মূল : মোহাম্মাদ সাঈদী মেহ্র
অনুবাদ : মোঃ ইউনুস আলী গাজী
আমর বিন উবাইদের সাথে হিশাম বিন হাকামের মুনাযিরা (বিতর্ক)
হিশাম বিন হাকাম ছিলেন, কালাম শাস্ত্র বিষয়ে ইমাম সাদিক (আ.) এর বিশিষ্ট ছাত্রদের একজন। তিনি একদা মু'তাযিলা সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব আমর বিন উবাইদের সাথে মুনাযিরা করেছিলেন। উক্ত বিতর্কে আমর হিশামের কাছে পরাজিত হয়, ঐ সভায় আমরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রও উপস্থিত ছিল। শেইখ কুলাইনি তার উসুলে কাফী গ্রন্থে উক্ত ঘটনাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন :
আলী ইবনে ইব্রাহিম তার পিতা হতে, তিনি হাসান বিন ইব্রাহিম হতে, তিনি ইউনুস বিন ইয়াকুব হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন : একদা ইমাম সাদিক (আ.) এর একদল সাথী তাঁর নিকট বসেছিলেন। তাদের মধ্যে হামরান বিন আ'ইয়ান, মুহাম্মাদ বিন নো'মান, হিশাম বিন সালেম, তাইয়ারসহ আরো অনেকে; যাদের মাঝে হিশাম বিন হাকামও ছিলেন। ঐ সময় হিশাম ছিলেন একজন যুবক।
ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : হে হিশাম! তুমি কি আমাদেরকে বলবে না যে, তুমি আমর বিন উবাইদের সাথে কি করেছো এবং কিভাবে তার কাছে প্রশ্ন করেছো? হিশাম বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (স.) এর সন্তান, আপনাকে শ্রেষ্ঠ মনে করি, আপনার সামনে আমি বলতে লজ্জা পাই এবং আমার জিহ্বায় জড়তা আসে। ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : ‘যখন তোমাকে কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই তখন তুমি সেটাকে পালন করো'
হিশাম বললেন : আমর বিন উবাইদ এবং বসরা মসজিদে তার সভার কথা আমার কানে এলো। এ বিষয়টি আমার নিকট মোটেও সহনীয় ছিল না। অতএব, আমি তার সাথে সাক্ষাতের জন্য বের হলাম এবং শুক্রবার দিন বসরায় প্রবেশ করলাম। বসরা মসজিদে প্রবেশ করে অনেক লোকের মাঝে নিজেকে আবিস্কার করলাম; যাদের মাঝে আমর বিন উবাইদ উপস্থিত ছিলেন...
উপস্থিত লোকেরা তার কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলো। আমিও তার নিকটে যাওয়ার জন্য জনগণের নিকট তার ঠিাকানা জানতে চাইলাম। আমাকে দেখিয়ে দিলে আমি উক্ত জমায়াতের শেষের দিকে যেয়ে দুই উরুর উপর ভর করে বসে বললাম : হে জ্ঞানী ব্যক্তি! আমি অপরিচিত এক ব্যক্তি, একটি প্রশ্ন করার অনুমতি কি আমাকে দেবেন?
-তিনি বললেন : হ্যাঁ।
-আমি বললাম : আপনার চোখ আছে?
-সে বললো : হে বত্স! এ কেমন প্রশ্ন, যা তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ সে বিষয়ে কেন প্রশ্ন করছো?
-আমি বললাম : আমার প্রশ্নগুলো এমনই।
-তিনি বললেন : জিজ্ঞেস করো, যদিও তোমার প্রশ্নগুলো বোকার মত।
-আমি বললাম : আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
-তিনি বললেন : ঠিক আছে জিজ্ঞেস করো।
-আপনার চোখ রয়েছে?
-উবাইদ : হ্যাঁ।
-সেগুলো দিয়ে কি কাজ করেন?
-উবাইদ : রং ও জনগণকে দেখি।
-আপনার নাক রয়েছে?
-উবাইদ : হ্যাঁ
-তা দিয়ে কি করেন?
-ঘ্রান নিয়ে থাকি।
-আপনার মুখ আছে?
-হ্যাঁ।
-তা দিয়ে কি করেন?
-খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করি।
-আপনার কান রয়েছে?
-হ্যাঁ।
-সেগুলো দিয়ে কি করেন?
-শব্দ শ্রবণ করি।
-আপনার কি অন্তর রয়েছে?
-হ্যাঁ।
-তা দিয়ে কি করেন?
-যা কিছু আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে অনুভব করি তা দিয়ে সেগুলোকে নির্ণয় করি।
-এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকা সত্ত্বেও কি আপনি অন্তর হতে মুখাপেক্ষীহীন নন?
