংবা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ববর্গের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাঁদের জীবন ছিল কর্মমুখর। নবুয়্যত কিংবা আধ্যাত্ম চেতনা তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন জীবিকা অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পাদনের পথ থেকে বিরত রাখেনি। ইমাম সাদেক (আ) বলেছেনঃ যেদিন মানব জাতির আদি পিতা আদম (আ) বেহেশত থেকে পৃথিবীতে এসেছেন,সেদিন থেকেই তাঁর পানাহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি তখন জিব্রাইল (আ) এর সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁর সাহায্য চাইলেন। জিব্রাইল (আ) তখন আদশ (আ)কে পরামর্শ দিয়েছিলেন এভাবেঃ হে আদম! তুমি যদি নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটাতে চাও তাহলে কৃষিবিদ হও এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত হও!হযরত নূহ (আ) এর ক্ষেত্রেও বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি কাঠমিস্ত্রির পেশায় নিয়োজিত থেকেই নয়শ' পঞ্চাশ বছর তাঁর কওমের লোকদের মাঝে দাওয়াতি কাজ করেন।
তারপরও কওমের লোকজন যখন ঈমান আনলো না তখন আল্লাহ তাঁকে আদেশ দিলেন খুরমা গাছ লাগাও। তিনি তাই করলেন। কওমের লোকেরা তাঁকে খুরমা গাছ লাগাতে দেখে উপহাস করলো। কিন্তু নূহ (আ) দমলেন না। খুরমা গাছগুলো যখন ফলবতী হয়ে উঠলো তখন আল্লাহর আদেশে সেগুলোকে কেটে ফেললেন এবং নৌকা বানালেন।
একইভাবে দাউদ (আ)কে একদিন আল্লাহ বললেনঃ হে দাউদ! তুমি একজন নেককার বান্দা! কিন্তু নিজ হাতে কাজকর্ম না করে নাবায়তুল মালের টাকা গ্রহণ করো!দাউদ (আ) একথা শুনে চল্লিশ দিন কাঁদলেন এবং আল্লাহ তাঁর জন্যে লোহাকে নরম করে দিলেন। তারপর দাউদ (আ) কাজ করতে শুরু করেন। নিজ হাতে তিনি তিনশ' ষাটটি লোহার বর্ম তৈরি করলেন এবং সেগুলো বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে বায়তুল মালের টাকার প্রয়োজনীয়তা দূর করলেন। তিনি খুরমা খেজুর গাছের পাতা দিয়ে জাম্বিল বানিয়েও বিক্রি করতেন এবং পরিবারের খাদ্যের জোগান দিতেন।
হযরত শোয়াইব (আ) যখন মূসা (আ) এর কাছে মেয়ে বিয়ে দিলেন তখন তিনি মূসাকে আট বছর তাঁর জন্যে কাজ করার শর্ত দিয়েছিলেন। মূসা (আ) তাই করলেন,আট বছরের স্থলে দশ বছর রাখালবৃত্তি করলেন। ঈসা (আ) কে একজন জিজ্ঞেস করেছিল-আমাদের মাঝে কে সবচেয়ে উত্তম। ঈসা (আ) জবাবে বলেছিলেনঃ যে তার নিজ হাতে কাজ করে এবং নিজের রুযির টাকায় খাবার গ্রহণ করে। স্বয়ং রাসূলে খোদা (সা) কর্মকঠোর হাতে চুম্বন দিয়ে বলেছিলেন-‘এটা সেই হাত যে হাত দোযখের আগুণে পুড়বে না'।
মানুষসহ সকল প্রাণীরই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো জীবনকে সচল রাখার জন্যে চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু চেষ্টা প্রচেষ্টা সম্পর্কে মানুষের রয়েছে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি। কেউ কেউ মনে করেন মানুষের জীবন এই পার্থিব জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেজন্যে তাদের সকল চেষ্টা বা কর্মতৎপরতা এই দুনিয়া কেন্দ্রিক। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন পার্থিব এই জগতেই মানব জীবন সমাপ্ত নয় বরং পরবর্তীকালে রয়েছে অনন্ত আরেক জীবন। সেজন্যে তাঁরা পরবর্তী পৃথিবীর অনন্ত জীবনের সুখ শান্তির স্বার্থে পার্থিব এই পৃথিবীর সকল সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগান। এই দ্বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
