বাঙ্গালী
Sunday 24th of November 2024
0
نفر 0

ইমাম রেযা (আ.)এর জন্মবার্ষিকী

জ্বিলক্বাদ মাসের এগারো তারিখ ইসলামের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, হিজরি একশ আটচলি-শ সন। নবীবংশের অষ্টম তারকার আবির্ভাবে মদিনার চারিদিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নাম তাঁর আলী। পিতা নবীবংশের সপ্তম ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.), আর মাতা উম্মুল বানিন নাজমা। তাঁর অনেকগুলো উপাধি ছিল। এসব উপাধির মধ্যে বহুল পরিচিত কয়েকটি হলো আবুল হাসান, রেযা, সাবির, রাযি এবং ফাযিল। উপাধি এবং বংশ পরিচয়সহ তাঁর পুরো নামটি দাঁড়ায় আবুল হাসান আলী ইবনে মূসা আর-রেযা। বিশ্বমানবতার মুক্তিকামী মহান পুরুষ, ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনকামী কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী নেতা নবীবংশের দীপ্তিমান অষ্টম নক্ষত্র ইমাম রেযার (আ.) শুভ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সবার প্রতি রইলো প্রাণঢালা অভিনন্দন ও মোবারকবাদ।

ঝর্ণাগুলো আজ ছড়াচ্ছে কেমন আনন্দের ধারা
আকাশেরনীলও যেন সর্বোচ্চরঙে মাতোয়ারা
নন্দিতনিঃশ্বাসে সবার কালো মেঘ যায় উড়ে
সূর্যেরবিকীর্ণআলোয় তারি সাতরঙ দেয় মুড়ে।
তোমারপ্রথম কান্নায় হাসে বিচিত্র এই প্রকৃতি
শব্দেশব্দে তার জেগে ওঠে নিষুপ্ত এ পৃথিবী
শীতলহাওয়ায় তোমারঅস্তিত্বেরভাসে ঘ্রাণ
সবুজ গমেরশীষে তা-ই বৃষ্টিকণারা আনে তান
এভাবেইতোমার প্রতিঅন্তরে জাগে গভীর প্রেম
দূরদূরান্তের পাড়ি দিয়ে তোমার সৌধে হেম
জ্বালিয়েমোমের বাতি , অন্তরকরে আলোয় পূর্ণ
হে ইমাম !তোমার জন্মদিনে চাই হৃদয়ভরা পূন্য।


নবীবংশেরপ্রত্যেক ইমামের জীবনই নিষ্পাপ ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এবং শাহাদাতের মহিমায় উজ্জ্বল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ভাষ্য অনুযায়ী ইমামদের জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ বষয়টি হলো রাজনৈতিক সংগ্রাম। হিজরী প্রথম শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইসলামি খেলাফত যখন সুস্পষ্টভাবেই রাজতন্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করে এবং ইসলামি নেতৃত্ব জোর- জুলুমপূর্ণ বাদশাহিতে রূপান্তরিত হয় , তখন থেকেই আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণ সময়োপযোগী পদ্ধতিতে বিদ্যমান সকল অব্যবস্থা বা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাঁদের রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকেন। তাঁদের এইসব রাজনীতির বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং ইমামতের ভিত্তিতে হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা। বলাবাহুল্য কায়েমি স্বার্থবাদি মহলের সমূহ অত্যাচার-নিপীড়নের মুখেও তাঁরা তাঁদের এই ইমামতের গুরুদায়িত্ব পালন করে গেছেন। যার ফলে যেন শাহাদাতের পবিত্র রক্ত থেকে জন্মলাভকারী লালাফুলে বাগানের পর বাগান ছেয়ে যাবার পরও ইমামতের সেই ধারা আজো অব্যাহত রয়েছে এবং তাঁদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তাঁদের
যোগ্য উত্তরসূরিগণপৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজো তৎপর রয়েছে। ইমামতের প্রদীপ্ত আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবী তাই তাঁদের যথার্থ দিক-নির্দেশনায় খুঁজে পাচ্ছে প্রকৃত ইসলামের সঠিক দিশা। ইমামের শুভজন্ম তাই সমগ্র মুসলিম জাতির মুক্তির স্মারক।