-না।
-কেন আপনি মুখাপেক্ষিহীন নন, এগুলো কি সুস্থ্য নয়?
-হে যুবক! যখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোন জিনিষের ঘ্রাণ নেয়, দেখে, আস্বাদন করে অথবা শ্রবন করে সন্দেহ পোষণ করে তখন সেটাকে অন্তরের উপরের ছেড়ে দেয় যাতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে এবং তাদের সন্দেহ দূরীভূত হয়।
-অতএব, মহান আল্লাহ্ অন্তরকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য দান করেছেন?
-হ্যাঁ।
-অর্থাৎ অন্তরের থাকাটা অত্যন্ত জরুরী এবং অন্তর ব্যতীত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিশ্চিত হতে পারে না?
-হ্যাঁ।
-হে আবু মারওয়ান, মহান আল্লাহ্ মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ইমাম ব্যতীত ছেড়ে দেননি যাতে সেগুলো সঠিককে ভুল হতে পৃথক করতে পারে এবং তাদের সন্দেহকে ইয়াকিন বা নিশ্চিত জ্ঞানে পরিবর্তিত করতে পারে। কিন্তু মানব জাতিকে তাদের সন্দেহ ও বিভেদের মাঝে ছেড়ে দিয়েছেন এবং কোন বিষয়ে সন্দেহের সম্মুখীন হলে শরণাপন্ন হওয়ার জন্য কোন ইমামকে তিনি নির্ধারণ করেননি? অথচ আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য তিনি ইমাম তথা পথপ্রদর্শক নির্ধারণ করেছেন যাতে আপনি কোন বিষয়ে সন্দেহের সম্মুখীন হলে তা দূর করে দেয়?! আমর বিন উবাইদ নিরব হয়ে গেলেন এবং কোন উত্তরই তিনি দিলেন না... অতঃপর তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিজের স্থানে বসালেন। এরপর আমি ঐ স্থান ত্যাগ না করা অবধি তিনি কোন কথাও বলেননি এবং নিজের স্থানও ত্যাগ করেননি।
ইমাম সাদিক (আ.) হেসে বললেন : হে হিশাম কে তোমাকে এমন শিক্ষা দিয়েছে? আমি বললাম : এটা এমন একটি বিষয় যা আমি আপনার নিকট হতে শিখেছি এবং সেটাকে শুধুমাত্র সাজিয়ে বর্ণনা করেছি। ইমাম সাদিক (আ.) বললেন : আল্লাহর কসম এ বিষয়টি ‘সুহুফে ইব্রাহিম ওয়া মুসা'তে লিপিবদ্ধ রয়েছে।[১]
রেওয়ায়েতসমূহে ইমামতের প্রকৃত স্থান
ইসলামি রেওয়ায়েত ইমামতের প্রকৃত স্থান এবং ইসলাম ধর্মে এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সুউচ্চ শিক্ষা উপস্থাপিত হয়েছে। এ রেওয়ায়েতসমূহের সংখ্যা এতই বেশী যে, তার প্রত্যেকটির একটি করে নমুনাও যদি এতে উল্লেখ করা হয় তবে তা আমাদের আলোচনাকে অধিক দীর্ঘায়িত করবে।[২] এ কারণে শুধুমাত্র কয়েকটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করাকে যথেষ্ট মনে করছি।
কিছু কিছু রেওয়ায়েতে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যে, পৃথিবী কখনই আল্লাহর হুজ্জাত বা ঐশী নেতা শূন্য থাকবে না। ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন :
«ما زالت الارض إلا و لله فیها الحجّة، یُعَرِّفُ الحلال و الحرام و یدعوا الناس إلی سبیل الله».
অনুবাদ : ‘সর্বদা পৃথিবীতে আল্লাহর হুজ্জাত উপস্থিত রয়েছেন, (যিনি) হালাল ও হারাম সম্পর্কে অবগত করেন এবং জনগণকে মহান আল্লাহর পথে আহবান জানান।[৩]
আবার কিছু কিছু রেওয়ায়েতে সত্য ইমামকে চেনার জন্য চেষ্টা চালানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছ : ইমাম সাদিক (আ.) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে আমরা পড়ে থাকি যে, মহানবী (স.) বলেছেন :
«من مات و لم یعرف إمام زمانه مات میتةً جاهلیّة».
