[ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ ইসলামিক স্টাডি সেণ্টারের একদল খ্রিস্টান বিজ্ঞানী ও গবেষক কর্তৃক প্রকাশিত ‘জিনিয়াস অব দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড' গ্রন্থের বিষয়বস্তু অনুসরণে এই নিবন্ধ রচিত। গ্রন্থটিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ লেখকগণ ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.)-এর জীবনের ওপর আলোকপাত করেন এবং তাঁর বাণীসমূহ বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে তুলনা করেন। এতে ইসলামী শিক্ষা এবং ইসলামী প্রতিভার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়।]
পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান
বিখ্যাত ফরাসি অংকশাস্ত্রবিদ ও দার্শনিক হেনরী পংকেয়ার (১৮৫৪-১৯১২) বলেছেন : ‘পৃথিবী তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে' এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।' জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক বছরগুলোতে নভোচারীরাও পৃথিবীর নিজস্ব কক্ষপথে ঘোরার ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে পারেননি। কেননা, ঐ সময় পর্যন্ত তাঁরা এ সংক্রান্ত কোন স্থায়ী ভিত্তি দাঁড় করাতে পারেননি। নভোচারীরা মহাকাশযানে করে মাত্র নব্বই মিনিট বা তার কিছু বেশি সময়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন এবং তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। কিন্তু নভোচারীরা ঐ সময় এতো দ্রুত এবং এতো উঁচু দিয়ে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করেন যে, পৃথিবীর কক্ষপথে ঘোরা, না-ঘোরার বিষয়টি আঁচ করতেই পারেননি। মানুষ যখন চাঁদে পদার্পণ করে তখন এ বিষয়টির অনেকটা নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং পৃথিবীর তার কক্ষ পথে ঘোরার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি গ্যালিলিও, কেপলার ও টিকো ব্রাহীর মতো মহাবিজ্ঞানীরাও, যাঁরা সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘোরার প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁরাও পৃথিবীর নিজস্ব কক্ষপথে ঘোরার বিষয়ে কোন আভাস দিয়ে যাননি। অথচ এসব মহাবিজ্ঞানীর কয়েক শতাব্দী আগে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে ঘোষণা করে গেছেন যে, পৃথিবী তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে এবং দিবারাত্রির আবর্তন সূর্য ঘোরার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। প্রাচীন বিজ্ঞানীরা অবশ্য বিশ্বাস করতেন যে, সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো, পৃথিবী নিজেই তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘোরে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘোরার ধারণাকে অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে নাকচ করে দিয়ে গেছেন।
পৃথিবীর জন্ম
পৃথিবীর জন্ম সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, একটি অংকুর (জার্ম) থেকে পৃথিবীর জন্ম হয়। এই অংকুরটি আবার দুটি বিপরীত ভাগে বিভক্ত হয়। এর প্রত্যেকটি ভাগ থেকে সৃষ্টি হয় অণু-পরমাণু। অণু-পরমাণুর সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় মৌলিক বস্তুরাজি। এই মৌলিক বস্তু বিস্তার লাভ করে বিভিন্ন রূপে অর্থাৎ ছোট ও বড় আকার বা অনুরূপ ধরনের বস্তুনিচয় তৈরি হয় এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এই সূত্রের মধ্যে আমরা হুবহু আণবিক সূত্রই দেখতে পাই। অণুর মধ্যে আছে পজেটিভ ও নেগেটিভ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিপরীতধর্মী পদার্থ। এই দুটির সমন্বয়েই অণু গঠিত হয় এবং অণু থেকে সৃষ্টি হয় মৌল উপাদান। আর অণুর মধ্যে সংখ্যাগত বিভিন্নতা দেখা দেয়।
মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, মাটিতে যেসব বস্তু আছে মানবদেহের মধ্যেও তা বিদ্যমান, তবে তা একেবারে সম পরিমাণে নয়। তিনি আরো বলেন, মানবদেহে চারটি উপাদান আছে প্রচুর পরিমাণে, আটটি উপাদান আছে কিছু পরিমাণ আর আটটি উপাদান আছে অতি সামান্য পরিমাণে।
ইমাম জাফর সাদিকে এই তত্ত্ব আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মানবদেহে যেসব বস্তু বা উপাদান কিছু পরিমাণে বিদ্যমান সেগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে : মলিবডেনাম, সিলিসিয়াম, ফ্লুওর, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও জিংক। অন্য যে আটটি উপাদান মানবদেহে আছে সেগুলো হচ্ছে : ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ক্লোর, সালফার ও আইরন।
এছাড়া মানবদেহে যে চারটি উপাদান প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান সেগুলো হচ্ছে : অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাদের ধারণা দিয়েছেন যে, যেহেতু পানির মধ্যে দাহ্য বস্তু রয়েছে, তাই পানিকে আগুনে রূপান্তরিত করা যায়। কি বিস্ময়কর ঘটনা যে, রং ও স্বাদ-গন্ধহীন একটি পদার্থের মধ্য থেকে তিনি হাইড্রোজেনের সন্ধান লাভ করেছেন। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ছাড়া পানি গবেষণা সম্ভব নয়, অথচ এই পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ইন্তেকালের বহু বছর পর।
পরিবেশ দূষণ
পৃথিবীতে শিল্প কারখানা যখন খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং তদজনিত কারণে পরিবেশের ওপর কোন বিপদের আশঙ্কা ছিল না, ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তখনই সুপারিশ করেছিলেন যে, মানবসমাজকে এমনভাবে বসবাস করতে হবে যাতে পরিবেশ দূষিত না হয়। অন্যথায় পরিবেশ দূষণ এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছবে যে, মানুষের বসবাসই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
আজকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ পরিবেশকে এমনভাবে দূষিত করে ফেলতে পারে যে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এখন থেকে কযেকশ' বছর পর ভূপৃষ্ঠে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের অবস্থা হবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয়ের চূড়ায় উঠে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের মতো ক্লেশকর।
নবজাতক শিশুকে মায়ের বাম দিকে রাখা
নবজাতক শিশুদের মায়ের বাম কোলে ঘুম পাড়ানো সংক্রান্ত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর পরামর্শটিও আজকের যুগে তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিচয় তুলে ধরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মর্মে মত প্রকাশের আগ পর্যন্ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইমামের ঐ সুপারিশ খুব একটা বুদ্ধিবৃত্তিক বলে বিবেচিত হয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নবজাতক শিশুদের ওপর গবেষণার জন্য একটি ইনস্টিটিউট আছে। নবজাতক শিশুদের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইনস্টিটিউট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, জন্মের প্রাথমিক দিনগুলোতে ঘুমানোর সময় শিশুরা মায়ের বাম কোলে থাকলে আরাম বোধ করে। বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুর ওপর গবেষণা চালিয়ে ইনস্টিটিউট দেখেছে যে, এ ব্যাপারে সকল শিশুর প্রবণতা অভিন্ন। এক্সরের মাধ্যমে মাতৃগর্ভস্থ অপরিণত শিশু বা ভ্রূণের ওপর গবেষণা চালানো হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত এ ব্যাপারে নতুন কোন তথ্য লাভ করা যায়নি।
