গালী-গালাজ ও লানত করার বিষয়ে তাকফিরীদের পরস্পর বিরোধী কথাবার্তার বিশ্লেষণ
আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা আবনার রিপোর্ট : গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) আহলে বাইত (আ.) বিশ্বসংস্থায় অনুষ্ঠিত বর্তমান যুগে সাহাবাদের প্রতি গালমন্দ ও অবমাননা করার বিষয়ে আয়োজিত বিশ্লেষণধর্মী এক সভায় হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন তৌহিদী বলেন : বর্তমান সময়ে খলিফাগণ ও সাহাবীদেরকে গালমন্দ করার বিষয়টিকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে শিয়াদেরকে কাফের আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আর সচরাচর সুন্নি মাযহাবের অনুসারীদেরকে শিয়াদের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে এ ইস্যুটিকেই বেশী ব্যবহার করা হয়।
তিনি বলেন : তাকফিরীরা বলে, শিয়ারা যেহেতু গালী-গালাজ ও লানত করে তাই তারা কাফের ও তাদের রক্ত মূল্যহীন। আর এ কারণেই তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে (কুরবাতান ইলাল্লাহ) হত্যা করা উচিত।
হাওযা ইলমিয়া কোমের এ শিক্ষক বলেন : শিয়া বা সুন্নি যে-ই হোক না কেন যদি কেউ যুক্তি-দলিল প্রণয়নের স্থলে গালমন্দ ও লানত করার পথ অবলম্বন করে আমরা তার বিরোধী। কেননা এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিপক্ষ একই কাজ করবে, যা বিভিন্ন সমস্যার জন্ম দেবে।
গালাগালী করা এবং লানত করার বিষয়ে শরিয়তের বিধান কি? -এ শীর্ষক প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বলেন : যদি কেউ গালমন্দ এবং লানত করে তবে তার রক্ত কি হালাল? এ ধরনের ব্যক্তি কি কাফের? আমাদের কথা হচ্ছে হযরত আলী (আ.) শীর্ষস্থানীয় একজন সাহাবী ও খলিফাদের অন্যতম। সুতরাং হযরত আলী (আ.) এর উপর লানত প্রেরণকারীদের ক্ষেত্রে যে বিধান জারী হবে, ঠিক একই বিধান অন্যান্য খলিফার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মুয়াবিয়া হযরত আলী (আ.) কে কাফের বলতো, অথচ মুয়াবিয়া সম্পর্কে সুন্নিরা বলেন যে, তিনি ইজতিহাদ করেছিলেন এবং ভুল করেছেন। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে সাহাবীদের পর কি ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? যদি বন্ধ করে দেয়া হয় তবে সুন্নি মাযহাবের ৪ ইমাম মুজতাহিদ নন।
তিনি বলেন : যদি সাহাবী নয় এমন কোন ব্যক্তি মুজতাহিদ হয় এবং কারো উপর লানত করে, তবে তার ক্ষেত্রেও বলতে হবে যে, সে ইজতিহাদ করেছে এবং ভুল করেছে। এ কাজ ঐ ব্যক্তির কাফের, ফাসিক এবং তার রক্ত হালাল হওয়ার কারণ হবে না।
খারেজি ও নাসেবীগণ হযরত আলী (আ.) কে লানত করতো -এ কথা উল্লেখ করে হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদী বলেন : খারেজীরা যে মুসলমান এ বিষয়টিতে সুন্নি মাযহাবের ইজমা রয়েছে এবং বুখারী খারেজী ও নাসেবীদের থেকে অনেক রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন।
তিনি আরো বলেন : প্রথম খলিফার যুগে এক ব্যক্তি খলিফাকে গালাগালী করলে একদল ব্যক্তি তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। এ সময় খলিফা তাদেরকে বাধা দিয়ে বলেন, শুধু আল্লাহর রাসূল (স.) কে গালী-গালাজকারীর হত্যার বিধান রয়েছে এবং অন্য ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তত্পর হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদী বলেছেন : ‘শিয়ারা সাহাবাদেরকে গালমন্দ করে' -বলে যে অপপ্রচার চালানো হয় তা ডাহা মিথ্যা বৈ কিছুই নয়। আমাদের গ্রন্থগুলোতে এমন একটি রেওয়ায়েতও পাওয়া যায় না যাতে সাহাবীদেরকে গালমন্দ করা করা হয়েছে। বরং এর বিপরীতে আমাদের মঙ্গলবার দিনের জন্য নির্ধারিত দোয়াতে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে দরুদ পাঠ করা হয়। অথচ খোদ সুন্নি মাযহাবের গ্রন্থগুলোতে সাহাবীদের উপর দরুদ পাঠের কথা উল্লেখ নেই।