আবুল হাসানের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ , তখন তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাযেম (আ.) শাহাদাতবরণ করেন। শাহাদাতের পর তাঁরি যোগ্য উত্তরসূরি ইমাম রেযা (আ) মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদানের গুরুভার গ্রহণ করেন। তাঁর ইমামতির সময়কাল ছিল বিশ বছর। এই বিশ বছরে আব্বাসীয় তিনজন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন এবং মামুনের শাসনকাল অতিক্রান্ত হয়েছিল। ইমাম রেযা তাঁর পিতা ইমাম মূসা (আ.) এর নীতি-আদর্শকে অব্যাহত গতি দান করেন। ফলে ইমাম মূসার (আ) শাহাদাতের পেছনে যেই কারণগুলো দেখা দিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই ইমাম রেযাও সেই কারণগুলোর মুখোমুখি হন। অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদি মহলের নেপথ্য রোষের মুখে পড়েন তিনি। আব্বাসীয় রাজবংশে বাদশা হারূন এবং মামুনই ছিল সবচে পরাক্রমশালী এবং দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। তারা প্রকাশ্যে ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তির কথা বলে বেড়াতেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইমামদের রক্তের তৃষ্ণায় তৃষিত ছিলেন। ইমামদের প্রতি তাঁদের এধরনের আচরণের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। এক, আলাভিদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া, এবং দুই শিয়া মুসলমানদের মন জয় করা। ইমামদের সাথে সম্পর্ক থাকার প্রমাণ থাকলে তাদের শাসনও বৈধ বলে গৃহীত হবে-এ ধরনের চিন্তাও ছিল তাদের মনে। কেননা; মুসলমানরা যদি দেখে যে, হযরত আলীর (আ) পরিবারবর্গের প্রতি বাদশাহর সম্পর্ক বা যোগাযোগ রয়েছে, তাহলে তারা আব্বাসীয়দের শাসনকে বৈধ মনে করে খুশি হবে, ফলে তারা আর বিরোধিতা করবে না। এরফলে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হবে। ইমাম রেযা (আ) শাসকদের এই অভিসন্ধিমূলক রাজনীতি বুঝতে পেরে তাদের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তাঁর কৌশলটি ছিল এমন, যারফলে একদিকে বাদশা মামুনের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়, অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের জনগণও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারে। আর সেই সত্য হলো এই যে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ি ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবলমাত্র নবী পরিবারের পবিত্র ইমামগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাঁরা ব্যতীত কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়। জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাদশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে-এই আশঙ্কায় মামুন ইমাম রেযাকে (আ.) সবসময়ই জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। শুধু ইমাম রেযা কেন প্রায় সকল ইমামকেই এভাবে গণবিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা তাঁদেরকে কঠোর প্রহরার মধ্যে রাখার ষড়যন্ত্র করে। তারপরও ইমামদের সুকৌশলের কারণে তাঁদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যায়।

শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে যে ইসলাম
জমিয়েছেপাড়ি কালেরযাত্রায়
আজো তাবিশ্বময় দীপ্তিমান
নবীবংশীয়ইমামতের সুদীপ্ত ধারায়