কাজ মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া ধর্ম এবং ধর্মীয় শিক্ষাগুলোও মানুষকে কাজের প্রতি উৎসাহিত করে। ধর্ম প্রাকৃতিক একটি বিষয়। এ কথার মানে হলো ধর্মের নিয়মনীতি আর প্রকৃতির নিয়মকানুন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরিপূরক। এর কারণটা হলো উভয়ই এক এবং অভিন্ন শক্তি থেকে উৎসারিত, সেই শক্তি হলো ‘খোদা'। প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী কাজ হলো প্রাকৃতিক বিচিত্র সম্পদ ও সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে উপকৃত হবার জন্যে মানবজাতির তৎপরতা। কর্মপ্রচেষ্টা মানুষের অভ্যন্তরীণ মেধা ও প্রতিভা বিকাশের অন্যতম একটি উপায়ও বটে। আর এই পন্থাটি ধর্মই মানুষের জন্যে প্রদর্শন করেছে যাতে কর্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মানুষ তার আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার সুযোগ পায়।
যেমনটি বলেছিলাম যে ইসলামের বিশ্বদর্শন অনুযায়ী মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য ও আনুগত্য লাভ করা। তাই যা কিছুই মানুষকে তার এই লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে তা-ই মানুষের কাছে বাঞ্ছনীয়। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনজীবিকা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য হলো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হবার শক্তি লাভ করা। মানুষ সুখ শান্তিতে বাস করার জন্যে এবং আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকার জন্যেও খাওয়া পরার প্রয়াজন রয়েছে, ঘরবাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধারও প্রয়োজন রয়েছে। আর এসবই নিশ্চিত হবে কেবল কাজ ও শ্রমের মধ্য দিয়ে। তাই মানুষের অকাট্য অধিকার হচ্ছে বস্তুগত চাহিদাগুলো মেটানোর জন্যে কর্মপ্রচেষ্টা চালানো। তবে শর্ত হলো ঐ কর্মপ্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে কোনোভাবেই আধ্যাত্মিক পূর্ণতার পথকে বন্ধ করা যাবে না, বরং বলা ভালো ঐ কর্মপ্রচেষ্টাকেই আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে পৌঁছার সোপান হিসেবে গ্রহণ করা সঙ্গত, কেননা এটাই হতে পারে তাকওয়া অর্জনের অন্যতম পন্থা। ইমাম বাকের (আ) একটি দোয়ায় বলেছেনঃ ‘হে খোদা!যতোদিন বেঁচে আছি তোমার কাছে কল্যাণময় জীবন কামনা করছি। তোমার কাছে সেরকম জীবন চাই যে রকম জীবন যাপন করলে তোমার আনুগত্যের শক্তি অর্জিত হবে এবং তোমার বেহেশতের জন্যে উপযুক্ততা অর্জিত হবে'।
গত আসরে আমরা নবীজী এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতসহ অন্যান্য নবীরাসূল ও আধ্যাত্মিক মহান ব্যক্তিত্ববর্গের জীবন পর্যালোচনা করে দেখিয়েছিলাম যে তাঁরা কাজ করার প্রতি কতোটা গুরুত্ব দিয়েছেন। নবীদের বেশিরভাগই কৃষিকাজ, পশুর রাখাল, কাঠ মিস্ত্রি, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামী দর্শনে কাজ করাটা ইবাদাত। জীবন জীবিকার প্রয়োজনীয় অর্থ যদি হালাল রুযির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় তাহলে আল্লাহর পথে জেহাদ করার সওয়াব অর্জিত হবে। মহানবী (সা) বক্তব্যে এবং বাস্তবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বেকার থাকার ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। আমরা আজকের আসরের পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনায় কাজের গুরুত্ব ও মূল্যায়ন সম্পর্কে নবীজীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