ইসলাম ধর্ম ঈমান ও কুফরের বিষয়ে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে -এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন : ইসলাম ধর্মে ঈমানের মানদণ্ড হচ্ছে শাহাদাতাইন পাঠ করা। অতএব, যদি কেউ শাহাদাতাইন পাঠ করে তবে সে মুসলমান। আর যদি কেউ প্রকাশ্যে বা অন্য কোনভাবে শাহাদাতাইনকে অস্বীকার করে তবে তা তার কুফরের কারণ হয়। এ ক্ষেত্রে শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গী অভিন্ন হওয়া এক বিষয় এবং একটি মাযহাবের সত্য ও সঠিক হওয়া অন্য বিষয়; যা কাফের হওয়ার কারণ হয় না।
সকল শিয়া গালী-গালাজ ও লানত করে না, বরং হয়তবা মুষ্টিমেয় একটি দল খলিফাগণ ও সাহাবীদেরকে লানত করে যারা শিয়াদের মাঝে ‘মুনাফিক' নামে পরিচিত। আর তারা শিয়াদের বিরুদ্ধে পরিবেশকে বিষিয়ে তোলার চক্রান্তে এ ধরনের ঘৃণ্য কর্ম করে থাকে -এ কথা উল্লেখ করে হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদী বলেন : সুন্নিদের একটি দল লানত করার চেয়ে জঘন্যভাবে শিয়াদেরকে কাফের এবং মুশরিক বলে আখ্যায়িত করে এবং অপরকে মুশরিক বলে আখ্যায়িত করা গালী-গালাজ ও লানত করা অপেক্ষা গুরুতর। অথচ শিয়ারা কখনই সুন্নিদেরকে কাফের বা মুশরিক বলে জ্ঞান করে না।
মধ্যপন্থী ও যুক্তিনির্ভর ব্যক্তিদের অনুসরণ করার মাঝে মুসলমানদের কল্যান নিহিত -এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন : মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে মুসলমানদেরকে প্রজ্ঞা, ওয়াজ-নসিহত এবং উত্তম বিতর্কের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সাথে কথা বলার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন এবং আমাদের উচিত এ পদ্ধতি অবলম্বন করা।
হাওযা ইলমিয়ার এ শিক্ষক বলেন : ইসলামি ঐক্যের অর্থ হচ্ছে, পরস্পরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়া এবং শত্রুদের বিপরীতে এক কাতারবদ্ধ হয়ে পরস্পরের জীবন ও সম্পদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আর সকল মুসলমান যে একই মাযহাবের অনুসরণ করবে এমন ধরনের চিন্তা করাটা অসম্ভব এক বিষয়।
তার সংযোজন : সুন্নি মাযহাবসমূহের মাঝেও বিভেদ পরিলক্ষিত। কেউ কেউ আবু হানিফার মর্যাদার বিষয়ে এতটা অতিরঞ্জন করেন যে, বলে থাকেন হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে নেমে আসার পর হানাফি ফিকাহ অনুসারে মতামত ব্যক্ত করবেন। অথচ এর বিপরীতে বুখার স্বীয় সহীহ গ্রন্থে আবু হানিফা থেকে একটি হাদীসও বর্ণনা করেননি এবং তিনি নিজের রেজাল গ্রন্থে আবু হানিফাকে দূর্বল রাবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বুখারী তার অন্য একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : ‘যখন আবু হানিফার মৃত্যুর খবর সুফিয়ান সুরীকে প্রদান করা হয় তখন তিনি আল-হামদুলিল্লাহ্ বলে বলেছিলেন, এ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মকে ধ্বংস করছিল এবং তার চেয়ে অশুভ সন্তান আর পৃথিবীতে জন্মলাভ করেনি।'
বক্তৃতা শেষে উপস্থিতদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদী।
