মুহাম্মদ সাইফুদ্দীন গাযী
॥ চার ॥
শায়খআবদুল কাদের জীলানী (রহ.) রচিত ‘গুনিয়াতুত্তালেবীন' কিতাবে হযরত আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : "শাবানের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর আসহাবেরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম [তারবীহ ও তাহাজ্জুদের প্রস্তুতিহিসাবে] কুরআন মাজীদ অধিক পরিমাণে পড়তে শুরু করতেন। নিজেদের ধনসম্পদেরযাকাত আদায় করে দিতেন, যেন গরীব-মিসকীনেরা রামাযানে উপকৃত হতে পারে।শাসক-প্রশাসকগণ বন্দীদের মধ্যে যারা দ-িত হওয়ার উপযুক্ত, তাদের দ-িত করতেনএবং অন্যদের মুক্ত করে দিতেন। ব্যবসায়ীরাও এ মাসে নিজেদের ঋণ পরিশোধ করেদিতেন এবং অন্যদের থেকে নিজেদের পাওনা উসূল করে নিতেন। মাহে রামাযানের চাঁদদেখা দিলে তাঁরা গোসল করে মসজিদে ইতিকাফে বসে যেতেন।" [মাসায়েলে শবেবরাত, মাওলানা রাফাত কাসেমী : পৃষ্ঠা-১৪]
যাকাত আদায়- সাহাবায়ে কিরাম বনামআমরা : হযরাতে সাহাবায়ে কিরামের নীতি ছিল, তাদের মধ্যে যাদের ওপর যাকাত ফরযহয়ে গেছে এবং যাদের রামাযানে বা তার আগে-পরে বছরপূর্তি হবে, তারারামাযানের অপেক্ষা না-করে রামাযানের প্রস্তুতির স্বার্থে শাবান মাসে যাকাতআদায় করে দিতেন। এতে করে একদিকে রামাযানের জন্য ঝামেলামুক্ত হওয়া গেল, অপরদিকে গরিব-মিসকিনদের রোযা পালনে বড় ধরনের সহযেগিতা হলো। এতে গরিবমুসলমানদের ইফতার-সাহরী ও জীবিকার বড় যোগান হতো। ফলে রোযা অবস্থায় দিনেরবেলা আয়-রোজগারের মানসিক ও শারীরিক চাপ অনেক কমে যেত। রোযা রাখা তাদের জন্যতেমন কষ্টকর হতো না। শা'বান মাসে রোযার এই পূর্বপ্রস্তুতির সময় সাহাবায়েকিরামের যাকাত আদায়ের ফলে তাদের এ দানের মান বহুগুণে বেড়ে যেত। কারণ তা ছিলযথাসময়ের দান। সময়ের এক টাকার দান অসময়ের হাজার টাকার দানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।ধনী সাহাবীরা মূলত এভাবেই গরিব সাহাবীদের নেক কাজে শরিক হতেন এবং নিজেদের সাওয়াবের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতেন।
পক্ষান্তরে এ যুগের ধনী মুসলমানদেরঅধিকাংশই এর উল্টো। কয়েক মাস আগে আদায় ওয়াজিব হওয়া যাকাত তারা অনর্থকরামাযানের জন্য বিলম্ব করে থাকেন। রামাযান আসলে যাকাত দেয়ার যেভাবে হিড়িকপড়ে যায়, দেখে মনে হয় ব্যবসায়ী ধনীদের সকলেই যেন রামাযানেই ব্যবসা শুরুকরেছেন। সোনা-গয়না, টাকা-পয়সা যা কিছুর মালিক হয়েছেন, সব রামাযানেই হয়েছেন।তাদের সকলের নিসাবের ওপর বছরপূর্তি যেন রামাযানেই হয়েছে এবং এ মাসেই তাদেরউপর যাকাত ফরয হয়েছে। আসলে কি ব্যাপারটি কি এমন? যদি না হয়ে থাকে, তা হলেপ্রায় সকলেই কেন একই সময়ে যাকাত আদায় করেন? রামাযানে কেন তাদের যাকাত দেয়ারহিড়িক পড়ে? তাদের ধারণা, রামাযানে যাকাত আদায় করলে বেশি সাওয়াব পাওয়াযাবে। অথচ পূর্বে ওয়াজিব হওয়া যাকাত যদি ইচ্ছাকৃতভাবে রামাযানের জন্যবিলম্ব করে, তা হলে সাওয়াবের স্থলে গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
যাকাতআদায়ে বিলম্ব করার ক্ষতি : রামাযানে যাকাত আদায় করার কারণে যদিও এক টাকায়সত্তর টাকা দান করার সওয়াবের আশা থাকে, কিন্তু এ দান যথাসময়ে না-হওয়ারকারণে তার গুণগত মান অনেক কম। কোয়ানটিটি তথা পরিমাণে বেশি মনে হলেওকোয়ালিটি তথা মানে অনেক কম। আর আল্লাহ তায়ালার কাছে যেকোন আমলের কোয়ানটিটিরচাইতে কোয়ালিটির মূল্য অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের আমলের পরিমাণনয়, মান দেখতে চান। কুরআন মাজীদের ৩ স্থানে আল্লাহ তায়ালা এই শব্দ বলেছেন : "তিনি তোমাদের পরীক্ষা নিতে চান, কে তোমাদের মধ্যে উত্তম আমলকারী।" লক্ষণীয় হলো, এখানে ‘অধিক আমলকারী' বলা হয়নি, বরং ‘উত্তম আমলকারী' বলাহয়েছে।
একজন গরিব, যখন তার দুটো টাকার খুবই প্রয়োজন, তখন তার এই দুইটাকার প্রয়োজন পূরণ করে দেয়ার দ্বারা যে পরিমাণ সওয়াব লাভ করা যাবে, অন্যসময়ে যখন তার কোন টাকারই প্রয়োজন নেই, তখন হাজার টাকা দান করা দ্বারা সেপরিমাণ সওয়াবের আশা করা যায় না।
যাকাত আদায়ে বিলম্ব করার দ্বারাযাকাতদাতার দ্বিতীয় যে ক্ষতি হয়, তা হলো একটি নেক কাজের সহযোগিতা করারসওয়াব থেকে বঞ্চিত রইল। এদেশে বহু গরিব-দুঃখী রয়েছে, যারা রোযা রাখারএকান্ত সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেবল দরিদ্রতার কারণে রোযা রাখতে পারে না।কারণ, তার কাছে এ পরিমাণ অর্থ নেই, যদ্বারা সে রামাযানে নিজের বাপরিবার-পরিজনের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে পারে। ফলে তাকে রামাযানের কাঠফাটারোদে মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে অসহনীয় খাটুনি খাটতে হয়, রিকশা-ভ্যান টানতেহয়, মানুষের মালের বোঝা বইতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে সে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রোযাথেকে বিরত থাকে, কিংবা রোযা রেখেও অপারগ হয়ে তা ভেঙ্গে ফেলে। এদেশেরবিত্তবানেরা যদি রামাযানের পূর্বেই যাকাত আদায় করে দিত, তা হলে হয়তো এসবঅজুহাতে এদের অনেকের রোযা ভাঙ্গতে হতো না। এজন্য যাদের রামাযানের পূর্বেইযাকাত আদায় করা ওয়াজিব হয়, কিংবা দু-একমাস পর যাকাত ওয়াজিব হবে।