বাঙ্গালী
Sunday 1st of September 2024
0
نفر 0

ইমাম মুসা কাযেম (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী

ইমাম মুসা কাযেম (আ) এর শাহাদাত বার্ষিকী
গভীর শোক দুঃখে বাগদাদ নগরী যেন নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। মরুর লু হাওয়া বইছে। তার সাথে সাথে আন্দোলিত হচ্ছে খেজুর শাখাগুলো। সারি সারি খেজুর গাছের শাখাগুলো মাথ দুলিয়ে যেন নগরীর একটি প্রান্তের দিকে নিরব ইঙ্গিত করছে। আব্বাসীয় শাসক খলিফা হারুন এখানেই এক কারাগার বানিয়েছেন। প্রাণ স্পন্দনে সুরভিত এক জনপদকে বিরান করে প্রাণের কাকলিকে সমূলে উৎখাত করে বাগদাদ নগরীর এই প্রান্তসীমায় গড়ে তোলা হয়েছে ভয়াবহ সে জিন্দান খানা। এই কারাগারের অন্তরালে জীবনপাত করেন নম্র, ভদ্র সুশীল এবং সজ্জন ব্যক্তিবর্গ। তাদের গলায়, হাতে ও পায়ে লোহার বেড়ী পরানো হয়। এভাবে এক সময় তাদেরকে ঠেলে দেয়া হয় নির্মম মৃত্যুর দিকে। এখানেই আটক রয়েছেন সে যুগের সবচেয়ে সজ্জন ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব।
রসূল (সাঃ) এর প্রপৌত্র ইমাম মূসা বিন জাফর(আঃ)। তার জীবনের সুদীর্ঘ ২৫টি বসন্ত অতিবাহিত হয়েছে এই কারাগারে। অথচ ইমাম মুসা ছিলেন ধৈর্য্য ও স্থিরতার মূর্ত প্রতীক। সর্বাবস্থায় তিনি ধৈর্য্য ধরতে পারতেন। রাগ বা ক্রোধের চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও তিনি পরিপূর্ণভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আর এ কারণে তিনি কাজেম বা ক্রোধ বিজয়ী হিসাবে পরিচয় লাভ করেছিলেন। আজ ইমাম মূসা কাজেমের শাহাদাত বার্ষিকী। তাই বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সকল মুসলমানকে জানাচ্ছি শোক ও সমবেদনা। আজ আমরা প্রথমেই ইমাম মূসা কাজেমের জীবনের একটি কাহিনী শুনবো এবং এরপর ইমামের জীবন ও কর্ম নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
বিপর্যস্ত এক প্রান্তর। বিশাল এই কৃষিক্ষেত্রের এখানে সেখানে সামান্য কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। এক বৃদ্ধের গৌরবের এই বিশাল সবুজ খামারের আর কিছুই যে অবশিষ্ট নেই। বৃদ্ধ তার ফসলের মাঠের এরকম দুর্দশা দেখে চোখে মুখে অন্ধকার দেখতে থাকে। পুরো এক বছরের সকল ফসল নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্লান্ত শ্রান্ত হতাশ এবং ভগ্ন মনোরথ বৃদ্ধ নিজ জমিনের উপর আক্রোশে ঘুষি মারে। তারপর দুই হাত উপরে তুলে ধরে করুণ ফরিয়াদ করে। হে আল্লাহ ! এবার আমার কি উপায় হবে ? জীবনের দীর্ঘ পথ সম্মানের সাথে পাড়ি দিয়েছি। লোক সমাজে বরাবরই তার মাথা উচু ছিলো, ছিলো সম্মান ও সম্ভ্রম। দুর্যোগ- দুর্বিপাকের এই ধকলে নিঃস্ব হয়ে এখন কারো কাছে তিনি যে হাত পাতবেন সে অবস্থায় নেই। কিন্তু ধার দেনার যে বিশাল বোঝা তার ঘাড়ে চেপেছে তা কি দিয়ে শোধ করবেন ?
নিজের অনাগত ভবিষ্যতের ভাবনায় মগ্ন এই বৃদ্ধ হঠাৎ অশ্ব খুরের আওয়াজ শুনতে পেলেন। পবিত্র মদিনা নগরী থেকে কেউ আগমণ করলেন বোধ হয়। বৃদ্ধ তার অশ্র" মুছলেন এবং অশ্বের শব্দ যে দিক থেকে আসছে সেদিকে মুখ ফেরালেন। হযরত ইমাম মূসা কাজেম (আঃ)এর নুরানী চেহারা তিনি দেখতে পেলেন এবং ইমামের সালামের জবাব দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইমাম গভীর মমতা ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কি হলো বাবা কেন কাঁদছেন ? নিজের বিধ্বস্ত ফসলের ক্ষেতের দিকে বৃদ্ধ ইঙ্গিত করলেন এবং আবারও কাঁদতে শুরু করলেন। ইমাম শান্ত সমাহিত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করলেন , আপনার কতটা ক্ষতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? জবাবে বৃদ্ধ সেই কান্নাকিষ্ট স্বরে বললেন, এই ক্ষেতের ফসল থেকে অন্তত: ১২০ দিনার পাবো বলে মনে করেছিলাম।
