ইরানে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অনলবর্ষী বক্তা, আদর্শ প্রচারক, আপোসহীন সংগ্রামী সংগঠক, তেহরানের জুমআর জামায়াতের প্রথম ইমাম এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মাহমুদ তালেকানীর ১০ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৯ সালের এই দিনে ৬৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী বলেছিলেন : ‘জনাব তালেকানী যাপন করেছেন আলোক ও হেদায়াতপ্রাপ্ত এবং জিহাদী জিন্দেগি। তিনি এমন এক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, জেল থেকে জেলে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং একটির পর একটি দুর্ভোগ তাঁকে পোহাতে হয়েছে, কিন্তু কখনই নিজের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে এতটুকু শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। বন্ধুরা একের পর এক হারিয়ে যাবেন আর তিনি সেটা দেখার জন্য বেঁচে থাকবেন- এমনটি তাঁর অভিপ্রায় ছিল না। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন এক আবু যার। তাঁর বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ছিল মালিক আশতারের তরবারির তীক্ষ্ণ ধার ও আক্রমণ ক্ষমতা।'
ইসলামী বিপ্লবকে চূড়ান্ত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পিছনে যেসব আলেমের দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম ও অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁদের অন্যতম হলেন আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মাহমুদ তালেকানী। কোম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা সমাপ্ত করে ইজতিহাদী যোগ্যতা অর্জন করার পর তালেকানী তেহরানে তৎপরতা শুরু করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্দেশেই পাহলভী শাসকগোষ্ঠী দেশের যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রায় সফল হয়েছিল। আয়াতুল্লাহ তালেকানী যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, কুরআন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতদের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হবে।
১৯৪১ সালে তিনি তেহরানে কানুন-ই-ইসলাম নামে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন। জনগণকে জ্ঞান দানের জন্য নিয়মিত সেখানে বক্তৃতা দানের ব্যবস্থা ছিল। কেন্দ্রটির পক্ষ থেকে ‘দানেশে ইমরুজ' নামে একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হতো। পরে যখন তালেকানী তেহরানের হেদায়াত মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন তখন কুরআন ক্লাস আরো সম্প্রসারিত হয়।
১৯৫৩ সালে সিআইএ পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুথানের পর হেদায়াত মসজিদ পাহলভী শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত জাতীয় মোর্চা যাঁরা গঠন করেছিলেন সেই জাতীয় নেতৃবৃন্দও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শাহের নির্দেশে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হলে তালেকানী তাঁর বন্ধু ও ভক্ত ছাত্রদের গৃহে অবস্থান করেই স্বীয় সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
আয়াতুল্লাহ তালেকানী ১৯৫০ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের বিশেষ বৈঠকে এবং ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত কুদ্স সম্মেলনে ইসলামী দুনিয়ার সামনে ঘোষণা দেন যে, ইরানের জনতা ইহুদিবাদ ও মুসলিম দেশগুলোর তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী।
১৯৬২ সালে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে কোম ও তেহরানে জনতার যে অভ্যুথান ঘটে, আয়াতুল্লাহ তালেকানী সেক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাকের লোকেরা তাঁকে গ্রেফতার করে। পরবর্তী বছর মুক্তি পেয়ে তিনি শাহের বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে জনতাকে সচেতন করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে সাভাকের লোকেরা তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে। আদালত তাঁকে ১০ বছরের কারাদ- দেয়। প্রহসনমূলক বিচার চলাকালে আদালত ও তাঁর বিচারের বিষয়টিকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা দিয়ে তিনি এজলাসে কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। সে ঘোষণার পর তিনি পাক কুরআনের সূরা ফাজ্র তেলাওয়াত করেন এবং আদালতের নিরাপত্তা রক্ষীদের উদ্দেশ্য বলেন : ‘যাও এবং তোমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বল যে, আমরা নই, তোমরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত।' মাত্র ১৬ বছর পরই তাঁর কথা বাস্তবরূপ গ্রহণ করল। তিনি যে সূরা ফাজ্র তেলাওয়াত করেছিলেন, সেটাই ইসলামের বিজয়ের এবং ‘প্রভাতের দশ দিনের' ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত হলো।
১৯৬৭ সালে পাহলভী শাসকচক্র চাপে পড়ে এক পর্যায়ে আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে মুক্তি দেয়। ১৯৭১ সালে তিনি আবার বন্দি হন এবং কিছুকাল পরে তাঁকে দক্ষিণ ইরানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৭৫ সালে আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে শেষবারের মতো গ্রেফতার করা হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭৮ সালে পাহলভী শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে জেলখানার দ্বার খুলে দেয়। আয়াতুল্লাহ তালেকানী অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে শাহের কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর তৎপর দেখা গেছে এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী বিপ্লবে তিনি তাঁর সকল সময় ব্যয় করেছেন। আয়াতুল্লাহ তালেকানীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, শাহবিরোধী সকল দলই তাঁর প্রশংসা করত। তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। ইসলামী বিপ্লবের স্বল্পকাল পূর্বে অনুষ্ঠিত তাসুয়া (মুহররমের নবম দিন) ও আশুরায় তিনি অতুলনীয় যোগ্যতার সাথে তাঁর ভূমিকা পালন করেন।
সামরিক আইন জারি হওয়া সত্ত্বেও আয়াতুল্লাহ তালেকানী আজাদী চত্বরে পৌঁছার লক্ষ্যে শোভাযাত্রা আহ্বান করেছিলেন এবং জনগণকে সে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য ডাক দেন। সে আহ্বানে হাজার হাজার মানুষ সাড়া দেয় এবং সকাল বেলায়ই তাঁর ছোট বাড়ির সম্মুখস্থ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সেদিন ছিল ৯ মুহররম, তাসুয়া। পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী তিনি জনতার সামনে হাজির হলেন। এ ঘটনার মধ্যেই তাঁর সে অভূতপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় মিলে।
ইরানী জাতি তাঁকে স্মরণ করবে এজন্য যে, তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দশ লক্ষাধিক লোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেদিন ইরানী জনতার এতদিনের গোপনে ও সাবধানে বলা কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন এবং সোচ্চার কণ্ঠ হয়েছেন।
‘বল, শাহ ধ্বংস হোক'- এ কথাটি তালেকানী সেদিন বার বার সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। কিছুক্ষণ পরপরই বুলন্দ আওয়াজ তুলে তিনি বলেছেন : ‘বল, শাহ ধ্বংস হোক।'
আয়াতুল্লাহ তালেকানী শাহ ও তার মার্কিনী প্রভুদের বিরুদ্ধে ৪০টি বছর দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রাম চালিয়েছেন। সেদিন ‘শাহ ধ্বংস হোক' বুলন্দ আওয়াজ তোলার পর সে স্লোগান অধিকতর বুলন্দ আওয়াজে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুনে অবশ্যই তিনি আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য এটি ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক' যথার্থ এ স্লোগানে রূপান্তরিত হয়।
(নিউজলেটার, সেপ্টেম্বর ১৯৯১)