একটি হাদিস দিয়ে শুরু করা যাক। নবী করিম (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে শ্রম দেয়, কষ্ট করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জেহাদকারী মুজাহিদের মতো....আমি আমার উম্মাতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে যে বিষয়ে উদ্বিগ্ন ও ভীত তাহলো উদরপূজা, বেশি ঘুম এবং বেকারত্ব...যে বা যারা নিজের জীবনের দায়িত্বভার জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয় সে বা তারা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে অবস্থান করে। রাসূলে খোদা (সা) সেই শৈশবকাল থেকেই বিচিত্র কাজকর্মে ব্যস্ত ছিলেন। শৈশব এবং কৈশোরে তিনি রাখালবৃত্তি করেছেন এবং যুবক বয়সে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ করেছেন। নবুয়্যতের দায়িত্ব পাবার পরও তিনি তাঁর কাজকর্ম থেকে বিরত ছিলেন না এবং কখনোই তিনি রাজা বাদশাদের মতো শাহী জীবনযাপন করেন নি।
নবুয়্যতির দায়িত্ব ছিল কর্মব্যস্ততাপূর্ণ। মদিনায় নবীজীবনের বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিতে দাওয়াতী এবং প্রতিরক্ষামূলক কাজে ব্যয় হয়েছে। তারপরও তিনি ন্যুনতম সুযোগকেও কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যয় করতে ভোলেন নি। তিনি সবসময় বলতেনঃ ‘আল্লাহ চান তাঁর বান্দারা হালাল রুযি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ুক'। নবীজী তাঁর দোয়ার একটা অংশে প্রায়ই বলতেনঃ ‘হে খোদা! আমি বেকারত্ব ও অলসতার ব্যাপারে তোমার কাছে মুক্তি চাই'।তিনি আরো বলেছেনঃ ‘যার পানি এবং মাটি রয়েছে অথচ কর্মপ্রচেষ্টার অভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট,সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে।' নবীজীর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ‘কুবা' মসজিদ নির্মাণ করার সময় নবীজী নিজেও মুসলমানদের সাথে কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন, শ্রম দিয়েছেন,তাদেঁর সাথে ছোটো বড়ো পাথর টেনে মসজিদের স্থানে নিয়ে গেছেন।যখনি তাঁর কোনো সাহাবি তাঁর কাছে আসতেন এবং বিনয়ের সাথে তাঁর জায়গায় কাজ করতে বলতেন,নবীজী কিছুতেই অনুমতি দিতেন না,বরং বলতেনঃ ‘তুমি যাও,আরো তো পাথর আছে,নিয়ে আসো'।
নবী করিম (সা)একদিন দেখলেন শক্তিমান এক যুবক সেই সকাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ বললেন,এই যুবক যদি নিজের যৌবনটাকে আল্লাহর রাস্তায় কাজে লাগাতো তাহলে তা কতোই না প্রশংসনীয় হতো। নবীজী বললেনঃ ‘এভাবে বলো না, এই যুবক যদি নিজের চাহিদা মেটানোর জন্যে এবং অপরের কাছে সাহায্য চাওয়া থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলে তার শ্রম আল্লাহর রাস্তাতেই ব্যয় হচ্ছে। একইভাবে যদি সে তার অসমর্থ বাবা-মার স্বার্থে কিংবা তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেপুলেকে অপরের দ্বারস্থ হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্যে কাজ করে থাকে, তাহলেও সে খোদার পথেই শ্রম দিচ্ছে'।নবীজী যেখানেই কারো প্রতি মনোনিবেশ করতেন তখনই তার পেশা সম্পর্কে জানতে চাইতেন।যদি সে বলতো যে কোনো কাজ করে না, তাহলে নবীজী রাগ করে বলতেনঃ ‘আমার আনুকূল্য হারালো। কোনো মুমিনের যদি পেশা না থাকে, তাহলে সে নিজের ধর্মকেই জীবিকার উপায় করে নেয়'।
নবীজীর একথার মানে হলো,জীবিকার ন্যূনতম জোগান না থাকলে মানুষের ধর্ম ও বিশ্বাস বিপদের মুখে পড়ে যায়। এ কারণে আমাদের সবারই এই দোয়া করা উচিতঃ ‘হে খোদা! আমাদেরকে বরকত দান করো! আমাদেরকে আর্থিক দৈন্যতার মাঝে আবদ্ধ করো না'! কেননা মানুষের রুটি রুযি নিশ্চিত না হলে ধর্মীয় কর্তব্য পালনে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। যাই হোক আল্লাহ আমাদের সবাইকে কর্মমূখর জীবন দান করুন। এই দোয়ার মধ্য দিয়ে শেষ করছি আজকের আলোচনা।