ইমাম এ কথা শোনার পর দ্রুতপায়ে নিজ ঘোড়ার কাছে ফিরে গেলেন। তারপর দেড়শ দিনারের একটি থলি হাতে নিয়ে বৃদ্ধের কাছে ফিরে এলেন। তিনি দিনারের এ থলি বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে কখনই হতাশ হতে নেই। দান গ্রহণে অনভ্যস্ত বৃদ্ধ অর্থের থলি হাতে পেয়ে বড়ো অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। এ অর্থ তিনি রাখবেন কি রাখবেন না সে ব্যাপারে দোটানায় পড়লেন। একবার ভাবলেন যাই হোক না কেন দিনারগুলো ফিরিয়ে দেই। এভাবে তিনি ইমাম মূসা কাজেমের চেহারা মোবারকের দিকে তাকালেন। তিনি অবাক হয়ে দেখতে পেলেন, সে চেহারায় পরম প্রশান্তি বিরাজ করছে। কোন গর্ব বা অহঙ্কারের তিল পরিমাণ ছায়া নেই। ইমামের আর্দ্র, কোমল এবং নমনীয় চেহারা মোবারকের দিকে তাকিয়ে অর্থের থলি ফিরিয়ে দেয়ার ইচ্ছে তার উবে গেল। ইমাম মূসা কাজেম বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। তারপর আবার যাত্রা শুরু করলেন। বৃদ্ধ দেখতে পেলেন তার দ্রুত গতিশীল ঘোড়া ক্রমেই দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।
এক জটিল যুগ সন্ধিক্ষণে ইমাম মূসা কাজেম আবির্ভুত হয়েছিলেন। সে সময় সমাজে ইসলামী মূল্যবোধ তলানীতে এসে ঠেকেছিলো। খলিফা এবং শাসকরা জনগণের সেবক হওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ফেতনা ফেসাদ, দুর্নীতি ও বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে ধন-সম্পদ, অর্থ-বিত্ত আহরণে মেতে উঠেছিলো। খলিফা দৃশ্যত ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বটে কিন্তু খলিফা বা তার আমীর ওমরারা কেউই ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তা বলার কোন উপায়ই ছিলো না। ছলচাতুরির মধ্য দিয়ে খলিফা নিজেকে নবীজির পথের অনুসারী বলে দাবী করতেন। সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠির চাপ ও দুর্নীতির কারণে এ ক্ষেত্রে বিরোধীতা করার তেমন কেউ ছিলো না। এমন ঘোরতর দুর্দিনে মুসলিম জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেন ইমাম মূসা কাজেম (আ)।
ইমাম মূসা কাজেম ইসলামী শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি মুসলমানদেরকে ধর্মীয় জ্ঞানে শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে নামকরা আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি দল তৈরী করেন। তার পিতা ইমাম সাদেক(আঃ) যে শিক্ষা ধারা গড়ে তুলেছিলেন ইমাম মুসা কাজেম সে ধারাকে আরও বি¯তৃত করার উদ্যোগ নেন। ইমাম মুসা কাজেমকে কেন্দ্র করে জ্ঞানী গুনী ব্যক্তিদের একটি পরিমন্ডল মদিনায় গড়ে ওঠে। ইমামের অসংখ্য ছাত্র সে সময় মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা, মিশর ও মরোক্কতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এভাবে ইমাম ইসলামের শিক্ষঅকে উজ্জীবিত করে তোলার সাধনায় অবিচল থাকেন। মুসলমানরা সে সময় আব্বাসীয় খলিফাদের সম্পদলিপ্সা স্পষ্ট দেখতে পায়। রাজকীয় সেনাবাহিনী বা রাজকার্য পরিচালনার জন্য যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী অর্থ কোষাগারে জমা হত। অন্যদিকে ইমাম মূসা দিনার বা দিরহাম কিছুই নিজের জন্য জমাতেন না। বরং অভাব ক্লিষ্টদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের অর্থ অকাতরে বিলিয়ে দিতেন।
