বাঙ্গালী
Thursday 26th of December 2024
0
نفر 0

ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) এর শাহাদাত বার্ষিকী২০১৪ইং

নবীজীর আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মদ বাকের (আ.) ১১৪ হিজরী সনের ৭ জিলহজ্ব ৫৭ বছর বয়সে শাহাদাতবরণ করেন। যেদিন তার শাহাদাতের খবর মদীনা শহরে ছড়িয়ে পড়লো সেদিন আহলে বাইতের অনুরাগীদের অন্তর শোকে-দুঃখে ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিল। কারণ হলো তারা আর নবীজীর আহলে বাইতের ঐ নূরানী ও সদয় চেহারাটি আর দেখবে না,মসজিদে আর তাঁর হৃদয়গ্রাহী উষ্ণ বক্তব্য শুনতে পাবে না-এই চিন্তায় তাদের মন ভেঙ্গে গেল। ইমামের অস্তিত্বহীনতা তাঁর ঘনিষ্ট সহচরদের জন্যে ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন জাবের ইবনে ইয়াযিদ জোফি। দুঃখের মুহূর্তগুলো যেন তার কাটছিল না। তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠছিল ইমামের প্রিয় সান্নিধ্যের বহু অমর স্মৃতি। জাবের প্রথমবারের মতো যখন ইমামকে মসজিদে দেখেছিলেন তখন বহু কৌতূহলী মানুষ ইমামের চারদিকে বৃত্তাকারে বসে ছিলেন। সবাই তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাময় কথা শুনছিলো। প্রথম যেই উপদেশটি তিনি ইমামের কাছ থেকে শুনেছিলেন সেটা তিনি কখনোই ভোলেন নি,সবসময় তা তার স্মরণে ছিল।

 

ইমামের ঐ উপদেশ তাকে সবসময় জ্ঞান-অন্বেষী করে রেখেছিল। ইমাম বাকের (আ.) বলেছিলেনঃ 'জ্ঞান অন্বেষণ করো! কেননা জ্ঞান অন্বেষণ করা পূণ্যের কাজ। জ্ঞান তোমাকে অন্ধকারে পথ দেখাবে, দুঃসময়ে জ্ঞান তোমাকে সাহায্য করবে। জ্ঞান হলো মানুষের সবচেয়ে উত্তম বন্ধু।' এই উপদেশ পাবার কারণে জাবের ইমাম বাকের (আ.) এর যুক্তি বাহাসের জলসায় এবং যে-কোনো জ্ঞানের আসরে উপস্থিত থাকতেন। ইমামের প্রজ্ঞাময় বক্তৃতা থেকে ভীষণ উপকৃত হতেন। জাবের তাই ইমামকে হারাবার ব্যথায় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ইমামের স্মৃতিময় সান্নিধ্যের কথা মনে করে কাঁদতে লাগলেন আর আনমনে ইমামের সেই বাণীটি আওড়ালেনঃ 'হে জাবের!যার অস্তিত্বে বা সত্ত্বায় আল্লাহর স্মরণের মাহাত্ম্য বিদ্যমান রয়েছে তার অন্তরে আর অন্য কোনো কিছুর প্রতি ভালোবাসা জাগবে না। খোদাকে যারা অন্বেষন করে,যারা তাকেঁ পেতে চায় তারা দুনিয়া পুজারী হয় না,পার্থিব জগতের মোহ তাদের মাঝে থাকে না। তাই চেষ্টা করো আল্লাহ তাঁর হেকমাত ও দ্বীনের যা কিছু তোমার কাছে আমানত রেখেছেন তা রক্ষণাবেক্ষণ করো!'

 

জাবেরও ইমামের জন্যে শোকাভিভুত জনতার কাতারে গিয়ে শামিল হলো। একদল লোক ইমামের পবিত্র লাশ কাধেঁ করে নিয়ে মদীনা শহরের বাকি কবরস্থানে নিয়ে গেল এবং তাকেঁ সেখানে দাফন করলো। এই দিনটিই সেইদিন অর্থাৎ ১১৪ হিজরীর জিলহজ্ব মাসের ৭ তারিখ। যেখানেই সত্য,ন্যায় ও বাস্তবতার নিদর্শন দেখা যাবে সেখানেই আহলে বাইতের নাম জ্বলজ্বল করবে। কেননা তাঁরা ছিলেন নীতিনৈতিকতার বিচারে সবোর্চ্চ পর্যায়ের। তাঁরা সবসময় অঙ্গনে এসেছেন সত্য-কল্যঅন ও মানবীয় পূর্ণতায় পৌঁছার পথ দেখাতে। মানুষের মাঝে তাদেঁর অস্তিত্বই ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল পথ প্রদর্শকের মতো।

 

ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতির মেয়াদকাল ছিল ১৯ বছর। হিজরী ৯৫ সালে তাঁর এই মেয়াদকালের সূচনা হয়। এই সময়টাতে ইসলামী সমাজ উমাইয়া শাসকদের শেষ দিককার এবং আব্বাসীয় শাসনের শুরুর দিককার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল। এই মেয়াদকালে বহু কিতাব এবং দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল। সেইসাথে কালের এই ক্রান্তিলগ্নে সমাজে বহুরকম বিকৃত ফের্কার বিস্তার ঘটেছিল। মানুষ তাই বিকৃত চিন্তার বেড়াজালে আটকে পড়ার সুযোগ ছিল খুব সহজেই। ইমাম বাকের (আ.) এবং তাঁর সন্তান ইমাম সাদেক (আ.) ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে দ্বীনের যথার্থ স্বরূপ প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মাঝে প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরার জোর প্রচেষ্টা চালান। তাদেঁর এই প্রচেষ্টা ছিল বেশ প্রভাব বিস্তারকারী। বিশেষ করে তাঁরা মদীনায় একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

 

জ্ঞানপিপাসু ও আধ্যাত্মিকতার আলো প্রত্যাশীরা দলে দলে তাই মদীনায় যেতে শুরু করেন। এভাবে দ্বীনের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে। এ কারণেই তাকেঁ বাকেরুল উলুম নামে অভিহিত করা হয়। যার অর্থ হলো পণ্ডিত বা জ্ঞানের বিশ্লেষক। ইমাম বাকের (আ.) তাঁর সময়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষার সীমান্তপ্রহরী ছিলেন। ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি ও নৈতিকতার বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিকৃত আকিদা ও চিন্তাচেতনার বিচার-বিশ্লেষণ করা এবং ইসলামের বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোর দৃঢ়তা ও মজবুতির ক্ষেত্রে ইমাম বাকের (আ.) মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন।

 

একটি সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই যেসব শাসক অত্যাচারী এবং কেবল নিজেদের স্বার্থচিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং মানবীয় কোনো নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন নয় তারা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। ইমাম বাকের (আ.) এর ইমামতিকালটি ছিল তেমনি এক শাসকগোষ্ঠির শাসনকাল। ইমাম তাই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং একজন সৎ নেতৃত্বের গুণাবলি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। এভাবে অত্যাচারী খলিফাদের কাজকর্ম জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে।সে কারণে আব্বাসীয় শাসক বিশেষ করে হিশাম বিন আব্দুল মালেকের ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন ইমাম।

 

ইমাম বাকের (আ.) সঠিক নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কে বলেনঃ নিঃসন্দেহে যাদের মাঝে তিনটি গুণের সমাবেশ নেই তারা নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য নয়। ঐ তিনটি গুণ হলো-এ্যাকঃ আল্লাহকে ভয় করা এবং খোদার নাফরমানী থেকে নিরাপদ থাকা, দুইঃ সহিষ্ণুতা ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকা এবং তিনঃ অধীনস্থদের ব্যাপারে পিতৃসুলভ সদয় হওয়া এবং তাদের সাথে সদাচরণ করা।

 

ইমাম বাকের (আ.) ছিলেন পরোপকারী ও অসহায়-বঞ্চিত জনগোষ্ঠির প্রতি সদয়। তিনি নিঃস্ব-হতদরিদ্রদের সাথে মিশতেন। তাদের সাথে কথা বলে তাদের ক্লান্ত আত্মাকে প্রশান্ত করতেন। তিনি সবাইকে বলতেন বঞ্চিতদেরকে যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাকা না হয়। তাঁর জ্ঞান আর মিষ্টি আচার-আচরণের কারণে জনগণ তাঁর কথায় ব্যাপক আকৃষ্ট হত। বহু ছাত্র তিনি তৈরি করে গেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত অসংখ্য হাদিস এখনো মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগছে। হিশাম বিন আব্দুল মালেক ইমামের এই প্রভাব সঞ্য করতে পারলো না। সে ছিল অর্থলোভি এক পাথর-হৃদয়। সে তার অধীনস্থদের আদেশ দেয় বিভিন্নভাবে ইমামকে যেন চাপের মুখে রাখা হয়। কিন্তু কোনোরকম সীমাবদ্ধতা আরোপ করে ইমামকে তাঁর দায়িত্ব পালন থেকে দূরে রাখতে পারে নি। ইমামের বিরুদ্ধে তাই হিশামের অন্তরে ক্ষোভের আগুণ আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।

 

অবশেষে হিশাম ইমামের নূরানী অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করলো। সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ইমাম বাকের (আ.) কে বিষপ্রয়োগে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাতের সেই শোকাবহ স্মৃতিময় দিনটিই হলো ৭ জিলহজ্ব। #

 

0
0% (نفر 0)
 
نظر شما در مورد این مطلب ؟
 
امتیاز شما به این مطلب ؟
اشتراک گذاری در شبکه های اجتماعی:

latest article

হযরত আলী (আ.) এর মর্যাদা
রমজানের ত্রিশ রোজার দোয়া
শিয়ারা কেন হযরত আলী (আ.) কে নিয়ে ...
ফাদাক সম্পর্কে “প্রথম খলিফার ...
হযরত ফাতেমার প্রতি নবী (সা.)-এর ...
খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ...
ইমাম রেজা (আ.)-এর জিয়ারতের সওয়াব এক ...
কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি ...
মুবাহালা
আখেরাতের ওপর বিশ্বাস

 
user comment