রমজান আসন্ন। এটা মহিমান্নিত মাস, যাতে আল্লাহ পাক রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে বেহেশ্তের দরজা গুলো খোলা থাকে আর দোজখের দরজা গুলো বন্ধ থাকে। এবং শয়তান কে শিকল পরিয়ে রাখা হয়। এখানে হাজার মাসের উপকারী রাত রয়েছে। যে ব্যক্তি এর মহিমা কে অস্বীকার করল, মুলত সে বঞ্চিত! ( আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্নিত হাদিস)
রমজানের বাকি মাত্র কিছু দিন! জীবনের যে কোন বিষয়ে সফলতা আনতে চাইলে, অথবা কোন বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারন করলে, তার প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের মন মানসিকতা কে স্থির করা এবং গোছানো হওয়া। পুরুষের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন, কিন্তু একজন নারী, বিশেষ করে যারা এখনও একাডেমিক পড়ালেখায় নিয়োজিত, তাদের কে পড়ালেখা,পরিবার পরিচালনা এবং সন্তানের দেখাশোনা সব গুলো কাজই করতে হয়। তাই তাদের জন্য এটা কোন সহজ কাজ নয়। রমজান নিয়ে সবারই কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকে। নিজের ক্ষেত্রেই বলি, জীবনের অনেক রমজান এসেছে , আবার চলে ও গেছে। কত কিছু ইচ্ছা ছিল, বাস্তবে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কেন? অনেক ভেবে দেখেছি, এর একমাত্র কারন দূর্বল পরিকল্পনা।যদিও রমজানের ইস্পিত সফলতা দানের মালিক একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা, তবুও শক্ত পরিকল্পনা এবং নিজের গোছানো হওয়া এক্ষেত্রে বড় ভুমিকা রাখে বলে আমার বিশ্বাস।
এখানে প্রস্তুতির কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল, হয়তো এগুলো আমাদের সবারই কাজে আসবে, ইনশাআল্লাহ!
লক্ষ্য নির্ধারন-
এই রমজানে আমার লক্ষ্য কি? কুরানের কতটুকু আংশ আমি পড়তে চাই। কতটুকু বুঝে পড়তে চাই। কতটুকু আমল করতে চাই। কুরানের কতোটুকু অংশ এই রমজানে মুখস্থ করা আমার পক্ষে সম্ভব। বাহ্যিক এবং মানসিক ভাবে নিজের মধ্যে রমজানের পরে আমি কতটুকু পরিবর্তন দেখতে চাই। কোন কোন বিশেষ বিষয় গুলো সম্পর্কে আমার জ্ঞান কে সমৃদ্ধ করব এই বিশেষ রহমতের মাসে। কতটা সমাজসেবা করবেন। কিভাবে মানুষের উপকার করা যায় তা নির্ধারন করতে হবে। এভাবে লক্ষ্য নির্ধারন করতে হবে।
মানসিক প্রস্তুতি :
যে কোনো কাজের জন্য প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। নিয়তে গরমিল থাকায় অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজও পড়ে থাকে অবহেলায়। রোজার ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা চোখে পড়ে। আবার দিনের বেলায় খাবার সামনে দেখে আত্মলালসায় ভোগেন কেউ কেউ। এজন্য লোভ, অহঙ্কার পরিত্যাগ করে মনোবল দৃঢ় করতে হবে।
শারীরিক প্রস্তুতি :
রোগ-শোক বাঙালির সহজাত প্রবৃত্তি। কেউ কেউ সারা বছরই নানান সমস্যায় ভোগেন। কেউ আবার মৌসুমি অসুখে। তারা ডা³ারের বরাত দিয়ে রোজা ছেড়ে দেন। এ প্রবণতা আত্মঘাতীই বটে। অনেকটা ‘মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা'র মতো। তাদের জন্য এখনই প্রয়োজন শারীরিক সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। সেজন্য ভালো ডা³ারের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করে রোজার আগেই সুস্থ-সবল দেহ তৈরি করে নিতে হবে।
শ্রমিকদের প্রস্তুতি :
শ্রমিক সারা বছরই শ্রমিক। রমজানেও নিশ্চয়ই তাদের কাজ ছাড়ার ফুরসত থাকবে না। তবে ইসলাম এক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা রেখেছে। তা হলো, রমজানে ভারী কোনো কাজ না করা। মালিকের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সহমর্মিতার। দিনমজুরদের জন্য ভালো হয় রোজার আগেই বাড়তি কিছু রোজগার জমিয়ে রাখা, যাতে রোজার দিনগুলোতে বাড়তি চাপ না আসে।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি :
রমজান এলেই ব্যবসায়ীরা খুশিতে আত্মহারা হন। সুযোগে মুনাফা করে নেন বছরের দ্বিগুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাড়তি ফায়দা লোটার ধান্দায় মত্ত থাকেন সবসময়। যে কারণে ভালো সব পণ্য থাকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটি শুধুই অমানবিক নয়, রীতিমত হিংস্রতাও। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে কঠোর সতর্কতা। রাসুল সা. বলেছেন, ‘কেউ যদি কৃত্রিম উপায়ে অর্থাত্ খাদ্য গুদামজাত করে সঙ্কট তৈরি করে, আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ দেবেন কিংবা একদিন না একদিন তাকে অবশ্যই গরিব বানাবেন।' অতএব ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। দাম বাড়ানোর কারণে যেন কোনো রোজাদার কষ্ট না পান, নিজেরাও যাতে হালাল উপার্জনে রোজা পালন করতে পারেন।
সর্বত্র পবিত্রতা রক্ষা করা :
রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা সবার জন্যই কর্তব্য। সবারই খেয়াল রাখা কর্তব্য, নিজের কারণে যাতে কোনো রোজাদারের ক্ষতি না হয়। পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে রমজানে গানবাজনা, সিনেমা হল, হোটেল এবং রোজাদারের জন্য ক্ষতিকর এমন সবকিছুই বন্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি অশ্লীল কথাবার্তা, শব্দদূষণ ইত্যাদি থেকে নিজেকে পবিত্র রাখতে হবে।
সারাদিনের খসড়া পরিকল্পনা
আমরা যারা চাকুরী করি তারা এক রকম খসড়া তৈরী করতে হবে, যারা ছাত্র তারা অন্যভাবে নিতে হবে। এবং পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে,এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
একজন অবিবাহিত মেয়ের জন্য রমজানে অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু একজন ব্যস্ত মায়ের জন্য তা ততটা সহজ নয়। যতটুকু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক সময়ে যাতে সম্পন্ন হয়, তার জন্য সারাটি দিনের কোন সময়টিকে কাজে লাগানো যায়, তা ভেবে বের করতে হবে। কখন আপনি কুরান পড়বেন? নিজের জন্য নফল নামাজ অথবা ইসলামি সাহিত্য অধ্যয়নের উপযুক্ত সময় কোনটি?তারাবিহ এবং কিয়াম, দুটোই কি সম্ভব? না কি যেকোন একটা?
বাস্তবে সারাদিনের এই সময় পরিকল্পনা অনেক সময় কাজে আসেনা। ছোট শিশু সন্তানের মায়ের জন্য ঘড়ির কাটা অনুযায়ী চলা কঠিন। তবু অন্তত এটুকু খেয়াল রাখতে হবে যে, রমজানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আজ আমার কতোটুকু করনীয় ছিল, আর কতোটুকু হল। মায়েদের ক্ষেত্রে যখন বাচ্চারা ঘুমায়, খেলে, অথবা কিন্ডার গার্ডেন, কিংবা স্কুলে ব্যস্ত থাকে সেই সময়টাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সাপ্তাহিক খাবারের তালিকা এবং শপিং লিষ্ট
আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, তাদেরকে নিজেদের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। পুরুষেরা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই দেখা যায় সংসার পরিচালনার প্রত্যেকটি দিক নিজেকেই সামলাতে হয়। রমজানে এটা আসলেই কঠিন যে, সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে কেনাকাটা করা। এটাতে রমজানের মুল্যবান সময়ের অপচয় ও হয়। তাছাড়া হালাল শপ গুলোতে প্রচুর ভীড় থাকে।তাই সারামাস, অন্তত পক্ষে সারা সপ্তাহের খাবারের পরিকল্পনা এবং কেনাকাটা সেরে রাখা দরকার। রমজান সংযমের মাস। এমনিতেই প্রত্যেক গৃহিনীর উচিত সংসারের অযথা খরচ কমানো। যা দরকার নেই, তা বর্জন করা। চাহিদার কোন সীমা নেই। কিন্তু মানুষ তার প্রয়োজনের সীমাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এই বিষয়ক একটি টিপস হচ্ছে, কম কম কেনাকাটায় বের হওয়া। গবেষনায় দেখা যায় ৬০ শতাংশ কেনাকাটা হয় তাতক্ষনিক!