শব্দ থেকে ছবি গ্রহণের পদ্ধতি আবিষ্কারের সাথে সাথে এই প্রতিষ্ঠান মায়ের হৃৎযন্ত্রের ওঠানামা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়। হৃৎযন্ত্রের এই ওঠানামার শব্দ সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভ্রূণ বা মাতৃগর্ভস্থ অপরিণত শিশুর কানে গিয়ে পৌঁছে। বহু গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইনস্টিটিউট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মাতৃগর্ভে ভ্রূণ বা অপরিণত শিশু যেহেতু মায়ের হৃৎস্পন্দন শুনে অভ্যস্ত তাই নবজাতক শিশু মায়ের বামদিকের কোলে ঘুমিয়ে বেশি আরাম বোধ করে। ডানদিকে বা অন্য কোন জায়গায় শুলে মায়ের হৃৎস্পন্দন শিশুর কানে পৌঁছে না বিধায় শিশু বলতে গেলে বিশ্রামহীন সময় কাটায়।
মানবদেহের উত্তাপ অসুস্থতা বিস্তার করে
আরো একটি বিষয় উপস্থাপন করে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি বলেছেন, অসুস্থ মানুষের শরীরে এক ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি হয়। এই উত্তাপ যখন সুস্থ মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয় তখন সেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইমাম জাফর সাদিকের এই তত্ত্বকে কুসংস্কার বলে মনে করা হতো, কিন্তু রুশ বিজ্ঞানীরা প্রথম এই কথার প্রতি স্বীকৃতি দিলে ইমামের তত্ত্বকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নভোসিবিরস্কে ঐ দেশের বৃহত্তম মেডিক্যাল, কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, অসুস্থ মানুষের শরীর থেকে নির্গত উত্তাপ সুস্থ মানুষের শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কাকে নিরঙ্কুশ শিক্ষিত বলে বিবেচনা করা যাবে? তিনি জবাব দিয়েছিলেন : ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর সবজান্তা কেউ নেই। মানুষের পক্ষে সবজান্তা হওয়া সম্ভব নয়, তা সে যদি হাজার বছরও জীবন পায় এবং সমস্ত জীবন ধরে জ্ঞান অর্জন করে। কেউ যদি তার জীবনকালের হাজার বছর ধরে সমগ্র বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান অর্জন করে ফেলে তাহলেও সে অপূর্ণ থাকে, কেননা, তার জীবনকালের বাইরেও পূর্বাপর বিশ্বে অনেক জ্ঞান রয়েছে যেগুলো জানা প্রয়োজন।'
ইমাম জাফর সাদিককে একবার অন্যান্য বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রকৃতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি জবাবে বলেছিলেন : ‘আমরা যে দুনিয়ার বাস করছি তার বাইরেও একটি দুনিয়া আছে। সেই দুনিয়া আমাদের বর্তমান দুনিয়ার চেয়ে অনেক বড়। সেই দুনিয়ায় আমাদের এই দুনিয়ার চেয়ে ভিন্নতর আরো অনেক দুনিয়া আছে।'
অন্যান্য দুনিয়ার সংখ্যা কত সে সম্পর্কেও ইমামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি জবাবে বলেছিলেন : ‘একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ তা জানে না।' তাঁকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিজ্ঞান যদি শিক্ষাযোগ্য হয়ে থাকে তাহলে তা বর্তমান দুনিয়ার বিজ্ঞান থেকে আলাদা বিবেচিত কিভাবে? ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছিলেন, ‘অন্য দুনিয়ায় দুই ধরনের বিজ্ঞান রয়েছে। এক ধরনের বিজ্ঞান এই দুনিয়ার মতোই আর এক ধরনের বিজ্ঞান আমাদের অনুধাবন ক্ষমতার বাইরে।' ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর এই বক্তব্যে বিজ্ঞানীরা হতবাক হয়ে পড়েন এবং কোন কোন বিজ্ঞানী তাঁর এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আমাদের এই শতাব্দীতে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং অন্য বিজ্ঞানীদের অবস্তুগত বিষয়ের অস্তিত্ব আবিষ্কারের ফলে ইমাম জাফর সাদিকের বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে। অবস্তুগত জগতের ভৌতিক আইন আমাদের জগতের ভৌতিক আইন থেকে আলাদা। এছাড়া যুক্তিবিদ্যার সব নিয়মও আমাদের অনুধাবনক্ষমতার বাইরে।
(নিউজলেটার, সেপ্টেম্বর ১৯৯১)