ইমাম এভাবে সেসময় সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যের রুপরেখা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। এর ফলে প্রতিদিনই আরো অধিকহারে জনগণ ইমামের পবিত্র দীক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তারা ইমামকে কেন্দ্র করে ইসলামের পথে নিজেদের জানমাল সপে দিতে থাকেন। ইমাম মূসা কাজেমের সেরা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্রীতদাসদের মুক্তি দেয়া তিনি অসংখ্য ক্রীতদাসকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিলেন। ইমামের এই কাজের মধ্য দিয়ে একথাই প্রমাণিত হয় যে মানুষের স্বাধীনতা তার কাছে অমূল্য হিসাবে বিবেচিত হতো।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম আলেম শেখ মুফিদ বলেছেন, ইমাম মুসা কাজেম তার যুগের শ্রেষ্ঠতম সাধক, শ্রেষ্ঠতম ধর্মবিদ ছিলেন। তিনি সম্ভ্রান্তমনা উদার হৃদয়ের পুরুষ ছিলেন। সবার সাথে তিনি সহৃদয় আচরণ করতেন। তিনি গরীব দুঃখীদের সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখতেন। রাতে তিনি দিনার দিরহাম এবং কাঁধে আটা-ময়দার বস্তা নিয়ে গরীব দুঃখীদের দ্বারে দ্বারে তা পৌছে দিতেন। মানব দরদী খোদার পথে উৎসর্গীত এই ব্যক্তিত্বের সাথে আব্বাসীয় খলিফা হারুনের সংঘাত বেধে ওঠে। তিনি মানুষকে সত্যের পথে ডাক দিতেন, ধর্মের পথে ডাক দিতেন- এটা হারুনের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। হযরত মূসা কাজেম(আঃ)কে শেষ পর্যন্ত করাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এতেও রাজরোষ নিবৃত্ত হয় না। তাই খলিফার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত ২৫শে রজব বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম মূসা কাজেম (আঃ)কে শহীদ করা হয়।
এবার ইমাম মূসা কাজেম (আঃ)এর কয়েকটি বাণী উপস্থাপন করছি।
ইমাম মূসা কাজেম বলেছেন, জনগণের সাথে প্রীতিপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে, পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার হয়ে ওঠে, মন প্রফুল- ও আশাবাদী হয়ে ওঠে আর সামাজিক সম্পর্ক সতেজ হয়ে ওঠে। ইমাম আরো বলেছেন, ধর্মের নামে যে বৈরাগ্য বরণ করে এবং দুনিয়ার প্রলোভনে যে ধর্মের পথ থেকে সরে যায় সে আমার কেউ নয়। ইমাম মূসা কাজেমের শিক্ষাকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমরা সঠিক ইসলামের পথে এগিয়ে যাব এই হোক আমাদের প্রতিশ্র"তি। #

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

অবশেষে আত্মসমর্পণ করলেন পুজদেমন
৪১৮ যাত্রী নিয়ে প্রথম হজ্ব ফ্লাইট ...
পাকিস্তানের কুয়েত্তা শহরে ...
বাহরাইন সরকারকে অবশ্যই ...
সামেরা শহরে ৫ বিস্ফোরণ ; বদর ...
ইয়েমেনের জনগণের সমর্থনে লন্ডনে ...
عراقی فوج اور سید الشھدا(ع) رضاکار فورس کا صوبہ ...
ইমাম মুসা কাযেম (আ) এর শাহাদাত ...
রায় প্রত্যখ্যান করে সমাবেশ : ...
পাকিস্তানেও লেগেছে একুশের ...

 
user comment