মুফতী শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : পোশাক মানব জীবনের এক অবিচ্ছিন্ন অংশ। পোশাক সম্বন্ধে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘হে আদম সন্তান! নিশ্চয় আমি তোমাদিগকে পোশাক দান করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের লজ্জা নিবারণ করতে পার এবং শোভা হিসেবেও; আর তাকওয়ার পোশাক- সে-ই তো উত্তম। এ হলো আল্লাহর নিদর্শনসমূহ হতে, আশা করা যায় তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।' (সূরা আরাফ, আয়াত ২৬)। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘মান তাশাবাহা বিকওমিন ফাহওয়া মিন হুম' যারা যে ধর্ম জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ ফকীহগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যেসকল পোশাক কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ নিদের্শন বা তাদের ধর্মীয় পোশাক সেগুলো মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। যা বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক নয়, তা পরিধান করা জায়েজ; আমাদের দেশের উলামায়ে কিরাম জুব্বা বা গোল লম্বা জামা পছন্দ করেন। এতে আরব ও আরবীয় সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্য ও মহব্বত প্রকাশ পায়। অনেকে পাঞ্জাবিকেও ইসলামী পোশাক মনে করেন: মূলত পাঞ্জাবি নামটি ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাথে সম্পর্কিত। ভারতীয় ধূতি, গেঞ্জি ও ফতুয়া (টি শার্ট) এর বিকল্প হিসেবে
পাঞ্জাবিকে অনেকটা ইসলামী ভাবধারার মনে করা যায়। ধূতি ফতুয়া বাঙালি পোশাক হলেও লুঙ্গী পাঞ্জাবি বাঙালি মুসলমানের পোশাক হিসেবেই পরিচিত।
লিবাস বা পোশাকের সুন্নাত নিয়ে আমাদের ভারতীয় উপ মাহাদেশের উলামায়ে কিরামের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। যেমন- প্রথম মত হলো- জামা গোল হতে হবে, লম্বায় কমপক্ষে নিছফ চাক (হাঁটু ও গোড়ালীর মাঝামাঝি) হতে হবে। তাদের দলিল হলো- নবীজি (সা.) কখনো একমাত্র জামা গায়ে নামাজ আদায় করেছেন। এখান থেকে বুঝা যায়, তা কমপক্ষে নিছফে চাক পরিমাণ লম্বা ছিল এবং গোল ছিল। তাই এটাই সুন্নাত। দ্বিতীয় মত হলো- জামা অবশ্যই নিছফ চাক (হাঁটু ও গোড়ালীর মাঝামাঝি) হতে হবে; তবে ফাড়া হলেও চলবে। তাদের দলিল হলো- নবীজি (সা.) কখনো জামা গায়ে ঘোড়ার পিঠে চড়লে, দেখা গেছে জামার কোনা বাতাসে উড়ছে; এতে বুঝা গেল তা ফাড়া ছিল। তাই এতেও সুন্নাত আদায় হবে। তৃতীয় মত হলো- উভয় মতের সমন্বয়ের জন্য হাঁটুর নিচ পর্যন্ত সেলাই করা ও নিচে সামান্য ফাড়া রাখা। চতুর্থ মত হলো- জামায় ১টি মাত্র বুতাম হবে এবং কলার হবে না। পঞ্চম মত হলো- একাধিক বুতামও দেয়া যাবে এবং কলার থাকলেও ক্ষতি নেই। ষষ্ঠ মত হলো- যে এলাকায় যেটাকে মানুষ ইসলামী পোশাক মনে করে তাতেই হবে। সপ্তম মত হলো- ইসলামী পোশাক নামে নির্দিষ্ট কোন পোশাক নেই। শালীন, ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত যে কোন পোশাকই ইসলামী পোশাক হিসেবে গণ্য হবে। যাতে
লজ্জা নিবারণ, ইজ্জত আভ্রু রক্ষা ও শোভা বর্ধন হয়। যা কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে; এবং খায়রুল কুরূন তথা সাহাবায়ে কিরাম তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীনদের আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয়।
কোর্ট, প্যান্ট ও টাই বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক কি-না? (কেউ কেউ মনে করেন এসব বিধর্মীদের ধর্মীয় পোশাক, বিশেষত টাই ক্রুসের চিহ্ন)। আসলে কোর্ট, প্যান্ট ও টাই বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ কোন ইয়াহুদী ধর্মযাজক (রাহেব ও রাব্বী) কখনো এ পোশাক পরেন না; অনুরূপ কোন খ্রিস্টান ধর্মযাজক (পাদ্রী ও পোপ) কখনো এ পোশাক পরেন না; এমনকি হিন্দু ধর্মযাজক (ঠাকুর ও ব্রাহ্মণ) এবং বৌদ্ধ ধর্মযাজক (ভিক্ষু ও পুরুহিত) তারাও এ পোশাক পরেন না। এতে বুঝা গেল এসব তাদের কারোই ধর্মীয় পোশাক নয় । পরিশেষে বলতে হয়- যদি কেউ কোনো পোশাককে জ্ঞানত সুন্নাত মনে করেন; কিন্তু অনীহা বশত তা আমল না করেন বা কোন পোশাককে সুন্নাতের খেলাফ মনে করেন তথাপি বিলাসিতা ও সৌখিনতাবশত তা পরিধান করেন; তাহলে তিনি সুন্নাত তরককারী হিসেবে গণ্য হবেন; অন্যথায় নয়।
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী হযরত আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রঃ) বলেন, দুটি বিদআত মুসলমানদের চরম ক্ষতি করেছে। এর একটি হলো মুসলিম দেশের মধ্যে সীমান্ত বা ভৌগলিক বিভাজন; দ্বিতীয়টি হলো পোশাকের বিভিন্নতায় ছুতায় মুসলমানদের বিভক্ত করণ।