অনুবাদ : ‘যে ব্যক্তি নিজের যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যুবরণ করে, সে জাহিলিয়্যাতের (মূর্খতার যুগের লোকদের) মৃত্যুবরণ করেছে'।[৪]
এছাড়া, ইমামগণ ও মহানবী (স.) স্থলাভিষিক্তদের সংজ্ঞায় উচ্চতর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন : বলা হয়েছে যে, তাঁরা সৃষ্টির উপর মহান আল্লাহর সাক্ষী স্বরূপ, তার পথের প্রতি নির্দেশনা দানকারী, পৃথিবীতে মহান আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি এবং (পৃথিবীতে) ঐশী জ্ঞানের ধারক।
ইমাম রেজা (আ.) ইসলামি সমাজে ইমামতের স্থানের বিষয়টি উল্লেখ করতে গিয়ে একটি পরিপূর্ণ ও দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হল।
মহানবী (স.) নিজের ওফাতের পূর্বে হযরত আলীকে মনোনয়নের মাধ্যমে নিজের রেসালাতকে পরিপূর্ণ করেছেন-এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন : ইমামতের স্থান এর অনেক উর্ধ্বে যে, জনগণ নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি ও ভোটের মাধ্যমে তাতে পৌঁছাতে সক্ষম হবে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে একজনকে ইমাম হিসেবে মনোনীত করবে... নিশ্চয়ই ইমামত নবীগণের পদ এবং আওসিয়ার মিরাস...(নবীদের স্থলাভিষিক্তদেও উত্তরাধিকার, দ্বীনের কর্ণধার ও মুসলমানদের শৃঙ্খলা বিধায়ক) মুমিনদের পার্থিব মুক্তি ও মু'মিনদের সম্মান; ইমামত ইসলামের সুবিস্তৃত শিকড় এবং ইসলামের সুউচ্চ শাখা স্বরূপ। নামায, রোজা ও হজ্ব, জিহাদের পূর্ণতা, গনিমত ও সাদকার বৃদ্ধি, শরয়ী আহকামের বাস্তবায়ন ও হদজারীকারী (দণ্ডবিধি প্রয়োগকারী) এবং ইসলামি ভূখণ্ডের সীমান্ত রক্ষা ইত্যাদি সকল দায়িত্ব ইমামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ইমাম আল্লাহর হালালকে হালাল ও হারামকে হারাম বলে পরিচয় করান এবং আল্লাহর বিধানসমূহের বাস্তবায়ন ঘটান। ঐশী আইনের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। (তারা) প্রজ্ঞা ও উপদেশ এবং স্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে জনগণকে তাদের প্রতিপালকের প্রতি আহবান জানান। ইমাম হলেন উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায়; যার আলো সমগ্র বিশ্বে ছেয়ে যায় এবং নিজে এত সুউচ্চ স্থানে অবস্থান করে যে, মানুষের দৃষ্টি ও হাত সেখানে পৌঁছায় না... ইমাম সঙ্গী'র দুঃসময়ের বন্ধু, দয়ালু পিতা, সহমর্মী, সহোদর ও শিশুর প্রতি ভালবাসা পোষণকারী মায়ের স্বরূপ এবং আল্লাহর বান্দাদের বিপদের সময় তাদের আশ্রয়স্থল।
ইমাম হলেন, জনগণের মাঝে আল্লাহর আস্থাভাজন, তাঁর বান্দাদের প্রতি হুজ্জাত, তাঁর ভূখণ্ডসমূহে তাঁর প্রতিনিধি, তাঁর প্রতি আহবানকারী এবং তাঁর অধিকারসমূহের রক্ষক। ইমাম; সকল গুনাহ হতে দূরে এবং সকল ত্র"টি হতে মুক্ত। তার রয়েছে বিশেষ জ্ঞান, তার (অন্যতম) বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধৈর্য্যধারণ করা... ইমাম হচ্ছে স্বীয় যুগের এমন এক ব্যক্তি যার সমতুল্য কেউ নয়, কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই তার সমপর্যায়ে নয় এবং তাঁর (বর্তমানে) তাঁর বিকল্প (ও প্রতিস্থাপযোগ্য) কেউ নয়...।[৫]
সূত্র :
(১) উসুলে কাফি, বাবুল হুজ্জাত। (মুহাদ্বিরাত ফিল ইলাহিয়্যাত, পৃ. ৩২০ হতে উদ্ধৃত)
(২) এ সকল রেওয়ায়েতের কিছু অংশ অধ্যয়নের জন্য উসুলে কাফি গ্রন্থের বাবুল হুজ্জাহ অধ্যায় অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
(৩) কুলাইনী, উসুলে কাফী, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৪, হাদীস নং ৩।
(৪) প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৭, হাদীস নং ৩।
(৫) প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৪-৩৯০।
source : www.islamquest.net