আর জনগণের কাছে ইমামগণের বার্তা পৌঁছে যাবার ফলে জনগণ প্রকৃত সত্য বুঝতে পারে, এবং নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। বিশেষ করে বাদশা মামুনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেযা যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন ইরাকের অধিকাংশ লোক মামুনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। হযরত আলীর (আ) খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহী যে হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। যার ফলে মামুন একটা আপোষনীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হন নি, কিন্তু পরবর্তিকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে । বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন। উলে-খ্য যে, নবীবংশের মধ্যে ইমাম রেযাই প্রথম ইরান সফর করেন। যাই হোক, যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। ইমামও নবী করিম (সা), তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান। চতুর বাদশাহ মামুন ইমামের আগমনে তার সকল সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলেন , হে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা বিন রেযার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে, খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো। ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন , তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারি না হয়ে থাক , তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হতে বাধ্য করে। ইমাম রেযা (আ) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। শর্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছিল এরকম-এক, তিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। দুই, দূরে থেকে তিনি খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মোনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন - হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল (আ.) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যতিত আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি , তোমার নবীর সুন্নতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি । ইমাম রেযার এই দায়িত্ব গ্রহণের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভেবেছিল , খেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ.) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার মূল অভিপ্রায়ের কথা তাদেরকে খুলে বলেন। তা থেকেই বোঝা যায় , যেমনটি আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেই বলেছেন, ইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তার পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল , শিয়াদের বৈপ-বিক সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। যাতে তাদের উত্তাল রাজনীতিতে ভাটা পড়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়ত , ইমামকে উত্তরাধিকার বানানোর মাধ্যমে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মহান উদার হিসেবে প্রমাণ করা। তো মামুনের এই অভিসন্ধির কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপদস্থ করতে পারে নি। বাদশা মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রেক্ষাপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশা ভীষণ ক্ষেপে যান এবং ইমামের বিরুদ্ধে অন্তরে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকেন। এইভাবে ইমামত , জনপ্রিয়তা , খেলাফত , আলীর বংশধর প্রভৃতি বিচিত্র কারণে বাদশাহ ইমামের বিরুদ্ধে শত্র"তা করতে থাকে। পক্ষান্তরে জনগণ উপলব্ধি করতে পারে যে , খেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি উপযুক্ত। ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা যতো বাড়তে থাকে , ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভিক হয়ে ওঠেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে পরাস্ত করা গেল না , তখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়জ্বালা মেটাবার চেষ্টা করে। ২০৩ হিজরীর ১৭ই সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর। আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে যেন অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের জন্মদিনে কাতারে কাতারে মানুষ আসে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সোনালি রঙ্গের সমাধিভবনের চারপাশ জাঁকজমক আর অপূর্ব ঐশ্বর্যে কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে নিমেষেই।কেনো তারা ইমামের মাযারে এসে ভিড় জমান ! এ সম্পর্কে যিয়ারতকারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁদের আবেগ-অনুভূতি জানিয়েছেন। একজন বলেছেন, আমি যখনই বা যেখানেই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই , তখনই ইমাম রেযার (আ) মাযারে চলে আসি। এখানে এসে আল্লাহর দরবারে সমস্যার সমাধান চেয়ে দোয়া করি। আমি বহুবার লক্ষ্য করেছি , ধর্মীয় এবং পবিত্র স্থানসমূহ বিশেষ করে ইমাম রেযার পবিত্র মাযারে এলে মনোবেদনা ও সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যায় এবং একধরনের মানসিক প্রশান্তিতে অন্তর ভরে যায়। মনের ভেতর নবীন আশার আলো জেগে ওঠে । এভাবে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতা ও আন্তরিক প্রশান্তির কথা বলেছেন। জীবিতাবস্থায় যিনি মানুষের কল্যাণে ছিলেন আত্মনিবেদিত , শহীদ হয়েও তিনি যে অমরত্মের আধ্যাত্মিক শক্তিবলে একইভাবে মানবকল্যাণ করে যাবেন-তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে !

 

ইমাম রেজা (আ.)'র জন্ম-বার্ষিকী পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী: মাজারে ৩০ লাখ অনুরাগীর ভিড়
ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হচ্ছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)'র পবিত্র জন্ম-বার্ষিকী।

 

এই শুভ জন্মদিন উপলক্ষে ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে অবস্থিত এই মহান ইমামের মাজার জিয়ারত করতে ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছেন ত্রিশ লাখেরও বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আজ সন্ধ্যা থেকেই ধর্মপ্রাণ ইরানিদের মধ্যে খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে এবং তারা উতসব পালন করছেন দান-খয়রাতসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।

 

হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ ইরানি হাতে ফুলসহ মাশহাদের পবিত্র মাজারের দিকে এগিয়ে-আসা শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন।

অনেকেই এই মহান ইমামের জন্মদিনে পবিত্র মাশহাদ শহরে আসার জন্য বহু দিন আগ থেকে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন।

 

ইরানের বিভিন্ন ধর্মীয়-কেন্দ্রসহ মসজিদগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে মৌলুদখানি ও বিতরণ করা হয়েছে নানা ধরনের মিষ্টি এবং শরবত। অনেকেই এই শুভ দিনকে বেছে নিয়েছেন বিয়ের উতসব অনুষ্ঠানের জন্য।

 

ইরানের ধর্মীয় শহর কোম ও শিরাজ নগরীতেও উতসবের বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে। কোমে রয়েছে ইমাম রেজা (আ.)'র বোন হযরত ফাতিমা মাসুমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)'র মাজার এবং শিরাজে রয়েছে ভাই শাহ চেরাগ (র.)'র মাজার।

 

ইসলামের বিশ্ববিশ্রুত ১২ জন নিষ্পাপ ইমামের মধ্যে ইমাম আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) ছিলেন অষ্টম। বংশধারার দিক থেকে তিনি হলেন ইমাম হুসাইন (আ.)'র নাতির নাতির পুত্র তথা ইমাম বাকির (আ.)'র নাতি ইমাম মুসা কাযিম (আ.)'র পুত্র। অর্থাত ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ছিলেন তাঁর দাদা। বারো ইমামের মধ্যে সর্বশেষ ইমাম হলেন মানবজাতির সর্বশেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদী (আ.)।

 

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারা বা আহলে বাইতের একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। ইমাম রেজা (আ.)'র পবিত্র মাজার থাকার কারণেই খোরাসান অঞ্চলটি মাশহাদ নামে খ্যাতি অর্জন করেছে।

 

এই মহান ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক মুবারকবাদ।

 

১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)।

 

ইমাম রেজা (আ.)'র পিতা ইমাম মুসা কাজিম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আমার বাবা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাকে বার বার বলতেন যে, আলে মুহাম্মাদের আলেম বা জ্ঞানী হবে তোমার বংশধর। আহা! আমি যদি তাঁকে দেখতে পেতাম!তাঁর নামও হবে আমিরুল মু'মিনিন (আ.)'র নাম তথা আলী।

 

প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। [এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)'র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.'র ছোট বোন। মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি। অসুস্থ ভাইকে দেখার উদ্দেশ্যে তিনি মদীনা থেকে ইরানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ সময় ইরানের ভেতরে তার কাফেলা সরকারি অনুচরদের হামলার শিকার হয়। তিনি নিজেও আহত হন এবং কোম নামক গ্রামে আশ্রয় নেন ও পরে সেখানেই ইন্তিকাল করেন। ]

 

আব্বাসিয় খলিফা মামুন ইমাম রেজা (আ.)-কে মদীনা থেকে খোরাসানের মার্ভে (বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের একটি শহর) আসতে বাধ্য করেছিলেন। মার্ভ ছিল মামুনের অস্থায়ী রাজধানী। রাজনৈতিক অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১ হিজরিতে হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে যুবরাজ তথা নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করে আব্বাসিয় খলিফা মামুন।


এ উপলক্ষে ব্যাপক উতসবের আয়োজন করেছিল ধূর্ত খলিফা মামুন। আসলে তার এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল মহানবীর (দ.) পবিত্র বংশধারা বা আহলে বাইতের অনুসারীদের মন জয় করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা এবং আহলে বাইতের পবিত্র ভাব-মর্যাদাকে কালিমালিপ্ত করা। উতসব অনুষ্ঠানে দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং মামুনের নিজ পুত্র আব্বাস ও সাধারণ জনতা ভবিষ্যত খলিফা হিসেবে হযরত ইমাম রেজা (আ.)'র প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এই মহান ইমামের নাম-খচিত মুদ্রা চালু করা হয়। এ ছাড়াও আব্বাসিয়দের রাষ্ট্রীয় রঙ্গ কালো থেকে বদলে সবুজ করা হয়েছিল।