((لَقَدْ رَضِیَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِینَ إِذْ یُبَایِعُونَکَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ)) -এ আয়াতের অবতীর্ণ হওয়ার বিষয়টি দৃষ্টিতে রেখে সাহাবাদের ন্যায়পরায়ণ হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন : যদি আমরা মেনে নেই যে, মহানবী (স.) এর ১ লক্ষ ৪০ হাজার সাহাবী ছিলেন। এ সংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৪০০ জন সাহাবী বাইয়াতে রেজওয়ানের সময় উপস্থিত ছিলেন। আর যদি এ আয়াতটিকে সাহাবীদের ন্যায়পরায়ণতার দলীল হিসেবে ধরেও নেই -যদিও আদৌ এমনটি নয়- তা সত্ত্বেও মোট সাহাবীদের ১ হাজার ভাগের একভাগ সাহাবীর ন্যায়পরায়ণ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হবে।
ইফকে'র আয়াত সম্পর্কে তিনি বলেন : পবিত্র কুরআনে ইফকের আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, একদল লোক মহানবী (স.) এর স্ত্রীর উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছিল। এতে মহানবী (স.) এর কোন স্ত্রীর নাম নেই। আর কোন শিয়াও এ ঘটনার সত্যতার পক্ষে কথা বলেনি। পক্ষান্তরে যারা মহানবী (স.) এর স্ত্রীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করেছে, সুন্নি মাযহাব তাদেরকে ন্যায়পরায়ণ বলে জ্ঞান করে এবং এর কারণ হল যেহেতু তারা সাহাবী। আয়াতটিতে এমন বলা হয়নি যে, মহানবী (স.) এর স্ত্রীগণ সকল বিষয়ে পবিত্র। এখানে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আয়েশা এমন কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, যার সাথে যুদ্ধ করাকে স্বয়ং আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করা বলে ঘোষণা করেছেন মহান আল্লাহ্।
সুন্নি মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সাহাবার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেন : সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, যে মুসলমান অন্তত একবার মহানবী (স.) কে দেখেছে সে সাহাবী। আর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যে সকল সাহাবীরা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে তাদের প্রশংসা করেছেন। আর যে সকল সাহাবী ফাসেক ছিলেন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাদের ভর্তসনা করেছেন।
সুন্নি মাযহাবের গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত ‘রাফয' শীর্ষক রেওয়ায়েত সম্পর্কে তিনি বলেন : যে সকল রেওয়ায়েতে ‘রাফেজী' শব্দ উল্লেখ হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই আহলে সুন্নাতের সনদ এবং রেজালের দৃষ্টিতে যায়িফ তথা দূর্বল। সুয়ূতী এবং ইবনে জাওযীও এ সকল রেওয়ায়েতকে দূর্বল বলে জানেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদী বলেন : মহান আল্লাহ্ এবং তার রাসুল (স.) এর প্রতি ভালবাসার বুদ্ধিবৃত্তি ভিত্তিক চাওয়া হচ্ছে আল্লাহ এবং তার রাসুল (স.) এর শত্রুদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে মহানবী (স.) এর প্রতি দরুদ প্রেরণের পর যারা মহানবী (স.) কে কষ্ট দেয় তাদের প্রতি লানত করেছেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম তৌহিদীর সংযোজন : সুন্নি মাযহাবের প্রখ্যাত কালামশাস্ত্রবিদ তাফতাজানী তার শরহে আকায়েদ গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.) কে হত্যার নির্দেশ দানের জন্য ইয়াযিদ এবং তার সকল সঙ্গী-সাথীদের প্রতি লানত করেছেন।