ইতোপূর্বে আমরা যেমনটি বলেছিলাম যে ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের বিশ্বাস তার জীবনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সকল ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ বিশ্বাস হচ্ছে জীবনের সকল কাজের ভিত্তিভূমি। তাই ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যও হচ্ছে মানুষ এবং সমাজকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছানো এবং মূল্যবোধগুলোকে শক্তিশালী করা। আর এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরির ব্যাপারে কাজের ভূমিকা অপরিসীম। কাজ মানুষকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ পার্থিব জগতের উন্নতির পাশাপাশি পরকালীন জীবনের মুক্তিরও উপায়। যাই হোক এ বিষয়টি নিয়ে আজকের আসরে আমরা কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইসলামের মৌলিক একটি বিশ্বাস হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীর রিযিকদাতা হলেন আল্লাহ, যেমনটি সূরা হুদের ছয় নম্বর আয়াতে এসেছে। তাহলে মানুষ কেন কাজ করে করে পরিশ্রান্ত হবে? কাজের প্রতি ইসলাম এতো গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটা কি স্ববিরোধী নয়-এ রকম জিজ্ঞাসা অনেকের মনে নিশ্চয়ই জাগে। বিখ্যাত চিন্তাবিদ মরহুম আয়াতুল্লাহ মোতাহহারী এ সম্পর্কে বলেছেনঃ আল্লাহকে আমরা যদি যথার্থভাবে চিনি এবং তাঁর গুণাবলি সম্পর্কে জানি, তাহলে বুঝতে পারবো যে জীবিকার ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের অধিকারের সাথে কোনো বিরোধ নেই। সেজন্যেই সকল অলি-আওলিয়াই কাজ করেছেন। আসলে রিযিকদাতার মানে হলো সৃষ্টিকূলের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সহযোগিতা করা।
যেমন, একটি উদ্ভিদ যখন শেকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে তার প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করে কিংবা কোনো জন্তু যখন তার দন্ত-নখরের শক্তি দিয়ে আক্রমণ চালায় তখন তারা মূলত তাদের রিযিক গ্রহণের শক্তিকেই কাজে লাগায় যা আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ তার সকল সৃষ্টিকেই রিযিক নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তবে মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা সেজন্যে মানুষকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। মানুষকে দিয়েছেন বিবেক বুদ্ধির সেরা নিয়ামত। তাই মানুষ তার জীবিকা নিশ্চিত করার জন্যে নিজের মেধার শক্তিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারে। মরহুম অধ্যাপক মোতাহহারী খোদার রিযিকদাতা হবার ব্যাপারে আরো বলেনঃ মানুষ নিজেদের আয় উপার্জনের জন্যে কিংবা নিজেদের সমৃদ্ধির জন্যে যেসব চেষ্টা চালান, তাও আল্লাহর রায্যাকিয়াতেরই প্রকাশ। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন সকল প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব তাঁর অর্থাৎ আল্লাহ যদি জীবিকার নিশ্চয়তা বিধানকারী না হতেন তাহলে সৃষ্টিকূলে না কোনো চাহিদা থাকতো না থাকতো সহজাত কোনো প্রবণতা। মানুষও নিজের অধিকার বা সম্পদ সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী হতো না।
এদিক থেকে বলা যায় আল্লাহ হলেন রিযিক সরবরাহকারী,তবে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই সবকিছু করেন। আর প্রকৃতির একটি নিয়ম হলো চেষ্টা ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বেশি সুযোগ সুবিধা মেলে। মানুষের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষেরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির বিষয়টি তার শারীরিক সক্ষমতা,চিন্তা ও বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী কর্মতৎপরতার ওপর নির্ভরশীল। আর এইসব সক্ষমতা আল্লাহর জীবিকা সরবরাহকারী সত্ত্বারই প্রমাণবাহী।