ধূর্ত খলিফা মামুনুর রশিদ মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত ছিল এবং এর ফলে আব্বাসিয়দের খিলাফত বৈধতা হারাতে পারে বলে তার আশঙ্কা বাড়ছিল। কারণ, নবী(সা.)- বংশের কাছে খিলাফত ফিরিয়ে দেয়ার শ্লোগান তুলে জনপ্রিয় গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে উমাইয়াদেরকে খিলাফতের ক্ষমতা থেকে উতখাত করা হয়েছিল। অথচ আব্বাসিয়রা নবী(সা.)- বংশের কাছে ক্ষমতা না দিয়ে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে।জনগণ আব্বাসিয়দের এই প্রতারণার কথা কখনও ভুলতে পারেনি।


এই প্রেক্ষাপটে খলিফা মামুন মদীনা থেকে হযরত ইমাম রেজা (আ.)-কে তার রাজধানী তথা সুদূর খোরাসানের মার্ভে আসতে বাধ্য করেন। মামুন ইমামের কাছে খেলাফত হস্তান্তর করতে চায় বলেও ঘোষণা করে। কিন্তু ইমামের প্রজ্ঞাপূর্ণ তাতক্ষণিক উত্তর মামুনের চক্রান্ত বানচাল করে দেয়। হযরত ইমাম রেজা (আ.) মামুনকে বললেন: "যদি খিলাফত সত্যিই তোমার অধিকার হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তোমাকে তা আমানত হিসেবে দান করে থাকেন তাহলে তা অন্যের কাছে ত্যাগ করা তোমার উচিত হবে না; আর এই খিলাফত যদি তোমার না হয়ে থাকে তাহলে তা তুমি অন্যকে কিভাবে দান করবে যা তোমার নিজের নয়?"


কিন্তু মামুন দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইমামের ওপর নানা পন্থায় চাপ দেয়া অব্যাহত রাখে এবং এমনকি গোপনে ইমামকে হত্যারও হুমকি দেয়। খিলাফতের পদ গ্রহণ না করলেও ইমাম যেন অন্ততঃ যুবরাজের পদ তথা পরবর্তী খলিফা হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন সে জন্য চাপ দিতে থাকে মামুন। ফলে মামুন(৩১) ইমামের(৫৩) চেয়ে ২২ বছরের ছোট হওয়া সত্ত্বেও শর্ত-সাপেক্ষে ওই প্রস্তাব মেনে নেন ইমাম রেজা (আ.)। যেমন, একটি শর্ত ছিল এটা যে, রাজকীয় পদে কারো নিয়োগ বা পদচ্যুতির কাজে ইমামের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। ইমামের এ ধরনের সতর্ক পদক্ষেপের ফলে মামুনের অসত উদ্দেশ্যগুলো বানচাল হয়ে যায় এবং জনগণের মধ্যে ইমামের প্রভাব দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। ফলে দুই বছর পর ২০৩ হিজরিতে মামুন খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে এই মহান ইমামকে শহীদ করে এবং তার রাজধানী মার্ভ থেকে বাগদাদে ফিরিয়ে আনে। #

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

ইমাম মাহদী (আ.)এর আগমন একটি অকাট্য ...
পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণ
রজব মাসের ফজিলত ও আমলসমূহ
তাসাউফ : মুসলিম উম্মাহর সেতুবন্ধন
শাবে জুম্মা
সালাতে তারাবী না তাহাজ্জুদ ?
দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব ও ...
‘ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিপ্লবই ...
ফিলিস্তিনি বালিকা
পরকালের জন্য প্রস্তুতি এবং ...

 
user comment