রমজানে কাজের সময় কমাতে আমরা প্যাকেটজাত কাটা সবজি খেতে পারি। আসলে যতটা সময় বাচানো যায় সে চেষ্টা করা দরকার।
দোয়ার তালিকা
রমজান দোয়া কবুলের মাস। এই মাসে আল্লাহ পাকের কাছে চাইলে তিনি বান্দাহ কে ফিরিয়ে দেন না। আমরা কি চাই আমাদের এই দুনিয়ায় এবং পরবর্তী জীবনে? দোযার এই লিষ্ট আমরা এভাবে করতে পারি। দুনিয়া, আখিরাত, ইবাদাত, উম্মাহ, পারষ্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি । আল্লাহর কাছে পাগলের মতো দোয়া করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আল্লাহ পাক হচ্ছেন আল মুজিব...জবাব দাতা। দোযা কবুল হবার সবচেয়ে ভাল সময় গুলোতে দোযা করি। ইফতারের সময়, নামাজে, তাহাজ্জুদ এ,শেষ দশ রাত এ। আল্লাহ আমাদের সবার সকল দোয়া কবুল করুন। আমীন।
ভাল কজের লিষ্ট
রমজান ফুরিয়ে গেলে অনেক সময় আফসোস হয়, হায়! কেন আমি রমজন এ এই ভাল কাজ টা করলাম না! সুতরাং দেরি না করে আসুন আজকেই একটা ভাল কাজের লিষ্ট বানিয়ে ফেলি।চিন্তা করে দেখি কোন কোন ভাল কাজ আমাদের পক্ষে সম্ভব।বিদেশের বাড়িতে গরিব মিসকিন কে খাওয়ানো বা দান করার সুযোগ অনেক কম। তাই এমন হতে পারে যে প্রত্যেক ইফতার ওয়াক্তে আমাদের শিশু সন্তান কে দিয়ে একটি দানবাক্সে কিছু অর্থ জমানো, যা পরবর্তীতে গরীব শিশুদের জন্য ব্যয় হবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এটা খুব পছন্দ করি, কারন আমি মনে করি এতে আমার সন্তানের মধ্যে দানশীলতার গুন সৃষ্টি হবে। আমরা যে শহরে থাকি, সেখানকার ছোট ছোট শিশু বা মহিলাদের জন্য কুরান শিক্ষার ক্লাস শুরু করতে পারি। নিকটস্থ মসজিদে কুরান দান করতে পারি। ফলমুল কিনে মসজিদে রেখে আসতে পারি। আশা করা যায়, কোন রোজাদার এই ফল খেয়ে রোজা ভাংলে অথবা এই কুরানের কপিটি পড়লে তার পুরস্কার আমি ও পাব।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
বাসায় কোন মেহমান এলে, তার আসার পূর্বেই আমরা আমাদের বাসা পরিষ্কার করে ফেলি। রমজান নামক এই পবিত্র অতিথি আসার পূর্বেও তেমনি ভাবে আমাদের চার পাশ পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া উচিত। তবে অবশ্যই এটা সুধু পারিপার্শিক পরিচ্ছন্নতা হবে না, এটা হবে আমাদের অন্তরের পরিচ্ছন্নতা ও।
ঈদের প্রস্তুতি
ঈদ। মুমিনের খুশী। সাধ্য মতো এই খুশীতে সবাই সামিল হবে এটাই রাসুলের সুন্নাহ! রমজানের প্রস্তুতির সময় তথা রমজানের আগেই এর প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।বেশির ভাগ মানুষই প্রস্তুতি নেয় শেষ দিকে। অথচ শেষ দশদিন অনেক গুরুত্বপূর্ন। তাই ঈদের কেনাকাটা, উপহার সামগ্রী, সারাদিনের পরিকল্পনা সব আগে ভাগে করে রাখা ভাল।
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে একটা সফল রমজান পালনের মদ্ধ্য দিয়ে জীবনের আসল লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করুন!আর, আগাম ঈদ শুভেচ্ছা সবাইকে।