আমরা আগেও বলেছি যে নবীজী এবং তাঁর আহলে বাইত কথায় এবং বাস্তবে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নিজেরাও জীবিকা নির্বাহের কাজে তৎপর ছিলেন। একদিন ইমাম কাজেম (আ) নিজের ক্ষেতে কাজ করছিলেন। আলি বিন আবি হামযাহ নামে এক লোক তাঁর কাছে এসে বললেনঃ ‘কেন এ কাজ অন্যদেরকে করতে দিচ্ছেন না'? ইমাম বললেনঃ কেন দেবো! আমার চেয়েও উত্তম ব্যক্তি সবসময় এরকম কাজে ব্যস্ত ছিলেন। লোকটি জানতে চাইলোঃ কে? ইমাম বললেনঃ স্বয়ং রাসুলে খোদা এবং ইমাম আলী (আ)। তাঁদের সবাই আমার পূর্বপুরুষ।মূলত কাজ করাটা নবীজী এবং আল্লাহর মনোনীত বান্দাদের সুন্নাত। আলী (আ) এর জীবনীতে এসেছে তিনি সবসময় জেহাদের ময়দান থেকে ফিরে শিক্ষা ও বিচার সংক্রান্ত তাঁর নিয়মিত কাজকর্মের পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন।তিনি নিজ হাতে বহু খেজুর বাগান আবাদ করেছেন। তিনি মদিনার পশ্চিমের ‘ইয়াম্বা' এলাকায় নিজ হাতে একটি কূপ খনন করেছেন। প্রচণ্ড বাতাসের বেগ থাকায় এ এলাকায় কেউ কাজ করতো না। আলী (আ) ঐ সেখানে জমি কিনে নিজ হাতে বহু কূপ খনন করেন এবং বহু খেজুর বাগান করেন,কষ্ট তাঁকে কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে নি।
আলী (আ) নিজের কর্মময় জীবনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ ‘মদিনায় ভীষণরকম ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাজের সন্ধানে তাই ঘর থেকে বের হলাম। মদিনার উপকণ্ঠেই দেখতে পেলাম এক বুড়িকে, বেশ কিছু মাটির ঢিলা জমিয়ে রেখেছে। বুঝতে পারলাম সেগুলোকে পানি দিয়ে ভেজাতে চায়। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম কাজটা আমি করে দিতে চাই, তবে মজুরি হিসেবে প্রতি বালতি পানি কূপ থেকে তোলার জন্যে একটি করে খুরমা দিতে হবে। আমি ষোলো বালতি পানি তুললাম।আমার হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। ষোলোটি খুরমা নিয়ে নবীজীর কাছে গেলাম এবং দুজনে সেগুলো খেলাম'।
এরকম আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, একদিন আলী (আ) খুরমার অনেক বিচি বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো-এগুলো কী? আলী (আ) বললেনঃ ইনশাআ... খুরমা গাছ। লোকটি বললো, ইমাম ঐ খুরমা-বিচিগুলো সবই নিজ হাতে রোপন করলেন।
হযরত আলী (আ) একবার এক বক্তব্যে বলেছিলেনঃ মুমিন ব্যক্তি সবসময় কর্মব্যস্ত থাকে। যে কাজ করে তার শক্তি বেড়ে যায়। জীবিকার কার্যকারণ হলো কাজ। অর্থাৎ কাজের সাথে জীবিকার সম্পর্ক। তাই জীবিকা অর্জন করতে হলে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করতে হবে। শরীর ভালো লাগছে না-এরকম অলসতা কিংবা ফুরফুরে ভাব উভয় অবস্থাতে যারা কাজ করে তাদের প্রতি মোবারকবাদ। কেননা বিমর্ষতা এবং অলসতা পরকালকে ধ্বংস করে দেয়। এভাবে লক্ষ্য করা যাবে ন্যায়বিচার, বীরত্ব, তাকওয়া, জ্ঞানের দিক থেকে অন্যতম শীর্ষস্থানে থাকা সত্ত্বেও কাজ কর্মকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। হযরত আলী (আ) এর দৃষ্টিতে মানুষ যদি তার পেশায় ও কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া বিধান এভং মানবীয় মূল্যবোধগুলোর সীমারেখা ঠিকঠাকমতো মেনে চলে,তাহলে তা একধরনের ইবাদাত। এ ধরনের পেশাজীবী লোক আল্লাহর প্রিয়ভাজন। তিনি বলেছেনঃ ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পেশাজীবী এবং আমানতদারী ভালোবাসেন'।(রেডিও তেহরান)

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

কোরআনের ঐতিহাসিক অলৌকিকতা
শিয়া-সূন্নীর মধ্যে পার্থক্য কি?
ইসলামের দৃষ্টিতে কর্ম ও শ্রম (২য় ...
মানুষ তার কর্মের ব্যাপারে ...
শীয়া মাযহাবের উৎপত্তি ও ...
ঈদুল ফিতর: ইসলামী ঐক্য ও ...
আল কোরআনের অলৌকিকতাঃ পৃথিবী
Apakah manusia dalam perbuatannya memiliki pilihan? Bila benar, sejauh manakah batas ...
শিয়া-সুন্নি বিরোধ কেন? শিয়ারা কি ...
ধর্মে কোন জোর-জুলুম নেই

 
user comment